somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেখে এলাম মুন্সিগঞ্জের বাবা আদম মসজিদ

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মধ্যযুগে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে অনেক দূরে ছিল আধুনিক মুন্সিগঞ্জ জেলা। জেলার প্রাচীন হিন্দু বসতি রামপাল উপজেলায় মধ্যযুগীয় মুসলিম ঐতিহ্যের একমাত্র প্রতিনিধি বাবা আদম মসজিদ। মসজিদটি পরবর্তী সময়ে সংস্কার করা হলেও এর আদিরূপ উত্তমভাবেই সংরক্ষিত হয়েছে বলে ধারণা হয়। স্থানীয় সুফি বাবা আদমের নামানুসারে মসজিদটি বাবা আদম মসজিদ নামে পরিচয় লাভ করে। জনশ্রুতি মতে, সুফি বাবা আদম মসজিদের পাশে একটি অতি সাধারণ সমাধিতে শায়িত রয়েছেন। মসজিদটি প্রাথমিক ইসলামী যুগের ছয় গম্বুজ মসজিদের প্রতিনিধিত্ব করে। জেলার মীর কাদিম থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণে ও বল্লালবাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে মসজিদটি অবস্থিত।

সাধারণ আয়তাকার মসজিদটি অভ্যন্তরভাগে ৬.৬৪ মিটার * ১০.২৩ মিটার পরিমাপের। মসজিদের চারপাশের দেয়ালগুলো ১.৮৫ মিটার প্রশস্ত। ইমারতের চারকোণে চারটি অষ্টকোণা টারেট রয়েছে। এগুলো রীতিবদ্ধভাবে কার্ণিশের সীমাতেই সমাপ্ত। এখানে পূর্বদেয়ালের তিনটি প্রবেশপথ ব্যতীত অপর কোন প্রবেশপথ নেই। মসজিদের মেঝে ভূমি থেকে কিছুটা উপরে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের সাথে তিনধাপের একটি সিঁড়ি দিয়ে ভূমি থেকে মেঝেতে প্রবেশ করা যায়। পূর্ব দেয়ালের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর ছন্দায়িতভাবে কিবলা দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে পূর্ব ও পশ্চিম কোণা চাপিয়ে সমান্তরালভাবে চারটি কুলুঙ্গি রয়েছে। ইমারত অভ্যন্তরে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত দু’টি স্তম্ভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্তম্ভ দু’টি মেঝে থেকে চার ফুট পর্যন্ত অষ্টকোণাকার এরপরে ষোল কোণা। এ দু’টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর মসজিদের ছয়টি গম্বুজ সংস্থাপিত। গম্বুজগুলো সুলতানী আমলের সাধারণ ক্ষুদ্রায়তনের ও অনুচ্চ। গম্বুজ শীর্ষে তিন স্তরের একটি ক্ষুদ্র নির্মাণ দেখা যায়। কালের যাত্রায় মসজিদের কয়েকটি গম্বুজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর তা নতুন করে নির্মাণ করে। মসজিদের কার্নিশগুলো দু’ধারে কিছুটা বক্র হয়ে নেমে গেছে।

এক সময় মসজিদটি টেরাকোটার চমৎকার অলঙ্করণ সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সংস্কারে এর অনেক নকশা হারিয়ে গেছে বলে জানা যায়। ইমারতের সমগ্র কার্নিশে ব্যান্ডের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খোপ নকশা স্থান পেয়েছে। চারকোণার টারেটগুলোর নিম্নাংশ কেন্দ্র করে দেয়ালে ব্যান্ড ও খোপ নকশা রয়েছে। মসজিদের পূর্ব প্রবেশ পথের শীর্ষে খোপ নকশা ও ইট খোদাই নকশা স্থান পেয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের দু’পাশে টেরাকোটার ছন্দায়িত চিত্রফলক দেখা যায়। মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের শীর্ষে সংস্থাপিত একটি শিলালিপি অনুসারে ১৪৮৩-৮৪ সালে সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহুর আমলে মালিক কাফুর নির্মাণ করেন। মসজিদের পাশেই ২৫ ফুট বাহুবিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইটে নির্মিত ঢিবি বাবা আদমের মাজার বলে কথিত। এ মসজিদ ও মাজার নিয়ে নানারকম জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে।

জানা যায়, বাবা আদম রাজা বল্লাল সেনের রাজত্বকালে (১১৫৮-৭৯) বিক্রমপুরে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। কোন এক পর্বে বাবা আদমের জবাইকৃত গরুর মাংসের একটি টুকরা চিল রাজবাড়িতে ফেলে দিলে গরু জবাই বিরোধী রাজা ক্রোধান্বিত হয়ে স্বসৈন্যে ফকিরের বিরুদ্ধে অভিযানে আসেন। তিনি বুকের মধ্যে কাপড়ের নিচে একটি কবুতর নিয়ে নেন। যদি তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন তবে কবুতরটি রাজবাড়িতে এসে সংবাদ দিবে, আর অন্তঃপুরীর নারীরা ম্লেচ্ছদের হাত হতে ইজ্জত বাঁচানোর জন্য রাজবাড়ির নিকটস্থ কুন্ডের আগুনের মধ্যে আত্মাহুতি দিবে। রাজা দরবেশের নিকটে এসে দেখলেন, তিনি গভীর তপস্যায় মগ্ন। রাজা তরবারির এক আঘাতে দরবেশের ভবলীলা সাঙ্গ করলেন। তিনি মনের আনন্দে দরবেশের রক্ত শরীর থেকে পরিষ্কার করার জন্য নিকটবর্তী নদীতে নামলেন। এ সময় তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কবুতরটি হঠাৎ ছাড়া পেয়ে রাজবাড়িতে উড়ে যায়। রাজা কবুতরের পিছনে পিছনে সবেগে দৌড়িয়েও কবুতরটির নিকটে আসতে পারেননি। রাজবাড়িতে এসে রাজা তার পরিবারের কাউকে অবশিষ্ট পাননি। তারা সবাই আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছে। মনের দুঃখে রাজাও তাদের অনুসরণ করলেন। ফলে সেখানে মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

রাজা বল্লাল সেন ১১৭৯ সালে মারা গেলে তার পুত্র লক্ষ্মণ সেন ১২০৬ সাল পর্যন্ত বিক্রমপুর অঞ্চলে রাজত্ব করেন। এরপরে লক্ষ্মণ সেনের একপুত্র বিশ্বরূপ সেন ১২২০ সাল পর্যন্ত ও আর এক পুত্র কেশব সেন ১২২৩ সাল পর্যন্ত বিক্রমপুরে রাজত্ব করেছিলেন বলে শিলালিপিতে প্রমাণ পাওয়া যায়। লক্ষ্মণ সেন অবশ্য ১২০৫ সালে গৌড়ের সিংহাসন হারিয়েছিলেন। ১২৪৫ সাল পর্যন্ত সেন বংশীয় নৃপতিগণ বিক্রমপুরে রাজত্ব করেছিলেন বলে মিনহাজ ‘তবাকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাই এতসব নির্ভরযোগ্য প্রমাণের পর রাজা বল্লাল সেনের সময় বিক্রমপুরে বাবা আদমের আবির্ভাব ও বল্লাল সেনের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কিত কাহিনী প্রমাণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।

মূলত শিলালিপি সূত্রে নিশ্চিত যে, আলোচ্য মসজিদটি উল্লেখিত জনশ্রুতিতে তিন শতাধিক বছর পরে নির্মিত হয়েছে। মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপিতে বাবা আদম শহীদের কোন উল্লেখ নেই, উল্লেখ নেই কোন মাজারেরও। শুধু জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করেই এই কল্পকাহিনী যুগ যুগ ধরে প্রচলিত রয়েছে। জনশ্রুতি যাই থাক, তার গুরুত্ব যতটুকুই হোক কিন্তু বাংলার মুসলিম ধর্মীয় ইমারত হিসেবে এ মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম।

৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

১. ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৯:০৯

ময়নামতি বলেছেন: মুসলিম ঐতিহ্য বিষয়ে আপনার পোস্ট সুন্দর ।

অত্যন্ত গোছালো লেখা ।



ধন্যবাদ।

পোস্টে প্লাস++++++++++++++

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:২৩

লেখক বলেছেন: পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।

২. ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:০৫

সিনবাদ বলেছেন: amar elakai oita.

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:২৪

লেখক বলেছেন: আপনাদের এলাকাটা সত্যি খুব সুন্দর।

৩. ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:৪০

বান_দর বলেছেন: ভাল লাগল।

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ রাত ৮:২৫

লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪. ০৮ ই মার্চ, ২০১২ রাত ৮:৩৯

জোছনার আলো বলেছেন: ভাল লাগল।

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বডি সোহেলের মন ভালো নেই !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৬ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:২৫


আমাদের জাতীয় নেতাদের বংশধরেরা বড়ই অদ্ভুত জীবন যাপন করছেন। তাদের বাপ চাচাদের মধ্যে মত-বিরোধ থাকিলেও একে অপর কে জনসম্মুখে অপমান করেন নাই। এক্ষেত্রে নেতাদের প্রজন্ম পূর্বপুরুষ দের ট্রাডিশন ধরে রাখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ই-মেইল ঠিকানা

লিখেছেন মি. বিকেল, ২৭ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ১:৩৩



যারা গল্প, কবিতা, সাহিত্য, ফিচার বা কলাম লিখতে আগ্রহী, তাদের জন্য এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা, সাহিত্য পাতা ইত্যাদির ই-মেইল ঠিকানা দেওয়া হলো। পত্রিকায় ছাপা হলে আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তার দায়ভার কি সেনাবাহিনী নেবে? তাদের সমালোচনাকে অনেকে সেনাবাহিনীর সমালোচনা মনে করছে কেন?

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ২:২৯

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখনও আমাদের জন্য গর্ব এবং আস্থার জায়গা। কারণ দুর্নীতির এই দেশে একমাত্র সেনাবাহিনীই সেই প্রতিষ্ঠান যার আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় সুনাম এখনও আছে। কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ: মৃতদেহ সৎকার এবং সঙ্গীতসৎকার....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:৪৯

প্রসঙ্গ: মৃতদেহ সৎকার এবং সঙ্গীতসৎকার....

কথা সাহিত্যিক শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহু বছর আগে তার “শ্রীকান্ত” উপন্যাসে ইন্দ্রকে দিয়ে সর্বকালীন এবং সর্বজন গৃহীত একটি উক্তি করিয়েছিলেন, সেটি হলো,- ”মরার আবার জাত কি”!

মৃতদেহ সৎকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্প: শেষ রাতের সুর (পর্ব ২)

লিখেছেন আমিই সাইফুল, ২৭ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫০

রাফি সাহেবের পড়ে যাওয়ার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। সকালের মিষ্টি রোদ গাজীপুরের এই ছোট্ট গ্রামে যখন পড়ছে, তখনই কাজের লোক রহিমা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ির নিচে রাফি সাহেব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×