১৯৫২ সালের ফেব্র“য়ারিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন সেদিনের পূর্ব বাংলার ৫ জন আদম সন্তান। এরা হলেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিক। তদানীন্তন সরকারের গণবিরোধী নির্মমতা দেখে একজন কবি লিখেছিলেন,
“ঝরাও রক্ত ঝরাও রক্ত যতো খুশী তুমি পারো
রাজপথে আজ জনতা জেগেছে, যতো খুশী তুমি মারো”। সেদিনের রক্ত বৃথা যায়নি। সমস্ত ষড়যন্ত্র এবং শাসক গোষ্ঠীর হঠকারিতা বানচাল করে বাংলা ভাষা তার আপন মহিমায় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে। সে দিন যারা রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আজ তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্র মতায় অধিষ্ঠিত। দীর্ঘ ৬০ বছর পর টেবিল ঘুরে গেছে। সেই সাথে আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং দৃষ্টিভঙ্গির হয়েছে পরিবর্তন। আজ তারা সে দিনের শাসক গোষ্ঠীর মতোই গণবিরোধী এবং স্বৈরাচারী। আজকের পুলিশ বাহিনী আওয়ামী সরকারের পেটোয়া বাহিনী। আওয়ামী সরকারের হুকুমে এই পেটোয়া বাহিনী লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও রাজশাহীতে সংগ্রামী জনতার ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছে। তাদের উদ্ধত গুলিবর্ষণে এই সুন্দর পৃথিবীর বুক থেকে অকালে ঝরে গেছে ৫টি তাজা প্রাণ। এই ৫টি তাজা প্রাণ হলেন চাঁদপুরের লিমন (২৫) ও আবুল হোসেন গাজী (৫৫) লক্ষ্মীপুরের রুবেল হোসেন (২২) ও আবুল কাশেম (৫০) এবং রাজশাহীর শফিকুল ইসলাম শফিক (৩২)। বড় করুণ এসব মৃত্যু। সারা বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং রাজশাহীতেও ২৯ এবং ৩০ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করছিলেন তারা। মিছিলকারীরা কোনো উস্কানি দেননি। কোনো রকম নাশকতামূলক কাজ তো দূরের কথা, ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সারা দেশব্যাপী গণমিছিলের কোথাও একটি পটকাও ফোটেনি। তারপরেও পুলিশ বিনা উস্কানিতে এমন বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছে। এই ৫ আদম সন্তানও শহীদ হয়েছেন। গণতন্ত্রের আলখেল্লা পরা স্বৈরাচারী আওয়ামী শাহী যে রক্ত ঝরালো সেই রক্তও বৃথা যাবে না।
গুলি চালানোর সতর্ক সংকেত ছিল না
গুলি চালানোর আগে পুলিশ সাধারণত একাধিক সংকেত দেয়। অনেক দিন আগে থেকেই মানুষ দেখে আসছেন যে গুলিবর্ষণের আগে পুলিশ একাধিক হুশিয়ারি সংকেত দেয়। লাল ব্যানার টাঙিয়ে দেয়া হয় অথবা লাল পতাকা উড়ানো হয়। লাল পতাকা দিয়ে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয় যে ঐ স্থানটি অতিক্রম করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করতে বাধ্য হবে। এবার পুলিশ সে ধরনের কোনো কিছুই করেনি। পুুুলিশের প্রতি মিছিলকারীরা কোনো পেট্রল বোমা ছোড়েনি, কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ফায়ার করেনি। তারপরেও পুলিশ গুলি ছুঁরেছে। কিন্তু আইন মোতাবেক পুলিশ তো নিজ থেকে কোনো গুলি ছুঁড়তে পারে না। গুলি ছোঁড়ার আগে অকুস্থলে থাকবেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। একমাত্র তিনিই হুকুম দেবেন, সেই মুহূর্তে গুলি করা চলবে কি না। কিন্তু আলোচ্য েেত্র আওয়ামী লীগ কোনোরূপ আইন-কানুন ও রীতি-নীতির তোয়াক্কা করেনি। তাদের ইচ্ছা হয়েছে, আর তারা গুলি মেরেছে। মনে হচ্ছিল, পুলিশের প্রচণ্ড রক্ত পিপাসা পেয়েছিল। মিছিলকারীদের সামনে পেয়েছে আর গুলিবর্ষণের মাধ্যমে তারা রক্ত পিপাসা মিটিয়েছে। নূরুল আমীন এবং আইয়ুব খানের আমলেও গুলি হয়েছে এবং মানুষ মারা গেছে। গুলিবর্ষণের সাথে সাথে আওয়ামী লীগের বিুব্ধ কর্মীরা বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেছে এবং গাড়ি ভাংচুর করেছে। তারপর তারা সারা দেশব্যাপী হরতাল পালন করেছে। হরতালে হয়েছে প্রচণ্ড সহিংসতা। কিন্তু এবার বিএনপির ৪ জন কর্মী এবং জামায়াতের ১ জন কর্মী পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছেন। এত বড় বিয়োগান্তক ঘটনার পরেও বিএনপি পরদিন হরতাল বা কোনো সক্রিয় কর্মসূচি দেয়নি।
নাশকতার জুজু
তারপরেও চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো সরকার বলছে যে, জামায়াত এবং শিবির নাকি গণমিছিল থেকে নাশকতা করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ নামক এই দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা। তারা চরম ফ্যাসিস্ট কায়দায় দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করেছে। তাদের রয়েছে বিরাট বাহিনী। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশ, র্যাব, বিডিআর। নাশকতাবাদ বা জঙ্গিবাদের কোনো খবর যদি তাদের হাতে থাকত তাহলে তারা তাদের গ্রেফতার করে জনগণের কাছে তাদের কুকীর্তি ফাঁস করে দিতো। কিন্তু সে সবের ধারে পাশে না গিয়ে এক জন জঙ্গিকেও ধরতে না পেরে, একটি অস্ত্রও উদ্ধার করতে সম না হয়ে তারা ঢালাওভাবে বলে দিয়েছে যে গণমিছিল থেকে নাশকতামূলক তৎপরতা চালানো হবে। এইভাবে কাল্পনিক এক ধারণার ওপর ভর করে সরকার ৫টি তাজা প্রাণ কেড়ে নিলো।
পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
পুলিশের এই বেপরোয়া গুলিবর্ষণ এবং ৫ জন মানুষকে হত্যা করা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ব পরিকল্পিত কাজ। তাদের উদ্দেশ্য, চেঙ্গিস খান এবং হালাকু খানের মতো বিরোধী দলের ওপর চণ্ডনীতি প্রয়োগ করা। সেই চণ্ডনীতির প্রচণ্ডতা এমন হবে যেটি দেখে বিরোধী দল ভয় পেয়ে যাবে এবং মাঠ ছেড়ে ঘরের ছেলের মতো ঘরে ফিরে যাবে। এটি কোনো ভিত্তিহীন আবিষ্কার নয়। কারণ এই গণমিছিলের গোড়ায় ফিরে গেলে দেখা যাবে, কেমন করে আওয়ামী লীগ গায়ে পড়ে ঝগড়ায় নেমেছে।
গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ১০ লাধিক লোকের জনসভায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেন যে আগামী ২৯ জানুয়ারি ৪ দলীয় জোটের উদ্যোগে ঢাকাসহ সারাদেশে গণমিছিল বের হবে। ছাত্রছাত্রীদের পরীা থাকার জন্য ফেব্র“য়ারি মাসকে আন্দোলনের বাইরে রাখা হবে। অতঃপর ১২ মার্চ সারাদেশ থেকে মানুষের ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ মার্চ। সেই মার্চ শেষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে লাখ লাখ লোকের বিশাল মহাসমাবেশ। সেই মহাসমাবেশ থেকে আন্দোলনের পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। চট্টগ্রামের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া নিজ থেকে ঘোষণা করেন যে বিএনপি তথা ৪ দলীয় জোট সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী নয়। জ্বালাও-পোড়াওয়ের কর্মসূচি বিএনপির নয়। বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে ৪ দলীয় জোট এই সরকারের পতন ঘটাবে। চট্টগ্রাম অভিমুখী রোড মার্চসহ ইতোপূর্বে ৪ দলীয় জোট ৩টি মহাসমাবেশ এবং বেশ কয়েকটি অনির্ধারিত পথসভা ও জনসভা করেছে। যদি বেগম খালেদা জিয়া সহিংসতা চাইতেন তাহলে ঐ লাখ লাখ লোকের জনসমাবেশে তিনি পরোভাবে জনসাধারণকে উস্কে দিতেন। তাহলে সারা বাংলাদেশে প্রলয় কাণ্ড ঘটত।
অরাজকতার নীল নকশা
২৯ জানুয়ারি বেগম জিয়া ঢাকাসহ সারাদেশে গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন চট্টগ্রামের জনসমুদ্র থেকে। সেই গণমিছিলের পাল্টা যদি কোনো কর্মসূচি দিতেই হয় তাহলে আওয়ামী লীগ তার ২-১ দিন আগে বা ২-১ দিন পরে কর্মসূচি দিতে পারত। কিন্তু ২৯ জানুয়ারির ৩-৪ দিন আগে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে ২৯ জানুয়ারি একই সময় অর্থাৎ বেলা ৩টায় পাল্টা সমাবেশ ডাকে। স্বাভাবিকভাবেই সর্বশ্রেণীর মানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয় যে, ২০ দিন আগে ৪ দলীয় জোট যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, মাত্র ২ দিন আগে আওয়ামী লীগ একটি পাল্টা সাংঘর্ষিক কর্মসূচি ঘোষণা করল কেন? তাহলে কি আওয়ামী লীগ যে কোনো ছুতানাতায় একটি প্রত্য সংঘর্ষ বাধাতে চাচ্ছে? তাহলে তারা কি চায়? রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার বুঝাতে পারেন যে, যেকোনো উছিলায় আওয়ামী লীগ একটি সংঘর্ষ বাধাতে চায় এবং সংঘর্ষ বাধিয়ে বিরোধী দলকে ক্রাশ করতে চায়। দেখা গেল, পুলিশ ২৯ জানুয়ারি সমগ্র মহানগরীতে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে। পুলিশ কেন ১৪৪ ধারা জারি করলো? বিএনপি ২০ দিন আগে গণমিছিল ও বিােভ সমাবেশ ডেকেছে এবং যথাযথ কর্তৃপরে নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণ করেছে। এই অবস্থায় পুলিশের যেটি করার কথা সেটি হলো, পাল্টা সমাবেশ না করার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং সাংঘর্ষিক কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা। সেটা না করে তারা ১৪৪ ধারা জারি করে। এই অবস্থায় সংঘর্ষ পরিহারের জন্য এবং বেআইনিভাবে জারিকৃত ১৪৪ ধারার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য বিএনপি গণমিছিলের তারিখ একদিন পিছিয়ে দেয়। নতুন তারিখ নির্ধারিত হয় ৩০ জানুয়ারি। সমস্ত মানুষের বিস্ময় উৎপাদন করে আওয়ামী লীগও তাদের পাল্টা সমাবেশের তারিখ একদিন পিছিয়ে দেয় এবং নতুন তারিখ নির্ধারণ করে ৩০ জানুয়ারি বিকাল ৩টায়। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগ চাচ্ছে একটি রক্তয়ী সংঘর্ষ। তাই যদি না হবে তাহলে আওয়ামী লীগ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের কর্মসূচি বিএনপির কর্মসূচির একদিন আগে বা পরে দিতে পারত। ২৯ তারিখ মফস্বলের যেসব জায়গায় ১৪৪ ধারা ছিল না সেসব জায়গায় গণমিছিল কর্মসূচি পালিত হয়। ২৯ তারিখ চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে কোনোরূপ উস্কানি ছাড়াই গণমিছিলকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়। ফলে ৪ জন বিএনপি কর্মী নিহত হন। ৩০ তারিখ রাজশাহীর গণমিছিলে বিনা উস্কানিতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ফলে একজন জামায়াত কর্মী নিহত হন। বিনা উস্কানিতে মানুষের প্রাণ হরণ এখন আওয়ামী লীগের কাছে ডাল ভাত হয়েছে। পরদিন ঢাকায় মিছিল ও পাল্টা মিছিল ধার্য ছিল। বিএনপি ও জামায়াত ৩০ তারিখের কর্মসূচিতে অটল থাকে।
এদিকে ২৯ তারিখ রাতে প্রায় সবগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার জন্য আওয়ামী লীগকে এককভাবে দায়ী করা হয়। সব শ্রেণীর আলোচক বলেন যে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্যই তো বিএনপি তাদের প্রোগ্রাম পিছিয়ে দিল। তারপর আওয়ামী লীগ ৩০ তারিখে তাদের কর্মসূচি নিয়ে যাওয়ায় এটি প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আওয়ামী লীগ পায়ে পাড়া দিয়ে হলেও বিএনপি তথা ৪ দলীয় জোটের সাথে সংঘর্ষে যেতে চায়।
আ’লীগের সাংঘর্ষিক নীতি নতুন কিছু নয়
রাজনীতিতে যারা প্রবীণ তারা বলেছেন যে, গায়ে পড়ে ঝগড়া করা তথা পরিকল্পিতভাবে মারামারি করা আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। অতীতেও দেখা গেছে যে, জামায়াতে ইসলামী যেখানেই জনসভা ডেকেছে আওয়ামী লীগ সেখানেই পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে। ফলে সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং জামায়াতের মিছিল বানচাল করা হয়েছে। এমন কি মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলের দিনেও তারা নিকটস্থ স্থানে পাল্টা কর্মসূচি আহ্বান করেছে এবং এভাবে তারা মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলও পণ্ড করেছে।
বিগত ৩০ বছরে আওয়ামী লীগ যে সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং তাদের জনপ্রিয়তা যে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে সেটি বুঝতে আর শেখ হাসিনার বাকি নাই। কেয়ারটেকার সরকার বিলোপ করে এবং পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেও আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে বিজয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে পারছে না। তাই তারা রক্তপাত ঘটাচ্ছে এবং লাশ নিয়ে রাজনীতি করছে। লাশ নিয়ে রাজনীতি করার পেছনে তাদের রয়েছে একটি গভীর দুরভিসন্ধি। সেটি হলো সারা দেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস করে, দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা। সেই ত্রাসের রাজত্বে সাজানো নির্বাচন দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া। কিন্তু তারা জানে না যে তারা ৩০ ও ৩১ তারিখের রক্ত ঝরানো ছাড়াও বিগত ৩ বছরে তাদের হাত রক্তে রঞ্জিত করেছে। তারা ভুলে গেছে যে, কোনো রক্তই বৃথা যায় না।
[লেখক-জামশেদ মেহেদি]