চোখের পাপড়িগুলো পর্যন্ত বরফ-সাদা। আর অবিরল তুষারপাতের ভেতর দিয়ে টিউব রেলওয়ে হয়ে পায়ে হেঁটে আমি এসেছি। পেঁজা তুলার মতো জমাট তুষার এখানে-ওখানে। গাছের পাতায়। ট্রাফিক সিগন্যালের মাথায়। ফুটপাথে। পুরো ওভারকোটে মোড়ানো আমার শরীর দেখে যে কারও মনে হতেই পারত, ‘এ মুভিং প্যাকেট অব গুডস।’ আমার সে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, স্তূপ স্তূপ বরফ আমার পায়ের নিচে বিছিয়ে রেখেছে রাজ্যের শুভ্রতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দাঁতের চেয়েও সে শুভ্রতা উজ্জ্বল, তবে একই রকম শীতল। আমার জুতার তলা দিয়ে ঠাণ্ডা ঢুকতে থাকে। অনুভব করি কনকনে বাতাস বরফাচ্ছন্নতাকে আরও উসকে দিয়ে কাঁপন ধরাতে এগিয়ে আসছে আমার রক্তে। সঙ্গী নাইমুল হক সেই সময় কড়া নাড়ে আকাঙ্ক্ষিত দরজায়। ১৯৯৫ সালের শীতে বিকালের লন্ডন দরজা খুলেই হাত বাড়ায়, ‘আহলান সাহলান, খোশ আমদিদ।’
ভদ্রলোকের মাথার চুলগুলো লন্ডনের বরফের চাইতেও সাদা। মুখভর্তি তারও চেয়ে সাদা সুবিন্যস্ত দাড়ি। পরনের পোশাকে এখনও লেগে আছে ওরিয়েন্টাল আভিজাত্যের ঘ্রাণ। দুধের সঙ্গে আলতা মেশানো গায়ের রঙ। হাত যখন বাড়ালেন আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। হাতের প্রতিটি পশমে পর্যন্ত শ্বেত সৌন্দর্যের কারুকাজ। পুরুষ্ঠ হাতটি আমি হাতের মধ্যে নিলাম। তিনি আমাকে ভেজা ওভারকোট সহই জড়িয়ে নিলেন বুকে, ‘ভাই সাহেব, কতদিন পরে আমার তরুণ ভাই খোঁজ নিতে এসেছে এই বদনসিবের।’
বললাম, বদনসিব হবেন কেন? তাসাদ্দুক ভাই আপনার সম্পর্কে আমাকে যা বলে দিয়েছেন তা থেকে আমার ধারণা হয়েছে, আপনি এক অসাধারণ মানুষ। আর তাসাদ্দুক ভাইয়ের মতো লোক তো যে কারও সম্পর্কে যা খুশি তা বলতে পারেন না।
স্মিত হেসে আমাকে হাত ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে তাজিমের সঙ্গে বসালেন। বাইরের ঠাণ্ডা রুমের উষ্ণতায় দ্রুত কেটে যাচ্ছে টের পাচ্ছি।
এর মধ্যে কফি চলে এলো। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে তাসাদ্দুক ভাই, মানে সেই সময়কার লন্ডনে বাংলাদেশীদের সব অগতির গতি তাসাদ্দুক আহমদের কথা ভাবছিলাম। তিনি আমাকে এই মানুষটির কাছে পাঠিয়ে বললেন, সৈয়দ কুতুবউদ্দিন সাহেব লন্ডনে এসেছেন সেই ১৯৪৯ সালে। তুমি তো ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কর। তার কাছে উপমহাদেশের ইতিহাসের বেশকিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়ে গেছে। একটা স্বাধীন দেশকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল তার জীবন্ত সাক্ষী তিনি। জানাশোনা লোক। একসময় লেখালেখি করতেন, এখন করেন না। বলেন, ‘এ জীবনে তো আর মাতৃভূমির স্বাধীনতা উদ্ধার করতে পারলাম না। এখন তো জীবনে লেগেছে ভাটার টান। আর পেছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে না। এখন চিরতরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ তবুও তুমি তার কাছে যাও। স্বাধীন হায়দারাবাদ কীভাবে ৬ দিনের যুদ্ধে ভারত দখল করে নিয়েছিল তার বিস্তারিত কথা শুনতে পাবে তার কাছে।
তাসাদ্দুক ভাইয়ের নির্দেশ মানতে এবং আমার অন্তরের আগ্রহ পূরণ করতেই এই শীতের বরফ ঠেলে এখানে আসা।
কফির কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম, আপনার কথা বলুন। আপনার দেশের কথা বলুন।
কুতুবউদ্দিন সাহেব গম্ভীর হয়ে গেছেন। বললেন, আমার নিজের কোনো কথা নেই। আর আমার কোনো দেশ নেই। আমি হলাম দেশহীন এক মানুষ। ১৯৪৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমার দেশ দখল করে নিয়েছে ভারত।
বললাম, সেই হায়দারাবাদের কথাই বলুন।
সৈয়দ কুতুবউদ্দিন বিখ্যাত উর্দু কবি দাগের গজল শোনান আমাদের :
‘দিল্লি সে চলে দাগ, করো সায়র ডেকান কি,
গওহর কি হুয়ি কদর, সমুন্দর সে নিকাল কে।
হায়দারাবাদ রহে তা-বা, কেয়ামত কায়েম
এহি, অ্যায় দাগ, মুসলমান কি এক বসতি হ্যায়।’
[হে দাগ, দিল্লি ছাড়। দাক্ষিণাত্যের পথে ভ্রমণ কর। মুক্তার দাম তো তখনই হয় যখন সে সমুদ্রের বাইরে আসতে পারে। হায়দারাবাদ কেয়ামত পর্যন্ত উজ্জ্বল থাক, চিরঞ্জীব হোক, কারণ এই তো একমাত্র স্থান যেখানে মুসলমানরা বাস করতে পারে।]
কবি দাগের সেই শুভকামনা পূর্ণ হয়নি। পূর্ণ হতে দেয়া হয়নি। স্বাধীন হায়দারাবাদ বেঁচে থাকেনি। বেঁচে থাকতে পারেনি। বেঁচে থাকতে দেয়া হয়নি। মুসলমানদের আবাসস্থল হয়েও সে নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারেনি। দাগের কবিতা লেখার ৫০ বছরের মধ্যে হায়দারাবাদ ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকারে পরিণত হয়ে রাষ্ট্র হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বিশ্বমানচিত্র থেকে মুছে গেছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম-নিশানা। ভারতীয় বাহিনী হায়দারাবাদ দখলের পর প্রথমেই ভেঙে দিয়েছিল এর সেনাবাহিনী। সব দেশপ্রেমিককে করেছিল শৃঙ্খলিত। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নিষিদ্ধ করে দিল উর্দুকে। নিষিদ্ধ হলো জাতীয় সঙ্গীত। রাষ্ট্র হিসেবে হায়দারাবাদের বিলুপ্তির ঘোষণা করে ভাষার ভিত্তিতে একে তিন টুকরো করা হলো। এক টুকরো দেয়া হলো অন্ধ্রকে, এক টুকরো মহারাষ্ট্রের সঙ্গে, অন্য টুকরো বিলীন করে দেয়া হলো মহিশুরের সঙ্গে। আমার দেশ হায়দারাবাদ রাষ্ট্রের শেষ ও একমাত্র চিহ্ন হিসেবে টিকে রইল শুধু শহর হায়দারাবাদ।
সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের চোখ চলে যায় সুদূর অতীতে। তার ফেলে আসা যৌবনে। তার হায়দারাবাদে। তার শৈশব তার কৈশোরে। নিজের ফেলে আসা গৃহের আঙিনায়। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নিমিষে তার হৃদয় লণ্ডন থেকে চলে যায় হারিয়ে যাওয়া হায়দারাবাদে।
টানা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার কথা বলতে শুরু করেন, আমি কি বেশি কথা বলছি?
বললাম, ঠিক আছে। আপনি বলুন।
তিনি বললেন, কী করব, আমি ছাড়া আজকের পৃথিবীতে বিলুপ্ত হায়দারাবাদের জন্য কথা বলার লোক, চোখের পানি ফেলার লোক তো হয়তো আর নেই।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে শুরু করেন সৈয়দ কুতুবউদ্দিন, ‘১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮, আমাদের স্বাধীনতা লাভের মাত্র এক বছর তিন মাসের মাথায়, যখন আমি মাত্র ৩১ বছরের যুবক। সদ্য বিয়ে করেছি মাতৃভূমির গৌরবে গৌরবান্বিত বুক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে দেশের জন্য কাজ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি কর্মক্ষেত্রে। অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী হায়দারাবাদের মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। হায়দারাবাদে কেউ কখনও না খেয়ে মরেনি। শিক্ষার হার ছিল উপমহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। সর্বত্র শান্তি আর সদ্য স্বাধীনতা লাভের আনন্দ। সেই সময় যখন আমরা কেবল ঘর গুছাচ্ছিলাম, দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলর জন্য কাজ করছিলাম, যখন কেবল মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছি, আমার সদ্য বিয়ে করা বিদুষী স্ত্রী বলত, সারাক্ষণ দেশ দেশ করে বাইরে থাক। এবার ঘরের দিকে একটু মন দাও। বললাম, ঘরকে সুন্দর করার জন্যই দেশকে সুন্দর করার কাজে মন দিয়েছি। তোমাকে, তোমার ঘরকে ভালোবাসি বলেই তো দেশকে ভালোবাসি।
স্ত্রী প্রসঙ্গ আসাতে বিমর্ষ হয়ে গেলেন কুতুবউদ্দিন সাহেব। ৭৮ বছরের প্রবীণ চোখে কি পানি এলো? আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কায়দা করে চোখ মুছে নিলেন বৃদ্ধ।
বলে চললেন, সেই সময় ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, পৃথিবীর সব নীতি-নিয়ম, জতিসংঘের সব সময় দু’পায়ে মাড়িয়ে হিংস্র হায়েনার মতো চার দিন থেকে হায়দারাবাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ভারতীয় সেনাবাহিনী। শত শত ট্যাঙ্ক, কামানের গর্জনে প্রকম্পিত হলো হায়দারাবাদের আকাশ-বাতাস-জমিন। ভারতের বোমারু বিমানগুলোর নির্বিচার বোমাবর্ষণে ক্ষত-বিক্ষত হলো ৫শ’ বছর ধরে গড়ে ওঠা সুন্দর দেশ হায়দারাবাদ।
উন্মত্তের মতো মুসলিম হত্যকাণ্ডে মেতে উঠল ভারতীয় সেনাবাহিনী। কারণ, তারাই ছিল হায়দারাবাদের স্বাধীনতা রক্ষার মূল চালিকাশক্তি। শহর, বন্দর, বাজার, গ্রাম, গঞ্জ ধ্বংস করে মাইলের পর মাইল বাড়িঘর, মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে রাজধানীর দিকে এগুতে থাকল ভারতীয় বাহিনী। প্রথম দুই দিনেই ৭০ হাজারের মতো নিরীহ সাধারণ মানুষ নিহত হলো ভারতীয় সৈন্যদের হাতে। ধর্ষিত হলো ৩০ হাজারের মতো মা-বোন। মানবসভ্যতার এত বড় বিপর্যয়ের মুখেও সেদিন মুখে কুলুপ এঁটে নীরব নিঃশব্দ হয়ে বসে রইল বিশ্ববিবেক।
এমনকি মুসলিম দেশগুলো পর্যন্ত সেদিন সাহায্য তো দূরের কথা, এই ভয়াবহ আগ্রাসানের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। এই নীরবতা, এই নিঃসঙ্গতা, এই জঘন্য উদাসীনতার কারণ কী ছিল, জাতিসংঘই বা কেন সেদিন নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকতে বিলম্ব করল? —তা আজও রহস্যাবৃতই হয়ে আছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম, মুসলিম দেশগুলো কেন হায়দারাবাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তা আজও কারও বোধগম্য নয়।
কিন্তু আমরা, আমার মতো লাখ লাখ স্বাধীনতাপিপাসু মানুষ, সেদিন আমাদের যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম ভারতীয় হানাদারদের বিরুদ্ধে। হায়দারাবাদের গণমানুষের প্রিয় নেতা কাশেম রিজভী বিপন্ন স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গড়ে তুলেছিলেন প্রবল প্রতিরোধ। কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত লক্ষাধিক সৈন্যের একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র জনতা যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারে ক’দিন?
ভারতের তল্পিবহনকারী, দালাল, সুবিধাভোগী, দেশদ্রোহীচক্র যারা নানা ছদ্মবরণে হায়দারাবাদের জাতীয় ঐক্য, সংহতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য কাজ করছিল, তারা এবার প্রকাশ্যে এসে হাত মেলালো ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে।
হায়দারাবাদের রাজনীতিবিদ, সমরনায়ক, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের বিরাট অংশ জাতীয় প্রতিরোধ সংগ্রামকে ভেতর থেকে ভয়ানক দুর্বল করে তুললেন। গোটা জাতিকে নানা কায়দায় পরিষ্কার দুটো ভাগে বিভক্ত করে তুলল। নানা কল্পকাহিনীর জন্ম দিল তারা। ভারতীয় পত্রপত্রিকা এক্ষেত্রে জোগালো ঢালাও সমর্থন।
ফলে আঘাত ও আগ্রাসন যখন প্রত্যক্ষভাবে এলো তখন দ্বিধাবিভক্ত জাতির পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আল ইদরুস করলেন চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ঠিক আপনাদের মীরজাফর যেভাবে সিরাজের সঙ্গে, মীর সাদেক যেভাবে টিপু সুলতানের সঙ্গে করেছিলেন।
তো আমাদের সব উদ্যোগ আয়োজন ব্যর্থ হয়ে গেল। ফলে মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে ১৮ সেপ্টেম্বর পতন হলো হায়দারাবাদের। মুছে গেল হায়দারাবাদ। আহ—!
বুকে চেপে রাখা একটা কষ্ট যেন গলা দিয়ে গোঙরানির মতো বেরিয়ে এলো কুতুবউদ্দিন সাহেবের। কথা বলা বন্ধ করে বাইরে তুষারপাত দেখার দিকে যেন মন দিলেন হঠাত্। আমরা কেউ কোনো কথা বলি না। আবার শুরু করেন বৃদ্ধ, ‘যুদ্ধের ময়দানে গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলাম। সেখান থেকে কীভাবে কোথায় গিয়েছি, বলতে পারব না। আমার জ্ঞান ফিরল পরাধীন হায়দারাবাদে ওসমানিয়া হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে আমাকে পাঠানো হলো জেলে। জেলের ঘানি টানলাম কয়েক মাস। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলো গোলযোগ সৃষ্টির। ভারতীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অভিযোগ এলো। অভিযোগ এলো রাষ্ট্রদ্রোহিতার। কয়েকজন ভারতীয় সৈনিক নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে আমার গুলিতে মরেছিল।
সেই মামলার হামলা পার হয়ে জামিন জুটল এরও ৬ মাস পর। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাইরে এসে দেখি সর্বত্র পতপত করে উড়ছে ভারতীয় পতাকা। ছারখার হয়ে গেছে হায়দারাবাদ। হায়দারাবাদ যেন ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। বেহুশের মতো ছুটলাম নিজ বাড়িতে।
আমাদের পুরো মহল্লাটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পড়ে আছে ছাইভস্ম আর পোড়ামাটি।
আমার বাবা-মা, দুটি ভাই—কারোই কোনো খোঁজ পেলাম না। হয়তো বন্ধ ঘরে আটকে তাদের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী।
হঠাত্ আমার স্ত্রী, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, যে নাকি একজন ভালো আইনজীবী হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাকে খুঁজলাম। আমার এক সদাশয় স্নেহময় হিন্দু প্রতিবেশী বৃদ্ধ বললেন, বাবা রে, সব তো শেষ হয়ে গেছে। ওরা এখানকার সহায়-সম্পদ সব লুণ্ঠন করেছে। মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। তবে মহল্লায় ঢুকে মেয়েদের, বিশেষ করে যুবতী মেয়েদের ওরা আগেই আলাদা করে ট্রাকে উঠিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।
তার পরের কয়েক মাস আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে, জীবনের ভয়কে তুচ্ছ করে আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেরিয়েছি আমার বাবা-মা, ভাই ও জেবুন্নেসা—আমার স্ত্রীকে। হাসপাতাল, মর্গ, জেলখানা, পতিতাপল্লী কোথাও বাদ দেইনি। আমার কয়েকজন হিন্দু বন্ধুর সহযোগিতায় ভারতীয় সৈন্যদের শিবিরেও খোঁজ নিয়েছি। কাউকেই পাইনি। আমি আর ওকেও খুঁজে পাইনি। ওর কী হয়েছিল, তাও কোনোদিন জানতে পারিনি। আমার মতো একরকম হাজার হাজার স্বামী তাদের স্ত্রীদের, বাবা তাদের ছেলে মেয়েদের খুঁজে পায়নি। হয়তো হায়দারাবাদের কোনো চিহ্নহীন গণকবরে চাপা পড়ে গেছে আমার জেবুন্নেসা, আমার বাবা-মা-ভাই।
তারপর আর কী,
‘ওহ দিল্ নহি রহা হ্যায়, নহ্ ওহ আব দিমাগ হ্যায়,
জি এনমেঁ আপনে বুঝতাসা কোই চিরাগ হ্যায়’
[সেই হৃদয় নেই, সেই মাথাও এখন নেই। শরীরে প্রাণ আছে, কিন্তু সে যেন নিভু নিভু প্রদীপ।]
কথা বলতে বলতেই আমাদের দিকে চোখ ফেরালেন সৈয়দ কুতুবউদ্দিন। তার মুখের দিকে তাকাতে ভয় করছিল আমার। না জানি কী সেখানে দেখাব। তবুও কথা শেষ হয় না তার, ‘শিকদার সাহেব, আপনাদের বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনে অনেক বড় দেশ ছিল আমার হায়দারাবাদ। শুধু আয়তনের দিক থেকেই নয়, সম্পদ, সমৃদ্ধি, সামর্থ্যের দিক থেকেও স্বাধীন রাষ্ট্র হায়দারাবাদের সম্মান ছিল অনেক উঁচুতে। হায়দারাবাদের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থা ছিল। সেনাবাহিনী ছিল। আইন, আদালত, বিচারব্যবস্থা ছিল। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, শুল্ক বিভাগ ছিল। নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাষা ছিল। নিজস্ব পতাকা ছিল। জাতীয় সঙ্গীত ছিল। পৃথিবীর দেশে দেশে নিজস্ব রাষ্ট্রদূত ছিল। জাতিসংঘে নিজস্ব প্রতিনিধি ছিল। সব ভারতের আগ্রাসী তাণ্ডবে মুহূর্তে মিথ্যা হয়ে গেল।
নিঃস্ব, রিক্ত, দুঃখী, পরাধীন হায়দারাবাদে আর থাকব না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপর কিছু বন্ধুবান্ধবের সাহায্যে ভারত-অধিকৃত হায়দারাবাদ থেকে রাতের অন্ধকারে পালালাম। তার পর নানা ঘাটে দোল খেতে খেতে এলাম লন্ডনে। সেই যে এলাম।
সৈয়দ কুতুব উদ্দিন আবার থামেন। এরই মধ্যে রাতের খাবারের ডাক আসে। আমি ও নাইমুল একসঙ্গে সৈয়দ কুতুবউদ্দিনের দিকে তাকাই। বুকে হাত বুলাতে বুলাতে আবার কথা শুরু করেন, ‘আমার এই বুকের ভেতরে অনেক জ্বালা, অনেক কষ্ট, অনেক স্বজন হারানোর কান্না। এগুলো আমার মধ্যে সারাক্ষণ দগদগে ঘায়ের মতো জ্বলতে থাকে। আমি ঘুমুতে পারি না বহুদিন। কাউকে যে বলে একটু হালকা হব, সে উপায়ও নেই। দরদি মানুষ কোথায়? ৭৮ বছর বয়সে এসেও আমি আজও ভুলতে পারিনি জেবুন্নেসার সেই শেষ বিদায়ের মুখটা। আমাকে বলেছিল, ‘তোমাকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিলাম। বিজয়ী হয়ে ফিরে এসো।’ আমি বিজয়ী হতে পারিনি বলেই হয়তো ভারতীয় সৈনিকরা আমার জেবুন্নেসাকে শিয়াল-শকুনের মতো কামড়ে কামড়ে খেয়েছে।
লন্ডনের তুষারপাতের মধ্যে এবার নেমে আসে অঝোর শ্রাবণ। বৃদ্ধের দুই চোখ দিয়ে বহুদিন পরে যেন উপচিয়ে নেমে আসে অবিরল পানির ধারা। রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠস্বর। তবুও ভাঙা ভাঙা গলায় আবৃত্তি করতে থাকেন মীর তকী মীরের গজল :
‘হু শমা—এ আখিরে শব্, শুন সরগুজশত মেরী,
ফির শুব্হ হোনে তকতো কিসসা হি মুখতসর হ্যায়।’
[শেষ রাতের প্রদীপ আমি, শুনে নাও আমার দুঃখের কাহিনী, ভোর হতে হতে তো সবই শেষ হয়ে যাবে।]
লেখক-আব্দুল হাই শিকদার।