গল্পটা এভাবে শুরু হয় অথবা গল্পটা এভাবে শেষ হয়। গল্পটা আমাদের দুজনের, গল্পটা তাদের দুজনের অথবা গল্পটা আমাদের তিনজনের। কিংবা অন্যভাবে বললে এটা কেবল আমার, একান্তই আমার গল্প। কারণ আমি ছাড়া, সম্ভবত, বাকি দুজন অপ্রাসঙ্গিক; কারণ আমি ছাড়া বাকি দুজন কখনো ভীষণভাবে দুজন, কখনো কখনো ভীষণভাবে কেউ-ই না।
গল্পটার শুরুতে এবং শেষে আমি নিধি অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে হত্যা করি। আমি খুবই আন্তরিক প্রচেষ্টায় হত্যাকাণ্ডটি সমাধা করি; হত্যার পরপর নিধির মুখ থেকে যে অদ্ভুত তরলটা ছিটকে পড়েছিল আমার হাতে আমি নিশ্চিত ওটা ওর লালা ছিল না - কারণ ওর লালা আমার বড় প্রিয় লেহ্য - ওটা কী ছিল আমি জানি না - তবে ওই তরলটা আমার শরীরে ছিটকে পড়েছিল আর সেই সঙ্গে আমার শরীর বেয়ে আমার জিভ পর্যন্ত উঠে এসেছিল এক অপরিচিত বিবমিষা; সেটাও ছিল তরল এবং আমাদের মসৃণ স্নানঘরে সেটা উগড়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে - সেই তরল-বিবমিষা-মুক্ত হওয়ার পর থেকে - আমি সজীব হয়ে উঠেছি। আমি নিধির নিস্তরঙ্গতার পাশে বসে আছি। আমি ওর স্থির ওষ্ঠ এবং অধরের কোমলতা বুঝবার চেষ্টা করছি ...
নিধির বুকে এখন হিমালয়ের গাম্ভীর্য, শীতলতা। রাতের পোশাকে সে এখনও পরিপাটি। প্রায় ধূসর চুলগুলোকে এলোমেলো বলা যাচ্ছে না । কপালে, চিবুকে, ঘাড়ে, হাতের তালুতে কি নাভিতে, উরুতে - না, কোথাও একফোঁটা মৃত্যু নেই; শুধু চোখ দুটো বাদে, বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখ দুটো বাদে। নিধি কি আমাকে দেখতে পেয়েছিল? মৃত্যু কি এতই বিস্ময়কর? সে কি বড় ভালোবাসত জীবন? এই বিস্ময়ের এবং বিস্ফোরণের কোনো মানে বের করতে আমি ব্যর্থ হই। আমি নিধির চোখের পাতা নামিয়ে আনি। নিধির এলানো শরীরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃত্যুকে এখন আমার সুন্দর লাগতে থাকে। আমি আলতো করে তার বুকে মাথা রাখি এবং অনেকদিন পর একটা হারিয়ে ফেলা গন্ধ খুঁজে পাই ...
ব্যাপারটা এমন না যে নিধিকে ভালোবাসতাম না আমি, তার প্রতি অনুভূতির কোনো নাম আমার জানা ছিল না। এটা ঠিক, নিধি কখনো কখনো স্রেফ একটা শরীর; মাফ করবেন, 'স্রেফ' শব্দটা কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারি না আমি। শরীর কখনো 'স্রেফ শরীর' হতে পারে না; শরীর আমার জন্য ছিল একটা উপাসনার ব্যাপার। নিধিকে উপাসনা করতাম আমি, তার শরীরকে। নিধি ছিল আমারএকটা প্রয়োজন, 'প্রয়োজন' বলেই হয়তো তার প্রতি আমার অনুভূতি নিয়ে নিঃসংশয় হতে পারিনি আমি; 'প্রয়োজন' বলেই এবং নিঃসংশয় ছিলাম না বলেই বোধ হয় আমি উপাসক হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু উপাসকেরা তো কেবল দেবীর কৃপা প্রার্থী নয়, তারা পুরোহিতও ধর্মের। নিধি, নিধির শরীর হয়ে উঠেছিল শুদ্ধতার প্রতীক, আমার কাছে। আমি ওই শুদ্ধতাকে পুজা করতাম, এবং ওই শুদ্ধতাকে রমণ করতাম এবং পুরোহিত হিসেবে যে ধর্মকে প্রতিপালন করতাম আমি ও পাহারা দিতাম - সামাজিক ধর্ম যেমন পাহারা দেয় প্রচলিত পাহারাদারেরা - তা ছিল নিধির নিঃশর্ত আনুগত্য। নিধি দেবী - কারণ সে বয়ে বেড়াত অনেক মরুভূমি আর অসংখ্য পৌরাণিক প্রস্তর - কথিত আছে যা কিনা উপমিত হতো কোনো কোনো পৌরাণিত শক্তিময়ীর যোনিদেশ হিসেবে।
কিন্তু নিধি নিজেই ডেকে আনল নিজের মৃত্যু। ঘটনাটা এরকম :
ঢাকার রাস্তায় সেদিন গাড়ির জট আর ছাড়ছিল না। আমি আটকা পড়েছিলাম। আমার গাড়ির শীতাতপটি ছিল নষ্ট। দুই, তিন ও চারচাকার শেকল দিয়ে তৈরি দীর্ঘ সরীসৃপটি এগোচ্ছিল, এগোচ্ছিল না। আমার পাশের পাশের গাড়িটি থেকে অবোধ্য কিছু ভাষা আর তীব্র বাদ্য ভেসে আসছিল। গাড়ির পাশের আয়নায় একটি তরুণ যুগল নিজেদের জড়িয়ে রেখেছিল। জানালার কাচে কদমফুল হাতে একটি শিশু বারবার কেঁদে উঠছিল। আর আকাশ থেকে গলে গলে পড়ছিল লাভা। এবং তখনই নিধিকে দেখি আমি। নিধি শাড়ি পরে ছিল। নিধি উঁচু জুতো পরে ছিল। তার ঘাড়ে রোদ পড়ে পড়ে ছলকে যাচ্ছিল। তার ঘাড়ের তিলটা আমি খুঁজছিলাম আমি এত দূর থেকে। নিধিকে মনে হচ্ছিল একটা রহস্যময়ী বক্ররেখা এবং তখনই আরেকটি ঋজু রেখা খঁজে পেলাম আমি। রেখাটি নিধির পাশে হাঁটছিল। আমি আবিষ্কার করলাম রেখাটি আসলে নিধির সঙ্গেই এগোচ্ছিল ফুটপাথ বরাবর। সরলরেখাটির কোনো কোনো ইঙ্গিতে বক্ররেখাটি আরও বেঁকে যাচ্ছিল। কখনো বক্রের অবোধ্য কোনো ভঙ্গিমার উত্তরে সরলরেখা অদ্ভুত কোনো ভঙ্গি করছিল, ফলে বক্ররেখাটি স্পন্দিত হচ্ছিল - আমি দেখছিলাম। আমার পৃথিবী অদ্ভুত কিছু জ্যামিতিতে ভরে উঠছিল। আমার শীতাতপহীন গাড়িটির ধূসর ঘড়িটি সময় দেখাচ্ছিল ২:২৯; এবং আমি ২:২৯ এ আটকে গিয়েছিলাম। আমি গাড়িগুলোকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, কদম-ফুল-হাতে শিশুটি হারিয়ে গিয়েছিল, আলিঙ্গনরত যুগলটিকে আমার গাড়ির আয়নায় আর খুঁজ পাচ্ছিলাম না। আমি অন্য আরেকটি পৃথিবীতে হারিয়ে গিয়েছিলাম যেখানে সময় এবং শব্দ বলে কিছু ছিল না; যা ভরে ছিল আশ্চর্য সব জ্যামিতিতে।
নিধি ছিল আমার প্রিয় পরিচিত মফস্বল, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছিলাম, যার প্রতিটি গলিপথ আমি চোখ বুজেই বের করে ফেলতে পারি; যার প্রতিটি দেওয়ালের গন্ধ আমার জানা। নিধির শরীরের গন্ধ আমার বড় বেশি জানা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ওর শরীরে আরেকটা কিসের গন্ধ যেন বাসা বাঁধতে থাকে। আমি আমার প্রিয় মফস্বলের রাস্তাঘাট ভুল করতে থাকি।
এরপর থেকে নিধিকে আমি নিয়মিত অনুসরণ করতে থাকি, আমি যেন ওই অপরিচিত, অনাত্মীয় গন্ধের উৎসমূল খুঁজে ফিরি। অনুসরণকারী হিসেবে আসি অনেক দতার পরিচয় দিতে থাকি! নিধি কখনো গাড়ি নিয়ে বেরোতো না। ও বেরোতো রিকশায়। আমি কয়েকশ গজ দূরত্ব বজায় রেখে ওর পিছু নিতাম। এজন্য আমি আমার এক বন্ধুর গাড়ি ধার করতাম, বন্ধুটিকে প্রতিদিন কিছু অসম্ভব অজুহাত দেখাতাম, বন্ধুটি কী বুঝত আমি জানি না, বন্ধুটি সবসময়ই আমাকে গাড়ি ধার দিত। এবং আস্তে আস্তে আমি আরও দ হয়ে উঠতে থাকলাম।
নিধির গন্তব্যগুলো ছিল মূলত গহনার বাজার, মূল্যবান সামগ্রীতে ঠাসা বিপনী বিতানগুলো, তার বান্ধবীদের বাড়ি, বাবার বাড়ি এবং সেই তৃতীয়জন। আমি পরে আবিষ্কার করেছিলাম যে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দুটো দিনেই তারা দেখা করত। তারা মিলিত হতো শহরের কোনো এক সড়কে এবং অনির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত। আসলে আমরা তিনজনই বেরিয়ে পড়তাম অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। এবং আমি চমকে উঠতাম, এতদিন এতভাবে পিছু নেওয়ার পরও নিধি আমাকে খুঁজে পেল না! আমি আমার দতা নিয়ে সংশয়ে ভুগতাম এবং একসময় ঘটনাগুলোর বাস্তবতাও আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠতে লাগল।
আমি মনে মনে প্রার্থনা করতাম ঘটনাগুলো যেন বাস্তব না হয়; এগুলো যেন স্রেফ দৃষ্টিবিভ্রম। সপ্তাহের ওই নির্দিষ্ট দুটো দিনে আমি প্রার্থনা এবং প্রত্যাশা নিয়ে আমার বাড়ির কয়েকশ গজ দূরে বন্ধুটির গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। নির্দিষ্ট সময়েই নিধি বেরিয়ে আসত, তাকে তখন আমার আর সাধারণ একজন মানুষ মনে হতো না, সে হয়ে উঠত আমার পরিচিত পৃথিবীর বাইরের কেউ। আমার ভেতর অসংখ্য নর্দমার কালো জল আর থিকথিকে কাদা একসঙ্গে ঢুকে যেত; আমার সব ইন্দ্রিয় দিয়ে - আমার সব অনুভূতি দিয়ে - অবারিত ডোবা, নালা আর নর্দমা আমার আত্মার দিকে অগ্রসর হতো - আমি মরীয়া হয়ে গাড়ির এক্সেলেটরে চাপ দিতাম। এবং তৃতীয়জন অবশ্যই অপো করত, কোনো ফুটপাথে, কোনো ওভারব্রিজে, কোনো পার্কের মূল দরোজায়, কোনো রেস্তোঁরার কাচঘেরা শীতাতপে, কোনো হ্রদের বাঁকানো সেতুতে তৃতীয় জন দাঁড়িয়ে থাকত; তাকে আমার মনে হতো - কিলবিল করে গড়িয়ে চলা কোনো সরীসৃপ দাঁড়িয়ে আছে। নিধি হেসে অভিবাদন জানাতো। উত্তরে হেসে উঠত সেই তৃতীয় জনও। তারপর শুরু হতো সেই বক্র আর সর লেখার নানান উপপাদ্য। আমি আমার ভেতর এক নালা কাদাজল আর অসম্ভবের প্রত্যাশা নিয়ে ও প্রার্থনা নিয়ে চন্দ্রাহতের মতন অনুসরণ করতাম। কিন্তু সপ্তাহের দুটো নির্দিষ্ট দিনের জ্যামিতি ছিল নিষ্ঠুর - না, ওখানে কোনো বিভ্রম বা অলীক কোনো কিছু ছিল না - পুরোটাই ছিল রেখা, তল, আকৃতি আর বস্তুর জ্যামিতি...
কিন্তু আমাদের যৌথজীবন ছিল ছেদহীন। আমি খুব স্বাভাবিক আচরণ করতাম; নিধিও। যদিও নিধি আমার পৌরহিত্যে ইতি টেনে দিয়েছিল, কারণ নিধি আমার কাছে বিশ্বস্ত ও শুদ্ধ ছিল না, কিন্তু তবুও আমরা মিলিত হতাম। আমি মিলিত হতাম হঠাৎ করে অচেনা হয়ে যাওয়া মফস্বলের রাস্তাঘাট খুঁজে ফেরার উন্মাদ আকাঙা নিয়ে; সেই গন্ধের অস্তিত্বহীনতার অসম্ভব প্রত্যাশা নিয়ে; এবং ব্যর্থ হতাম; এবং বাস্তবতার পরাক্রমে কুঁকড়ে উঠতাম। নিধি মিলিত হতো কেন আমার জানা নেই। হয়তো সে ভাবত আমি তখনো তার উপাসক ছিলাম। এবং তারপরই সেই ঘটনাটি ঘটে যে কারণে গল্পের শুরুতে নিধিকে নিহত হতে হয় ...
নিধির সাপ্তাহিক অভিসার এবং আমার দ অনুসরণ আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। (আপনারা হয়তো 'জীবন' শব্দটার সঙ্গে একমত হতে চাইবেন না। বলবেন 'অসুস্থ জীবন'। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি প্রতিবার অনুসরণ করতাম বিভ্রমের প্রত্যাশায়...)। সম্ভবত সপ্তাহের সেই দুটো দিনকে আমি বিশ্বাস করতে চাইতাম না। সম্ভবত সপ্তাহের সেই দুটো দিন আমাদের জীবনের অনেক গভীরে ঢুকে গিয়েছিল এবং সে কারণেই ওই দুটো দিন আমাদের জীবনের ভেতরে ছিল না। কিন্তু যেদিন ঘটনাটা ঘটল, সে দিনটা অন্য দিন ছিল এবং সেদিন তুমুল বৃষ্টি ছিল। আমি ছিলাম গাড়িতে। দুটো ওয়াইপার বৃষ্টির সঙ্গে যুদ্ধ করে পেরে উঠছিল না। রাস্তাঘাট স্বচ্ছ শাদাটে স্ফটিকে ভেসে যাচ্ছিল। আমি এগোচ্ছিলাম ধীর গতিতে। রিকশাগুলো ছিল রঙিন, তাদের বৈচিত্রময় পর্দার কারণে। রিকশাঅলাদের ফুলহাতা শার্ট শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছিল এবং সে ব্যাপারে তারা মোটেই মনোযোগী ছিল না। মাঝেমধ্যেই হিস হিস করে কিছু গাড়ি আমাকে পাশ কাটাচ্ছিল। আমি তাদের গতির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে জায়গা করে দিচ্ছিলাম এবং তখনই আমার কয়েক হাত দূরের একটা রিকআর ছইয়ের ফাঁকে আমি খুব পরিচিত একটা নকশা আবিষ্কার করি। আমার খুব চেনা হয়ে যাওয়া কিছু চুল, খুব প্রিয় রঙের ত্বক, তার চেয়েও প্রিয় একটা তিল ছইয়ের ফাঁক দিয়ে আমি চিনে ফেলি। এবং সেই নকশা, সেই চুল, সেই ত্বক, সেই তিলের মালিকানা বুঝে নিতে ব্যগ্র একটি ভিজে যাওয়া জামার আস্তিনও ছইয়ের ফাঁক গলে আমার চোখে ভাসে। আমি গাড়ির গতি সামান্য বাড়াই। রিকশার সমান্তরালে এগোতে থাকি। জানালার কাচ দিয়ে ভিজে যাওয়া শাড়ি আর উঁচু জুতোর মাঝখানে ধবধবে পাÑ সেই পুরোনো সমন্বয় আমি আবিষ্কার করি। গাড়ির বামদিকের আয়নায় এরপর একটি দৃশ্য দৃশ্যায়িত হতে থাকে। আমি এক পলকই আয়নাটায় তাকিয়ে থাকতে পারি। বৃষ্টির জল বারবার নেমে এসে আয়না থেকে সেই দৃশ্যটা মুছে ফেলতে চায়, যেন বাস্তব দৃশ্যটাকে বিভ্রম বানানোর জন্য লড়াই করে বৃষ্টি; কিন্তু বাস্তবতা আবার বিজয়ী হয়; প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটাকে পরাজিত করে দৃশ্যটা পুনরাভিনীত হতে থাকে; আমি বামের আয়নায় চুইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের সঙ্গে চারটি ঠোঁট গড়িয়ে যেতে দেখি এবং আমি এতটুকুই দেখি। এর বেশি কিছু দেখা আমার পে সম্ভব হয় না। আমি গাড়ির একসেলেটরে চাপ দিই।
তখনই নিধিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিই আমি। আপনারা বলবেন, কেন আমি ওর মুখোমুখি হলাম না। এর উত্তর আমি আপনাদের দিতে পারব না। দিলেও বিশ্বাস করবেন না।
নিধিকে প্রশ্ন করার মানে হলো আমাদের জীবনে তৃতীয় আরেকজন ঢুকে যাওয়া। আমাদের বাস্তবতায় আরেক বাস্তবতার ঢুকে যাওয়া ... না, এটা চাইনি আমি; আমার মনে হয়েছিল নিধিকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাগুলোও নিহত হবে। আরিক অর্থে, আমার হত্যাকৌশলটাও ছিল তেমনি। অথচ মানুষ কেন, এর আগে আমি একটি বেড়ালও হত্যা করি নি ...
আমার শক্তি নিয়ে আমার বরাবরই সংশয় ছিল; এবং আমি এটাও জানতাম মানুষ যখন জীবনের জন্য লড়াই করে তখন তার শক্তি অনেকগুণ বেড়ে যায়। সুতরাং বিষাক্ত কীটনাশক দিয়ে আমি সহজেই কাজটা সারতে পারতাম। কিন্তু আমি ওই দিকে যাইনি। আমার মনস্তত্বে ঘটনা চাপা দেওয়ার একটা আকুতি কাজ করছিল ...
আমি নিধির মুখে যখন বালিশটা চেপে ধরি - আমার বালিশের নিচে চাপা পড়তে থাকে বিভিন্ন জ্যামিতি, বিভিন্ন বিকেল, রঙচটা পার্কের বেঞ্চ, তৃতীয় একটি কণ্ঠের পৌরুষ, খুব পরিচিত একটি গ্রীবায় এসে পড়া একচিলতে রোদ। রিকশার ছইয়ের ফাঁক দিয়ে প্রিয় একটি তিলের বিদ্রুপ আমার বালিশের নিচে এমে হাঁসফাঁস করতে থাকে। এবং আমার নিজেকে আরও শক্তিশালী মনে হতে থাকে। এক সময় আমি ঈশ্বর হয়ে যাই। এক সময় আমি মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক বনে যাই। এক সময় আমি মুত্যুকে অপো করতে বলি। এক সময় একটি প্রবল শক্তিশালী বালিশ মৃত্যুর মালিকানা পেয়ে যায় এবং নিধি হাঁসফাঁস করতে থাকে; আমি মৃত্যুকে আরেকটু জিরোতে বলি কারণ আমি তখন বালিশচাপা দিতে ব্যস্ত বন্দুর কাছে দেওয়া আমার সমস্ত কৈফিয়তগুলো, বালিশচাপা দিচ্ছি দ অনুসরণগুলো আর ইতিহাসগুলো। এবং এক সময় সদ্য দাঁড়াতে শেখা একটা সরীসৃপকে আমি আমার বালিশের নিচে পেয়ে যাই যে সরীসৃপটিকে আমি রিকশায়, পার্কে, বৃষ্টিতে, গোধূলিতে বারবার অবিশ্বাস করেছি। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে সরীসৃপটিকে পিষে ফেলতে চাই, আমি আমার অস্তিত্ব দিয়ে সরীসৃপটির অস্তিত্ব মিশিয়ে দিতে চাই; এবং এমন সময় বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টির শব্দ শোনা যেতে থাকে এবং এমন সময় (সম্ভবত) নিধি নিহত হয় ...
২
দীর্ঘ সময় আমি নিধির বুকে মাথা পেতে ছিলাম। আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? আমি যখন উঠে বসলাম বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছে। আমি জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, জানালাটা সরিয়ে বৃষ্টি দেখছি। জানালার ফাঁক গলে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। আমার পেছনে, বিছানায়, নিধি পড়ে আছে। তার পাশে শুয়ে আছে তিনজন মানুষের একটা ইতিহাস। কিছুক্ষণ আগে - কতক্ষণ হলো জানি না - আমি সেই ইতিহাসকে বালিশচাপা দিয়েছি। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা মাছি ঢুকে পড়ে ঘরে একটানা শব্দ করতে করতে। মাছিটা নিধির গন্ধ আবিষ্কার করেছে নিশ্চয়ই। মাছির শব্দে শিউরে উঠি আমি। এই প্রথম, মাছির উপস্থিতে, অনুভব করি আমি - আমি একজন হন্তারক!