পৃথিবীতে প্রথম যে এককোষী প্রাণের উদ্ভব ঘটে সেটি অক্সিজেনমুক্ত পরিবেশেই টিকে ছিল দীর্ঘ সময়। মহাজাগতিক রশ্মি থেকে শক্তি সংগ্রহ করে তারা বেঁচে থাকত। এগুলোর মধ্যে ব্যাকটেরিয়াই ছিল প্রধান। প্রায় দেড়শ’ কোটি বছরের প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনসম্পন্ন প্রাণীরা আসে। তাদের বিকাশের ফলেই বহুকোষী প্রাণের উদ্ভব ঘটে। ফলে বহুকোষীরা প্রথম থেকেই অক্সিজেনসম্পন্নই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরের গভীরে এমন বহুকোষী প্রাণীর সন্ধান জীববিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, যারা অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে থাকে এবং জন্ম দিতে পারে তাদের পরবর্তী বংশধরদের। ইতালির আনকোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জীববিজ্ঞানী গভীর সমুদ্রে গবেষণা করতে গিয়ে Loricifera পর্বের অন্তর্গত তিনটি (একই পর্বের) প্রাণীকে খুঁজে পান এ বছর।
লুকজারিয়ান শিংয়ের ড্রাগন :
লুকজারিয়ান শিংয়ের ড্রাগনের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আজ থেকে প্রায় ৭ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে এদের পাওয়া যেত বর্তমান আমেরিকার উটা অঞ্চলে। এদের ওজন ছিল ২৫০০ কেজি এবং বিশাল মাথায় ছিল ১৫টি শিং। ২০০৭ সালে উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীর কঙ্কালের ফসিল আবিষ্কার করেন। আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে পশ্চিম ক্রিটাশিয়াস জলাভূমির উপকূলে এই প্রাণীগুলোর পদচারণার চিহ্ন পাওয়া গেছে।
তড়িৎ দ্বিমেরুতার মান নির্ণয় :
গেল বছরের প্রথমদিকে বিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণায় ঘটেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সম্ভব হয়েছে তড়িৎ দ্বিমেরুতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যায়ে মান নির্ণয়। উল্লেখ্য, ১৮৯৬ সালে জেজে থমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। ইলেকট্রন সম্পর্কে আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ‘ইলেকট্রনকে ঠিকমতো বোঝা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ তা এ কাজটির মাধ্যমে এক ধাপ এগিয়ে গেল
ইলেকট্রন প্রবাহে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি। ইলেকট্রনের সংজ্ঞায় নতুন করে যোগ হতে যাচ্ছে তড়িৎ দ্বিমেরুতার মাত্রা বা ইলেকট্রিক ডাইপোল মোমেন্ট।
কৃত্রিম জীবনের খোঁজে :
এ বছর সিনথেটিক লাইফের আবিষ্কার পরীক্ষাগারে সম্ভব হয়েছে। ব্যাপারটি আর কিছুই নয়, শুধু ডিএনএ বা আরএনএ ব্যবহার করে জীববিজ্ঞানের সংখ্যাকীকরণ বা ডিজিটালাইজেশন। জিনোমের সিকোয়েন্স করা থেকে যাত্রা শুরু এবং ডিজিটাল কোডকে কম্পিউটারে স্থাপন। তারপর কম্পিউটারের সাহায্যে নতুন জীবনের মালমসলা সাজানো। এভাবে মালমসলা সাজিয়ে সরল জীবনের ভিত্তিও গড়েছেন বিজ্ঞানী ক্রেগ ভেন্টর। রসায়নাগারে কৃত্রিম ভাইরাস তৈরির চেষ্টা সফল হয়েছে অনেক দিন হলো; ২০০৩ সালে প্রথম সিনথেটিক ভাইরাস তৈরি করা হয়েছিল। পোলিও ভাইরাসসহ ১০ হাজার প্রজাতির ভাইরাস তৈরি সম্ভব হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে এর জিনোম পর্যবেক্ষণ করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাহায্যে। এক ব্যাকটেরিয়া থেকে অন্য ব্যাকটেরিয়ায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াও সফল হয়েছে। ক্রেগ ভেন্টর মনে করেন, আগামী দু’বছরের মধ্যেই আদিকোষ বা প্রোক্যারিয়ট আর ১০ বছরের মধ্যে প্রকৃত কোষ বা ইউক্যারিয়ট বানানো সম্ভব হবে।
নতুন গ্রহের সন্ধান :
এ বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরা বেশ কিছু নতুন গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। গ্রহগুলো সৌরজগতের বাইরে। তেমনি একটি গ্রহ হচ্ছে এইচআইপি ১৩০৪৪বি। এটি একটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তনশীল। বিজ্ঞানীরা জানান, এ রকম নক্ষত্র আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে আরও রয়েছে। সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হলো ৫৮১ জি গ্গি্নস নক্ষত্রের লাইভেবল বেল্টের সন্ধান। এ বেল্টের বৈশিষ্ট্য হলো এর ভেতরের আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডাও নয়, খুব বেশি গরম নয়। অনেকটা পৃথিবীর মতো।
পিরামিডের রহস্য উদ্ধারে রোবট :
সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার হচ্ছে রোবট। প্রায় সবকিছুতেই রোবটের সফল ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা সে চিকিৎসাক্ষেত্রে হোক কিংবা কোনো কিছু উদ্ঘাটন বা উদ্ধারের ব্যাপারে হোক না কেন। সম্প্রতি আবার এ রোবট আলোচিত হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার বছরের পুরনো পিরামিডের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য। ‘পিরামিড অব খুপু’ নামে পরিচিত বিস্ময়কর এ পিরামিডটি তৈরি হয়েছিল যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ২ হাজার ৫৬০ বছর আগে। সাড়ে ৪ হাজার বছর ধরে কেউই জানে না বা জানতে সক্ষম হয়নি পিরামিডের বন্ধ দরজার পেছনের গুপ্ত কক্ষটিতে কী আছে! মিসরের খুপুর পিরামিডের রানীর কক্ষ থেকে চলে যাওয়া দুটি সুড়ঙ্গপথের ওই দরজা দুটির পেছনের রহস্য উদ্ধারের লক্ষ্যে পুরাতত্ত্ব বিষয়ে মিসরের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব অ্যান্টিকুইটিস’ এবং যুক্তরাজ্যের লিডস ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী যৌথভাবে একটি রোবট তৈরি করেছে।
হার্শেল টেলিস্কোপে মেঘপুঞ্জের ছবি :
সম্প্রতি মহাশূন্যে প্রেরিত হয়েছে নতুন আধুনিক মহাকাশ মানমন্দির হার্শেল। এ হার্শেল টেলিস্কোপ অ্যাকুলিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ১০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এ কৃষ্ণকায় মেঘপুঞ্জের ছবিটি পাঠিয়েছে। ছবিটি তোলা হয়েছে হার্শেল টেলিস্কোপের অবলোহিত আলো শনাক্তকরণ অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে গভীর মহাশূন্যে প্রায় ১০০টির মতো ভ্রূণ নক্ষত্রের। যে নক্ষত্রগুলোয় ইতিমধ্যে থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়েছে। ছবিতে আরও প্রায় ৬০০টি নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো সবে নক্ষত্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করেছে।
নতুন মৌলের সন্ধান:
রসায়নবিদরা এ বছর নতুন একটি মৌলের সন্ধান পেয়েছেন। যাকে তারা ১১৭ নম্বর মৌল বলে দাবি করেছেন। এটি একটি ভারী পদার্থ যেটি ক্যালসিয়াম মৌলের আইসোটোপ এবং ভারী পাইয়ের মিশ্রণে বিজ্ঞানীরা প্রস্তুত করেছেন। রাশিয়া তাদের কণাত্বরক যন্ত্রে এ নতুন পদার্থটি তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন।
চাঁদমামার গায়ে জল :
১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং চাঁদে প্রথম পদক্ষেপ ফেলে সূচনা করেছিলেন চন্দ্রজয়ের প্রথম অধ্যায়ের। ২২ অক্টোবর ২০০৮ ভারত রচনা করেছিল দ্বিতীয় অধ্যায়। ভারতের মহাকাশযান চন্দ্রায়ন-১-এর অভিযান থেকে জানা যায় চাঁদের উত্তর মেরুতে বরফপানির অস্তিত্ব। এটিকেই চন্দ্রজয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আগ্নেয়গিরির মুখগুলোয় যে বরফ পানি পাওয়া গেছে ওই মুখগুলোর ব্যাস দুই থেকে পনেরো কিলোমিটার। নাসার বিজ্ঞানীরা জানান, চন্দ্রায়ন-১ -এর তথ্যমতে সেখানে বরফপানির পুরুত্ব হচ্ছে কয়েক কিলোমিটার। হটসনে অবস্থিত লুনার এবং প্লানেটরি ইনস্টিটিউটের ড. পল স্পুডিসের ধারণা, সেখানকার প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন বরফপানি রয়েছে।
বিড়াল ও কুকুরের তরল খাদ্য গ্রহণে অভিনবত্ব :
ম্যাসাচুসেটস প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভার্জিনিয়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বিড়াল ও কুকুরের দুধ ও অন্যান্য তরল খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে একটি চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। আমরা যেমন ভেজা রুটি খাওয়ার সময় ঠোঁট সংযত রাখি, তেমনি এ প্রাণী দুটি তরল খাদ্য গ্রহণের সময় তাদের জিহ্বাকে একটি নলার মতো আঁকরে পরিণত করে যেন তারা পাইপ লাগিয়ে তরল নিচ্ছে।
অবশ্যই মন্তব্য করবেন
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১১ রাত ২:০৫