আপনি কি একটি স্মার্টফোনের গর্বিত মালিক হতে চান? চান এপল আইফোন অথবা স্যামসাং গ্যালাক্সি এস সিরিজের ফোনের সমকক্ষ ফোনের মালিক হতে? তাও আবার স্বল্প খরচে, মাত্র এক হাজার টাকায়? তাহলে সাম্প্রতিক বিশ্বকে তাক লাগান এক অনন্য আচানক মোবাইল সেটের রিভিউ নিয়ে এই পোস্ট একমাত্র আপনার জন্যেই।

ভাবছেন কিভাবে সম্ভব, যেখানে বাংলাদেশি ওয়াল্টন কোম্পানিই এত কম টাকায় সেট দিতে পারে না, সেখানে তা কিভাবে সম্ভব?
আরে দুনিয়ার তাবত বুদ্ধি কি এপল আর স্যামসাং কোম্পানিরই? তাদেরকে টেক্কা দেওয়ার মত লোক কি এ দুনিয়ায় নাই?আরে আমি থাকতে আপনার কোন ভরসা নাই।

তবে তা দেখে আসার আগে কয়েকটি গল্প শুনে নিয়ে একটু চাঙ্গা হোনঃ
গল্প একঃ এম্পি থ্রি কিনব, এক বন্ধুর কাছে ক্রিয়েটিভ এর এম্পি থ্রিতে গান শুনে ফিদা হয়ে গেছিলাম, দাম ছয় হাজার টাকা, ৫১২ মেগাবাইট। কেনার জন্য যখন বাসায় আকাশ পাতাল ফাটায় ফেলতেছি তখন এক কাজিন আসিয়া অট্টহাসি হাসিয়া সবার সামনে পাইন মাইরা শুনায় দিল সনির ১ জিবির এম্পি ফোর এর দাম ৩ হাজার টাকা যাহার গর্বিত মালিক তিনি নিজেই।


গল্প দুইঃ হেডফোন কিনব, মাইক্রোল্যব হেডফোন তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আইডিবিতে খোজ নিয়া জানলাম দাম তিনশ প্লাস। কিন্তু এই দামের কথা শুনে আমার বন্ধু হেসেই খুন। আরে আমাদের টাউন হলে মাত্র একশ বিশ টাকায় এই হেডফোন পাওয়া যায়। লোভে পইরা বন্ধুরে দিলাম ১২০ টাকা লগে খাওয়াইলাম চা সিগারেট। পরদিন বন্ধু যে হেডফোন আমারে দিল তা হুবুহু মাইক্রোল্যাবের মতন দেখতে, সেই মোড়কের মতই এক মোড়কে


ঘটনা তিনঃ আমার প্রাক্তন কাজের ছেলে মোবাইল কিনছে, আইসা পার্ট লইতেছে, মামা আপনের মতন একখান মোবাইল কিন্না ফেলাইলাম, ভিডু কেমরা গান সব আছে, বুলু টুতও আছে, আপনের কেমরা কত? আমারটা নাকি আট পিক্সেল।

যাউজ্ঞা গল্প শোনা শেষ, এবার আসি আচানক এই মোবাইলে কি কি আছে তা শুনেন আর টাস্কি খান
১. অপারেটিং সিস্টেমঃ আইওএস ও এন্ড্রয়েড ডুয়েল সিস্টেম
২. ডিসপ্লেঃ ত্রীডি এল ই ডি, হাই ডেফিনেশান
৩. প্রসেসরঃ ইন্টেল কোর আই সেভেন পরবর্তি জেনারেশন
৪. টাচ স্ক্রীনঃ কাপাসিয়া টাচ স্ক্রিন উইথ গন্ডার গ্লাস
৫. ইন্টার্নাল মেমরিঃ লাগে না,
৬. এক্সটার্নাল মেমরিঃ হিসাব নাই।
৭. ক্যামেরাঃ ১০০ মেগাপিক্সেল সামনে পিছনে ডাইনে বায়ে
৮. এম পি থ্রি, ফোর ফাই্ভ সিক্স, জিপিএস উইথ স্যাটেলাইট, নড়ানড়ি রোটেটিং, ওয়াইম্যাক্স বিলাই ইন্টারনেট, হাইফাই ইত্যাদি।
কি টাস্কিত? হুম ঠিকই ধরছেন পৃথিবীর সবচে লেটেস্ট ফোনের সব গুনাবলিই এই আচানক ফোনে আছে।তাইলে আর দেরি কেন, কিন্না ফেলান দৌড়ের ওপর। আর বাশ দিয়া ফকির বানায় দেন বিশ্বের বাঘা বাঘা মোবাইল কোম্পানিরে। কি ভাবছেন? সব বুদ্ধি আপনারই আর সব মানুষের মাথায় ঘিলু নাই, বড় বড় কোম্পানি কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রজেক্ট তৈরি করে মোবাইল তৈরি করে আর চায়নার অক্ষাত মা বাপহিন এক ফোন সেই সব ফোনকে হারিয়ে দিবে, তাহলে মানুষ কেন সেইসব ফোন ব্যাবহার করবে?
ইদানিং একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে অনেকেই চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন মোবাইলের ব্যাপারে আগ্রহ সৃস্টি করে নিজের আখের গোছানোর চেস্টা করছেন। সবচে বড় সমস্যা এসব ক্ষেত্রে সরাসরি প্রতারনার আশ্র্য় নেয়া হচ্ছে ব্লগ বা ফেসবুকে এই বলে যে সেই সব সেটের ব্যবহারকারি তারা নিজেরাই।জাস্ট ইউজার রিভিউ হিসেবে তারা সেটের গুনগান গাচ্ছে। ব্যাপারটা কি আসলেই তাই?এগুলোর পেছনে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত কিনা তা কে বলবে? হ্যা এটা সত্য তাদের মোবাইলে আপনি সব পাবেন, কিন্তু আপনি কি নিচের পয়েন্টগুলো একবারো চিন্তা করেছেনঃ
১। তারা হয়তো মোবাইলে কোয়াড কোর এর প্রসেসর দেয় কিন্তু আসলেই সেটার পারফর্মেন্স কি কোয়াড কোরের মতন?
২।তাদের ইন্টার্নাল মেমরি যতই বলুক সেখানে এপস বা গেম কি লোড করা যায়? সব গেম বা এপস কি সাপোর্ট করে?
৩। তাদের প্রদেয় টাচ স্ক্রীন কতটুকু রেসপন্সিভ? তার কোয়ালিটিটাও কেমন? শত গরিলা গ্লাসের কথাই বলুক তা সত্যিই কি গরিলা গ্লাসের মতন?তা কি সত্যি স্মুথ এন্ড ইউজার ফ্রেন্ডলি?
৪। স্ক্রিন রেজুলেশান বলুন বা সাউন্ড কোয়ালিটি অথবা জিপিএস, ব্লুটুথের কথাই বলুন সেগুলো কতটা মান সম্পন্ন?
৫। সবোপরি সেটটা কতটা মান সম্পন্ন ও টেকসই?
এসমস্ত হাই কনফিগার্ড নকল সেট হাতে নিয়ে আপনি যে বিপত্তিতে পরতে পারেনঃ
১। সেট অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়া,
২। সেট স্লো হয়ে ঘন ঘন হ্যাং হয়ে যাওয়া
৩। সব এপস ও গেমস সাপোর্ট না করা,
৪। ইন্টারনাল মেমরি প্রবলেম
৫। স্ক্রিন রেজুলেশন নামেই ভাল, কাজে নয়।
৬। টাচ স্ক্রিন আন রেসপন্সিভ, ঠুনকো
৭। ক্যামেরা কোয়ালিটি খুবই লো হোক সে ১০০ মেগাপিক্সেল
৮। ব্লুটুথ ওয়াই ফাই সিগনাল রিসিভ খুবই দুর্বল।
সব মিলিয়ে ফলাফল ভয়াবহ ঠুনকো এক সেট যা কেনা মানে পানিতে টাকা ফেলা।
একটা কথা মনে রাখতে হবে বিশ্বের ভাল ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো বা এপল স্যামসাং শত কোটি টাকার প্রজেক্ট করে যে ফোন বিক্রি করছে তার সমকক্ষ যদি অন্য সেট হয় তাহলে সেই সেটের দামও ওই এপল স্যামসাং এর দামের আশপাশে, কিন্তু ভয়াবহ কম দামের কখনো হতে পারে না, এবং অখ্যাত তো নয়ই, কারন ভাল কোয়ালিটি ও স্পেসিফিশানের মোবাইল হলে এতদিনে সে সুপরিচিত একটি ফোন হতে যেত। আনেকেই আমাকে সাজেস্ট করেছে ৫০-৬০ হাজার টাকা দিয়ে স্যামসাং এপল সেট না কিনে ২০ হাজার টাকায় সনি/ এইচটিসি কেনার জন্য। কারন ঐসব হাই বাজেটের ফোন আর মিড বাজেটের ফোনের পারফরমেন্স প্রায় সমান। হতে পারে তাদের কথা আংশিক সঠিক,কারন আমার মত সাধারন ইউজারের জন্য সামর্থ অনুযায়ি দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর জন্য এই সব মিড বাজেরটের সেটই পার্ফেক্ট এবং আমার পূর্ন চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু তাই বলে এই মিড বাজেটের সেটের পারফরমেন্স কখনোই হাই বাজেটের সেটের সমকক্ষ হতে পারে না, আর যদি খুব ভাল হয় তাহলে সেই সেটটি ঐ মিড বাজেটের মোবাইলগুলোর মধ্যে সেরা সেট হবে কিন্তু কখনোই এপল স্যামসাং, সনির হাই বাজেট ফোনের সমকক্ষ হতে পারবে না।
তো যেখানে নামি ব্র্যান্ডের মিড বাজেটের একটি ফোনের সাথে ব্র্যান্ডেড হাই রেঞ্জের সেটের তুলনা নাই, সেখানে অখ্যাত চাইনিজ ব্র্যান্ডের সেটের তুলনা করাটা নিতান্তই বোকামি। একটা জিনিস লক্ষনিয় আমাদের দেশি ব্রান্ড ওয়াল্টনের পক্ষেও হাই স্পেসিফিকশান সেটের মূল্য ১৫ হাজার এর কম রাখা সম্ভব হয় নাই।
তাই সবাইকে বলব বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে লোভে পরবেন না, কারন অনলাইনে আপনাকে কে কখন তার নিজের ব্যবসার আখের গোছাতে কাজের লাগাবে বা ব্যবসা চাংগা করতে গিয়ে আপনার সরলতার সুযোগ নিয়ে আপনার দীর্ঘদিনের আশাটাই ভংগ করে দেওয়ার পায়তারা করবে তার খোজ হয়তো আপনি পাবেন না। মনে রাখবেন একটি ২ হাজার টাকার সিম্ফনি হয়তো একটি তিন হাজার টাকার নোকিয়ার চাইতে ভাল হতে পারে কিন্তু কখনৈ তা ৬ হাজার টাকার নোকিয়ার সমান নয়, তেমনি ৬ হাজার টাকার নোকিয়া কখনোই ১৫ হাজার টাকার স্যামসাং বা সনির সমান নয়, তাহলে কেওই ব্যবসা করতে পারতো না।
আর তাই কোন কিছু কেনার আগে তার ব্যাপারে ভাল ভাবে জেনে নিন, দয়া করে লোভে পরবেন না। কারন যেখানেই ফাকি সেখানেই লোভনীয় প্রস্তাবের বসবাস।
তবে কেনাকাটার ব্যাপারে আমি কয়েকটি টিপস মেনে চলি।আশা করি এই টিপ্সগুলো মেনে চললে কেনাকাটায় ঠকার চান্স খুবই কম।
১। কোন কিছু কেনার আগে পন্যটির ব্যাপারে নেটে সার্চ দিয়ে এর সম্বন্ধে একটা আইডিয়া নিন।এর দাম, মডেল পারলে এর অথরাইজড ডিলার কে তার খোজ নিন। সাথে এর ইউজার রিভিউ পরতে ভুলবেন না।
২। পন্য কেনার আগে ভাল করে মার্কেট যাচাই করুন, দাম শুনলেই কিনতে হবে এমন শর্ত কোথাও নেই, অতএব সেই মার্কেটে কিকি পন্য আছে, তার প্রাইস রেঞ্জ কেমন তা ভালভাবে জেনে নিন। পছন্দের পন্যটি ভালভাবে দেখার ও বোঝার চেস্টা করুন, এর কার্যকারিতা ভাল করে শুনুন ও পারলে চেক করে দেখুন। আমাদের দেশের মোবাইল মার্কেটে এখনো এই ট্রেন্ড চালু আছে যে শুধু মোবাইল আউটলুকিং দেখেই মানুষ মোবাইল কেনে, এই ট্রেন্ডটি পরিহার করুন।
৩। সব সময় চেস্টা করুন ভাল পরিচিত কিংবা বহুল বিক্রিত দোকানে যেতে।আমরা অনেকেই হয়তো একটু বেশ দাম নেয় এমন ভাল দোকার গুলোয় যেতে চাই না, কিন্তু মনে রাখতে হবে ৫০০ বা এক হাজার টাকা বাচাতে গিয়ে বাটপার দোকানির হাতে পরে আপনার পাচ বা ততোধিক হাজার টাকার পুরোটাই পানিতে চলে গেলে লস আপনারই।
৪।এক দোকানের পন্য থেকে অন্য দোকানের পন্যের দামের পার্থক্য খুব বেশি হলে কিংবা কমে পেলেই লাফিয়ে কিনতে যাবেন না। ভাল করে যাচাই করুন পন্যটির আসল অবস্থা। কারন ভাল দোকান তার রেপুটশনের কথা চিন্তা করে কখনোই আপনাকে নকল পন্য ধড়িয়ে দেবে না।কিংবা ত্রুটী যুক্ত মাল বেচবে না।অতএব ওরা কখনোই মার্কেট রেটের কমে দিতে পারবে না।অতএব কোন দোকানির কম মূল্যের মুলা গেলার আগে সাবধান। তাই চেস্টা করুন বহুল বিক্রিত পরিচিত ভাল দোকানগুলোয় যেতে।
৫। সবার আগে চেস্টা করুন লেটেস্ট মডেলের পন্য কিনতে। দেখা যাবে একই দামের কাছাকাছি পুরনো একটি মডেলের পন্য কিনলেন যার থেকে সামান্য টাকা হেরফের করে বা সেই টাকায়ই পেতে পারতেন আপগ্রডেড ভার্সনের পন্য।
৬। কেনার আগেই অবশ্যই দেখে নিন পন্যটি ইনটেক্ট কিনা, কখনোই ডিসপ্লের পন্য বা লুজ পন্য কিনবেন না।এসব ক্ষেত্রে শতকরা ১০০ ভাগ পন্যটি প্রবলেমেটিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।চেস্টা করুন তার বাক্স বা প্যাকেটির কোয়ালিটি দেখতে। কারন একটি প্যাকেট বা বক্সের কোয়ালিটি দেখলেই বোঝা যায় পন্যটি আসল না নকল। নকল পন্যে কখনোই তার প্যাকে্টটি উন্নত মানের করবে না।
৭। কখনোই দোকানির চাপ, প্রশংসা কিংবা চাটুকারিতায় পন্য কিনবেন না। একটা জিনিস মনে রাখবে আপনি টাকা দিয়া পন্য কিনতে এসেছেন, কারো দয়ায় নয়। এবং যার কাছ থেকে নিতে এসছেন এটা তাদের ব্যবসা, সাথে লাভের প্রশ্ন জড়িত। আর তাই সে চাইবে আপনাকে তার স্বার্থ অনুযাইয়ি পন্য গছিয়ে দিতে, অথচ হয়ত দেখা যাবে সেই পন্যটি কেনা আপনার জীবনের একটি স্বপ্ন ছিল। সামান্য একটু মানষিক চাপ না সামলাতে পারার জন্য আপনার স্বপ্নটাই হয়তো ভংগ করে দিতে পারে ঐসব দোকানি।
তবে সব পন্য কেনার আগে সবচেয়ে বেশি দরকার একটি সুন্দর মানষিক প্রস্ততি, মার্কেট বা দোকান চয়েজ সর্বোপরি একজন ভাল বুঝদার সঙ্গি, যে আপনাকে প্রপার পরামর্শ দিতে পারবে (সারাক্ষন আপনাকে ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার তালে থাকবে না

আশা করি এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখলে আমাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্নটা খুব ভাল ভাবেই পূরন হয়ে যাবে।
অনেকদিন পর ব্লগে লিখলাম, এই লেখাটা কোন বিশেষজ্ঞ মতামত নয়, জাস্ট নিজের কথাগুলোই গুছিয়ে লেখা। সবাইকে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৩ রাত ৯:২০