নতুন বছর শুরু হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতি চাঙা হওয়ার কিছু আভাস মিলতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব জটিলতার (ফিসকল ক্লিফ) আপাতত অবসান হওয়ায় তাৎক্ষণিক ইতিবাচক প্রভাব যেমন পড়েছে, তেমনি বিশ্ব বাণিজ্যপ্রবাহে গতি কিছুটা জোরালো হয়েছে গত বছর শেষ হওয়ার আগেই।
বিশ্ব শেয়ারবাজার গত শুক্রবার সাপ্তাহিক লেনদেন শেষে আট মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমএসসিআই বিশ্ব সূচক দশমিক ৭০ শতাংশ বেড়ে ৩৪৯ দশমিক ৩০ পয়েন্টে উন্নীত হয়। এর আগে সর্বশেষ গত মে মাসে এই সূচক এর চেয়ে বেশি ছিল। বিশ্ব শেয়ারবাজারের প্রতিনিধিত্বমূলক নির্দেশিকা হিসেবে খ্যাত এমএসসিআই বৈশ্বিক সূচক বিশ্বের ২৪টি উন্নত ও ২১টি উদীয়মান অর্থনীতির প্রধান শেয়ারবাজারগুলোকে সমন্বিত করে গঠিত।
একাধিক কারণে বিশ্ব শেয়ারবাজারে এই উত্থান ঘটেছে। আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত স্পেন সরকার বিশ্ব বাজার থেকে ঋণ নিতে গিয়ে নিলামে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দর উঠেছে। এতে করে স্প্যানিশ বন্ডের সুদের হার ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর মানে হলো, স্প্যানিশ বন্ডকে আগের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। অন্যভাবে বললে, ঘাটতি অর্থায়নে স্পেন সরকারের সক্ষমতার প্রতি আস্থা কিছুটা বেড়েছে।
আবার ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) নীতিনির্ধারণী সুদের হার অপরিবর্তিত রেখেছে। ধারণা করা হচ্ছিল, এই সুদের হার সামান্য কমিয়ে অর্থপ্রবাহকে আরেকটু শিথিল করা হবে। সেটি করা হয়নি। আর তাই বেড়েছে ইউরোর দর।
অন্যদিকে গত শুক্রবারই জানা গেছে, নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতি এক লাফে প্রায় ১৬ শতাংশ বেড়ে চার হাজার ৮৭০ কোাটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। এটি এপ্রিল মাসের পর সর্বোচ্চ। এই সময়কালে বহির্বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৩০ কোটি ডলার। আমদানির ক্ষেত্রে ভোগ্যপণ্যের অংশই বেড়েছে ৪৬০ কোটি ডলার। অন্যদিকে এই সময়ে দেশটির রপ্তানি আয় ছিল ১৮ হাজার ২৬০ কোটি ডলার।
আবার জাপান সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে, অর্থনীতিকে চাঙা করতে ১১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যয় করবে। অবকাঠামো বিনির্মাণ ও পুনর্গঠনসহ ব্যবসা সম্প্রসারণে এই অর্থ ব্যয় করা হবে। এর ফলে ছয় লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে মনে করছে জাপান সরকার। আর অর্থনীতি দুই শতাংশ বাড়বে।
আরেকটি সুখবর হলো চীনের মূল্যস্ফীতি ২০১১ সালের ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে ২০১২ সালে ২ দশমিক ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে।
তবে এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এখনই বলা যাবে না বিশ্ব অর্থনীতি দ্রুত চাঙা হয়ে উঠবে।
আশাবাদীদের যুক্তি হলো, বাণিজ্যচক্র। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অর্থনীতিতে মন্দা দেখা যায় ও তা প্রলম্বিত হয়। তারপর আবার তা ঘুরে দাঁড়ায় ও চাঙা হয়। এভাবে চক্রাকারে অর্থনীতি অগ্রসর হতে থাকে। এই ধারণার ওপরই বাণিজ্যচক্র প্রতিষ্ঠিত। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের জের ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দা নেমে আসে। পরের বছর বড় ধরনের পতন ঘটে। সেখান থেকে ২০১০ সালে কিছুটা উত্থান ঘটেছিল। কিন্তু ইউরোপের আর্থিক সংকট প্রবল হয়ে পড়ায় এই ধারা টেকসই হতে পারেনি। ২০১১ ও ২০১২ সালে নিম্নমুখী প্রবণতা বজায় থাকে।
চাহিদা কমে যাওয়া, লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়া ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার মধ্য দিয়েই পার করতে হয়েছে বছরের পর বছর। ইউরোপের সংকটটা মূলত আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম থেকে উদ্ভূত। আর্থিক বাজারে ফাটকাবাজি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ায় তা আর অগ্রসর হতে পারেনি। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই শুধু বিপদে পড়েনি, বিভিন্ন রাষ্ট্রকেও বিপদে ফেলেছে। আর তাই স্পেন, গ্রিস, পর্তুগালসহ অভিন্ন মুদ্রা ইউরো ব্যবহারকারী বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নড়বড়ে হয়ে ওঠে। খোদ ইউরোর ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
আমেরিকা-ইউরোপের প্রলম্বিত মন্দার বিপরীতে অগ্রসর উদীয়মান অর্থনীতিগুলো বিশেষত ব্রিক (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) শক্তিশালী হয়ে উঠবে—এমন ভবিষ্যদ্বাণীও বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। চীনের ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে কমে গত বছর হয়েছে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। ভারতের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আর ২০১০ সালে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ব্রাজিল গত বছর ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখেনি।
তবে নতুন বছরের প্রথম দিকে সবাই কম-বেশি সুখবর খোঁজে। আর তাই বোধ হয় বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বিশ্ব অর্থনীতি চাঙা হওয়ার আভাস দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।