somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছিন্নস্মৃতি: শৈশব পর্যায়

১১ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মেজোমামা ছিলেন জীববিজ্ঞানী। গবেষনার কাজে তাঁর সাপ দরকার হত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাপুড়েরা সাপ বিক্রি করতে মেজোমামার খোঁজে আসত । আমার সাপুড়েদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলতে দেরি হত না। আমাকে তারা বলত লাইমাই পাহাড়ের রহস্যময় গুহার কথা, সাপের মাথার মনির কথা। অবশ্য মেজোমামাকে সাপের মনির কথা জিগ্যেস করলেই মেজোমামা উড়িতে দিয়ে বলতেন, ‘ধ্যাত! সাপের মনিটনি বলে কিসসু নেই!’ জীববিজ্ঞানীর কথায় আমার মন খারাপ হত। আমার ইচ্ছে করত সাপুড়েদের সঙ্গে লাইমাই পাহাড়ে গুহায় চলে যাই, সাপের মাথার মনি দেখি...
মেজমামা আর আমরা থাকতাম একই কমপাউন্ডে । মেজমামার বাড়িতে অনেক বই ছিল। সত্যজিৎ রায়ের বই ভরতি আলমারির দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকতাম। একবার। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। আমি সত্যজিৎ রায়ের একটা বই নিয়েছি। মেজোমামী নরম সুরে বললেন, শার্টের ভিতরে গুঁজে নিয়ে যা। নইলে ভিজবে। মেজোমামা পরম যত্নে বইটা আমার শার্টে গুঁজে দিলেন। মেজোমামী লেখালেখি করেন; দেশের মানুষ তাঁকে চেনেন।( তিনিই আমার ডাকনামটা রেখেছিলেন।) তো, লেখকরা সচরাচর বই-টই ধার দিতে চান না। মেজোমামী অবশ্য কী কারণে আমাকে বই দিতেন ...
বিকেলে ইশকুল থেকে ফিরে মেজমামার সঙ্গে লনে ফুটবল খেলতাম। তখন কী আর বুঝতাম -যিনি এই মুহূর্তে বলে কিক করছেন তিনি একজন বড় মাপের সায়েনটিষ্ট। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মিঠে পানিতে চিংড়ি চাষ তাঁরই গবেষনার ফল ...
ছেলেবেলায় আমার চারপাশে ছিল বইয়ের অফুরন্ত সম্ভার। রাস্তার ওপারে ‘সবুজ লাইব্রেরি’ নামে বইয়ের একটা দোকান ছিল। আজও আছে। বিকেলের দিকে যেতাম দোকানটায়। এক টাকা কি দুই টাকায় ‘কুয়াশা’ সিরিজ পাওয়া যেত। অবশ্য কেনার মতো পয়সা ছিল না। আমার মুখ দেখেই হয়তো দোকানের লোকটার দয়া হত। বইয়ের পাতা ভাঁজ না করার শর্তে আমাকে ‘কুয়াশা’ সিরিজের বই পড়তে দিতেন। ফাঁকা ফুটপাতের ওপরই পড়তে বসে যেতাম। কী নির্জন রাস্তা; জনশূন্য শান্তিনগর মোড়। দশ/পনেরো মিনিট পর পর একটা রিকশা কি একটা মাজদা গাড়ি কি রামপুরা- গুলিস্তান রুটে সবুজ রঙের ধ্যাড়ধ্যাড়া মুড়ির টিন যেত। সেই ১৯৭৭/৭৮ সালের কথা ... পড়তে পড়তে সন্ধ্যা নেমে আসত। আমিনবাগ জামে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসত। দোকানে বই ফেরৎ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে বাড়ি ফিরতাম ...
বই আমার আম্মাও পড়তেন। সংসারের হাজারও ঝক্কিঝামেলা সামলে। আশুতোষ, নীহাররঞ্জন, নিমাই ভাট্টাচার্য। বুঝে কিংবা না-বুঝে আমিও বইগুলো পড়ে ফেলতাম। ক্লাস সিক্সে বিমল মিত্রের দুই পর্বের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছিলাম। বই পড়ার অভ্যেস আম্মার কাছ থেকেই পেয়েছি মনে হয়। আব্বাও বই পড়তেন। তবে বেশির ভাগই আইন আর ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক। আর কী যেন লিখতেন ডাইরিতে। ছোট ছোট অক্ষর। বোঝা মুশকিল। আব্বার স্মৃতি মানেই কালো কোট। দুপুরবেলা কোর্ট থেকে ফিরছেন। হাতে চিতল মাছ ঝুলছে। আব্বা মারা যাবার পর আমরা চিতল মাছ খাইনা। আজও ...
আম্মা ‘বড়দের বই’ খবরের কাগজে মুড়িয়ে তোশকের নীচে লুকিয়ে রেখে দিতেন। (ওসব বইয়ে আজকালকার টিনএজারদের নিষিদ্ধ কিছু খুঁজে পাওয়ার কথা না।) ‘বড়দের বই’ মানে সৈয়দ শামসুল হক এর ‘খেলারাম খেলে যা’ কিংবা সমরেশ বসু -র ‘বিবর’ বা ‘প্রজাপতি’। আম্মা স্কুলে চলে গেলে বইগুলো বার করে পড়তাম। তবে সে সব বই পড়ার অনুভূতি মনে নেই। তবে আশুতোষের দুই পর্বের ‘ সোনার হরিণ নেই’ পড়ে দীর্ঘদিন বিষন্ন ছিলাম মনে আছে ...
পাড়ার পপেল ভাইয়ের বইয়ের লাইব্রেরি ছিল। বেশির ভাগ বইই দস্যু বনহুর, দস্যু পাঞ্জা আর কুয়াশা সিরিজের। অবশ্য বই প্রতি চার আনা (নাকি আট) আনা করে নিতেন । আমি ছিলাম পপেল ভাইয়ের ফুটবল টিমের গোলকিপার। বাঁ কিংবা ডান দিকে শূন্যে উড়ে বল গ্রিপ করার ব্যাপারে পারদর্শী ছিলাম, জটলা থেকে বল মুহূর্তেই ছিটকে আসার কয়েক সেকেন্ড আগেই গেস করতে পারতাম কোন্ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ব, বল দিতাম আমাদের দলের প্লেয়ারকে, বলে উলটো-পালটা কিক করতাম না। কাজেই মাঝেমাঝে পয়সা ছাড়াই বই দিতেন পপেল ভাই। দস্যু বনহুর, দস্যু পাঞ্জা, কুয়াশার বইয়ের পাতায় ডুবে কোন্ কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতাম ...
ছেলেবেলার ফুটবল নিয়ে একটি ঘটনা আজও মনে আছে। বিকেলে আমি আর গৌতম ‘জাম্বুরা’ নামে খ্যাত ছোট একটা রাবারের বল দিয়ে খেলছিলাম। মাঠের একপাশে বড় পাঁচ নম্বর বল দিয়ে খেলছিল শহীদবাগ স্পোর্টি ক্লাবের ছেলেরা । বল গড়িয়ে ওপাশে গেছে। আমি বল আনতে গেলাম। শহীদবাগ স্পোর্টি ক্লাবের একজন আমাকে উপদেশ দিল ... প্লেয়ার হতে চাইলে পাঁচ নম্বর বড় বলে খেল। জাম্বুরা দিয়ে খেলো না। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, ছেলেটি নাইনে কি টেন-এ। কাজেই বড়দের কথা মেনে নিলাম। তিন দিন পর শহীদবাগ স্পোর্টি ক্লাবের সঙ্গে আমাদের ম্যাচ। পপেল ভাই ক্যাপ্টেইন। আমি গোলরক্ষক । তুমুল উত্তেজনা খেলায়। প্রথম হাফে এক গোল খেয়ে বসলাম। পপেল ভাই গোল শোধ করলেন। পরে আশীষ ভাইও একটা গোল করলেন। এরই মধ্যে একটা পেনালটি ঠেকিয়ে দিলাম। ২ / ১ গোলে জিতে বুক ফুলিয়ে পাড়ায় ফিরলাম।
ফুটবলে মজে গিয়েছিলাম। গোলকিপারের প্যাড লাগানো প্যান্ট কিনে ফেলেছি নবাবপুর থেকে।গোলকিপার হিসেবে আশেপাশে ‘খেপ’ও মারতাম ওই বয়েসেই। একবার রামপুরায় এক স্কুলে হায়ারে খেলতে গিয়ে ৭ গোল খেয়েছি। গোলপোস্টের পিছনে লাঠিসোটা নিয়ে স্থানীয় উঠতি মাস্তান ছিল। গোল ধরলে আর রক্ষা ছিল না। টাকা-পয়সা তো দূরের কথা... ফেরার বাস ভাড়াও দেয়নি ...
স্কুলের ক্লাসটিমেও গোলকিপারই ছিলাম। তবে ফলাফল ভালো ছিল না। একবার তো পাঁচ গোলও হজম করতে হয়েছে । ছোট মাঠ। কখন যে চোখের পলকে জালে বল জড়িয়ে যেত। তবে যে শ্যামলা মেয়েটিকে আমার ভালো লাগত সে পরে পাঁচ গোল খেয়েছি বলে আমায় দেখে ফিক করে হেসেছিল ...এই সুখেই কয়েকটা দিন কেটে গিয়েছিল। মেয়েটি আমাদের পাড়ায় থাকত। একই ক্লাসে পড়লেও কথাবার্তা হয়নি কখনও ... মেয়েটিকে দেখার তৃষ্ণা আসলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রেমের উপন্যাস পড়ার ফল বলেই মনে হয়। গৌতম, শাকিল, পার্থ- পাড়ার এই বন্ধুদের নিয়ে আমি যে দেয়ালের ওপর বসে আড্ডা দিতাম, সেখান থেকে শ্যামলা মেয়েটির ঘরের জানালা চোখে পড়ত ... কয়েক মাস সাধ্যি সাধনার পর একবার চিরুনি দিয়ে ওকে চুল আঁচড়াতে দেখেছিলাম ... ব্যস, ওই টুকুই ...
খেলার টানেই স্কুল শুরুর আগেই স্কুলে হাজির হতাম। তবে স্যারদের জ্বালায় শান্তিমতো খেলতে পারতাম না। খালি চোখ রাঙানি। টিসি দেওয়ার হুমকি। তবে স্কুলে অন্য ব্যাপারও ছিল। প্রিন্সিপাল ছিলেন সাহা স্যার। মাঝারি উচ্চতার ফরসা অভিজাত চেহারা। ক্লাসে এসে আমাদের কাঁচা মনে কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করতেন । মানে সাহা স্যার ছিলেন কমিউনিষ্ট।কৃষকরা চাষবাস না করলে কী খাবে বল তো? কাজেই ... আমাদের শৈশবে শুক্রবার স্কুল বন্ধ ছিল। সাহা স্যার নামাজের ছুটি দিতেন। আমরা এক দৌড়ে কাকরাইল কি টিপটপ মসজিদ। কাকরাইল মসজিদে বাইরেও যেমন আস্তর নেই, ভিতরেও নেই ...গা কেমন ছমছম করত ...
শুধু ফুটবল না, ক্রিকেটও খেলতাম। স্পিন বল করতাম। আমার স্পিনের ঘূর্নি বেশ কার্যকরীই ছিল। একবার একটি টিমকে আমাদের পাড়ার টিম হারিয়ে দিয়েছিল । ম্যাচটা হয়েছিল মতিঝিল কলোনির মাঠে। অমি স্লিপে ছিলাম। প্রথম ওভারে শাহজাহান পেস বল করছিল। মাথার ওপর দিয়ে লাল রঙের একটা রেখা চলে যাচ্ছিল। গোলকিপার বলেই হয়তো আমার রিফ্লেক্স অসম্ভব ভালো। বিদ্যুৎবেগে মাথার ওপরে হাত তুলে দেখি যে আমার হাতের মুঠোয় টকটকে লাল কাঠের বল (ছেলেবেলায় আমরা ক্রিকেট বলকে কাঠের বল বলতাম) পরের ম্যাচে ওই টিমের সঙ্গেই আবার হেরে গিয়েছিলাম। কোন্ পত্রিকায় যেন ছোট করে খবরটা ছেপেও ছিল। অথচ আমরা যে ওদের সঙ্গে যে জিতে ছিলাম সে কথা ছাপানি! এ নিয়ে পপেল ভাই কী যেন বলেছিলেন আশীষ ভাইকে। আজ আর মনে নেই ... পপেল ভাই পরবর্তী জীবনে বেশ নামকরা ডাক্তার হয়েছেন। আশীষ ভাই কোথায় আছেন জানি না ...
ছেলেবেলায় খুব টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম শহর ঢাকা । আজকের দিনের মতন এত বারণ-টারণ ছিল না, এত গন্ডি-টন্ডি ছিল না। ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি। শবে বরাতের সময় পটকা কিনতে বন্ধুদের নিয়ে শান্তিনগর থেকে হাঁটতে হাঁটতেই চকবাজারে চলে যেতাম । কুরবানী ঈদের সময় আব্বার সঙ্গে গাবতলী যেতাম গরু কিনতে। কখনও মালিবাগ মোড় থেকে মুড়ির টিনে উঠে একাই চলে যেতাম পল্টন। সারা দুপুর স্টেডিয়ামে চক্কর মারতাম । আমাকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস খুব টানত। এই যেমন ক্যাসিও ক্যালকুলেটর কিংবা স্টিরিও সেট। স্টেডিয়ামের পুব দিকে শ্রমিকরা অনেক বড় একটা গর্ত খুঁড়েছে, দালান উঠছে, অনেক লোক কাজ করছে, বসে বসে দেখতাম। বিকেলের দিকে পল্টনের গলির ভিতর দিয়ে হেঁটে শান্তিনগর ফিরতাম।
ফুটবল খেলাও দেখতে যেতাম স্টেডিয়ামে। আমি ছিলাম মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সার্পোটার । স্কুলের সহপাঠী বিদেশ মিত্রর প্ররোচণায় কমিউনিষ্ট ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলাম, ফলে মোহামেডান ছেড়ে কিছুদিন ব্রাদার্স ইউনিয়ন সাপোর্ট করেছিলাম। তবে আজ বুঝি যে ... আমি আজও মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবেরই সাপোর্টার ... বাবু মামা (আম্মার খালাতো ভাই ) ছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের কট্টর সমর্থক। আবাহনী জিতলে বাবুমামা দশ-পনেরো প্যাকে হক- এর কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়ে আসতেন। শান্তিনগর মোড়ের হক এর কাচ্চি বিরিয়ানির সুনাম আছে।
বই আর ফুটবল ছাড়াও আমার শৈশবজুড়ে ছিল গান। বাসায় পুরনো একটা রেডিও ছিল; মা-বাবার বিয়ের গিফট। গানের লোভে জিনিসটা আমি দখল করেছিলাম । রেডিও তে বাজত: রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপাতায় সাজাই তরণি/ একা একা করি খেলা’ কিংবা সাবিনা ইয়াসমিনের ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান/ যেন ভুলে যেও না।’ কিংবা আবদুল আলীমের: এই সুন্দর ফুল/ এই সুন্দর ফল/ মিঠা নদীর পানি/ খোদা তোমার মেহেরবাণী।’ রাত্রে আকাশবাণীতে শুনতাম রাগসংগীত । কী যে তার অদ্ভূত সুর। সেতার কি সরোদের; খেয়াল কি ঠুংরির ... যেন অন্য কোনও সময়ের মূর্চ্ছনা অন্ধকার ঘরে ছড়িয়েছে । বাতাসের ধাক্কায় টিনের চালের ওপর পেয়ারা ডালের ঘঁষা খাওয়ার শব্দ উঠত। ওস্তাদি গানের সুরে ও তানে এক বালকের অবচেতনে দোলা লাগত ... শৈশবের নিঝুম সেই রাত্রিতে কী এক রহস্যবিস্ময় নিয়ে কেমন যেন জেগে উঠত ...
আমি নানাবাড়িতেই বড় হয়েছি। (তবে আমরা নানাবাড়ি বলতাম না, বলতাম নানীর বাড়ি।) নানির বাড়িতে সারাদিন চলত দস্যিপনা। এই যেমন জলপাই গাছ বেয়ে নানীর বাড়ির ছাদে উঠে যেতাম, হরবরি গাছে উঠে টপকাতাম দেয়াল । নানির বাড়িটা ছিল নানা জাতের গাছগাছালিতে ভরা বিশাল কমপাউন্ড। আগে ছিল অধ্যাপক সুবোধ মুখার্জীর ‘বাগানবাড়ি’ । পরে আমার নানা বাগানবাড়িটা কিনে নাম বদলে রেখেছিলনে: ‘দারুস সালাম’। একটা বেলগাছ ছিল। সারা বছরই বেল ধরত। বেলের জন্য কত জায়গা থেকে যে লোকজন আসত । বেলগাছের পাশে ছিল করমচা গাছ, মেহেদির ঝোপ। কাছেই কলাঝোপ। দেওয়ালের ওপাশে প্রতিবেশির নাড়কেল গাছ, জামরুল গাছ, গোয়াল ঘর। ছোটখালার মুখে শুনেছি পঞ্চাশের দশকে আনারসের ক্ষেতও ছিল। কামরাঙা আর লিচুগাছে টিয়া পাখির আক্রমন নিজের চোখেই দেখেছি। দড়ি ধরে টানতাম। গাছের ডগায় কেরোসিনের টিনে ঢং ঢং শব্দ হত। পাজি টিয়ারা উড়ে পালাত ...
কামরাঙা গাছটা ছিল অনেক বড়। নীচে সিমেন্ট বাঁধানো চত্তর, পানির কল, সার্ভেন্ট বাথরুম। বড়মামীর পেট্রেশিয়া নামে এক খ্রিস্টান আয়া ছিল। পেট্রেশিয়া নাকি অনেক রাতে বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠেছে। কামরাঙা গাছের নীচে একটা উটকে পানি খেতে দেখে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল গিয়েছিল। এমন ভুতুরে ঘটনা নানাবাড়িতে আরও ঘটেছে। কাজল-বাদলরা ভাড়া থাকত টিনসেডের ঘরে। প্রায়ই নাকি জোছনারাতে নানীবাড়ির ছাদের ওপর বিশাল বড় রাজহাঁস নামত- এমন আরও ভুতুরে দৃশ্য দেখেছিল ওরা।
এক দুপুরে আমগাছে উঠেছি। ইয়া বড়-বড় আম। বাইরের দিকটা সবুজ। বেশ নরম। খোসা ছিলে দেখি ভিতরে পাকা। গাছ থেকে নেমে দৌড়। সোজা আম্মার কাছে গিয়ে আমটা দেখালাম। আম্মা হাসলেন। বড় প্রসন্ন-মধুর হাসি। ছেলের আবিস্কারকে যেন এপ্রিশিয়েট করলেন। আমের কী যেন নাম বললেন। আজ আর মনে নেই ...
ইডেনে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়ই আমার আম্মার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল । ভীষণ জেদি মহিলা ছিলেন। এম . এ পাস করবেনই । একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াতেন। তারপরও জগন্নাথ কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে নাইট শিফটে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হলেন । সন্ধ্যার আগে-আগে আম্মার সঙ্গে মালিবাগ মোড় থেকে ঠেলাঠেলি করে মুড়ির টিনে উঠতাম । গন্তব্য বাংলাবাজার। বড় একটা হল ঘরে বাতি জ্বলত, বেঞ্চর ওপর বসে থাকা ছাত্রছাত্রীরা কেমন শান্ত, জীবনহীন, ছায়া-ছায়া; বুড়োমতন একজন স্যার কীসব বলে যেতেন। পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়েছি । অথচ শৈশবেই ইতিহাসের অধ্যাপকের ক্লাস আমার করা হয়ে গেছে। আম্মা পড়তেন রান্না করার সময় । আব্বা আইনজীবি। মামলা-মোকদ্দমার জন্য গ্রামের বাড়ির থেকে লোকজন আসতেই থাকত। এ ভাত খাবে তো ও রুটি খাবে; এর অজুর জন্য গরম পানি চাই তো ওর জন্য তরকারি গরম কর। আম্মা পড়তেন এসবই সামলে ...
আম্মার ক্লাসমেটদের সঙ্গে একবার সোনার গাঁ গিয়েছিলাম পিকনিকে ... সেই বুড়োমতন স্যার একটু পর পরই সবাইকে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘক্ষণ এটা-ওটা বলতেন। পিকনিকে এসে পড়াশোনা হচ্ছে দেখে আমি ভয়ানক বিরক্ত হচ্ছিলাম ... তবে প্রথম দর্শনেই ঐতিহাসিক স্থানটি ভালো লেগে গিয়েছিল ...
ছোটমামীর সঙ্গে খয়েরি রঙের একটা ছোট্ট অস্টিন গাড়ি করে নিউমার্কেট যাওয়ার স্মৃতি বড়ই সুখের। সেই সত্তর দশকের মাঝামাঝি ঢাকার রাস্তা যে কী রকম জ্যামহীন ছিল । ছোটমামী সাবধানে ঢাকার বাহনশূন্য রাস্তায় ছোট গাড়িটা চালাতেন। কেনাকাটা সেরে একটা আইক্রিমের দোকানে নিয়ে যেতেন। একটা গোবলেটের ওপর ক্রিকেট বলের সমান আইক্রিম। আমি একাই খেতাম, ছোটমামী খেতেন না। ছোটমামী কথা বলতেন কম। আমি আইসক্রিম খাওয়ার সময়ও চুপ করে থাকতেন।
অশেষ স্নেহ পেয়েছিলাম আর এক জন বৃদ্ধার কাছ থেকে। ইনি আমার বড়মামার শাশুড়ি। বাদামি চুলের ধবধবে ফরসা চেহারার ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলা লখনউর উর্দুভাষী এই বৃদ্ধার নাম ছিল: বেগম। ধানমন্ডিতে একটি গাছগাছালি ছাওয়া বাড়িতে থাকতেন । শান্তিনগর থেকে গাড়িভর্তি করে ছোটরা যেতাম ধানমন্ডি। বেগম আমার জন্য আলাদা প্লেট, কাঁটা চামচ বার করতেন। বসতে দিতেন তাঁর নিজের গদীআঁটা চেয়ারে ...
একবার গ্রামে যাওয়ার সময় আমার মেজবোন শান্ত¦না নৌকা থেকে হঠাৎই খালের পানিতে পড়ে গিয়েছিল। রতন ভাই (আব্বার দিক থেকে আমার এক দূর সর্ম্পকের আত্মীয় ) নৌকায় ছিলেন। তিনি খালের পানিতে ঝাঁপিড়ে পড়ে শান্ত¦না বাঁচিয়েছিলেন। রতন ভাই কী যেন চাকরি করতেন। গাড়ি ছিল। গাড়ি নিয়ে এসে ছোটদের নিয়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। পচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় ঢাকায় রাস্তায় সামরিক যানবাহনের বহর নেমেছিল। আমরা রাস্তায় ট্যাঙ্ক দেখেছিলাম । রতন ভাইয়ের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কী কারণে যেন যাওয়া হয়নি। ...
সেই দিনগুলি আমাদের জন্য কিছুটা উদ্বেগজনকই ছিল। আমার নানাবাড়ির পাশেই ছিল একজন আওয়ামি পন্থি রাজনৈতিক নেতার বাড়ি। সেই সুবাদে আর্মিরা আমাদের বাড়িটিও ঘিরে ফেলেছিল। সার্চ করতেও এসেছিল। আমার এক নানা (আম্মার খালু) সৈনিকদের সব ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন সঙ্গে আমিও ছিলাম ...আম্মা তখন রেডিওতে শিক্ষাবিষয়ক পোগ্রাম করতেন। আম্মা বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না। রাস্তার ওপারে অপেক্ষা করছিলেন। আম্মা নিশ্চয়ই উদ্বিগ ছিলেন। কেননা, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর আমি আম্মাকে কাঁদতে দেখেছি ...
ছেলেবেলার আমাদের বাড়িটা ছিল টিনসেডের একতলা। বাড়ির সামনে অর্ধবৃত্তাকার রেডঅক্সাইডের ছোট বারান্দা। ছোট উঠান। এক পাশে গোলাপের ঝার। ভোরবেলা উঠেই যে গোলাপি রঙের গোলাপের গন্ধ নেওয়া ছিল প্রতিদিনের অভ্যেস- আজ ভাবলে অবাকই হই। দেয়ালের পাশে একটা নিমগাছ। ওটা বেয়ে টিনের চালে উঠে যেতাম। পিছনের উঠানে ছিল কাঁঠাল গাছ। পুবদিকে শেওলা ধরা দেয়াল ।
পরে অবশ্য আমরা নানাবাড়ির কম্পাউন্ডের ভিতরেই আরেকটি বাড়িতে উঠে আসি। একতলা বাংলো টাইপের সেই বাড়ির ছাদে ছিল লাল রঙের টালি আর সামনের দিকে অ্যাজবেসটস। বৃষ্টির শব্দ আগের মতন শোনা যেত না বলেই বাড়িটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি । টিনের চালের ওপর বৃষ্টিপতনের শব্দের জন্য আজও বুকে মোচড় দেয়।
আমার বড়মামারও টিনের চালের ওপর বৃষ্টি পরার শব্দ ভালো লাগে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পাইলট ছিলেন বড়মামা। লন্ডনে সেটেল করেছেন। দেশি বৃষ্টিটা ভীষণ মিস করেন। ঢাকায় সিরামিক ইটের যে দোতলা বাড়িটা করেছিলেন, সে বাড়ির সিঁড়িঘরের ছাদ ছিল টিনের; ওই টিনের চালের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনবেন বলেই।
লালটালির সেই বাড়ির সামনে ছিল বেশ বড় একটা সুন্দর সবুজ ঘাসের লন । লনের পশ্চিম দিকে ছিল দেয়াল-ঘেরা নানার কবর। ফুটলবল খেলার সময় বল প্রায়ই ড্রপ খেতে খেতে দেয়াল টপকে নানার কবরে চলে যেত, বলটা কবর থেকে আনার সময় আমার গা কেন জানি শিরশির করত। কবরের দেয়ালের সামনে ছিল বেঁটে মতন একটা অপরিচিত জাতের পাম গাছ। দেয়াল ঘেঁষে ছিল শিউলি, বকুল, আর আমলকি গাছ। ভোরবেলা আমি আর আমার বড়বোন স্বাতী শিউলির ফুল কুড়াতাম ...
আমি আর স্বাতী দু’জন পিঠাপিঠি ভাইবোন। দু’জনের মধ্যে ভারি ভাব। আজও ... শৈশবের নানাবাড়িতে কত না ফল ছিল । কামরাঙা জলপাই আতা সফেদা হরবরি আমলকি ...আরও কত কত ফল। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর কামরাঙা কি জলপাই খেতে খেতে স্বাতী পড়ার বই থেকে মুখস্ত বলত, আহারের পর ফল খাওয়া একটি ভালো অভ্যেস।
শৈশব এমনই স্বপ্নের মতো সুন্দর ছিল ...
তবে সবটুকু না ...
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স চার। আম্মার মুখে হাজারবার ওই সময়ের কথা শুনেছি বলে অনেক কিছুই মনে আছে। ২৫ মার্চ রাত ... ঘর অন্ধকার ... আমরা মেঝের ওপর শুয়ে আছি ... বাইরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ ... প্রাচন্ড ...আমার মনে হচ্ছিল কারা যেন আমাদের বাড়ির দেয়ালে গুলি করছে ... কেন করছে? আমাদের বাড়ির পিছনেই রাজারবাগ পুলিশ লাইন। পরদিন ভোরে দেখলাম উঠানে শেওলা ধরা দেয়াল ঘেঁষে কয়েক জন মানুষ ... লুঙ্গি পরা ... খালি গা ... থরথর করে কাঁপছে ... রাজারবাগ থেকে পালিয়ে এসেছে ... ভীষণ ভয় পেয়েছে ... মনে আছে ...ওই ভয়ার্ত মুখগুলি আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ...

উৎসর্গ: স্নেহময়ী মাতামহী আমেনা খাতুন ...
৪৫৬ বার পঠিত
২২টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চাঁদ গাজীর ব্যান তুলে নিন/ ব্লগ কর্তৃপক্ষ ‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩




আমি যদি গাজী’ ভাইয়ের যায়গায় হতাম জিবনেও সামু’তে লেখার জন্য ফিরে আসতাম না।
হয় বিকল্প কোন প্লাটফর্ম করে নিতাম নিজের জন্য। অথবা বাঁশের কেল্লার মত কোথাও লিখতাম।
নিচে ব্লগার মিররডডল-এর করা পুরো... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করা এবং বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।

লিখেছেন জ্যাকেল , ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা বরাবরই সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের কাজ হলো সত্য প্রকাশ, জনমতের প্রতিনিধিত্ব এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ উঠেছে যে, বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার সাজিদ কমেন্ট অফ রাখায় এখানে লিখছি (সাময়িক)

লিখেছেন মিরোরডডল , ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৫


সাজিদের বিদায় পোষ্ট দেখলাম, কমেন্ট সেকশন বন্ধ রাখায় ভাবলাম এখানেই লিখে যাই।

জানিনা কি বলবো, হয়তো এটাই দেখা বাকি ছিলো।
চলে যাবার কারণ জানিনা কিন্তু অনুমান করতে পারছি।
Man! you shouldn't leave.

ব্লগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হতে যাচ্ছেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৭


আজকাল মানুষ চেনা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তা বুঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে এই কথা আরো বেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কখনো বিদায় বলতে নাই

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



ব্লগে কিছুদিন ধরে অনিয়মিত হওয়ায় কখন কি ঘটে জানি না।
কিছুক্ষণ আগে মিররডলের একটা পোস্টে জানতে পারলাম , ব্লগার আমি সাজিদ ঘোষণা দিয়ে ব্লগ ছেড়েছেন । তার সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×