‘দিবা নিশি যেই নরে, তামাকু ভক্ষণ করে,
অন্তকালে চলে যায় কাশী।’
শুধু তামাকই নয়, যে ছানা ছাড়া মিষ্টি তৈরি করা যায় না- সে ছানা তৈরির প্রক্রিয়াটিও পর্তুগিজদের বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। মুগল আমলে ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাসোয়া বার্ণিয়ের ভারতবর্ষে এসেছিলেন । তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালির সঙ্গে মিশে পর্তুগিজরা নানারকম সুস্বাদু মিষ্টান্ন ও তৈরি করেছে সেকালে।’ বাংলায় যে পর্তুগিজদের এত অবদান তারাই আবার বাংলাজুড়ে ফিরিঙ্গী জলদস্যু হিসেবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।বাংলা প্রথম বইটিও ছেপেছিল তারা। কাজেই আমরা বাংলায় পর্তুগিজ জাতির পরস্পরবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতি কৌতূহল হতেই পারি।
ইউরোপের মানচিত্রে পর্তুগালের অবস্থান । দেশটি ছোট। তবে মধ্যযুগের শেষে সেই ভূ-আবিস্কারের যুগে প্রযুক্তির কল্যাণেই সারা বিশ্বে তাদের অগ্রযাত্রা হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য।
ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম বাংলায় আসে। এ প্রসঙ্গে একজন লেখক লিখেছেন:: The Portuguese first visited Bengal in 1517, just 33 years after Bartholomew Diaz landed at Calicut on the East coast.তো, কে বার্থোলোমিউ দিয়াজ ? বার্থোলোমিউ দিয়াজ ছিলেন একজন রোমান ক্যাথলিক পর্তুগীজ নৌ-অভিযাত্রী। তার জন্ম ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে। এঁকে ভারতে যাওয়ার বিকল্প পথ বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কারণ পনেরো শতকের শেষ দিক থেকে এশিয়া থেকে মসলা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভেনিস ও আরব বণিকদের এড়িয়ে বিকল্প পথ অনুসরণ করে ভারতে তথা বাংলায় অনুপ্রবেশ করা পর্তুগিজদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
বার্থোলোমিউ দিয়াজ কালিকূট বন্দরে অবতরণ করেন। অবশ্য ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন ভাস্কো দা গামা। এই পর্তুগীজ নৌ কমান্ডার ১৫২৪ সালে সালে স্বল্প সময়ের জন্য 'পর্তুগীজ ইন্ডিয়া'র গভর্নর ও ছিলেন। যদ্দুর জানি, ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার নেতৃত্বে ইউরোপীয়রা জলপথে ভারতে প্রবেশ করেছিলো। সেটা কালিকূটেই ছিলো।
পঞ্চদশ শতকের হালকা ও দ্রুতগামী পর্তুগিজ জাহাজ। উপযুক্ত জাহাজ নির্মান ছাড়াও অক্ষাংশ নির্ণয়ে কৌণিক উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহারও সমুদ্রযাত্রায় পর্তুগিজদের প্রাধান্য দিয়েছিল।
পর্তুগিজদের বাংলায় আসার আগেই ইউরোপ অবধি বাংলার ধনসম্পদের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলার উর্বরা মাটিই বাংলার কৃষিপণ্যকে একটি উন্নত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। বিশেষ করে চাল এবং তুলা। এছাড়া মসলা ও বস্ত্রশিল্পেও বাংলার প্রশংসনীয় অগ্রগতি হয়েছিল সেকালে। রোমান মেয়েরা নাকি ঢাকাই মসলিন কাপড়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। এসব কারণেই পর্তুগিজ বণিকের লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছিল সুজলাসুফলাশষ্যশ্যামলা বাংলার ওপর । এই ধন সম্পদই বাংলার মানুষের জন্য অশেষ দুঃখের কারণ হয়েছিল। চর্যাপদের কবিরা যার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন বহু বছর আগেই:আপনা মাংসে হরিণা বৈরী
এই পদ রচনা করে। বাংলায় উৎপন্ন পণ্যের বিপননের জন্য ষোড়শ শতাব্দীর বাংলায় দুটো সমৃদ্ধশালী বাণিজ্য-কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।বাংলার পুবের চট্টগ্রাম আর পশ্চিমের সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদীর পাশে ছিল সপ্তগ্রাম ছিল একটি সরগরম গঞ্জ। রেশম, কার্পাস, গালা, চিনি, সুতার কাপড় আর চালের আড়ত-কি নেই সেখানে। চট্টগ্রামও অনুরূপ পণ্যে সমৃদ্ধশালী ছিল। পণ্যলোভী পর্তুগীজরা প্রথমে ঘাঁটি গেড়েছিল চট্টগ্রামে। তারপর সপ্তগ্রামে। চট্টগ্রাম হচ্ছে তাদের কাছে ‘পোর্ট-গ্রান্ডী’ অর্থাৎ বড় স্বর্গ। আর সপ্তগ্রাম হচ্ছে ‘পোর্ট পিকানো’; অর্থাৎ ছোট স্বর্গ’। বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। যে গৌড় অচিরেই অধিকার করে নেবে মুগলরা।
হুগলি নদী। বাংলায় পর্তুগীজ জাতির ইতিহাস আলোচনায় বারবার এ নদীর কথা আসবে । পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন,‘পর্তুগিজরা যখন হুগলিতে জাঁকিয়ে বসেছে, তখন একটু একটু করে পতন শুরু হয়ে গেছে সপ্তগ্রামের। আর এদিকে পর্তুগিজদের দাপট দম্ভ দুঃসাহসের মাত্রা ক্রমশ ডিগ্রি পেরিয়ে গেছে। (পুরনো কলকাতার কথাচিত্র;পৃষ্ঠা; ৪৪)
১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। মুগল বাদশা আকবর পর্তুগীজদের হুগলি নদীর পাড়ে বসতি স্থাপনের সনদ প্রদান করেন। জায়গাটি ঠিক কোথায় ছিল? বর্তমান কলকাতার ২৫ মাইল উজানে। পর্তুগিজরা তাদের বসতিকে বলত Porto Pequeno. অবশ্য এখন জায়গাটি ব্যান্ডেল নামেই পরিচিত। জায়গাটি ষোড়শ শতকের একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে। বাংলার পণ্য ছিল শস্তা। পর্তুগিজ বণিকেরা সে পণ্য কিনে এশিয়ার পুবের বন্দরে চড়া মূল্যে বিক্রি করত । প্রথম প্রথম কেবল বর্ষাকালেই তারা বাংলায় ব্যবসা করত । বর্ষা শেষ হলে তারা গোয়ায় চলে যেত। কেননা, পশ্চিম ভারতের গোয়া ছিল পর্তুগিজদের অন্যতম ঘাঁটি। পরে অবশ্য পর্তুগিজরা বাংলায় স্থায়ী ভাবে বসতি গড়ে তোলে। এবং ধীরে ধীরে বণিক থেকে পরিনত হয় জলদস্যুতে। কিভাবে? সে কথায় আমি পরে আসছি।
বাংলাদেশের মানচিত্রে চট্টগ্রামের অবস্থান। বাংলায় পর্তুগীজ জাতির ইতিহাস আলোচনায় বারবার এ অঞ্চলের কথা আসবে ...
১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় পর্তুগিজদের বংশধরের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০০ হাজার। অবশ্য বিশুদ্ধ পর্তুগীজ ছিল মাত্র ৩০০। বাংলাপিডিয়ায় অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন, ‘তাদের (অর্থাৎ পর্তুগিজদের) আগমনের প্রথম দিক থেকেই পর্তুগিজরা স্থানীয় মহিলাদের সাথে বিয়েতে আপত্তি করে নি।’ কুড়ি হাজার পর্তুগিজের অর্ধেক বাস করত হুগলি। বাকিরা সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রাম, বানজা (এই জায়গাটি কোথায় ছিল?) ঢাকা এবং অন্যত্র। পর্তুগিজরা বিলাসবহুল জীবন কাটাত । তারা স্থানীয় নবাবদের মতন পোশাক পড়ত। আর? আর...... “made merry with dancing slave girls, seamstresses, cooks and confectioners.” তৎকালীন বাংলার সমাজে দাসপ্রথা ছিল। পর্তুগিজদের বাড়িতে দাস ছিল। এদের প্রধান কাজ ছিল আম কমলা লেবু আদা এবং আচার থেকে মিষ্টান্ন তৈরি করা। (আচার থেকে কীভাবে মিষ্টি তৈরি হয় বলতে পারি না, তবে মূল বইতে এরকমই লেখা আছে) পর্তুগিজ ময়রারা তৈরি করত রুটি, কেক এবং পেস্ট্রি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় পদ।
রসগোল্লা। যদ্দূর জানি দুধ থেকে ছানা তৈরি না-করার জন্য ভারতে (বাংলায়) কি এক বৈদিক সংস্কার ছিল। দুধ থেকে চিজ তৈরি করতে সক্ষম পর্তুগিজদের তো সে সংস্কার মানার কথা নয়। কাজেই বাঙালি ময়রাদের সামনে ছানার মিষ্টান্ন তৈরির এক নতুন দিগন্ত খুলেগিয়েছিল ।
ওদিকে পর্তুগিজ পাদ্রীদের সঙ্গে বাদশা আকবর- এর ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আকবর অন্যধর্ম সম্বন্ধে ছিলেন উদার। তা সত্ত্বেও অনেক চেষ্টা করেও পর্তুগিজ পাদ্রীরা আকবরকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করাতে পারেননি। সে যাই হোক। আকবরের রাজত্বকাল থেকে শায়েস্তা খাঁর আমল অবধি অর্থাৎ ১৬৬৬ অবধি বাংলার গ্রাম ও জনপদে অবাধ লুন্ঠন চালিয়েছিল পুর্তগিজরা। বাংলার মানুষের কাছে তারা ‘হার্মাদ’ নামে পরিচিত ছিল। হার্মাদ অর্থ ‘জলদস্যু’। কথাটা এসেছে স্পেনিশ নৌবহর ‘আরমাডা’ থেকে। জলপথে, একটা দুটো নয়, অসংখ্য জাহাজ এক সারিতে সাজিয়ে শুরু হত তাদের লুন্ঠন অভিযান। জাহাজগুলিকে বলা হত ‘বহর’। বহরেরক্যাপ্টেন-‘বহরদার’। আক্রমনের প্রধান প্রধান স্থান ছিল চট্টগ্রাম, খুলনা, চব্বিশ পরগণার উপকূল,নোয়াখালি, সন্দ্বীপ, বরিশাল। এসব জায়গায় পর্তুগিজদের ঘরবাড়িও ছিল।
বাংলার জনগনের ওপর যুগে যুগে কম অত্যাচার হয়নি। আজ আর বাংলায় জলদস্যুর আক্রমন নেই। তবে দেশিও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ভিনদেশি তস্করের চেয়ে কম নয় ...
বাংলায় পর্তুগিজদের ওপর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছিল শিথিল । ফলে তারা দন্ডপ্রাপ্ত আসামী এবং সন্ত্রাসীদের নিয়ে অবাধে লুন্ঠন করত। বিশেষ করে পূর্ববাংলায়। পর্তুগিজরা দন্ডপ্রাপ্ত আসামী এবং সন্ত্রাসীদের কোথা থেকে যোগাড় করত? ‘বুলখক খানা’ থেকে। ‘বুলখক খানা’ কি? বাদশা আকবর সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁকে বলতেন-‘বুলখক খানা’। অর্থাৎ বিদ্রোহীদের আড্ডা। মুগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত যারা, তারা এসে জমায়েত হত এই সপ্তগ্রামেই। এদের সঙ্গে যোগ দিত বাংলার পুবের আরাকানি এবং মগরা। এরা চট্টগ্রামের আশেপাশেই বাস করত, জাতে ছিল সেমি-ট্রাইবাল, ধর্মে বৌদ্ধ। (দেখুন,(পূর্ণেন্দু পত্রী; পুরনো কলকাতার কথাচিত্র) এদের ফিরিঙ্গীও বলা হত। একটি সূত্র অনুযায়ী ফিরিঙ্গী শব্দটি এসেছে ‘ফ্রাঙ্ক’ থেকে।(দেখুন,
Colleen Taylor Sen;The Portuguese Influence on Bengali Cuisine) আরবরা ক্রসেডারদের ফ্রাঙ্ক বলত। সে যাই হোক। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজার নামটি আজও সেই স্মৃতি বহন করে। ফিরিঙ্গী ও পর্তুগিজরা মিলে বাংলায় লুন্ঠন চালিয়েছিল।
বাংলার দুঃখিনী নারী। এরা সপ্তদশ-অস্টাদশ শতকে লাঞ্ছিত হয়েছে পর্তুগিজদের দ্বারা, ১৯৭১ এ পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা এবং বর্তমানে লাঞ্ছিত হচ্ছে বিকারগ্রস্থ পুরুষ দ্বারা। এবং এ নির্যাতন থেকে শিশুদেরও রেহাই নেই!
হার্মাদরা কখনও ছোট ছোট ডিঙিতে তীরের বেগে ছুটে এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলত বণিকের জলযান। কখনও-বা মাইলের পর মাইল হেঁটে এসে কলরব-মুখর উৎসব বাড়িতে হানা দিয়ে লোকের ওপর অত্যাচার চালাত। মেয়েদের ওপর অত্যাচার ছিল অকল্পনীয়। মেয়েদের চরম অপমানের পর ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে দিত আরাকানে। আজও বাংলাদেশের পল্লী গানে সেইসব হত্যভাগ্য নারীদের বিলাপ ধ্বনিত হয়:
অভাগিনীরে মনে রাখিও। ঘাটে আমার কলসী পড়িয়া রহিল, আমার হাতের কঙ্কন ফেলিয়া আসিয়াছি;আমাকে মনে করিয়া দুঃখ হইলে কঙ্কন ও কলসী তোমার হাত দুখানি দিয়া ছুঁইও-তাহাতে আমি জুড়াইব। আর সুন্দরী দেখিয়া একটি মেয়ে বিবাহ করিও। আমি যে আদর ও স্নেহের জন্য পাগল ছিলাম, তাহা তাহাকে দিও, হতভাগিনীর অদৃষ্টে তাহা নাই।
সমুদ্র উপকূলীয় গ্রামগুলিতে হানা দিয়ে নারী অপহরণ এবং ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করা ছিল পর্তুগিজদের একচেটিয়া ব্যবসা। এই ব্যবসার কেন্দ্র ছিল বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি । পর্তুগিজরা ছোট ছোট শিশুদেরও অপহরণ করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিত।
পর্তুগিজ হার্মাদ আক্রমনের প্রাক্কালে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের ঢাকা শহরের একটি প্রাচীন মানচিত্র। বুড়িগঙ্গা নদীতে হার্মাদের রণতরী থেকে কামান দাগত বলে সে সময় খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না ঢাকাবাসী । অবশ্য সেসময় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ছিল টলটলে । যা আজ কালো হয়ে উঠেছে অসুখি ঢাকাবাসীর প্রতীক হিসেবে ।
আকবরের মৃত্যুর পর মুগল সিংহাসনটি লাভ করলেন বাদশা জাহাঙ্গীর। তাঁর সেনাপতি ছিলেন অসম সাহসী মানসিংহ। তিনি দ্বিতীয়বার বাংলায় আসেন বারো ভূঁইয়াদের বিদ্রোহ দমন করতে। পর্তুগিজরা সে সময় মুগল সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। ফ্রান্সিস কার্ভালো, রডা গঞ্জালেস প্রমূখ পর্তুগিজরা প্রতাপাদিত্যর পক্ষের নৌ সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। একই সঙ্গে তারা হুগলীতেও হামলা অব্যাহত রেখেছিল। পদ্মা- মেঘনা আর কর্ণফুলিতে বাণিজ্যতরী আটকে কর আদায় করত । মক্কাগামী হযযাত্রীদের জাহাজ থামিয়ে লুটপাট করত। ভাঙত হিন্দুদের দেবমূর্তি । এসব কথা সম্রাট জাহাঙ্গীরের কানে গেলে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। পর্তুগিজ দমনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। ঢাকার নতুন নাম হল ‘জাহাঙ্গীর নগর।’
সম্রাট শাহজাহান। (১৫৯২-১৬৬৬) এঁর সময়েই বাংলায় পুর্তুগিজ শক্তি নির্মূল হয়। বাবা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিদ্রোহ করে শাহজাহান একবার বাংলায় এসেছিলেন। সেসময় তিনি পর্তুগিজদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন। শাহজাহান ঠিকই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে বাদশা জাহাঙ্গীর ইন্তেকাল করেন। মুগল তখতে বসলেন শাহাজাহান । কাশেম খাঁকে তিনি বাংলার শাসনকর্তা করে পাঠালেন। তার আগে বাদশা কাশেম খাঁকে বললেন,‘আমার প্রজার সুখেই আমার সুখ।আপনি পর্তুগিজদের ধ্বংস করেন’। এর পরপরই মুগল সৈন্যদের সঙ্গে পর্তুগিজদের যুদ্ধ বাঁধল। বড় ভয়ঙ্কর ছিল সে যুদ্ধ । তিন মাস চলল সে যুদ্ধ। তারপর ব্যান্ডেলে মুগল সৈন্যরা মাটির তলায় সুড়ঙ্গ কেটে, সেই সুড়ঙ্গে বারুদ পুরে গোটা পতুর্গিজ দুর্গই উড়িয়ে দিল। হাজার হাজার পুর্তগিজ নরনারী নিহত হল। ওদিকে ১৬৬৬ সালে মুগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদখান পর্তুগিজদের পরাজিত করে চট্টগ্রামে মুগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য,১৬৬৬ সালটি সম্রাট শাহজাহান- এর মৃত্যুর বছর।
সেন্ট জেভিয়ার। (১৫০৬-১৫৫২)
তবে এও সত্য যে পর্তুগিজ মাত্রই হার্মাদ বজ্জাত ছিল না। অনেক সৎ মানুষ ছিলেন তাদের মধ্যে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার । অতি সজ্জন সাধু ছিলেন তিনি । রাজনীতি নয়, ধর্মই ছিল এঁর আদর্শ। বাংলায় পর্তুগিজদের অত্যাচার ও অসংযত জীবনযাত্রায় ক্রদ্ধ হয়ে উনি একসময় চলে যান শ্রীলঙ্কায়। তারপরে জাপানে। মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ এনে প্রোথিত করা হয় ভারতের গোয়ায়।
কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে সেন্ট জেভিয়ার কলেজের একাংশ। আশ্চর্য! বাংলায় আজ কোথাও আর পর্তুগিজ নির্যাতনের চিহ্ন নেই। অথচ একজন পর্তুগিজ সাধুই কেবল বাংলায় সত্য হয়ে রইলেন। মানুষ তার পরও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না!
মুগলা পর্তুগিজদের দমন করেছিল। তবে পর্তুগিজরাও মুগলদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। মুগলরা আরব বানিজ্য জাহাজে রাধুঁনি ছিল। পর্তুগিজরা এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল। তারা মুগলদের তাদের জাহাজে নিয়োগ দিত। এভাবে রান্না শিখেছিল। হয়ে উঠেছিল দক্ষ ময়রা । কেবল রান্নাবান্না্ই নয়, পর্তুগিজ ভাষাটিও বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অষ্টাদশ শতক অবধি পর্তুগিজ ভাষাটি বাংলায় প্রচলিত ছিল। এমনকী রবার্ট ক্লাইভ অবধি অনর্গল পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
ব্যান্ডেল গির্জা। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের নির্মিত। । পশ্চিম বাংলায় সবচে পুরোনো গির্জা এটি ।
পর্তুগিজরা যতই গ্রামবাংলা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিক না কেন বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কিন্তু কম নয়। যেমন বাংলায় ছাপাখানা বা বই ছাপানোর পিছনে পর্তুগিজদের অবদান অসামান্য। বাংলা ভাষার প্রথম বইটি পর্তুগিজদের হাতেই ছাপা । পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ১৭৪৩ সালে এই অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল । হরফ অবশ্য রোমান। সে সময় তিনটি বই ছাপা হয়েছিল। (১) ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ।(২) কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ। এবং (৩) বাংলা ও পর্তুগিজ ভাষার শব্দকোষ ও ব্যাকরণ। ১৫৯৯ সালে ফাদার সোসা একটি ক্ষুদ্রাকৃতি ধর্মীয় পুস্তিকা বাংলায় অনুবাদ করেন। অবশ্য এর কোনও প্রতিলিপি এখন আর নেই।
আজ আর চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীতে পর্তুগিজ হার্মাদের আক্রমনের ভয় নেই, নদীটি স্বাধীন বাংলাদেশের একটি নদী। অথচ এককালে হার্মাদরা কখনও ছোট ছোট ডিঙিতে তীরের বেগে ছুটে এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলত বণিকের জলযান। কখনও-বা মাইলের পর মাইল হেঁটে এসে কলরব-মুখর উৎসব বাড়িতে হানা দিয়ে লোকের ওপর অত্যাচার। মেয়েদের ওপর অত্যাচার ছিল অকল্পনীয়। ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে দিত আরাকানে।
বাংলার ইতিহাসে পর্তুগিজ-অধ্যায়ের কথা ভাবলে আজ আমাদের অবাকই হতে হয়। তার পরও তারা বাংলার সংস্কৃতিতে আজও নানাভাবে রয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজারের কথা আগেই বলেছি। আজও বাঙালি মেয়েরা ‘ফিরিঙ্গী’ নামে এক ধরনের ‘খোঁপা’ বাধে । এছাড়া বহু পর্তুগিজ শব্দ যে যে বাংলায় প্রচলিত সে সম্বন্ধে এ লেখার গোড়ায় বলেছি। পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন,‘ যে ‘সাবান’ রোজ গায়ে মাখি, যে ‘জানালায়’ আকাশকে কাজে পাই, যে ‘আলমারি’তে থাকে থাকে সাজাই অনেক দামে কেনা আদরের বইগুলো,‘বেহালা’র কান্নায় নিজের কান্না শুনে কাঁদি যখন,‘বোতাম’ লাগাই জামায়, পা ছড়িয়ে জিরিয়ে নিই ‘কেদারায়’ বসে, তখন ক্ষণে ক্ষণে আমরা পর্তুগিজদের সম্পদকেই নিজেদের ব্যবহারে খাটাচ্ছি। (পুরনো কলকাতার কথাচিত্র;পৃষ্ঠা;৫৫) এছাড়া মাস্তুল, ইস্ত্রী, আলপিন, তুফান, বজরা, কামান, পিস্তল, লোকলস্কর এবং আয়া শব্দটিও পর্তুগিজ। সবচে বড় কথা - বাংলাদেশের বরিশাল এবং সন্দীপসহ দক্ষিণ-পূর্বে বসবাসরত অনেক বাঙালির গৌড়বর্ণ আজও পর্তুগিজ স্মৃতি বহন করে।
ছবি। ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
পূর্ণেন্দু পত্রী; পুরনো কলকাতার কথাচিত্র
বাংলাপিডিয়া
Colleen Taylor Sen;The Portuguese Influence on Bengali Cuisine
Food on the Move Proceedings of the Oxford Symposium on Food and Cookery 1996