হনুমানের রূপ ধরে সাদা ভূতটা অশথ গাছের ডালে ঝুলে ছিল।
কোনও কারণ ছাড়াই। মানে, সাদা ভূতটা অশথ গাছের ডালে এমনি-এমনিই ঝুলে ছিল। ওই সাদা ভূতটা কিন্তু যখন-তখন নিজের ইচ্ছে মতন আপন খেয়াল খুশি মতন যে কোনও রূপ ধরতে পারে। এই এখন যেমন সাদা ভূতটা একটা হনুমানের রূপ ধরে অশথ গাছের ডালে ঝুলে আছে।
অশথ গাছটা ছিল একটা ছোট্ট নদীর ধারে। সেই নদীর নাম ঝিলিমিলি। ঝিলিমিলি নদীর তীরে বালুচর। বালুচর যেখানে শেষ সেখানেই ঘাসের বনের শুরু। আবার ঘাসের বন যেখানে শেষ অশথ গাছটা ঠিক সেখানেই । আর হ্যাঁ, অশথ গাছটা মস্ত বড় । এই অশথ গাছেই কুটুস নামে একটা কাঠবেড়ালী, চিরি নামে একটা ফিঙ্গে পাখি, গড়ান নামে একটা দাঁড়কাক, ভুতুম নামে একটা কাছিম আর লালসারি নামে পিঁপড়ের দল বাস করে । এখন রাত্রি বলে ওরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। কেবল গড়ান নামে দাঁড়কাকটা জেগে। আর সাদা ভূতটাও জেগে। রাত যতই বাড়ে ততই ওই সাদা ভুতটার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যায় কি না তাই।
হ্যাঁ, ভূতেদের এমনই নিয়ম। মানে, অন্তত ওই সাদা ভূতের অমনই নিয়ম।
সময়টা এখন রাতদুপুর। সময়টা এখন রাতদুপুর হলেও কিন্তু চারিদিকে মোটেও ঘুটঘুটে অন্ধকার নেই। বরং সারা আকাশে ছড়িয়ে আছে চাঁদের দুধ-সাদা আলো । আর ওই নীল আকাশের মাঝমধ্যিখানে ভেসে রয়েছে রুপার থালার মতন মস্ত একটা গোল চাঁদ। সেই চাঁদ থেকেই তো রুপালি আলো গলে গলে পড়ছিল ঝিলিমিলি নদীটার ওপর। তাইই ঝিলিমিলি নদীর দুপাশটা আজ রাতে ঝলমলে জোছনায় ভরে রয়েছে।
এইরকম সময়েই তো পরিরা নেমে আসে ঝিলিমিলি নদীর পাড়ে, বালুচরের ওপর। পরিরা আসে পরির দেশ থেকে। চাঁদের দেশের পাশেই তো পরির দেশ। চাঁদের দেশের পাশ ঘেঁষে আকাশপথ দিয়েই তো যেতে হয় পরির দেশে। পরিরা যখন দলবেঁধে আকাশ থেকে নীচে নামে তখন কিন্তু আকাশে মস্ত একটা গোলপানা পূর্নিমার চাঁদকে থাকতেই হয় ।
হ্যাঁ, এটাই নিয়ম।
ঘোর অমাবশ্যার রাতে পথ হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে বলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে পরিদের নীচে নামা নিষেধ। হ্যাঁ, শুধুমাত্র পূর্নিমার রাতেই পরিরা পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে। হ্যাঁ, এটাই নিয়ম। আর, কত রকম যে পরি হয়। লাল পরি, নীল পরি, হলুদ পরি, বাদামি পরি, খয়েরি পরি। খয়েরি পরি? হ্যাঁ, এমনকি খয়েরি পরিও হয় কিন্তু। ওরা সবাই হাত ধরাধরি করে গান গাইতে গাইতে দল বেঁেধ আকাশ থেকে নেমে আসে নীচে।
অশথ গাছের ডালে হনুমানের মতন ঝুলে থাকা সাদা ভুতটা কিন্ত পরিদের এতসব ব্যাপারস্যাপার জানে না। এই ঝিলিমিলি নদীর পাড়ের দেশটায় এক মাসও হয়নি ও এসেছে । এক মাস আগে সাদা ভূতটা তা হলে কোথায় ছিল? এক মাস আগে ওই সাদা ভূতটা ছিল বড় একটা শহরে।
তা হলে ও এই এই ঝিলিমিলি নদীর পাড়ের দেশটায় কেন এল?
জানই তো শহরে কত রকমের ঝক্কিঝামেলা। এই ধর ট্রাফিক জ্যাম, গাড়িঘোড়ার ভিড়, তার ওপর লোকজনের ভিড়, তার ওপর ইলেকট্রিকের তার, ইলেকট্রিকের আলো। সন্ধ্যের পর শহরের বাড়িঘর আর দোকাপাটে জ্বলে ওঠে নানা রকম রঙবেরঙ-এর ঝলমলে আলোর নিয়ন সাইন। জান তো ভূতেরা কিন্তু রাত্রিবেলা ইলেকট্রিকের আলো একেবারেই সহ্য করতে পারে না। ওই অশথ গাছের ডালে ঝুলে থাকা সাদা ভূতটা তো আরও পারে। সেজন্যই তো সাদা ভূতটা পালিয়ে এল ঝিলিমিলি নদীর নিরিবিলি পাড়ে।
তা, এই ঝিলিমিলি নদীর পাড়ের এই নিরিবিলি দেশটা কিন্তু বেশ। বড় শান্ত আর নির্জন। এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে সাদা ভূতটা। সেজন্যই তো ও মনে মনে বলল, এখানে এসে ভালই আছি আমি। সময় পেলেই অশথ গাছের ডালে ঝুল খাচ্ছি আর নদীর পাড়ে ঘাসের বনে লুকিয়ে থাকছি। আমার যা খুশি তাই করছি। এই যেমন এখন আমি অথশ গাছের ডালে হনুমানের মতন ঝুলে আছি । আর একটু পরেই যাব ঝিলিমিলি নদীর ধারে বড় বড় ঘাসের বনের ভিতর।
ওই বড় বড় ঘাসের বনে যাওয়ার পর সাদা ভূতটা কী রুপ ধরবে তা এখনও ঠিক করেনি ও । হয়তো সে তখন হয়ে যেতে পারে একটা কাঠবেড়ালি কি একট ময়না পাখি। হ্যাঁ, সাদা ভূতটা যে কত রুপই না ধরতে পারে।
ওদিকে আকাশটা আজ জোছনায় ভরে আছে বলেই পরিদের ছোট্ট দলটা আকাশপথ ধরে ধরে ধীরে ধীরে নেমে আসছিল নীচে। একেবারে চাঁদের কোল ঘেঁষেই নেমে আসছিল ওরা । আর তাতেই ওদের ছোট্ট শরীরে চাঁদের হলুদ কিরণ লেগে যাচ্ছিল। আর তাতেই হলুদ পরিকে যেন আরও একটু বেশি হলুদ লাগছিল। সেজন্য লাল পরি তো বলেই ফেলল, ভাই হলুদ পরি, তোকে যে আজ আরও হলুদ লাগছে দেখতে।
হলুদ পরিটা উড়তে উড়তে এক টুকরো সাদা মেঘের ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। সাদা মেঘকে ও ভেবেছিল আইসক্রীম। তাই কামড়ে দিল। ভুল বুঝতে পেরে আবার দলে ফিরে এল। ঠিক তক্ষুনি লাল পরির কথাটা ওর কানে গেল। তখন হলুদ পরি বলল, লাগবে না? আমরা যে চাঁদমামার হলদেটে আলোর মধ্য দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। দেখ্ না, নীল পরিকেও কেমন নীল নীল লাগছে।
সবাই একসঙ্গে নীল পরির দিকে তাকাল। হ্যাঁ, সত্যিই তো নীল পরিকে আজ যেন একটু বেশিই নীলাভ লাগছে।
নীল পরির নাম রাকা। রাকার আজ ভীষন মন খারাপ। কেন? কারণ রাকা আজ আম্মুর কাছে বকুনি খেয়েছে। কেন? রাকা আজ বিকেলে দুধ খায়নি, তাই। জান তো, ওরও না তোমাদের মতোই দুধ খেতে মোটেও ভালো লাগে না, তাইই ও বিকেলবেলায় দুধ খেতে চায়নি। এই জন্যেই তো আম্মু বকল। এই জন্যেই তো রাকার এখন ভীষনই মন খারাপ লাগছে। নীচে নামতে নামতে রাকা ভাবল, পরিদের দেশটা মোটেই ভালো না। দুধ না খেলে পরির দেশের আম্মুরা বকে। আর ওই নীচের পৃথিবীটা কী সুন্দর। নীল রঙের। ঠিক যেন আমার গায়ের রঙের মতনই রঙ। এর ওপর থেকে ওই নীল-নীল গোল পৃথিবীটাকে স্বপ্নের দেশের মতন লাগছে। হ্যাঁ, তাই। এখন থেকে আমি ওই স্বপ্নময় নীলাভ পৃথিবীতেই থাকব। ঝিলিমিলি নদীর পাড়ে বালুচরে নেমেই আমি ঘাসের বনের মধ্যে লুকিয়ে যাব, হ্যাঁ, আমি তাইই করব। আমি আর কখনোই পরির দেশের রানিবাড়িতে ফিরে যাব না। হ্যাঁ।
কিন্তু, পরিদের দেশের রাজবাড়ি না বলে রানিবাড়ি কেন বলল রাকা? রানিবাড়ি- এই কথাটা কেমন অদ্ভুত তাই না?
সেটাই এখন তোমাদের খুলে বলছি। আসলে পরির দেশের রাজ্যটা শাসন করেন একজন রানি। রাজা নয় । সেজন্যই পরির দেশের রাজপ্রাসাদের নাম রানিবাড়ি, রাজবাড়ি নয়। ভারি মজার, তাই না?
সে যাই হোক। খানিক বাদে পরিদের দলটা এসে নামল ঝিলিমিলি নদীর পাড়ে।
নদীর ধারেই বালুচর। চাঁদের আলোয় বালুচরটা যেন দিনের বেলার মতো হয়ে আছে। নদীর ওপার থেকে শীতল মিষ্টি বাতাসেরা ছুটে এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল বালুচরের ওপর। তাতে অবশ্য সামান্য ঘূর্ণির মতন উঠছিল। তবে গান গাওয়ার জন্য আর নাচবার জন্য এমন জায়গা আর কটা আছে বল? সেই জন্যই তো বালুচর নামার পরপরই গান ধরল সুকন্ঠি সবুজ পরি:
আমরা যে ভাই পরির দল
থাকি পরির দেশে,
রাত ফুরোলেই চলে যাব
চোখের নিমিষে ।
গান গাইতে গাইতে সবুজ পরি মাথা দুলিয়ে হাততালিও দিচ্ছিল। অন্য পরিরাও সব সবুজ পরির ঘিরে ঘিরে নাচছিল। রাকা কিন্তু ওদের সঙ্গে গেল না। বরং ও খানিক দূরে দাঁড়িয়ে মুখ গোমড়া করে থাকল। এদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে পালানো যায়। হলুদ পরিটা আবার সবচে পাজী। ওর চোখ ফাঁকি দেওয়াই তো সবচে মুশকিল।
ঘাসের বনের ভিতরে লুকিয়ে থেকে সাদা ভূতটা কিন্তু সবই দেখছিল। ও কিন্তু এর আগে কখনও পরি দেখেনি। কেন? ও একটা শহুরে ভুত তো তাই। আর জান তো, শহরের ভিড় রাস্তায়, জঞ্জালে ভরা ফুটপাতের ওপর কি লোকে ভরতি পার্কে কিংবা ছাদের ওপর পরিরা কখনও নামে না। কোনও নিরিবিলি নদীর তীরের এমন শুনশান নিশুতি রাতেই পরিরা নামে। ধর, পরিরা কখনও-কখনও শহরের রাস্তায়, ফুটপাতে, বাড়ির ছাদে এমনকী পার্কেও নামল। তা হলেও ধর যে ওই সাদা ভুতটা ওদের কখনও দেখেনি। এজন্যই তো সাদা ভুতটা পরির দলটাকে মন দিয়ে দেখছিল আর ভাবছিল, কারা এরা? সাদা ভুতটা ভালো করে রাকাকেই দেখছিল। ভাবল, এর সঙ্গেই খাতির করে সব জেনে নেব নাকি?
ঘাসের বনের দিকে তাকাল রাকা । কে যেন ওখানে লুকিয়ে রয়েছে মনে হল। সে যেই হোক, হাতছানি দিয়েও ডাকছে। আমি কি এখন ওর কাছে যাব। হ্যাঁ সেই ভালো। আমার তো এখন একজন পৃথিবীর বন্ধু চাই, ও নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবে। আমি বরং ওর কাছেই যাই।
এইসব ভেবেই ঘাসের বনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল রাকা।
আর ওদিকে তখন সবুজ পরিকে ঘিরে সবাই গান গাইছিল:
মোরা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াই
ঘুমাই সবুজ পাতায়,
মোদের চোখে স্বপ্নে ভরা
লিখি তোমার খাতায় ।
গান গাইতে গাইতে পরিরা নাচছিল। এই কারণে, রাকা যে ঘাসের বনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল তা কিন্তু ওদের মধ্যে কেউই খেয়াল করল না। এমন কী হলুদ পরিও না।
রাকা তো ঘাসের বনে গেল। তারপর কী হল শোন। ঘাসের বনের ভিতরে সাদা ভূতটা একটা ছোট ছেলের রুপ ধরে ছিল। রাকা সাদা ভূতটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বেশ কতক্ষন সাদা ভূতের দিকে তাকিয়ে রইল।
অবশেষে সাদা ভূতটাই বলল, তুমি কে ভাই?
রাকা বলল, আমি? আমি হলাম একটা নীল পরি। আমার নাম রাকা। কিন্তু তুমি কে?
সাদা ভূতটা বলল, আমার নাম পিদিম। আমি হলাম সাদা রঙের একটা ভূত।
সাদা রঙের ভুতটার নাম পিদিম শুনে রাকা মনে মনে হাসল। কী অদ্ভূত নাম রে বাবা। কারও নাম পিদিম হয় বলে রাকা জীবনে শোনেনি। যাক, আমার হাসি পেলেও হাসা ঠিক হবে না। কারণ, এখানে লুকিয়ে থাকতে হলে এই পিদিমের সাহায্য নিতে হবে। সেজন্য হাসি লুকিয়ে রাকা জানতে চাইল, তা পিদিমবাবু, কোথায় থাক তুমি?
পিদিম হাত তুলে একটু দূরে একটা অশথ গাছটা দেখিয়ে বলল, ওই যে ওখানে।
চাঁদের আলোয় ভালো করে অশথ গাছটা দেখে নিয়ে রাকা বলল, আমাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারবে?
পিদিম খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ। খুব পারব। চল আমার সঙ্গে।
রাকা ভারি খুশি হয়ে পিদিমের হাত ধরে হাঁটতে লাগল। ঘাসের বনের শেষে কিছুটা ভেজা মাটি ছড়ানো তারপরই সেই অশথ গাছটা।
ওরা অশথ গাছের নীচে এসে দাঁড়াল।
গভীর রাত বলেই অশথ গাছটায় যারা থাকে তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমায়নি কেবল গড়ান নামে দাঁড়কাকটা। সে পাতার আড়ালে একটা ডালের ওপর বসে রাকা আর পিদিমকে দেখছিল।
রাকা অশথতলার ঝিঁঝি-ডাকা অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলল, জায়গাটা বেশ। আমি কিন্তু এখন থেকে এখানেই থাকব পিদিম।
পিদিম ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে গুঁড়ির ওপর উঠে বসে দুহাতটা ঝেরে নিয়ে ভারি অবাক হয়ে জানতে চাইল, কেন, তুমি এখন থেকে এখানে থাকবে কেন?
রাকাও তখন খানিকটা উড়ে পিদিমের পাশে বসল। অবাক হয়েই পিদিম রাকার উড়াল দেখল। আর আবছা অন্ধকারে মিষ্টি একটা গন্ধও ছড়িয়েছে। পিদিম ভাবল, রাকা একটা নীল পরি। নীল পরিদের গায়ে বুঝি মিষ্টি গন্ধ থাকে। ভারি অদ্ভুত তো!
পিদিমের পাশে বসেই গলায় অভিমানী সুর ফুটিয়ে রাকা বলল, জান তো পিদিম, আমরা হলাম গিয়ে পরি। পরির দেশ থেকেই আমরা এসেছি । একটু পরই অন্য পরিরা সব পরির দেশে চলে যাবে। আমি কিন্তু যাব না।
একটা পাজি মশা পিদিমের ঠিক নাকের ওপর বিনবিন - বিনবিন করছিল। ডান হাতের একটা ঝাপটায় মশাটাকে তাড়িয়ে দিয়ে পিদিম এবার যেন খানিকটা অধৈর্য্য হয়েই বলল, আহা, আমি তো সেটাই জানতে চাচ্ছি রাকা। তুমি আর পরির দেশে যাবে না কেন, আর এখানেই বা থাকতে চাচ্ছ কেন তুমি?
রাকা তখন পিদিমকে সবকথা খুলে বলল। রাকা দুধ খায়নি বলে কেমন করে ওর আম্মু বকাঝকা করল । অবশ্য একটু বানিয়েই বলল। যেমন, রাকার মা নাকি রাকাকে “মুখপুড়ি” বলেছে। আসলে রাকার মা রাকাকে মোটেও “মুখপুড়ি” বলেননি। কথাটা রাকা একটু বানিয়েই বলল পিদিমকে।
রাকার মুখে সব বৃত্তান্ত শুনেটুনে তখন পিদিম ভীষণই সিরিয়াস হয়ে বলল, ঠিক আছে রাকা। তুমি মোটেও ঘাবড়িও না । আমিও শহর থেকেই পালিয়ে এসেছি কিনা। তবে এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি আর শান্ত। এখন থেকে আমরা তা হলে বন্ধু, কী বল?
হ্যাঁ, তাইতো। রাকা মাথা নেড়ে বলল।
পিদিম ওর নাকের ওপর এসে পড়া আরেকটা মশা তাড়িয়ে বলল, এখন থেকে আমরা তা হলে এই গাছেই থাকব, কী বল। তা হলে কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না।
রাকা চারদিকের অন্ধকার-অন্ধকার ডালপালার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, এই গাছটায় আর কেউ থাকে না পিদিম? না, তুমি একাই থাক?
না না। পিদিম হাত নেড়ে বলল, এই গাছে আমি ছাড়াও থাকে কুটুস নামে একটা কাঠবেড়ালী, চিরি নামে একটা ফিঙ্গে পাখি, লালসারি নামে পিঁপড়ের দল, ভূতুম নামে একটা কাছিম আর গড়ান নামে একটা দাঁড়কাক।
রাকা চোখ বড় বড় করে বলল, ওরে বাবা এতকিছু। বলে, তাপরপর জিগ্যেস করল, সবাই তোমার বন্ধু?
পিদিম মাথা দুলিয়ে বলল, হ্যাঁ।
রাকা চারদিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ওরা এখন কোথায়?
পিদিম বলল, রাত্রি বলে ঘুমিয়ে আছে সব।
কথা বলতে বলতে অল্প অল্প ঘুম পাচ্ছিল রাকার । ও হাই তুলে বলল, ওরা আমার সঙ্গে মিশবে তো? আমি আবার একটু লাজুক কিনা।
পিদিম অভয় দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, মিশবে না মানে, একশোবার মিশবে। তুমি সাই হলেও ওরা তো সাই নাও হতে পারে। কাল ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব, হ্যাঁ।
রাকা হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠিক আছে। তাই দিও। কিন্তু এখন আমার ঘুম পেয়েছে, তার কী হবে।
ভূতেদের অবশ্য এত সকাল-সকাল ঘুম ধরে না। আজ রাকার সঙ্গে পরিচয় হল বলেই কিনা কে জানে পিদিমেরও হাই উঠতে লাগল ঘনঘন । ও বলল, আমারও একটু একটু ঘুম পেয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে রাকা।
রাকা খুশি হয়ে বলল, চল, তা হলে চল ঘুমাই।
চল। পিদিম বলল।
একটু পর ওরা দুজনে অশথ গাছের একটা মোটা ডালের ওপরে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অশথ গাছটার পাতার আড়ালে বসে থেকে গড়ান নামের দাঁড়কাকটা পিদিম আর রাকার কথাবার্তা সবই শুনছিল। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে গম্ভীরভাবে কয়েকবার মাথা নাড়ল গড়ান ।
আর ততক্ষনে অথশতলার অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাকও বেশ তীব্র আর ঘন হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে ঝিলিমিলি নদীর ওপারের তালবন থেকে এক দমকা শীতল হাওয়া বয়ে এসে অশথ গাছটার ডালপালা কাঁপিয়ে দিল সরসর করে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করল রাকা । স্বপ্নটা ভারি সুন্দর হবে বলেই মনে হল । সবুজ গাছপালায় ভরতি রানবাড়ির সুন্দর বাগানটার ঠিক মাঝমধ্যিখানে ফোয়ারার ধারে শ্বেত পাথরের একটা বেদিতে বসে রয়েছে ও। একা। বাগানে যে কত রকমের ফুলের ফলের গাছ। আর মাথার ওপরে আকাশটা তো নীলবর্ণের হয়েই ছিল। আর সে আকাশ থেকে সোনা রোদ ঝরে ঝরে পড়ে সবদিক আলোয় ভেসে অপরুপ হয়ে ছিল। সেই সঙ্গে মিষ্টি বাতাসও বইছিল। নানা বর্নের ফুলের গাছে গাছে মউমাছিরা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল। ফুলের গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। পাখিরাও ডাকাডাকি করছিল।
এই জন্যই স্বপ্নটা ভারি সুন্দর হবে বলেই মনে হল রাকার।
দূরে সিংহদুয়ারের কাছে রানবাড়ির দারোয়ান পবনবাবু রঙচঙা উর্দি পরে পায়চারি করছিল; ওখানেই তো সে দিন নেই রাত নেই দাঁড়িয়ে থাকে কিংবা পায়চারি করে। পবনবাবু ইয়া দশাশই চেহারা, এর ওপর ইয়া বড় একটা মোচ নাকের নীচে ঝুলছে, হাতে একটা মুগুর, ভারি কটমট করে তাকায়, রাকার খানিক ভয়ই লাগে অবশ্য সেকথা মুখে কখনও স্বীকার করে না রাকা।
তো বাগানটার ঠিক মাঝমধ্যিখানে ফোয়ারার ধারে শ্বেত পাথরের একটা বেদিতে বসে একা একা বসে রঙ্গন ফুলের মালা গাঁথছিল রাকা। মনে রেখ কিন্তু, রঙ্গন ফুলটা যেমন পৃথিবীতে ফোটে, তেমনি পরির দেশেও ফোটে ।
সে যাই হোক, দূর থেকে সবুজ পরিকে আসতে দেখা গেল। রাকা মুখ তুলে তাকাল। সবুজ পরি আজ চকোলেট কালারের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। তাই ওকে ভারি সুন্দরই দেখাচ্ছিল। সবুজ পরি রাকার কাছে এসে বলল, ভাই নীল পরি, আমাকে এক্ষুনি একটা ছড়া লিখে দে না।
রাকা পালটা প্রশ্ন করল, কেন রে সবুজ? আমায় এক্ষুনি ছড়া লিখতে হবে কেন?
সবুজ পরি বলল, কাল তো হলুদ পরির জন্মদিন, তাই। নতুন একটা গান করে কাল ওর জন্মদিনে ওকে গানটা শুনিয়ে সারপ্রাইস দেব।
রাকা মাথা নেড়ে বলল, না রে আনিলা, আমি এখন ছড়া লিখতে পারব না। আমার মাথায় এখন ছড়া আসছে না।
হ্যাঁ, সবুজ পরির নাম আনিলা। আনিলা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কেন রে রাকা তোর মায় এখন ছড়া আসছে না কেন?
রাকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমি কি জানি কেন আমার মাথায় ছড়া আসছে না।
আনিলা তখন বলল, তবু একটু ভাবতে চেষ্টা কর না ভাই। আমাদের মধ্যে একমাত্র তুই তো ছড়া লিখতে পারিস। ইস, আমার কত ইচ্ছে ছিল কাল হলুদ পরিকে সারপ্রাইস দেব।
এত করে যখন বলছে তখন তো ছড়া একটা লিখে দিতেই হয়। এই কথাটা ভেবে নাক টানল রাকা । আজ সকাল থেকে নাকের ভিতরে সামান্য সর্দি সর্দি ভাব। নিয়ে রাকা বলতে লাগল:
হলুদ পরি, হলুদ পরি
পাচ্ছে না টের সুড়সুড়ি,
হলুদ পরির মনটা ভালো
ওই দ্যাখো ভাই ফুটছে আলো।
আনিলা অসম্ভব খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে বলল, বাহ্, খুব ভালো হয়েছে রে রাকা।
রাকা লজ্জ্বা পেল। ও হেসে বলল, দূর, মোটেও ভালো হয়নি।
আনিলা ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, না না, সতি বলছি, দারুন ভালো হয়েছে। তিন সত্যি। হলুদ পরির মনটা ভালো / ওই দ্যাখো ভাই ফুটছে আলো। বাহঃ, কী সুন্দর। আফসানা খুশিতে মরে যাবে। আমি এখন যাই রে রাকা। ল্যাপটপে ছড়াটা তুলে নিই, তারপর প্রিন্ট করে পিয়ানোর সামনে বসে সুর বসাতে চেষ্টা করি। হাতে একদমই সময় নেই, ইস্, কী যে হবে।
এই কথা বলে আনিলা হন হন করে হেঁটে প্রাসাদের ওদিকে চলে গেল।
আনিলা চলে যেতেই রাকা আবার রঙ্গন ফুলের মালা গাঁথায় মন দিল । ঝুড়িভরতি ফুল। এই বেতের ঝুড়িটা মা ওকে গত জন্মদিনে গিফট করেছে। রাকার জন্মদিন দশ জুলাই। ইস্, ফুলগুলি এত সুন্দর ...
এত সুন্দর ফুল কই পেলে রাকা ? বলতে বলতে হলুদ রঙের সূর্যমুখীর ঝারটার ওপাশ থেকে রাকার সামনে এসে দাঁড়াল পিদিম।
ওমাঃ, পিদিম তুমি? এখানে কী করে এলে? বলে রাকা উঠে দাঁড়াল। ভারি অবাক হয়ে গেছে রাকা।
হাত তুলে নীলবর্ণের আকাশটা দেখিয়ে পিদিম বলল, সবাই যেভাবে আসে, ওই আকাশপথ দিয়ে। বলে মিহিন ঘাসের ওপর পা গুটিয়ে বসে পড়ল পিদিম । বসেই বলল, এই রাকা, আমার না ভীষন খিদে পেয়েছে। ইস, পরির দেশ এতদূর জানলে এক ঠোঙা কাসুন্দি দেওয়া ঝালমুড়ি নিয়ে আসতাম। সকাল আমায় কিছু খাওয়া না । তোদের দেশে এই প্রথম এলাম। আমায় না খাইয়ে রাখবি?
পিদিমের কথা শুনে রাকা মিটমিট করে হাসছিল। এবার বলল, আহা কী খাবে তাই বল না, এত গিট্টু মারছ কেন?
পিদিম গম্ভীর হয়ে বলল, যা খাওয়াবে। আমি হলাম অতিথি। কী খাব না খাব অতিথিদের তা বলার নিয়ম নেই। তবে রসগোল্লা হলে ভালো হয়, আবার আবার রসগোল্লা খেতে ভালো লাগে কি না তাই।
আচ্ছা, ঠিক আছে তুমি এখানে একটুখানি বস, আমি তোমার জন্য এক্ষুনি খাবার নিয়ে আসছি।
আচ্ছা।
আমার মোটেও দেরি হবে না কিন্তু। বলতে বলতে রাকা রঙ্গন ফুলগুলি ঝুড়িতে রেখে প্রাসাদের সিঁড়ির কাছে চলে এল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রাকা ঘুরে একবার দেখল পিদিমটা ঘাসের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। রাকার হাসি পেল। পিদিমটা কী মজা করেই না বলল, আমি হলাম অতিথি। কী খাব না খাবো অতিথিদের তা বলার নিয়ম নেই।
দেখা গেল বাগান থেকে প্রাসাদের যে সিঁড়িটা উঠে গেছে তার রং সাদা। দুপাশে সোনার তৈরি অদ্ভূত অদ্ভূত জন্তুর সব মূর্তি। যেমন একটা সোনার তৈরি ঘোড়ার পিঠে ডানা লাগানো। সিঁড়ির দিয়ে উঠলে সাদা দেওয়াল ঘেরা লাল রঙের মেঝের বড় একটা প্রাঙ্গন। সকাল বেলাকার রোদে ডুবে রয়েছে। সাদা দেওয়াল কালো রঙের সিঁড়ি আঁকা ওখান দিয়েই যেতে হয় দোতলায়। এই মুহুর্তে প্রাঙ্গনে কেউ নেই। মেঝের ওপর রোদের ভিতর কেবল মু আড়মোড়া ভাঙ্গছে। মু হল বাদামি রঙের একটা বেড়াল; ওই মু নামের বেড়ালটা রাকার দিদিমা মমতাময়ীর। রাকার দিদিমা মমতাময়ী খুব ভালো, নীল চোখ আর দারুন ফরসা গায়ের রং রোজ রাতে ঘুবোবার আগে কত যে গল্প বলেন রাকাকে। রাকা শুনেছে দিদিমা নাকি চাঁদের বুড়ির কী রকম আত্মীয় হন।
রাকা ডান দিকে ঘুরর। প্রাসাদের কিচেনটা ও দিকেই কিনা। বড় একটা বারান্দা মতন, দিকটা খোলা, বাগান চোখে পড়ে। সেখান থেকে অনেক আলো এসে পড়েছে। বারান্দার মেঝেটা সাদা পাথরের; মাঝে-মাঝে কালো নকশা। সকাল বেলায় মেঝের ওপর সর্ষে দানা ছিটিয়ে দিয়েছে সচেতন নামে বুড়ো মালি। কালোসাদা পায়রাগুলি তাই খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে এখন।
পরিরানির কঠিন নির্দেশ; পরিরাজ্যে একটি প্রাণিও যেন না খেয়ে থাকে।
এবার বাঁয়ে ঘুরল রাকা । সামনে ঘুঙ্গুরঘর। এই ঘুঙ্গুরঘরটা আসলে নাচ শেখার ঘর। কাচের ঘরটা এখন ফাঁকা। ওস্তাদজীর নাম নৃত্যরতন রায়। তিনি আসবেন বিকেলে। তখন রাকাও নাচের তালিম নেবে।
ঘুঙ্গুরঘরটা পেরিয়ে গেলেই সুইমিংপুলঅলা বিশাল স্নানঘর।
স্নানঘরের চারপাশে কাচে-ঘেরা আর মাথার ওপরে ছাদটাও কাচের; সুইচ টিপে সরানো যায়। তখন বৃষ্টি এলে ভেজা যায়। বাগানেও অবশ্য বৃষ্টিতে ভেজা যায়। তবে বৃষ্টির সময় বাগানের ব্যঙেরা বড্ড বেশি লাফালাফি করে।
স্নানঘরে ব্যাঙেদের উৎপাত নেই।
স্নানঘরটা পেরিয়ে যেতে যেতে রাকা ভাবল, ইস, সাংঘাতিক একটা ভুল হয়ে গেল। পিদিমকে বাগানে না-বসিয়ে রেখে প্রাসাদের ভিতরে এনেই বসানো উচিত ছিল। ও কী ভাববে। ভাববে, আমরা পরিরা এটিকেট-ম্যানারস্ জানি না। ছিঃ। কত বড় ভুল হয়ে গেল। আচ্ছা, আমি না-হয় পরে পিদিমের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব । এখন দেখি ওকে কী খেতে দেওয়া যায়।
ভাবতে ভাবতে কিচেনের সামনে চলে এল রাকা।
কিচেনের দরজাটা হলুদ রঙের প্লাসটিকের । দরজার গায়ে বড় বড় করে কালো অক্ষরে লেখা: বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেদ! । রানবাড়ির হেড বাবুর্চি ভোলা মিঞাই কথাটা লিখে রেখেছে । বলা বাহুল্য লোকটা ভীষন মজার। রাকার সঙ্গে ভোলা মিঞার দারুন খাতির। ভোলা মিঞা রাকাকেই সবচে বেশি ভালোবাসে । সুতরাং কিচেনে ঢোকার জন্য রাকার অনুমতি প্রয়োজন হয় না।
রাকা দরজা ঠেলে কিচেনের ভিতরে ঢুকল।
ভোলা মিঞা যথারীতি মাথায় সাদা রঙের কিচেন-পোশাক আর টুপি পরে ছিল। পেয়াজ কাটছিল। হাতে একটা চকচকে ছুড়ি। ভোলা মিঞা লোকটা ভীষন শুকনো আর দারুন লম্বা একটা মানুষ।
দরজায় ক্যাচ করে শব্দ হতেই মুখ তুলে রাকাকে দেখল ভোলা মিঞা। হেসে বলল, গুড মরনিং, রাকাসোনা।
মরনিং, ভোলা কাকা। রাকা বলল। তারপর বলল, এখন বল ভোলা কাকা কি কি খাবার আছে তোমার ভাঁড়ারে?
ভোলা মিঞা গম্ভীর হয়ে বলল, রাকামণি, এখন তো পূর্বাহ্ণ। তাই এখনও রান্না হয়নি।
রাকা মুখচোখ কুচঁকে বলল, পূর্বাহ্ণ মানে কী। উফ, তুমি এত কঠিন কঠিন কথা বল না।
ভোলা মিঞা বলল, পূর্বাহ্ণ মানে, সকালের শেষ কিন্তু তখনও দুপুর ঠিক শুরু হয়নি ।
বুঝেছি।
কিচেনটা বেশ বড়। এক কোণায় একটা মেরুন রঙের নো-ফ্রস্ট স্যামসঙ ফ্রিজ। রাকা ফ্রিজের কাছে গিয়ে ফ্রিজের দরজাটা খুলল। এক ঝলক ঠান্ডা ধোঁওয়া বেরুল। ফ্রিজের ভিতরে তেমন কিছু নেই। কেবল কুমড়ার একটা ফলি, দুটো লেবু, একটা ঢেঁড়শ আর একটা ক্যান প্রাণের অরেঞ্জ জুস পড়ে আছে। না, একটা আইসক্রিমের নীল বাক্সও দেখা যাচ্ছে। বাস্কটা খুলল রাকা। অনেক কটা রসগোল্লা। ফাইন। এই নিয়ে যাই। আর অরেঞ্জ জুসটা।
আজ বাজার করনি ভোলা মিঞা?
ভোলা মিঞার পেয়াজ কাটা শেষ। কিচেনের কলটা ছাড়তে ছাড়তে বলল, মেরুন বজারে গেছে, এখনও ফেরেনি।
মেরুন হল ভোলা মিঞার সাগরেদ। অল্প বয়েসি একটা ছেলে। রান্নাবান্নার তালিম নিচ্ছে। বড় হয়ে সে-ই তো হেড বাবুর্চি হবে।
রাকা একটা রুপোর ট্রে বার করল। একটা প্লেটে রাখল মিষ্টিগুলো । অরেঞ্জ জুসটাও রাখল। রাখার পর জিগ্যেস করল, আজ কী রাঁধবে ভোলা কাকা?
ভোলা মিঞা বলল, বাঁধাকপি দিয়ে কুচোচিংরি আর ঝিকিমিকি নদীর বোয়াল। বোয়াল না-পেলে মেরুনকে চিতল মাছ আনতে বলেছি, ভেজে দেব। আজ মধু ময়রা বলেছে দই দিয়ে যাবে। দিয়ে গেলে খেও। আর নীলবর্নের পাহাড়ের মধু তো রয়েছেই, খেও তাও পনিরের সঙ্গে ।
রাকা বলল, আচ্ছা, ভালো করে রেঁধ। আজ আমার এক বন্ধু খাবে দুপুরে।
ভোলা মিঞা কল বন্ধ করতে করতে বলল, আচ্ছা। রাঁধব। তা তোমার বন্ধুটি কে?
রাকা বলল, ওর নাম পিদিম। পৃথিবীতে থাকে। ও একটা সাদা ভূত।
ভোলা মিঞা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ভালো। খাওয়ার সময পরিচয় করিয়ে দিয়ো না হয়। আমি জীবনে কখনও সাদা ভূত দেখিনি।
দেব। বলে রাকা ট্রেটা নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল।
পিদিম শুয়ে ছিল। রাকা ট্রেটা এনে রাখাল পিদিমের সামনে। পে¬টভরতি রসগোল্লা দেখে তড়াক করে সিদে হয়ে বসল পিদিম। বসেই একটা রসগোল্লা মুখে পুড়ে বলল, তুমি কী করে জানলে ভাই আমি রসগোল্লা খেতে ভালোবাসি?
রাকা ওর পাশে বসতে বসতে বলল, আমি তো জানি না তুমি রসগোল্লা খেতে ভালোবাস। রান্নাঘরে দেখি রসগোল্লা ছাড়া আর কিছু নেই, তাই রসগোল্লাই নিয়ে এলাম।
পরির দেশের রসগোল্লা বড় খাসা রে রাকা। বলে আরও দুটো মুখে পুরে দিল পিদিম।
রাকা হেসে বলল, হবে না। রসের হাঁড়ি দোকানের তো তাই।
রসগোল্লা খেতে পেয়ে পিদিমের মুড ভালোই ছিল। তাই সে পরম আহলাদে জিগ্যেস করল, রসের হাঁড়ি আবার কী গো।
রাকা বলল, রসের হাঁড়ি হল একটা মিষ্টির দোকানের নাম। দোকানটা পান্তুয়া পাড়ায়, সন্দেশ পল্লির পাশে, দইপাড়ার পাশ দিয়ে যেতে হয়।
পান্তুয়া পাড়া মানে? পিদিম আরও অবাক হয়ে বলল।
রাকা বলল, আহা মিষ্টির দোকানগুলি তো সব ওখানেই, মানে পান্তুয়া পাড়ায়, তুমি কিছুই জান না।
পিদিম বলল দাঁতে জিভ কেটে বলল, নতুন এসেছি তো। আস্তে আস্তে সবই জেনে যাব। তা অরেঞ্জ জুসটা তুমিই খেও। আমি খাব না।
রাকা হাত নেড়ে বলল, না না আমি জুস খাই না। আমার জুস খেতে তেতো লাগে।
তেতো না তিতো না বল তিতা। পিদিম শুধরে দিল।
রাকা বলল, আমাদের দেশে আমরা তিতেকে তেতোই বলি ভাই।
আঙুলের রস চাটতে চাটতে পিদিম বলল, পৃথিবীতে তিতে বলে বা তিতা বলে।
রাকা একটু রাগ করেই বলে ফেলল, এটা পৃথিবী নয় ভাই। এটা হল পরিরাজ্য।
জানি। আর আমি পরিরাজ্যে বেড়াতে এসেছি। আমায় তুমি ফ্রিজের রসগোলা ...না না পান্তুয়া পাড়ার রসগোলা খাওয়াচ্ছ আর আমিও সব চেটেপুটে খাচ্ছি। বলে পিদিম আরও দুটো রসগোল্লা মুখের ভিতর দিয়ে পেটের ভিতরে চালান করে দিল।
দোতলার ঝুলবারান্দায় রাকার মা, মানে পরিরানিকে দেখা গেল। তিনি বললেন, কে এসেছে রে রাকা? কার সঙ্গে বসে কথা কইছিস?
রাকা মুখ তুলে সামান্য চেঁচিয়ে বলল, এ আমার বন্ধু মা। এর নাম হল পিদিম। পৃথিবী থেকে এসেছে, বেড়াতে।
ও। তা, ওকে বলিস দুপুরে ভাত খেয়ে যেতে । এই পিদিম, তুমি দুপুরে আমাদেন সঙ্গে খেও কিন্তু।
আচ্ছা, মাসিমা তাই খাব।
রাকা আদুরে গলায় বলল, মা, তা হলে তুমি ভোলা মিঞাকে ঝিকিমিকি নদীর চিতল মাছের পোলাও রাঁধতে বলো, বাদামি বাদাম দিয়ে। কিচেনে গিয়ে দেখলাম, ভোলা মিঞা কী সব ঝিঙে দিয়ে চিংড়ির চচ্চড়ি রাঁধার প্ল্যান করছে। মনে হচ্ছে মাছের ডিম দিয়ে করলাও রাঁধবে।
পরিরানি হেসে বললেন, আচ্ছা, তুমি অত ভাবিস নে। আমি ভোলা মিঞাকে যা বলার বলছি। বলে হাসতে হাসতেই রানিমা ওপাশে চলে গেলেন।
পরিরানি চলে যেতেই পিদিম জানতে চাইল, উনি কে রে? সাত সকালে এত সেজে রয়েছেন?
রাকা জিগ্যেস করল, যাকে এই মাত্র দোতলার বারান্দায় দেখা গেল?
হ্যাঁ।
রাকা বলল, উনিই আমার মা হন।
আমায় যিনি খেয়ে যেতে বললেন। আর আমিও বললাম, আচ্ছা, মাসিমা তাই খাব।
হ্যাঁ।
ও। দুপুরে তা হলে আমাকে পোলাও খাওয়াবে রাকা?
হ্যাঁ। ঝিকিমিকি নদীর চিতল মাছের চিতলপোলাও।
পিদিম বলল, আমি ইলিশপোলাও খেতে ভালোবাসি। চিতলপোলাওয়ের নাম জীবনে আমি শুনিনি।
রাকা বলল, আমিও ইলিশপোলাওয়ের নাম জীবনে শুনিনি ভাই।
পিদিম বলল, ইলিশ হল এক ধরনের মাছ। নদীতে হয়। সকালবেলায় শান্তিনগর বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। অবশ্য মাছগুলি শান্তিনগর বাজারে কী করে আসে তা অনেক ভেবেও আমি বার করতে পারিনি।
রাকা বলল, ও, ইলিশ তাহলে হল গিয়ে মাছ, আমি ভাবলাম কী না কী, বাদাম বুঝি।
পিদিম হাত নেড়ে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে বলল, না না ইলিশ মোটেও বাদামের মতন তো নয়।
এবার বুঝেছি। ইলিশ হল গিয়ে মাছ।
পিদিমের সবগুলি রসগোল্লা খাওয়া শেষ। ও অরেঞ্জ জুস দিয়ে হাত ধুয়ে নিল। রাকা হাসি চেপে ওকে একটা নীল রঙের টিস্যুপেপার বার করে দিল। পিদিম হাত মুছে নিল।
রাকা বলল, পিদিম তুমি তো পরির দেশে প্রথম এলে না তাই না?
পিদিম বলল, হ্যাঁ, তাই তো।
রাকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তা হলে চল, তোমায় আমি আমাদের দেশটা ঘুরিয়ে দেখাই। আমরা অবশ্য দুপুরের আগেই ফিরে আসব। আশা করি ততক্ষনে চিতলপোলাউ রান্না হয়ে যাবে।
পিদিম খুশি হয়ে বলল, আমরা মজা করে খাব।
হ্যাঁ। এখন চল।
বলে ফোয়ারার ওপাশে হাঁটতে লাগল রাকা। এখানে ঘন ঝোপ। মাঝখানে পাথর বিছান পথ। ঝোপটা পেরিয়ে গেল রাকা । পিদিম ওকে লক্ষ্মী ছেলের মতন অনুসরন করল। দেখা গেল একটা বড় একটা ঝাঁকড়া শিমুল গাছ। আর শিমুল গাছের তলায় একটা সোনার রথ দাঁড়িয়ে। সাদা রঙের চারটে দারুন হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া । একটা ঘোড়া রাকাকে দেখেই চিহি হি করে ডেকে উঠল। রাকা হাসল। পিদিম দেখল রথের ওপর লাল রঙের জোব্বা পরে ভীষনই থুরথুরে এক বুড়ো বসে । ধবধবে সাদা দাঁড়ি আর ভীষনই ফর্সা চেহারা। রাকাকে দেখেই বুড়ো বলল, গুড মরনিঙ রাকাসোনা।
রাকা বলল, গুড মরনিং সারথী দাদু।
পিদিমও বলল, গুড মরনিং সারথী দাদু।
গুডমরনিং।
ওরা রথে উঠে বসল রথটা দুলে উঠল। একটা ঘোড়া চিহি হি করে ডেকে উঠল। পিদিম ফিসফিস করে জানতে চাইল, সারথী বুড়োর নাম কি রে রাকা?
আন্দালিব।
কোথায় যাবে গো মা? সারথী বুড়ো আন্দালিব জিগ্যেস করল।
রাকা বলল, কোথাও না সারথীদাদু। এমনি এমনি চল কত ক্ষন। আমার এই বন্ধুটাকে পরির দেশটা দেখিয়ে আনি। ও এর আগে কখনও আসেনি তো তাই।
আচ্ছা, বেশ। তাই হবে । বলে সারথী বুড়ো রথটা ঘুরিয়ে নিল।
রথটা চলতে শুরু করলেই রাকা বলল, জান পিদিম, এই রথটার না অনেক বয়স।
কত? পিদিম বলল।
রাকা সামান্য ভেবে বলল, কম করে সাতশো বছর তো হবেই। আর সারথীবুড়োর বয়সও সাড়ে সাতশ বছরের কম না।
কে বলল?
মা।