মাহজাবীন বলে, পুকুরের পানি বেশি সবুজ হওয়া মাছের জন্য খারাপ। সার দিতে হবে কিনা তা আপনি সহজেই পরীক্ষা করতে পারেন। পানিতে হাত ডুবিয়ে দেখুন যে পানির ওপর থেকে নখ দেখা যাচ্ছে কিনা। কনুই পর্যন্ত হাত ডোবানোর পরও যদি নখ দেখা না যায় তবে বুঝবেন যে সার দেবার দরকার আছে।
গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলায় রাতৈল গ্রাম । রাতৈল এক্সপেরিমেন্টাল প্রণ হ্যাচারী প্রজেক্ট এর কো-অর্ডিনেটর মাহজাবীন আমিন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়াশো শেষ করে থিসিসের জন্য এখন রাতৈল গ্রামে ফিল্ড ওয়ার্ক করছে।
ছবির মতন সুন্দর গ্রাম রাতৈল । দক্ষিণে সুন্দর ও মনোরম মধুমতি নদী। সে নদীর পাড়ে থরে থরে সাজানো সবুজ। সেই সঙ্গে উপড়ি পাওনা অটুট নির্জনতা আর দূষন মুক্ত বাতাস।
মাহজাবীন এর মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়।
আজ দুপুরে মাঠ থেকে ফিরতেই মোবাইল বাজল। মাহমুদ। নার্ভাস বোধ করল মাহজাবীন । ধরবে কিনা বুঝতে পারল না। তারপর সমস্ত দ্বিধাদ্বন্ধ কাটিয়ে বলল, হ্যালো।
কী ব্যাপার ফোন বন্ধ কেন?
মাত্র ফিল্ড থেকে ফিরলাম । মোবাইল ব্যাগের ভিতরে ছিল।
তুমি আর ক’দিন ওসব অজ পাড়াগাঁয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াবে? ঘর সংসার কি করবে না?
আমি আমার থিসিস-এর কাজে এখানে এসেছি মাহমুদ। ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি না তো।
থিসিস-টিসিস আমার দরকার নাই ইডিয়েট মেয়ে! আমার দরকার ঘরের বউ।
মাহজাবীন চুপ করে থাকে।
মার শরীর ভালো না। তুমি থিসিস-টিসিস বাদ দিয়ে আজই ফিরে এসো।
আমার ফিরতে দেরি হবে। কথাটা বলার সময় মাহজাবীনের কন্ঠস্বর কাঁপছিল।
মাহমুদ অশোভন ভাষার একটা গালি দিল।
মোবাইল অফ করে দেয় মাহজাবীন।
থরথর করে কাঁপছে।
এভাবেই রাতৈল গ্রামের মনোরম পরিবেশে প্রচন্ড মানসিক উদ্বেগের ভিতর গ্রামের গলদা চিংড়ি চাষীদের শিখিয়ে পড়িয়ে মাহজাবীন-এর দিনগুলি কাটছিল ।
মাহজাবীন যে ঘরটিতে থাকে তার ঠিক পিছনেই একটি উঠান। পরিচ্ছন্ন ভাবে লেপা মাটির উঠানটি নারকেল গাছে ঘেরা। উঠান ঘিরে কয়েকটি মাটির ঘর। ওসব ঘরে মতুয়ারা বাস করে। এরা লোক স¤প্রদায়। এদের ধর্মগুরুর নাম হরিচাঁদ ঠাকুর; হরিচাঁদ ঠাকুর এর জন্ম ওরাকান্দি। ওরাকান্দি জায়গটা রাতৈল থেকে কয়েক মাইল উত্তর-পুবে। মতুয়ারা প্রতি বুধবার উঠানে জড়ো হয়ে জয়ডঙ্কা কাঁসর ঝাঁঝর শঙ্খ ও শিঙ্গা বাজিয়ে নামকীর্তন করে। এভাবে ওরা হরিস্মরণ করে। একে ওরা হরিসভা বলে।
মতুয়াদের গান-বাজনায় মাহজাবীন বিরক্তই বোধ করে। এমনিতেই ও চশমা পরা গম্ভীর মুখের কম কথা বলা চিন্তায় আচ্ছন্ন একজন মানুষ। নির্বাচিত রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া গান তেমন শোনে না। ওরা ভাবনার অনেকটা জুড়ে থাকে থিসিস-এর বিষয়বস্তু। এম এস সিতে মাহজাবীন এন্টমোলজি (কীটতত্ত্ব) নিয়েছিল যদিও তবে ওর গবেষনার বিষয়বস্তু ফ্রেশওয়াটার বায়োলজি। ওর থিসিস এর শিরোনাম: ‘ফিসারীজ রিসোর্সেস অ্যান্ড অপরটিউনিটিস ইন ফ্রেশওয়াটার ফিশ কালচার ইন বাংলাদেশ।’ যে কারণে ওর এই ঘরটাই ক্ষুদে একটি ল্যাবরেটরি হয়ে উঠেছে। মাহজাবীন-এর সুপারভাইজার অধ্যাপক আহমেদ কবীর। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে নতুন ভাবনার কথা জানায়। অনেক রাত অবধি মাঠ পর্যায়ের পাওয়া তথ্য/উপাত্তগুলি পর্যালোচনা করতে হয়। অধ্যাপক আহমেদ কবীর আগেই লক্ষ করেছেন যে পুকুরে রুই কাতলা মাছের সঙ্গে চিংড়ি চাষ করা যায়। তবে রাতৈল গ্রামে অনেক গলদা চিংড়ি চাষীই যে পুকুরে অন্য কোনও মাছ না-রেখে কেবল চিংড়ি চাষ করে; মাহজাবীন এটা লক্ষ করেছে। পুকুরে কিছু কাতলা ও সিলভার কার্প রাখতেই হবে। না হলে পুকুরের পানি দূষনের সম্ভাবনা থাকে। কেন? এই বিষয়টি নিয়েই এ মাহজাবীন গবেষনা করছে।
এই সব ভাবনার সময় মতুয়াদের নাচগান অস্বস্তিকরই বটে। গানের সঙ্গে জয়ডঙ্কা, কাঁসর-ঝাঁঝর শঙ্খ ও শিঙ্গার তীব্র ধ্বনি- মাহজাবীনের ভুরু তো কুঞ্চিত হয়ে উঠবেই। মাহজাবীন ভাবে ... আসলে এরা কারা? এই মতুয়ারা? এদের নাম গোপালগঞ্জ আসার আগে কখনও শোনেনি। মাহজাবীনের জন্ম ঢাকা শহরে। সে শহরেই বেড়ে ওঠা। গ্রামীণ লোকস¤প্রদায় নিয়ে ঢাকা শহরে কেউ মাথা ঘামায় কি? লোকস¤প্রদায় নিয়ে বইপত্র ছাপা হয় বটে, তবে মুষ্টিমেয় মানুষই তা পড়ে। আসলে গ্রামীণ লোকস¤প্রদায় শহরের মানুষের আলোচনার বিষয়ই নয়। ঢাকা শহরে হরিচাঁদ ঠাকুর এর নাম ক’জন শুনেছে? টিভিতে মতুয়াদের নিয়ে কোনও প্রতিবেদন দেখেছে বলেও মনে হয় না। তাহলে কারা এরা? এই মতুয়ারা? ইসলামে শিয়া ও সুন্নির প্রভেদ আছে। এরা কি তেমনই? মতুয়ারা কি হিন্দুধর্মের কোনও শাখা?
এভাবে প্রশ্নে প্রশ্নে, বিরক্তিতে, দিনভর রাতৈল গ্রামের মাঠে মাঠে, নিবিড় গবেষনায়, বিবাহ সংক্রান্ত উৎকন্ঠায় মাহজাবীনের দিনগুলি কেটে যাচ্ছে।
রাতৈল গ্রামের একজন সম্পন্ন কৃষক আমিন শেখ । ষাট বিঘা ধানী জমি ছাড়াও তার গোটা কয়েক পুকুরও আছে তার । লাভের আশায় পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে । মাহজাবীন আজ আমিন শেখকে বলছিল, আপনি সব সময় মনে রাখবেন চিংড়ি খাবার খায় রাতে, আর দিনে বিশ্রাম করে। এদের বৃদ্ধির জন্য এরা মাঝে মাঝে খোলসা ছাড়ে। এ সময় তারা বেশ অসহায় হয়ে থাকে, কোনও আশ্রয় না পেলে পুকুরের ধারে গিয়ে বসে। তাছাড়া গভীর রাতেও পানির ওপরের দিকে বা পুকুর পাড়ে চলে আসে। পুকুরের ধারে থাকলে ব্যাঙ, পাখি ইত্যাদি এদের সহজেই খেয়ে ফেলতে পারে। এ ছাড়া দূর্বল চিংড়িদের সবল চিংড়িরা আক্রমন করে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই চিংড়ির আশ্রয় ও বিশ্রামের জন্য পুকুরে প্রচুর পরিমান ‘জাগ’ বা ‘ঝাঁকি’ দিতে হয়।
আমিন শেখ মাথা নাড়ে।
রাতৈলসহ আশেপাশের আরও কিছু গ্রামে এক্সপেরিমেন্টাল প্রণ হ্যাচারী প্রজেক্ট রয়েছে। কাশিয়ানী তে মাসে একবার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর দের মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর দের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়। আজ সকালে কাশিয়ানী গিয়েছিল মাহজাবীন। সভায় আজ ‘জেনেটিক অ্যান্ড সাব-সেলুলার ডাইভারসিটি’ প্রসঙ্গে লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করল মাহজাবীন । আসলে এই নিবন্ধটি ওর থিসিস পেপারের ভূমিকা। অন্যান্য কো-অর্ডিনেটরা নিবন্ধের প্রশংসা করল। এবার কেবল সুপারভাইজার অধ্যাপক আহমেদ কবীর এর অনুমোদনের অপেক্ষা।
রাতৈল ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়াল। কাশিয়ানী থেকেই খেয়ে এসেছে। বিছানায় শুয়ে সামান্য বিশ্রাম নিল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙার পর টের পেল ঘর অন্ধকার। কেবল জানালার কাছে এক ফালি শুভ্র আলো। তার মানে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চাঁদও উঠেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছিল । ঝিঁঝিও ডাকছিল।
কীর্তনা এসে ঘরে ঢুকল। ওর হাতে চায়ের কাপ। চমৎকার লেবু চা তৈরি করে কীর্তনা। এই ছাব্বিশ/সাতাশ বছরের মেয়েটিই ওর রান্নাবান্না করে দেয়। কীর্তনা মতুয়া। বছর খানেক হল বিধবা হয়েছে। ওর স্বামী পেশায় ছিল ধীবর- মাছ ধরত মধুমতি নদীতে । একবার ঝড় উঠল ...যা হোক। মতুয়া স¤প্রদায়ে নাকি বিধবা বিবাহ হয়। কীর্তনার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
মাহজাবীন লক্ষ করেছে, কীর্তনা গরীব বিধবা হলেও সব সময় হাসিখুশিই থাকে। যেন কারও বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ বা অভিযোগ নেই ওর। ওদিকে নারী বলেই মাহজাবীন এর মানসিক সঙ্কট টের পায় কীর্তনা । নতুন কিছু রান্না করে খুশি করতে চেষ্টা করে। দিন কয়েক আগে কীর্তনা মাহজাবীন কে বেলে মাছের পাতুরি রেঁখে খাওয়াল। অপূর্ব স্বাদ। মাহজাবীনের মা মাঝে মধ্যে কই মাছের পাতুরি রাঁধলেও কখনও বেলে মাছের পাতুরি রাঁধেন নি- যদিও বেলে মাছ থেকে শুরু করে নারকেল বাটা, সরিষা বাটা, কলাপাতা –প্রায় সব উপকরণই পাওয়া যায় ঢাকায়।
মাহজাবীনের অনুসন্ধানী মন কীর্তনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিল বেলে মাছের পাতুরি রন্ধনপ্রক্রিয়া।
প্রথমে উপকরণ সম্বন্ধে বলল কীর্তনা । অবশ্য ওর মতো করে। মাহজাবীনও ওর মতো করে টুকে নিল সব। ও যা বুঝল তা এই: বেলে মাছ লাগবে ৫০০ গ্রামের মত, নারকেল বাটা ২ টেবিল চামচ, সরিষা বাটা ১ চা চামচ, রসুন বাটা ১ চা চামচ, পেঁয়াজ বাটা ১ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ (মোটা করে কাটা) ১ কাপ, হলুদ গুঁড়ো আধা চা চামচ, মরিচ গুঁড়ো আধা চা চামচ, সরিষার তেল ৪ টেবিল চামচ, লবণ স্বাদমতো, পানি সামান্য। এবার রন্ধনপ্রক্রিয়া। সব উপকরণ একসঙ্গে মেখে আধা ঘন্টার মতো মেরিনেট করে রাখতে হবে । (এই আধা ঘন্টা হয়তো কীর্তনার পর্যবেক্ষনের ফল। কাজেই সময়টা ইম্পরটেন্ট।) বড় এক টুকরো কলাপাতার মাঝখানে তেল মেখে তাতে সব মাছ সাজিয়ে রাখতে হবে। তার পর তাওয়ায় কলাপাতাসহ মাছ দিয়ে মৃদু আঁচে ঢেকে ১০-১৫ মিনিট রান্না করে নিতে হেেব । এক পিঠ ভাজা হলে অন্য একটি নতুন কলাপাতায় তেল মাখতে হবে। একটি প্লেটে মাছগুলো রেখে নতুন কলাপাতা দিয়ে ঢেকে উল্টে দিয়ে তাওয়ায় দিতে হবে । আরও পাঁচ মিনিট মৃদু আঁচে রান্না করে নিতে হবে।ব্যস। মাছ ভাজা হলেই পাতুরি রান্না শেষ।
মাহজাবীন রান্না শিখেই মাকে ফোন করেছিল ঢাকায়।
মা হেসে বলল, আরে শোন। বেলে মাছের পাতুরি আমিও রাঁধতে জানি।
জান!
হ্যাঁ। যদিও আগে কখনও রান্না করা হয় নি । কিন্তু, এ বার তুই ঢাকায় এলে তোকে রেঁধে খাওয়াব।
তুমি আবার কবে বেলে মাছের পাতুরি রাঁধতে শিখলে মা?
শিখেছি বিয়ের পর। আমার শ্বাশুড়ির কাছে । তোরা তখনও হোস নি। ওরা বরগুনার মানুষ। ওদের মতো পাতুরি কেউ করতে পারে না।
মাহজাবীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শ্বাশুড়ির সঙ্গে মায়ের কী সুন্দর অ্যাডজাস্ট হয়েছিল। আমার হল না।
কথা সত্য।
বিয়ের পর থেকেই মাহমুদের মা উঠতে-বসতে মাহজাবীন এর খুঁত ধরে। মাহজাবীনই-বা ছাড়বে কেন? ও ভিকারুন্নেছা নুন স্কুলে পড়ার সময় বির্তকে আগুন ছড়াত। কাজেই কথা সেও শোনায়। মাতৃভক্ত মাহমুদ মহা বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার মতন শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করাই আমার ঠিক হয়নি।
কেন ! অশিক্ষত মেয়ে হলে তোমাদের পিষতে সুবিধা হত না?
মাহমুদ সেদিনই প্রথম মাহজাবীনের গালে থাপ্পড় মেরেছিল ; সম্ভবত মাকে খুশি করতেই । সেই অভিমান আর ক্ষোভ আর দূর হল না। যে কোনও মেয়ে মাহজাবীনের মুখের দিকে একবার তাকালেই বুঝতে পারে। আজ সকালেও কাশিয়ানী বাস্টস্ট্যান্ডে বোরখা পরা একজন মাঝবয়েসি মহিলা ওর মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। এই কীর্তনাও মাহজাবীনের মানসিক সঙ্কট টের পায়। এবং মাহজাবীন কে খুশি রাখতে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কান্ড করে। একদিন দুপুরে আলু ভাজা করেছিল কীর্তনা। খেতে অপূর্ব লাগছিল। খাওয়ার পর কীর্তনা জিগ্যেস করল, ও দিদি, ভাতে লগে কি খাইলেন কন ত?
কেন আলু ভাজি?
কীর্তনা তো হাসতে হাসতে শেষ। পরে হাসি থামিয়ে বলল, কাঁকড়া খাইলেন গো দিদি কাঁকড়া । মালো পাড়ার বলরামের পুকুরের কাঁকড়া।
কি! কাঁকড়া ! মাহজাবীন তো থ। হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না।
কীর্তনার কাছে মতুয়াদের সম্পর্কে অল্প অল্প করে জানছে মাহজাবীন; মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া। হরিনামে যে মেতে থাকে সেই মতুয়া। মতুয়া স¤প্রদায়ে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত। বাল্যবিবাহের তীব্র বিরোধীতা করা হয়। নারীপুরুষ নির্বিশেষে ধর্মের প্রচার করতে পারে। ধর্মপ্রচারককে বলা হয় : ‘গোঁসাই।’ মতুয়াদের প্রতি ওদের ধর্মগুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের বারোটি আদেশ আছে। একে দ্বাদশ আজ্ঞা বলা হয়-যা মতুয়ারা নিত্যদিনের জীবনযাপনে পালন করার চেস্টা করে। হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞার ৩ নং আদেশটি হল : নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে।
কথাটা শুনে সেদিন মাহজাবীনের শরীর কেঁপে উঠেছিল।
ধীরে সুস্থে চা শেষ করল মাহজাবীন। চা খেতে খেতে জেনেটিক অ্যান্ড সাব-সেলুলার ডাইভারসিটি নিয়ে ভাবছিল। ভাবছিল জেনেটিক ডাইভারসিটি তো হতেই পারে, উপরোন্ত জীব বা উদ্ভিদ কোষেরও ডাইভারসিটি হতে পারে যাকে বলা হয় মেটাবলিক পাথওয়েজ কিংবা সেল ফাংশনিং উইদিন আ সেল ...
মাহজাবীনের হঠাৎই মনে পড়ল মোবাইল অফ । মায়ের কথা মনে হতেই অন করল। কিছুক্ষন কথা হল মায়ের সঙ্গে। মা আজ কাঁদল। মাহজাবীনের বড় ভাই পারভেজ মিনোসোটায় থাকে। সদ্য বিধবা মাকে মিনোসোটায় নিয়ে যেতে চায়। মাহজাবীন ওর আসন্ন নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে কেঁপে উঠল। ওর জীবনের সঙ্কট, যা কেউ-ই বোঝে না, একমাত্র মা-ই বোঝে। মাহমুদের আচরণে মা বিস্মিত, ক্ষুব্দ। প্রায়ই মা বলেন, তোর বাবা তো এমন ছিল না। আমাদের বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। তখন আমাদের নতুন সংসার। অভাব ছিল তবে অশান্তি ছিল না। এখন তোদের এত অঢেল আছে, শান্তি নাই কেন রে? তোর বাবাও তো তোর দাদীকে গভীর শ্রদ্ধা করত। কই, তাতে তো কোনও সমস্যা হয়নি।
মাহজাবীন আর কি বলবে। কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মায়ের সঙ্গে কথা বলে ফোনটা অফ করতেই মাহমুদের ফোন এল। এই সব মুহূর্তে বড় নার্ভাস বোধ করে মাহজাবীন । কোনওমতে বলতে পারল, হ্যালো।
এই তোর ফোন বন্ধ ক্যান! কতক্ষণ ধরে ট্রাই করতেছি!
বাইরে থেকে ফিরে ফোন অন করতে মনে ছিল না। আর ...আর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
তুই ইচ্ছে করে মোবাইল অফ রাখছিস । আমার সঙ্গে তোর কথা বলতে ঘেন্না লাগে? না?
না! বিশ্বাস কর।
তোকে আমি বিশ্বাস করব। গ্রামের কোন লাঙের সঙ্গে মিশতেছিস তুই? ঘুমায়া ছিলি ক্যান? সত্যি কথা ক ।
আমি তো সত্যি কথাই বললাম।
খানকি মাগী!
ইউ শাট আপ! চেঁচিয়ে বলে মাহজাবীন ফোন অফ করে দেয়।
সারা থরথর করে শরীর কাঁপছে। বিয়ে হয়েছে দু’বছর। মাহমুদ এর আগেও গালাগাল করেছে। আজও দিল। আজ সব শেষ করে দিল। মাহজাবীন টের পেল ওর কাঁধের নীচে ঘামে ভিজে গেছে। রাগে শরীর কাঁপছে।
মাহমুদের ইচ্ছে মাহজাবীন থিসিস না করে ওর মায়ের বাঁদিগিরি করুক। কিন্তু, তা কি করে সম্ভব! মেয়ে থিসিস করবে-এটা তো মাহজাবীনের বাবার স্বপ্ন। এ কারণেই থিসিস শেষ করার আগে বিয়ের ইচ্ছে ছিল না মাহজাবীন এর। বাবার ডান কিডনিতে ম্যাস (টিউমার) হয়েছিল। ডায়ালেসিস চলছিল ব্যাংককের বামরুমগ্রাদ হসপিটালে। তখনই একদিন কেবিনে শুয়ে থাকা বিপর্যস্ত বাবাকে কথা দিয়েছিল। তাছাড়া তখন মাহমুদ সদ্য অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ শেষ করে একটি বিখ্যাত মালটি-ন্যাশনালে ঢুকেছে। স্মার্ট, সুদর্শন। নাম করা এক সংসদ সদস্যের বোনের ছেলে। বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা করার জন্য এদেশে সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকে। বাবাও ফাঁদে পা দিলেন। তাছাড়া মাহমুদের ব্যাপারে পারভেজ ভাইয়ের সম্মতি ছিল। একসঙ্গে নটরডেমে পড়ত।
মাহজাবীন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।
তারপর উঠে দাঁড়াল।
ওর চিৎকার শুনে কীর্তনা একবার উকিঁ দিয়ে গেল।
ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
উঠান ভর্তি জোছনা। কারা যেন ধূপ জ্বেলেছে। সেই গন্ধ। মধুমতি নদীটিও খুব কাছেই। ওখান থেকে লোনা বাতাস ভেসে এসে উঠানে আছড়ে পড়ছে। উঠন ঘেরা নারকেল পাতায় সরসর শব্দ ওঠে।
উঠানে মতুয়ারা জড়ো হচ্ছে। আজ কি বুধবার? ও জানে একটু পরেই বেজে উঠবে জয়ডঙ্কা, কাঁসর-ঝাঁঝর শঙ্খ ও শিঙ্গা ধ্বনি । সেই সঙ্গে গান ।
এই পূর্ণিমার সন্ধ্যায় মাহজাবীন অবশ বোধ করে।
এবং অপরিচিত আঙিনায় পা রাখে ।
উঠানে মতুয়ারা গাইছে:
হরি ধ্যান হরি জ্ঞান হরি নাম সার।
প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার।
গানের সঙ্গে বাজছে জয়ডঙ্কা, কাঁসর-ঝাঁঝর; কেউ আবার শঙ্খ বাজাচ্ছে, কেউ-বা ফুঁক দিচ্ছে শিঙ্গায় ।
কেউ কেউ ভাবের আবেশে লুটিয়ে পড়ছে।
কীর্তনা কখন যেন উঠানে নেমে এল।
মাহজাবীন-এর হাত ধরল। সুরে সুরে গেয়ে উঠল:
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা/
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।
মাহজাবীন এর কেমন ঘোর লাগে। ও কীর্তনার মতো সুখি হতে চায়। গানের চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে চায়।
কীর্তনা ওকে এক পাক ঘুরিয়ে দেয়। তারপর খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে। কানামাছি খেলার মতো টলতে টলতে উঠানের মাঝখানে চলে আসে মাহজাবীন । ওকে ঘিরে মত্ত মতুয়ারা নাচছে। জয়ডঙ্কা, কাঁসর-ঝাঁঝর এর আওয়াজ মাহজাবীনের করোটির দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। আর কীর্তনা যেন ওর অভ্যন্তরে ঘুমিয়ে থাকা আদিম নৃত্যবোধটিকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে দিতে চায়। শহরের ইটপাথরের ভিতর জন্ম নিয়ে ও যতটা জড়, যতটা নিষ্ক্রয় হয়ে উঠেছে আজ রাতে মধুমতী নদীর পাড়ের এই উঠানে তার চেয়েও বেশি উদ্দাম আর মৃত্তিকালগ্ন হয়ে উঠবে যেন।
মাহজাবীন এর মনে হয় কে যেন ওকে ‘জাগ’ দিচ্ছে । কে যেন ওকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। মাহজাবীন ঘুরে ঘুরে এক অদ্ভূত ভঙ্গিমায় নাচতে থাকে ...যেন সে শরবিদ্ধ এবং জয়ডঙ্কা, কাঁসর-ঝাঁঝর এর তীব্র নিনাদে মুছে যেতে থাকে শহুরে সব মুখোশ-মুখ।
রাত্রির আকাশে মস্ত এক চাঁদ।
উথালপাথাল হাওয়ার ভিতরে সে চাঁদ তার সমস্ত ধবল তরল কিরণ ঢেলে দিচ্ছে দক্ষিণ বাংলার এক অলৌকিক দৃশ্যের ওপর।
তথ্য নির্দেশ:
চিংড়ি চাষ সম্পর্কে তথ্যের উৎস: ড: মাহমুদুল আমীন এর নিবন্ধ ‘সংক্ষেপে গলদা চিংড়ি চাষের নিয়ম।’ ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত প্রফেসর মাহমুদুল আমীন স্মারক গ্রন্থ। )
মতুয়াদের সম্পর্কে তথ্যের উৎস: বাংলাপিডিয়া এবং আমার লেখা একটি পোস্ট: হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা।