গত বছর মার্চ মাসে বেলজিয়াম থেকে একটা পিস্তল কিনেছিলেন আহমেদ আজীজ খান। কোল্ট .থ্রি এইট সুপার, সিঙ্গেল অ্যাকশন; সাধারনত এসব পিস্তলের চেম্বারে ন’টা গুলি থাকে। এ অবধি একটা গুলিও খরচ হয়নি; আজ একটা গুলি খরচ হতে পারে।
ড্রয়ার থেকে কোল্টটা বার করে কোটের পকেটে ভরে নিচে নেমে এলেন আহমেদ আজীজ খান । ন’টার মতো বাজে। একতলার কাচে ঘেরা ডাউনিং কাম লিভিং রুমটি সকালের রোদে ঝলমল করছিল। গত দু’দিন ঘন কুয়াশার ঘের ছিল, আজ কুয়াশা কেটে মনোরম রোদ উঠেছে, বন্দরনগরীটি আজ ঝলমল করে হাসছে। আজ থেকে ৫৮ বছর আগে রাউজান উপজেলার বীনাজুরির একটি গ্রামে আহমেদ আজীজ খান এর জন্ম, সেই জন্মগ্রামের ওপরও নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে কুয়াশাশূন্য রোদ ঝলমল করছে।
লিভিং রুমের কোণে একটা ৫৬ ইঞ্চি প্লাজমা টিভি, লো ভলিউমে অন করা । এটিএন বাংলার সংবাদ চলছে। টিভির কাছে একটা সোফায় বসে আহমেদ আজীজ খান এর মা জয়তুন বিবি ঝিমুচ্ছেন। বৃদ্ধা জয়তুন বিবি দীর্ঘদিন ধরে অবশ। অবশ আর বোধশক্তিহীন। ভাগ্যিস! ব্যাংকের লোকেরা এ বাড়ি ক্রোক করতে এলে বৃদ্ধা টের পাবে না। আহমেদ আজীজ খান ম্লান হাসলেন।
টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখেছে নাজমা । মেয়েটি ড্রাইভার সাত্তারের বউ। অনেক দিন ধরে এ বাড়িতে আছে। বেশ লক্ষ্মী মেয়ে। নাজমার বিরুদ্ধেআহমেদ আজীজ খান -এর স্ত্রী রওশন আরার বিশেষ অভিযোগ নেই। রওশন আরার বোনের ছেলে ইমতিয়াজ-তার বিয়ে। বাড়ির সবাই ঢাকা গেছে। সারা বাড়ি সুনসান করছে। আহমেদ আজীজ খানেরও ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল; কাজ আছে বলে এড়িয়ে গেছেন তিনি।
আহমেদ আজীজ খান সাধারনত সকালের দিকে কিছু না কিছু খান । আজ আর খিদে টের পেলেন না, বরং কাচের ফ্রেঞ্চ উইনডো ঠেলে একতলার রোদ ছড়ানো বাগানে বেরিয়ে এলেন। ছোট্ট বাগানটি বেশ সুন্দর; একপাশে সূর্যমূখির ঝার, অন্য পাশে ছোট্ট একটি নীল জলের সুইমিং পুল; ছেলেমেয়েদের জন্য । ছেলেবেলায় যা যা মিস করেছেন সেসব যেন ছেলেমেয়েরা মিস না করে। শরিকি পুকুরে গোছল করতে নেমে ছেলেবেলায় মেজো চাচার লাথি খেয়েছিল বালক আজীজুল্লাহ। সেই মুহূর্ত থেকে জেদ। কিশোর বয়েসে রাউজান উপজেলার বীনাজুরির একটি অজ গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম শহর। সে শহর বড় নির্মম, বড় কঠিন; শহরে গেঁয়ো উদ্বাস্তু মানুষের কঠিন জীবনসংগ্রাম। বিপদজনক সব বাঁক, অন্ধকার সব পাঁক । বড় এক ভাইয়ের পরামর্শক্রমে আজীজুল্লাহ আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর যায়। আনোয়ারার দক্ষিণে উপকূল। রাতগভীরে বিদেশি পন্য ভর্তি ট্রলার ভিড়ত সে উপকূলে । রাতের অন্ধকারে ট্রলার থেকে মাল খালাস করত কিশোর আজীজুল্লাহ । বড় বিপদজনক সে জীবন, তবে একবার বেশ ভালো লাভ হল। লাভের সে টাকা নিয়ে স্মাগলিং থেকে সরে আসে তরুণ আজীজুল্লাহ । চট্ট্রগ্রাম- রাউজান রুটে বাস নামায়। সেই শুরু ... তিরিশের মধ্যেই মুরাদপুরে দশ কাঠার ওপর সুরম্য দোতলা বাড়িটির নির্মান কাজ শেষ, চল্লিশের মধ্যেই এক্সপেক্ট গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর চেয়ারম্যান; নামটিও ততদিনে বদলে নিয়েছেন। মেজো চাচার মৃত্যুর সময় খবর পেয়েও যাননি । তার আগে মেজ চাচী বিশ হাজার টাকার জন্য পায়ে পরেছেন । ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা আছে বলে এড়িয়ে গেছেন। গত রাতে মেজো চাচাকে স্বপ্নে দেখেছেন । সেই কথা মনে করে এক্সপেক্ট গ্র“প অভ ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ আজীজ খান থমকে দাঁড়ালেন।
সাদা রঙের বি এম ডাবলিউ টা গেটের কাছে পার্ক করা। গাড়ির পাশে সাত্তার দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে সে দিকে এগিয়ে গেলেন আহমেদ আজীজ খান, গাড়িতে উঠে বসলেন; তারপর বললেন, অফিস।
গত রাতে মেজো চাচা স্বপ্নে কী যেন বলছিলেন।
পাত্থর অই বাচি থাই, কী লাভ রে আজীজুল্লাহ! তুই ও আঁর ফোঁয়ারে চলি আই।(পাথর হয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ রে আজীজুল্লাহ! তুই বরং আমার কাছে চলে আয়।)
স্বপ্নে মেজো চাচা কি এমন কিছু বললেন?
সত্যি মেজো চাচা আমি পাথর হয়ে গেছি। অনেক দিন ধরে আমায় কিছু স্পর্শ করে না। তখন কথাটা আমার মনে হয়নি-যখন আমি আঠারো বছর বয়েসে, প্রেমহীন একটা বন্দরনগরে এসে জীবনসংগ্রাম শুরু করি । তখন আমার মনে হয়নি যে জীবনের সমস্ত অর্জনের পর সবই শূন্য ঠেকবে। আমি এখন ভাবি এত প্রতিষ্ঠার কী প্রয়োজন ছিল? এই শহরে আসার কী প্রয়োজন ছিল? শহরটা একটা ফাঁদ; আমি এখন ফাঁদে আটকে ছটফট করছি।
এক্সপেক্ট গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ-এর হেড অফিসের বেজমেন্টে গাড়ি থামল সাত্তার । গাড়ি থেকে নেমে সাত্তারকে একটি চেক দিয়ে আহমেদ আজীজ খান বললেন, ব্যাংক থেকে চেকটা ভাঙ্গিয়ে আন।
জ্বী, স্যার। বলে চলে যায় সাত্তার। ছেলেটা ভারি বিশ্বস্ত । অফিসে কাউকে তেমন বিশ্বাস করতে পারেন না তিনি। বছর কয়েক হল কোম্পানী তেমন লাভের মুখ দেখছে না। ক’ মাস পরপর কর্মচারীদের বেতন আটকে যাচ্ছে। কর্মচারীরা সব ভিতরে ভিতরে ফুঁসে আছে।
অফিসে ঢোকার কিছুক্ষণ পর সেক্রেটারি এসে কফি দিয়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে কফিতে চুমুক দিলেন । তিক্ত তরলটুকু জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল । একটা সিগারেট ধরাবেন কিনা ভাবলেন। ঠিক তখনই ঢাকা থেকে রওশন আরার ফোন এল।...এই শোন, বিয়ের পর ইমতিয়াজরা কক্সবাজারে যেতে চাইছে। তুমি ‘সিলভার বিচ’ এ ওদের জন্য রুমের ব্যবস্থা করে দাও।
ওকে।
এই শোন, ইমতিয়াজের শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের কথা অনেক শুনেছে । ওদের একদিন দাওয়াত করে খাওয়াতে হবে। ওরা কবে না কবে চিটাগাং আসে । র্যাডিসনে পার্টি দিই, কি বল?
ওকে।
এই শোন, আমার সঙ্গে টাকা যা ছিল শেষ। তুমি রিজভীকে দিয়ে আজই কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও।
ওকে।
এই শোন, রুমার জন্মদিন ঢাকায় করতে চাইছে। আমরা এ মাসটা ঢাকায় থেকে তারপর ফিরছি।
ওকে।
উলটো দিকের দেওয়ালে ‘সিলভার বিচ’ হোটেলের একটি পোস্টার। এক্সপেক্ট গ্র“প অভ ইন্ডাস্ট্রিজ এর লেটেস্ট প্রোজেক্ট । নিষ্কন্টক জমি কিনেছিলেন কক্সবাজারের কলাতলিতে। এখন অন্যজন জমির মালিকানা দাবী করেছে। স্থানীয় ষড়যন্ত্র আর কী। মামলা চলছে। তা ছাড়া সি বিচ ঘেঁষে হোটেল নির্মাণ করায় পরিবেশবাদীরা খেপে উঠেছে, আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। আহমেদ আজীজ খান-এর বড় মেয়ে রেহনুমা, রেহনুমাও সে দলে শরিক হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে জয়েন করেছে রেহনুমা- এরা যেমন হয়, ভীষণ পরিবেশ সচেতন। তিরিশ বছর বয়েসে অমানুষিক সংগ্রাম করে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে যে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন-সে বাড়িতে আজ একা হয়ে পড়ছেন আহমেদ আজীজ খান । ব্যাংক লোন নিয়ে শিপব্রেকিং ব্যাবসায় প্রায় কোটি টাকা ইনভেস্ট করার পর রেহনুমার বিক্ষুব্ধ আচরনে গুটিয়ে নিতে হয়েছে সে প্রজেক্ট ।
আহমেদ আজীজ খান এর মাথার ওপর এখন একটি খগড় ঝুলে আছে।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে এল সাত্তার । আহমেদ আজীজ খান পঞ্চাশ হাজার টাকার
বান্ডিল দুটি কোটের পকেটে রেখে বলল, তুমি নিচে যাও। আমি একটু পর আসছি।
সাত্তার চয়ে যায়। ভীষণ অস্থির লাগছে। ঝুঁকে মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে একটা বিশেষ নাম্বারে প্রেস করলেন।
অনেক দিন পর যে? কেমন আছেন? ও প্রান্ত থেকে ফারহানা রহমান জিজ্ঞেস করলেন।
আছি। আপনি কি আজ ফ্রি?
হ্যাঁ। কেন বলুন তো? ভারি মিষ্টি কন্ঠস্বর মহিলার।
আপনি কি গেস্ট হাউজে আসতে পারবেন? আমি অফিস থেকে রওনা হচ্ছি।
ওকে, আসছি। ফারহানা রহমান বললেন।
ফোন অফ করে উঠে দাঁড়ালেন আহমেদ আজীজ খান । একটু পর ফারহানা রহমান এর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে ঈষৎ উত্তেজনা বোধ করছেন একজন পাথর-মানুষ। ফারহানা রহমান হাউজ ওয়াইফ, মেহেদীবাগে থাকে। এ শহরের যে কয়েকজন মহিলা এক্সপেক্ট বাইং হাউজের ফরেন বায়ারদের অন্তরঙ্গ সঙ্গ দেয় ফারহানা রহমান তাদের একজন। মহিলার প্রতি কেমন এক মায়াময় অনুভূতি জন্মে গেছে। ব্যাখ্যাতীত একটা ব্যাপার। অন্তরঙ্গ সম্পর্কের বাইরেও কেমন একটা দায়িত্ববোধ অনুভূত হয়। তাহলে কি একেবারেই পাথর হওয়া যায় না?
নিচে নেমে গাড়িতে উঠে আহমেদ আজীজ খান বললেন, গেস্ট হাউজ।
চারিদিকে ঝলমলে রোদ। রাস্তায় অবশ্য জ্যাম। জ্যামে একটি লাল রঙের ভলবো বাস থেমে আছে। বাসটির গায়ে রুপালি রঙে লেখা: হাইওয়ে। একটা সময় ছিল যখন রাস্তায় নিজের কোম্পানীর বাস দেখলে বুকের ভিতরে আনন্দের বন্যা বইত। হায়, বুকের ভিতরকার নদীটি কবে শুকিয়ে গেছে। আহমেদ আজীজ খান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পরিবহন ব্যবসায় প্রথম প্রথম লাভ হত। এখন তেমন লাভ হয় না বরং লস হয়। নতুন নতুন কোম্পানী ব্যাংক লোন নিয়ে যাত্রীদের বেশি বেশি সুবিধা দিচ্ছে। আহমেদ আজীজ খান-এর আর ব্যাংক লোন নেওয়ার সাহস নেই।
মোবাইল ফোনটা বাজল। মোজাম্মেল হোসেন । লোকটা ডাচ বাংলা ব্যাংক-এর ম্যানেজার ।
হ্যালো ।
আমি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন স্যার ।
জ্বী, জ্বী বলুন।
কাল মিটিংয়ে আসছেন তো স্যার?
বুকের ভিতরে নীরব বিস্ফোরন টের পেলেন আহমেদ আজীজ খান । তবে পাথরের গায়ে বারুদের হলুদ দাগ কাটল না। তিনি বললেন, আসব।
প্লিজ, আসবেন স্যার। আমার চাকরি নিয়া টানাটানি। এই বয়েসে চাকরি গেলে বালবাচ্চা নিয়ে খাব কী। আমার ওপর প্রেসার আছে। লোনটা আমিই স্যাঙকসান করেছিলাম। প্লিজ স্যার স্যার আসবেন ।
আসব। বলে ফোন অফ করে দিলেন আহমেদ আজীজ খান ।
এর আগে মোজাম্মেল হোসেন ফোন দিলেই বুকটা ঢিপ ঢিপ করত। আজ আর কোনওরকম অনুভূতি হচ্ছে না।কোটি টাকার ব্যাংক লোন। অনেক দিন ধরে ঝুলে আছে। দুটি ইন্ডাস্ট্রি বিক্রি করে দিয়েও মিটিগেইট করা যায়নি। চট্টগ্রাম চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ আহমেদ আজীজ খান-এর সমস্যাটি মধ্যস্থতা পারত। ভাগ্য বৈরী- প্রতিষ্ঠানটি দলাদলি করে দু-ভাগ হয়ে গেল। প্রতিপক্ষরা এখন কলকাঠি নাড়ছে। দীর্ঘকাল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ! এরচে বরং ...
গেস্ট হাউজটা বিশ্ব রোডের ওপর। সাদা রংকরা লোহার গেট, ভিতরে পার্কিং স্পেস; লাল রঙের সিরামিক ইঁটের দোতলা দালান। বাইরের দেওয়ালে সবুজ অর্কিডের ঝার। এক্সপেক্ট গ্র“প অভ ইন্ডাস্ট্রিজ দীর্ঘদিন ধরে অ্যাপ্যারল এক্সপোর্ট করছে, গেস্ট হাউজটা তখনই নির্মান করা হয়েছিল। ফরেন বায়াররা এলে এখানেই থাকে, মেয়েদের অন্তরঙ্গ সঙ্গ নেয়। আহমেদ আজীজ খান মাঝেমধ্যে এখানে নিরিবিলি সময় কাটান, মদ পান করেন; বাসায় ওসব করা যায় না। রওশন আরা আজকাল নামাজ ধরেছে।
দোতলায় সুন্দর করে সাজানো একটি রুম তার নিজের । মেঝেতে দু-ইঞ্চি পুরু নীল কার্পেট, দেওয়ালে ঘিয়ে রঙের ডিস্টেম্পার, জানালায় কালো পরদা- এক কোণে বড় একটি তামার বুদ্ধমূর্তি; (এক জার্মান বায়ারের গিফট)। গত বছর মার্চ মাসে বেলজিয়াম থেকে কয়েকটি পেইন্টিংস কিনে এনেছিলেন। উত্তরমূখি দেয়ালে ভেরমেয়ারের আঁকা একটি ছবি ঝুলছে। তার নিচে কালো ভারী সোফা। ঘরের পরদা নামানো। চমৎকার একটি শেডের ওপাশ থেকে ম্লান আলো ছড়াচ্ছে।
সোফায় বসে সিগারেট ধরালেন আহমেদ আজীজ খান । ছেলে মেয়েদের চাপে ছেড়ে দিয়েছিলেন। দু-বছর ধরে লুকিয়ে খাচ্ছেন। যখন মোজাম্মেল হোসেন ব্যাংকলোন সংক্রান্ত দুঃসংবাদটি দিলেন। ব্যাংক লোন নিয়ে রিয়েল স্টেট ব্যবসায় জড়ানো উচিত হয়নি; রাস্তার পাশে প্লট, আইন মোতাবেক জায়গা রাখা হয়নি; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভেঙ্গে ফেলতে হল নির্মিয়মান এরকম কয়েকটি পাঁচতলা-ছ’তলা ভবন।
দরজায় মৃদু নক হল।
কাম ইন।
ফারহানা রহমান। শ্যামলা, ঈষৎ পৃথুলা- তবে নাক-মুখ-চোখ বেশ সুশ্রী। কাজল কালো চোখ, ছোট্ট নাকে হীরের নাকফুল। চল্লিশের মতো বয়স মহিলার। সাদা শাড়ির ওপর সাদা শাল জড়ানো । তা সত্ত্বেও ভারী স্তন দুটি টের পাওয়া যায়। ফারহানা রহমান ইদানিং চশমা নিয়েছেন- দেখে কলেজের অধ্যাপিকা বলে ভুল বোঝার অবকাশ থেকেই যায়।
সোফায় বসে ফারহানা রহমান বললেন, স্যার, আজ আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে।
কেন? আহমেদ আজীজ খান এর ভ্রঁ কুঁচকে যায়।
আর বলবেন না, এখানে আসার সময় হঠাৎই একটা কল এল। আমাকে দুটোর মধ্যে আগ্রাবাদ যেতে হবে। ক্লায়েন্ট আছে। কী মুশকিলে পড়লাম বলেন তো।
ক্যান্সেল করা যায় না? আহমেদ আজীজ খান এর কন্ঠস্বরে ক্ষীণ রসিকতার আভাস।
মৃদু হেসে ফারহানা রহমান বললেন, যায়। আপনি যদি বলেন।
আহমেদ আজীজ খান হাসলেন। আসলে এসবই হল টেকনিক। বসদের খুশি রাখতে ফারহানা রহমান কে এ ধরনের টেকনিকের আশ্রয় নিতে হয়। আহমেদ আজীজ খান জানেন ফারহানা রহমান এর স্বামী লুৎফুর রহমান পঙ্গু। লুৎফুর রহমান বাম রাজনীতি করত। দীর্ঘদিন জেলে ছিল।
কোটের পকেট থেকে টাকার বান্ডিল দুটি বার করে আহমেদ আজীজ খান বললেন, এটা আপনি রাখুন।
ওমা! এত। থ্যাঙ্কস। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম!
মাথা নাড়লেন আহমেদ আজীজ খান। আকাশ থেকে টাকা পড়লে কে না খুশি হয়। সিগারেট নিভিয়ে অ্যাশট্রেতে রাখলেন তিনি।
ফারহানা রহমান বললেন, মেয়ের ভর্তির জন্য টাকা দরকার ছিল। আপনি আজ আমার যা উপকার করলেন।
আপনার মেয়ে যেন কি সে পড়ে? অন্যমনস্ক হয়ে জানতে চাইলেন আহমেদ আজীজ খান।
ডলি এবার এইচ এস সি পাস করল। প্রাইভেট ভার্সিটিতে দেব ভাবছি। চারিদিকে যা কম্পিটিশন। ভালো কোথাও না পড়লে ফিউচারে কোথাও টিকতে পারবে না।
ওহ্ ।
জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ডলি। ওর জন্য দোওয়া করবেন স্যার।
চেম্বারে ন’টা গুলি সহ কোটের পকেটে রাখা কোল্ট .থ্রি এইট সুপার সিঙ্গেল অ্যাকশন পিস্তলটি স্পর্শ করে আহমেদ আজীজ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন, করব। অবশ্যই করব। আপনি এখন যেতে পারেন।
বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গি করে ফারহানা রহমান বললেন, ওমা, আপনিই তো আসতে বললেন তখন? এখন আবার যেতে বলছেন যে?
আজ মুড নেই। মলিন হাসলেন আহমেদ আজীজ খান।
তাহলে থাক। বলে ব্যাগটা তুলে নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন ফারহানা রহমান । তারপর নীল কার্পেটের ওপর দিয়ে দরজার কাছে চলে আসতে সময় লাগল না । যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে । লোকটা যদি মত বদলে ফেলে? মুডে ছিল বলেই এত টাকা দিয়ে দিলেন। আবার না ফেরৎ নিয়ে নেয়?
গেস্ট হাউজের বাইরে রোদ ঝলমল করছে। সেই সঙ্গে শীতের কনকনে হাওয়াও আছে। ধুলো উড়িয়ে বিশ্বরোডের ওপর দিয়ে একটি ট্রাক চলে যায়। শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন ফারহানা রহমান । মুখ তুলে এক পলক দেখলেন ওপরের আকাশটা আজ কী সুন্দর নীল রঙে সেজে আছে। দৃশ্যটা স্পর্শ করে না তাকে। তিনি এক পাথর-নারী!
গেটের কাছে এসে গুলির শব্দ শুনতে পেলেন ফারহানা রহমান; থমকে দাঁড়ালেন, তবে চমকে উঠলেন না। খুব একটা অবাকও হলেন না। স্বামী লুৎফুর রহমান বাম রাজনীতি করে- এই অজুহাতে ১৯৮৯ সালে একবার ফারহানা রহমান গ্রেফতার করা হয়েছিল । জিজ্ঞাসাবাদকারীরা ফারহানা রহমানকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল: বলেন, আপনিও কি বাংলাদেশে ভূমি সংস্কার চান? তরুণী ফারহানা কি জবাব দেবে। ফারহানা রহমানের চোখের সামনেই লুৎফুর রহমানের পা দুটি রড দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। তারপর ভীষণ শীতল একটা সেলের অমসৃন মেঝের ওপর পড়ে থাকা ফারহানা রহমান-এর আতঙ্কিত ঘামে ভেজা শরীর ঘিরে চলে মত্ত তান্ডব। ...তারপর থেকে কারও মৃত্যুতে বিচলিত হন না এই পাথর-নারী!