ডেভিড হেয়ারের জন্ম স্কটল্যান্ডে। ১৭৭৫ সালে। তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন সে পরিবারটি ঘড়ি তৈরি করত। আমরা জানি, সে সময়- অর্থাৎ সপ্তদশ শতকে অনেক ইউরোপীয়ই জীবিকার তাগিদে ভারতবর্ষে এসেছিল । ডেভিড হেয়ারও তেমনি এসেছিলেন-কোলকাতায়; সময়টা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ। হেয়ার তখন ২৫ বছর বয়েসি যুবক। কোলকাতায় থিতু হয়ে ঘড়ির ব্যবসা শুরু করলেন। মানুষটি ছিলেন অন্য রকম; কাজেই বাঙালিদের সঙ্গে মিশতেন, ভালো বাংলা শিখেছিলেন; বাংলায় কথা বলতেন দেশি খাবার খেতেন ও ধুতি-পাঞ্জাবি পড়তেন। শুধু তাই নয়, হেয়ার হয়ে উঠেছিলেন নেটিভ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে যোগসূত্র।
ঘড়ির ব্যবসা করে প্রভূত ধন অর্জন করেছিলেন হেয়ার। স্কটল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার কথা। গেলেন না। কেননা, ততদিনে কোলকাতার মানুষের দুঃখদুর্দশা (যার অন্যতম কারণ ঔপনিবেশিক শাসন) দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন হেয়ার। ঔপনিবেশিক শাসনে নিষ্পেষিত মানুষের জন্য কী করা যায় ভাবছিলেন। হেয়ার সম্ভবত ভেবেছিলেন, কোলকাতার মানুষ শিক্ষিত হলে কর্ম সংস্থান হবে। কাজেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনই হবে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। তখন ১৮১৭ সাল। হেয়ারের বয়স ৪২ । তখন কোলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন হাইড ইষ্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনের কথাটা হেয়ার তাঁকে বোঝালেন; ফল হল। অতপর হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা। যার পিছনে হেয়ারের অবদান অসামান্য।
১৮৫৫ সাল থেকে হিন্দু কলেজের নাম হয় প্রেসিডেন্সি কলেজ।
বাংলার সমাজজীবনে হেয়ার কর্তৃক হিন্দু কলেজ স্থাপনের ফলাফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। কেননা, বাংলার মুক্তিবুদ্ধির ‘ইয়াং বেঙ্গল’ আন্দোলন এ কলেজ ঘিরেই গড়ে উঠেছিল। কলেজের ছাত্রদের বলা হত ইয়ং বেঙ্গল; এরা প্রত্যেকেই ছিল মুক্তমনা এবং উদার শিক্ষক ডিরোজিওর (১৮০৯-১৮৩১) ছাত্র। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ছিলেন পর্তুগিজ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। মাত্র ১৭ বছর বয়েসে ডিরোজিও হিন্দু কলেজে যোগ দেন। ডিরোজিও ছিলেন উদার ও মুক্তমনা। “তিনি তাঁর ছাত্রদের জীবন ও সমাজ-প্রক্রিয়ার প্রতি যুক্তিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করা শিক্ষা দিয়েছিলেন।” ডিরোজিওর সঙ্গে হেয়ারের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ট।
ইয়ং বেঙ্গলের একটি সংগঠন ছিল। ‘সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অভ জেনারেল নলেজ’। হেয়ার সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষক হন।
১৮১৮ সাল। ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করলেন হেয়ার। এটি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় বই প্রকাশনা সংস্থা; উদ্দেশ্য সহজে বোধগম্য- কোলকাতাবাসীর কাছে সুলভে বাংলা ও ইংরেজী বই পৌঁছে দেওয়া।
আমি যখনকার কথা বলছি-সেই সময়টায় রাজা রামমোহন রায় সামাজিক সংস্কারে নেমেছিলেন। রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গেও হেয়ারের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ট।
এবার হেয়ারের অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের দিকে তাকানো যাক। ঔপনিবেশিক আমলের প্রচলিত আইনগুলি উৎপীড়নমূলক এবং অমানবিক বলে প্রতীয়মান হয়েছিল হেয়ারের কাছে। আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময়টায় শ্রম আইনের আওতায় ভারতীয় শ্রমিকদের দাস হিসেবে ইউরোপের প্লানটেশন কলোনিগুলিতে পাঠানো হত। ঐ শ্রম আইনটি ছিল নিষ্ঠুর ও অমানবিক। হেয়ার ঐ শ্রম আইনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। কলোনিয়াল আইনের সংস্কার সাধনের জন্য ব্যাপক প্রচার করেছিলেন হেয়ার। এমন কী, দেশিয় সংবাদপত্রের ওপর থেকে সমস্ত রকম বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেন। দেশের সকল জেলা আদালতে জুরির মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে তিনি জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেন। এর আগে ব্যবস্থাটি কেবল কোলকাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আগেই বলেছি, নানাবিধ সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে হেয়ার ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে ঋণমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৮৪০ সালে মাসিক ১০০০ রুপি বেতনে তাঁকে কোলকাতার শেরিফ নিযুক্ত করা হয়।
১৮৪২ সালের ১ জুন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে হেয়ার মৃত্যুবরণ করেন। ঐতিহাসিক সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন,Irrespective of caste and creed, religion and race, all mourned his death. The Calcutta public raised a memorial statue of him by public subscriptions. The Memorial Statue (1847) reads that Hare 'having acquired an ample competence cheerfully relinquished the prospect of returning to enjoy it in his native land in order to promote the welfare of that of his adoption'. (বাংলাপিডিয়া)
সূত্র: বাংলাপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:০৪