চারচক্ষের মিলন হলে নিজেকে বাংলা সিনেমার কবরীর মতো লাগে─তখন বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে মুমের আলোয় ঘরটিকে মায়াময় করে তোলা হয়েছিল। মানুষ পাঠ করার কৌশল তখনও সে অর্জন করতে পারেনি। এক রিক্ত নারী বলে তাকে বড় বেশি অবজ্ঞা করে, এক পৌরুষ-প্রদর্শক অবশেষে নিজেকেই ছোট করে ফেলে। মায়মোনা সেই সব ঘোরলাগা দিন পার করে, এক তৈলাক্ত শরীর দেখতে দেখতে, যার ভেতরে কেবল পা-িত্যের কচকচানী ছাড়া মানুষ বলতে যা বোঝায় এর কোনোটাই ছিল না। একদিন সাহস করে মায়মোনা বলেছিল─
: তুমি সঙ্গীত শোনো, বোঝ না।
: তুমি আরক্ত করো, হও না।
: অনেক রোমান্টিক আচরণ করো, এর প্রকৃত রঙ জানো না।
: নিজেকে যেদিন তোমার হাতে সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছিলাম এর কানাকড়িরও মর্যাদা রাখতে তুমি ব্যর্থ হয়েছ, কিংবা রাখতে পারোনি। পারবে কেন? তুমি তো নিজেকেই জানো না।
এসবের কোনোটারই উত্তর সেদিনের ওই শরীরী-মানুষ দিতে পারেনি। আর তখন থেকে মায়মোনা অন্য জীবন বেছে নেয়।
সে জীবনটা কেমন ছিল?
মায়মোনা এক পুরাণ বৃক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায়। বিকালের দীর্ঘছায়া পুরাণ বৃক্ষের বাকলের সঙ্গে মিশে গেলে, নিজেকে ছায়াহীন মানুষ ভাবতে ভালো লাগে। সূর্যের বিপরীত থেকে বুড়ো বৃক্ষটি তার ছায়া যেভাবে গ্রাস করেছে, সেভাবে যদি তাকে গ্রহণ করতো, মানব কূলের উপর তার নির্ভরতা থাকতো না। অবশ্য ইতোমধ্যে সে অনেক নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে।
স্টেপনি গ্রিন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতে একদিন মনে হয়েছিল, লন্ডন মহানগরীর সমস্ত ব্যস্ততা এই আন্ডারগ্রাউন্ড রেলপথ ধরে পাতালে মিলিয়ে যায়। আর মানুষ ফ্ল্যাট বাড়িতে বেদুম ঘুমিয়ে পূণর্বার শক্তি সঞ্চয় করে আরেকটি দিনের জন্য। নিঃশেষ না হয়ে নতুন নতুন ভাবনায় আবর্ত হতে থাকে মানুষ। এই সামান্য জীবন-দর্শনে আনমনার ভেতর মায়মোনা হঠাৎ চমকে ওঠে। কী সে খোঁজে পায় নিজের জন্য? বিদ্যুৎ বেগে নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেলে─মানুষ বেদনায় মরে যায় না, মানুষ জেগে ওঠে। সেই থেকে তার কারোর প্রতি কোনো নির্ভরতা নেই। এই পুরাণ বৃক্ষটি আজ নিশ্চিন্তে তাকে গ্রহণ করতে পারে─এই ভাবনায় সে বৃক্ষের বাকল স্পর্শ করে প্রীত হতে চাইলে, সমস্ত বেথনাল গ্রিন পার্ক এক সঙ্গে নড়ে ওঠে।
: হে পুরাণ বৃক্ষ, তুমি কি পূর্ব জনমে আমার পরিত্যক্ত স্বামী ছিলে?
: তোমার কুড়ালে ছেদানো শরীরে কেন আমার পরিত্যক্ত স্বামীর ঘ্রাণ, যে গন্ধ আমি শয়ন কক্ষের বিছানা-চাদর-জানালা-ফ্রিজার─ব্যবহৃত কোনো আসবাব-পত্রে অনুভব করি না।
: শয়ন কক্ষে আমি চামড়ার একটি বেল্ট ঝুলিয়ে রেখেছি যা কেবল বিগত দিনের ভয়ঙ্কর রাত্রিকে স্মরণে তুলে দেবে, যাতে কোনোক্রমে ভুলে না যাই পেশি-শক্তি পুরুষের কাছে আমি একদিন বড় অসহায় ছিলাম। আর আমি ভুল পথে যেতে চাই না। কোনোভাবে পূণর্বার বিভ্রান্ত না হওয়ার একটি কৌশলই হলো আমার শয়নকক্ষে ঝুলন্ত এই চামড়ার বেল্ট।
বৃক্ষের শরীরে এতো বোবা কাহিনীর কোনো স্বাক্ষর নেই জেনেও পূণর্বার হাত রাখে মায়মোনা। চোখ দুটি বোজা। বৃক্ষটি জীবনে একশ’ পয়ষট্টি মাতাল-সন্ধ্যার স্বাক্ষী ধরে রাখলেও মায়মোনার চরণ কোনো দিন এই পথে পা বাড়ায়নি। এখন বৃক্ষটিকে অনেক আপন মনে হওয়াতে তার ঘ্রাণ নিজের পোশাকের মতোই খুব পরিচিত লাগে। একটা দমকা হাওয়ার সাথে সকল দুঃখ-কষ্ট মিলিয়ে যায়। বেদনার কিছু সময় সে অনবিজ্ঞ নারী হিসেবে পার করে এসেছে। অভিজ্ঞতা তাকে পূর্ণ মানুষরূপে ভাবতে শিখিয়েছে। যদিও ওপথ ছিল দীর্ঘ ক্লান্তিকর।
: হে বৃক্ষ আমি স্বামী শব্দটিকে কাচটুকরা করে ভেঙে ফেলেছি। তুমি তো অন্ধবৃক্ষ। তোমাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই─তুমি আমাকে গ্রহণ করো।
: যে মাতাল স্বামী লাল ঝা-া উড়িয়ে মানুষ খুন করতো, একদিন সুযোগ বুঝে এই পরবাসে পালিয়ে এসেছিল। আর আমিও এমনই নির্বোধ-মাকাল, তার কেবল কেতাবী কথায় আমার কাঁচা বয়স বন্ধকী রেখেছিলাম। সে ছিল একজন হঠকারী চিন্তার অনুগত যা জেনেছি অনেক দেনা শোধ করে।
: একদিন আমাকে নিঃস্ব করে শিশু এ্যবোসের দায়ে সে জেলে গেল। আমি কী করে তার লাগি রোদন করি বলো?
বৃক্ষের বাকল একটু একটু করে ঝরে পড়ে। শিকড়ে জমেছে অনেক পুরানো পাতার আবর্জনা। জমে থাকা কষের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নতুন কষ। শাড়ির পাড় দিয়ে মায়মোনা মুছে দেয় বয়োজেষ্ঠ্য বৃক্ষের শরীর-ফাটা কান্না।
এই মাত্র সে আরেক অভিজ্ঞতার স্রোতে ভাসতে থাকে।
২.
মায়মোনার ছোটখালা থাকেন লেস্টারে। সেই খালা ছিল তার সুন্দর আদর্শ। একদিন জীবন-সংসারকে দু’ভাগ করে এক গোরা যুবকের সঙ্গে অজানা শহরে পাড়ি দেন। লন্ডনের কেউ জানে না ছোটখালা কোথায় আছেন। কেবল মায়মোনার টেলিফোনের মেমরিতে সংরক্ষীত আছে তার কণ্ঠস্বর। সবাই যখন ধিক্কারে ধিক্কারে মুখে ফেনা তুলছিল সে মনে মনে খুশিই হয়েছিল ছোটখালার প্রতি। কেন এতো আকণ্ঠ সমর্থন ছোটখালার প্রতি, মায়মোনা সঠিকভাবে আবিষ্কার করতে পারেনি। তার কথা ছিল আবেগ-ঘন। তার চিন্তা ছিল সবসময় অন্যের জন্য─অন্যকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য অনেক সুযোগ তৈরি করে দেয়া। রাত জেগে গল্প করার সে কী নেশা। রাতে জোসনা ফুটলে বলতো, চাঁদ গলে পড়ছে, আয় বাইরে গিয়ে একটু মেখে আসি। বৃষ্টি হলে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে চোখে উদাস ভাব ফুটিয়ে বলতো, আজ আমি নিঃস্ব হয়ে যেতে চাই, যে পারো আমায় তোলে নাও। ছোটখালার বয়স তার কাছাকাছি হওয়াতে কথা বুঝতে মোটেই অসুবিধা হতো না মায়মোনার। গুরুদ- দিতে গিয়ে, নিজেকে পণ্য করে স্বদেশের ছেলে আবিদ আলী ওরফে লিচ্চু মিয়াকে বিয়ে করে বিলেতে নিয়ে আসে ছোটখালা। সেই থেকে তার গ্লানি টানতে টানতে অবশেষে নিজেকে স্বেচ্চায় গোরা যুবকের হাতে সপে দেয়।
মায়মোনা ছোটখালার মতো হতে পারেনি। দুঃখগুলো ভাগ করলেও দু’জনের মত ও পথ ভিন্ন। ডিগবাথের শহরটা ছিল ছোটখালার সবচে প্রিয়। পাহাড়ের উঁচু চুড়া থেকে নিচের সড়ক-পথ আর চলন্ত গাড়িগুলোকে বাচ্চাদের খেলনার গাড়ির মতো লাগে। রাত্রির ঝিম ধরা ঠা-ায় একা একা বসে মায়মোনার বলতে ইচ্ছা করে─
: ছোটখালা, তুমি ডিগবাথের কতো উঁচু চুড়াতে বাস করো?
: তোমার কি কখনো গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে না?
: তোমার সংসারে এখন কতো আদর খেলা করে?
: আমার যে নিজের চেনা জায়গা ছাড়া কোথাও নিরাপদ লাগে না।
: মাত্র এক বছরের নিঃসঙ্গতায় আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
: কোনো শিশু-মুখ দেখলেই বুকের ভেতর মুচড় দিয়ে উঠে।
: পুরুষের প্রথম স্পর্শ পেয়ে একটি লাল জামা কিনে ছিলাম, আজও তা অব্যবহৃত রয়ে গেল।
মায়মোনার চোখে রাত্রির আকাশ দু’ভাগ হয়ে যায়। শূন্য-অন্ধকার থেকে শিশু-যিজাজ বেরিয়ে আসেন। শূন্যে হামাগুড়ি দিয়ে তার কুল ভরাট করে হেসে উঠেন যিজাজ। পূণ্যবান স্তন জোড়া উন্মোক্ত করে মায়মোনা। ক্ষুধার্ত শিশু স্তনের বোটা মুখে পুরে নিলে, মায়মোনা কাঁপতে থাকে।
: তুমি কাঁপছো কেন মা?
শিশুর বাক্য শ্রবণে ভয়ার্থ মায়মোনা বলে, আমি কি বিবি মরিয়ম?
: হ্যাঁ। তোমার বেদনায় আকাশ দু’ভাগ হওয়াতে আমি শূন্য থেকে গড়িয়ে পড়ি। প্রকৃতি আমাকে তোমার কুলে ফেলে দিল। তুমিও পৃথিবীর পূণ্যবানদের একজন যারা প্রতিনিয়ত নিজের নিরাপত্তার জন্য আগল তুলে রাখতে পছন্দ করো।
মায়মোনা সকল কিছুর অর্থ বোঝার আগে সুখ-নিন্দ্রার ভেতর তলিয়ে যেতে থাকে ...।
নাভির তীব্র ব্যথায় মায়মোনা জেগে ওঠে। কাচের জারের আড়াল থেকে দুটো পেইন কিলার হাতে নেয়। হেলান দেয়া সোফা থেকে আড়ষ্ট পায়ের দিকে চেয়ে চমকে ওঠে। ক’ফোটা রক্ত-বিন্দু পায়ের পাতায় জমাট হয়ে আছে। কখন ঘটল বুঝতে পারেনি। ঋতুবতী-জ্বর নিয়ে চোখ দু’টো বুজে রাখার চেষ্টা করে। আবার নারীত্বই জেগে ওঠে তার অতল গহবর থেকে। পাগল করা চৈতী-দুপুরে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করুক, নগর বিসরিয়ে কেউ এক তোড়া রক্তগোলাপ নিয়ে আসুক, সিগারেটের কড়া গন্ধ-মুখে কেউ ঠোঁট-জোড়া বাড়িয়ে দিক, চঞ্চল দুপুরে কেউ অফিস ফাঁকি দিয়ে তার মোবাইলে এসএমএস করুক─এসব উষ্ণ কথা গোপনে তরুলতা হয়ে বাড়তে থাকলে মায়মোনা দেয়ালে টাঙানো চামড়ার বেল্টের প্রতি তীব্র চোখে তাকায়। বুঝতে পারে, কোরামিনের ড্রপ কাজ করেছে। বেল্টটা এক নির্যাতীত নারীর প্রতীক। একে ফেলে দিলেই মায়মোনার আবার পতন ঘটবে─আবারও ভুল পথে, ক্লেদাক্ত সড়ক মাড়াতে হবে। নিজেকে আর কোনো আবেগের সাথে জড়াতে চায় না।
তারও অনেক পরে দৃশ্যত ছিল একটি পুরাণ বৃক্ষের নিচে ছায়া ছায়া দুপুর। মাঠভর্তি শিশুদের কোলাহল। আকাশ বিদীর্ণ করে নেমে আসা সূর্যের কিরণ। দমকা হাওয়ায় কুসুম-কুসুম ঘ্রাণে একটি আচল খসে পড়ে, শিকড় জড়িয়ে।
পরদিন শহরের প্রধান পত্রিকাগুলোর শিরোনাম : একটি অদ্ভুত আত্মাহুতি। ১০ অক্টোবর ১৯৯৫ সাল। একজন অপ্রকৃতস্ত যুবা মহিলা মানবকূলের প্রতি ভরসা হারিয়ে একটি পুরাণ বৃক্ষের কাছে প্রার্থনা রাখেন তাকে গ্রহণ করার জন্য। আবেগাপ্লোত যুবা মহিলাটির নাম মায়মোনা। তিনি বৃক্ষের গায়ে মাথা টুকতে টুকতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। শেষে তাকে মৃত বলে সনাক্ত করা হয়। সূত্র : বেথনাল গ্রিন পুলিশ স্টেশন।
e-mail : amoyez@yahoo.co.uk