০১ অক্টোবর ২০১২,আমরা তখন মেরিন একাডেমীর সিনিয়র ক্যাডেট।তখন রাত ১১টা কিংবা ১২টা, ঠিক মনে আছে সেদিন ভরা পূর্ণিমা ছিল। আসন্ন শীতের জানান দিতে পাতলা ছেঁড়া কুয়াশার চাদর ফোর টপ গ্রাউন্ডের অনেক উপরে ইতঃস্তত ঝুলে আছে।সে কুয়াশা চাঁদের আলো খুব বেশি ম্লান করে দিতে পারে নি।খুব একটা নিসর্গ প্রেমিক ছিলাম না কেউই, অর্থহীন খুচরা আড্ডা চলছিল ১০৩ ডর্মেটরির সামনের সিঁড়িতে ।
সামনের সবুজ ঘাসে হটাৎ নড়াচড়ায় সবাই সচকিত হয়ে উঠি ।চাঁদের রূপালী আলোতে হয়ত চন্দ্রাহত হয়ে পড়েছিল আগন্তুক প্রাণীটি, না হলে কেন আমাদের মত নির্দয়ের সামনে হাজিরা দিতে আসবে কেন অসময়ে!
আমাদের মধ্যে থেকে কেউ কিংবা আমিই হয়ত প্রথম আগন্তুককে সনাক্ত করে চিৎকার দিয়েছিলাম, ‘সাপ-সাপ!’।আগেও দেখেছি সাপ দেখলেই সবার মাঝেই এক হন্তারক জেগে ওঠে, নিদেন পক্ষে একটা ঢিল তো মারা চাইই।আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। এক আগন্তুকের বিপরীতে আমারা অনেকজন।মূহুর্তেই পৌরুষ জেগে উঠল আমাদের মাঝে ।অস্ত্র হিসেবে আমাদের পছন্দ হল জুতা রাখার শেলফে থেকে ভাঙা প্রায় দেড় ফুট এক কাঠের টুকরা ।অস্ত্রের এক প্রান্ত থেকে দুইটি পেরেক বের হয়ে আমদের অস্ত্রকে মরনাস্ত্রের শোভা দান করল।পৈশাচিক উল্লাসে হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়লাম সবাই।হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত হলে এক বীরোচিত কর্ম সম্পাদনের আনন্দে আচ্ছন্ন আমরা সবাই।শৈশবকালে সাপের সিনেমা নেহায়েৎ কম দেখি নি, তাই আগন্তকের জোড়াটি আশেপাশেই থাকতে পারে এই অনুমেয় আ্তঙ্কে লাইট জ্বালিয়ে ছোটখাট চিরুণী অভিজান চালানো হল আশেপাশে।আসল কথা অন্তঃস্থিত হটাৎ জাগ্রত জল্লাদ সিঙেল বলিতে খুব একটা তৃপ্ত হয়নি ।আগন্তুকের জোড়াটাকে মনে হয় চাঁদের রূপালী আলো বিমুগ্ধ করতে পারা নি কিংবা কোন মাটির ফোকরে সে তখন শীতনিদ্রায় যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।অতএব আমরা আশাহত হয়ে শুতে যাই।
পরদিন সকালে এক ডর্মমেটের তুমুল ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে।বিলওয়ালের হাতে মেলে ধরা সেদিনের ‘প্রথম আলো’ দৈনিকের একটি পাতা ।আধো ঘুমে আধো জাগরণেই দেখি গতকালের সেই আগন্তুকের ছবি পেপারের অনেকটা অংশ জুড়ে। আমাদের গোপন যজ্ঞের কথা কি জেনে গেল সারা দেশ!ধড়মড় করে উঠে বসে পেপার হাতে নিই।না কেউ জানে নি আমাদের নির্মম অনাচারের কথা ।
পেপার থেকে জানা যায় আগন্তুকটি সেই ডাইনোসর যুগেও পৃথিবীর আলো বাতাস গায়ে মেখেছে।বৈজ্ঞানিক নাম chikila fulleri. সিলেটের লাউয়াছড়াতে প্রাপ্ত মৃত সাপটি প্রথমবারের মত বাংলাদেশে এর অস্তিত্ব জানান দিয়েছে।মৃত সেই সাপের ছবিই ছেপেছে প্রথম আলো।
১৪ কোটি বছর ধরে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এক প্রাগঐতিহাসিকের মানুষের বর্বরতার যূপকষ্ঠে বলি হওয়া নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কি!ছবির মৃত সাপটি তাই কটাক্ষ করে আমাকে, ড্রেনে পড়ে থাকে তার জাতভাই।ত্যাবদা মেরে খাটের উপর বসে থাকে আমার ভেতরের নিষ্ঠুর জল্লাদ কিংবা আমিই ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২২