বইয়ের কিছু গল্পে উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অবক্ষয়পীড়িত সমাজের অসুস্থ চিত্র।
‘মধ্যিখানে চর’ গল্পের বিভ্রান্ত বিপর্যস্ত সবুজ যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল স্বাধীন দেশে সেই স্বপ্নের সামান্যতম প্রতিফলন খুঁজে পায় নি।যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেই স্বপ্নশূন্য তরুণদের প্রতিনিধি সবুজ তাই বুড়ো পাইকারের পেটে লাথি কষিয়ে ডাকাতি করে।অথচ একদিন পাকিস্তনি সৈন্যদের উপর বেয়েনেট চার্জ করেছিল সবুজরাই।
‘মুকিযোদ্ধার মা’ গল্পে শহীদ আবু চানের মা মরিয়ম দরজায় দরজায় গিয়ে হাঁক দেয়-‘ভিক্ষা দ্যান গো বাবাজী,আমি মুক্তিযোদ্ধার মা’, আর সুযোগ পেলেই তার শহীদ পুত্র আবু চানের গল্প আরম্ভ করে।শহীদ আবু চান রামদা দিয়ে কুপিয়ে এক পাঞ্জাবী সৈন্যকে হত্যা করেছিল।স্বাধীনতার বিশ-একুশ বছর পর এসে ভিখারিণী ভিক্ষা প্রার্থনার সাথে মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি মেনে নিতে চায় না কেউ। মরিয়মকে বেঁধে রেখে লাঞ্চিত করে এলাকার প্রভাবশালী রুস্তম।পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র দেশপ্রেমিক শাহজাহান সাহেব এসব আদিখ্যেতা পছন্দ করেন না, বলেন-এত বছর পর কিসের মুক্তিযুদ্ধ!কিসের গোলাম আজমের বিচার!
‘এই বাংলায়’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা অনন্য এক গল্প।শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আর বীরঙনাদের আত্মারা মর্ত্যলোকে নেমে আসে স্বাধীনতার উৎসবের দিনে।তারা দেখে বিজয় মঞ্চে সম্মানের আসন দখল করে বসে আছে স্বাধীনতার বিরোধী পক্ষের শক্তিরা।গল্পের অতিপ্রাকৃত দিকটি রাহাত খান অসামান্য দক্ষতায় গৌন করে রক্তার্জিত স্বাধীনতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন।
ইমান আলীর মৃত্যু গল্পের শুরুতেই দেখে যায় মুমূর্ষ ইমান আলীর আসন্ন সম্ভাব্য মৃত্যুতে শোকাতর হয়ে পড়ে তার সন্তানরা।ইমান আলী সুস্থ হলে সেখানে দেখা যায় স্নেহ মমতায় পরিপূর্ণ এক সুস্থ যৌথ পরিবার চিত্র।এরপর দেখা যায় বন্যা পরবর্তী অভাব দুর্ভিক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত মূল্যবোধের চিত্র।লঙরখানার উদ্দেশে যাত্রাপথেই বোঝাতুল্য মৃতুপথযাত্রী ইমান আলীকে ফেলে রেখে যায় তার তিন সন্তান।ক্ষুধা ,অভাব,দারিদ্র যে মানুষের সমস্ত মূল্যবোধস্থিত ইতিবাচকতাকে ধ্বংস করে ফেলে সেই নির্মম সত্যই বলতে চেয়েছেন গল্পকার এই গল্পে।
এরকমই আরেকটি গল্প ‘উদ্বেল পিপাসা’য় অসুস্থ যুবক তার ওষুধ ও খাবারের জোগানদার স্ত্রী খালেদাকে খুজে পায় পাশের রুমে তার বন্ধু হাসানের বাহুলগ্ন অবস্থায়।মুহূর্তেই তার মাঝে জেগে ওঠে সীমাহীন ক্রোধ এবং ইর্ষা।কিন্তু বেঁচে থাকার আকুতির কাছে পরাজিত হয় সেই সব অনুভূতি।এই দুই গল্পই মনে করিয়ে দেয় তারাশঙ্কররে ‘তারিণী মাঝি’ গল্পের কথা।‘তারিনী মাঝি’ গল্পের প্রথমেই দেখা যায় স্ত্রীর প্রতি মাঝির সীমাহীন ভালবাসার প্রকাশ।এক রাতে বন্যায় সব ভেসে গেলে সাঁতার না জানা স্ত্রীকে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে একসাথে বেঁচে থাকতে চায় তারিণী মাঝি।কিন্তু একসময় বন্যার পানি আরো বাড়তে উভয়ের মাঝেই জেগে ওঠে বেঁচে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি।মাঝি বউ মাঝিকে আশ্রয় করে তাকে আরো শক্ত করে পানির নিচে চেপে ধরে নিজে বেঁচে থাকতে চায় আর মাঝি তার এতদিনের ভালবাসার স্ত্রীকে ছুঁড়ে ফেলে তার নিজের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করে। বেঁচে থাকার আকুলতার কাছে ভালবাসা পরাজিত হয় নির্মমভাবে।
‘আমাদের বিষবৃক্ষ’ আমার পড়া বাংলা সাহিত্যের গল্পগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ একটি গল্প।১৯৫০ সালে ময়মনসিং দাঙা আর তিন বালকের বন্ধুত্ব নিয়ে অসাধারণ একটি গল্প।গল্পের স্বল্প পরিসরে রাহাত খান সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন ভয়াবহ রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন সুন্দরভাবে।
রাহাত খানের গল্প খুব সহজ সরল ক্যাজুয়াল ভাষায় লেখা ফলে পাঠক মনযোগের কোনরূপ বিঘ্নতা না ঘটিয়েই গল্প চলে আসে উপসংহারে।বইয়ের শুরুতেই আহমাদ মোস্তফা কামালের ভূমিকাও সুপাঠ্য ও পাঠ সহায়ক।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১৯