তারপর টিনের চালে মৃদু টুপটাপ শিশিরের শব্দ আর ভূত অন্ধকার গায়ে মেখে নামে হিম রাত।সাঁওতাল পাড়ায় হটাৎ কে যেন ঢোলে টুড্ডুঙ শব্দ তুলে মিশিয়ে দিল রাতের সাথে। কিসমিসের মত দেখতে শুকনো নিমের ফল শিশির মেখে টিনের উপর টুপটাপ শব্দে পড়ে চমকিয়ে দেয়।রাত দশটার ইংরেজী সংবাদের ভলিউম বাড়িয়ে দিল কেউ।
সেই অপার্থিব সুনসান নীরব রাতগুলোতে লেপের নিচে কল্পনায় পাওয়া আমি দেবতাদের সমস্ত কূটকৌশল বানচাল করে দিয়ে একিলিসকে বিপরীতে হেক্টরকে জিতিয়ে দেই, কয়েকটি সফল বিপ্লব পরিচালনা করে কত নতুন দেশ আবিষ্কার করে পরিশ্রান্ত আমি ধূসর চুল বাতাসে উড়িয়ে ঘরের পথ ধরে ফিরি ।পথের দুপাশে সবাই ভিড় করে আমাকে দেখতে। আমায় নিয়ে লেখা স্তুতিগাঁথা গাইছে সুন্দরী মেয়েরা। লম্বা চুলের খুব সুন্দর দেখতে মুক্তা ম্যাডামের মুখটা বারবার দেখি সেই মেয়েদের ভীড়ে।
তারপর খুব সাদা একটা সকাল।লেপের নিচের উষ্ণতাটুকুর মায়া ছাড়তে সময় লাগে কিছুক্ষন।বাহিরে চাপ চাপ সাদা কুয়াশা চোখ ধাঁধিয়ে দেয় ।তারপর লাল উলের সোয়েটারটা গায়ে চড়িয়ে বড়বোনকে সাথে নিয়ে একছুটে বড়রাস্তার পাশের শিউলি তলায়। গাছের উপরে ফুলগুলো তখনো মেঘের মত কিছু কুয়াশার আড়ালে।লিকলিকে গাছটা ধরে ঝাঁকা দিতেই নরম নরম সাদা ফুলগুলো ঢেকে দেয় ঘাসের শিশির ভেজা সবুজটুকু।দু হাত ভর্তি করে শিউলি ফুল কুড়াই।বুকের ভেতর আনন্দ খলবল করে।
প্রাইভটে যাওয়ার ছল করে একদিন রাতে কয়েকজন মিলে রাসমেলা যাওয়ার রাস্তায় উঠে আসি।কুয়াশা আর চাঁদের আলোয় ভেজা রাস্তার মিহি নরম সাদা বালুতে পা ডুবে যায় ।পাশের বিলের উপর থেকে হাহাকারের মত শব্দ করে উঠে আসা ঠান্ডা বাতাস হাড়ে কাঁপন ধরায়। বাঁশঝাড়গুলো আঁকড়ে ধরে থাকে গাঢ় অন্ধকার।নীরবতা অসহ্য লাগে বলে বোধ হয় হিমাংশু গলা কাঁপিয়ে আসিফের গান ধরে-‘তুই যদি মোর চন্দ্র হতি বাঁশবাগানের মাথায়……’।তারপর সেই আলো আলো রাসমেলা, ধূপ-চন্দনের গন্ধ,ভোঁ বাশির শব্দ ,ঢাকের শব্দ,নরম বালি ,অন্ধকার আর মানুষের হল্লা। হিমাংশু চিনিয়ে দেয় রাধা-কৃষ্ণ,দ্রৌপদী পান্ডবদের। রাতটা কেমন অলীক আর রহস্যময় লাগে, জন্মান্তরের স্মৃতি যেন ভেসে আসে গন্ধ আর শব্দ হয়ে।
শীত আসছে।পদ্মার উপর ঝুলে থাকা ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা ভেতরে কোথায় যেন এক বিন্দু আলো জ্বালিয়ে দেয়।সেই আলোতেই দেখি রাসমেলা,ভাপাপিঠার সকাল, বাঁধাকপির নতুন পাতায় মুক্তোর মত শিশির, গাঁদা ফুলের গাছে দুইটা কলি,সুপারি গাছের পড়ে যাওয়া একটা খোল দিয়ে বানানো স্লেজগাড়ি,রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে কুয়াশায় আটকে ছড়িয়ে গেল চারপাশে,ধোঁয়া আর কুয়াশায় আটকে গেল আমার খন্ড খন্ড অস্তিত্ব।
বিন্দু আলোয় হাতড়ে হাতড়ে নিয়ে আসি মদিরতা মাখা সময়গুলো ।জীবনতৃষ্ণার সেই আলোটুকু ধ্রুবতারার মত জ্বলে জ্বলে প্রেরণা যোগায় অনেকদিন বেঁচে থাকার ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:০৩