সপ্তম শ্রেণীতে,স্কুলের বাংলা পাঠ্য বইয়ে তারাশঙ্করের একটা গল্প ছিল। ‘ডাক হরকরা’ মনে আছে? সেই যে দীনু ডাক হরকরা।
মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যবই প্রণেতারা একটু চালাকি করেছিলেন গল্পটাতে।পাঠ্যবইয়ে স্থান পাওয়া ‘ডাক হরকরা’ গল্পটা ছিল অনেকখানি সংক্ষেপিত।তাদের দোষ দিচ্ছি না।
গল্পের প্রধান চরিত্র দীনু ছিল অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ একজন ডাকহরকরা। কাঁধের উপর মেল ব্যাগ, মাথায় ছেঁড়া একটি মাথালি, এক হাতে একটি বল্লম,আর বল্লমের সাথে ঝুলানো ঘন্টা নিয়ে সে পোস্ট অফিসে পৌঁছে দিত সররকারের ডাক।পথে তার এতটুকু দেরি হত না।ঘুটঘুটে অন্ধকার,ঝড়-বাদলা উপেক্ষা করে ঠিক সময়ে পৌঁছে দিত সরকারের ডাক।রাতের বেলা পথের পাশে ঝোপের মধ্যে ওভারসিয়ার বাবু লুকিয়ে থাকত।ডাক হরকরা দেরি করলেই ওভারসিয়ার রিপোর্ট করে ডাক হরকরার নামে জরিমানা করে দিত।কিন্তু দীনু ডাক হরকরাকে ওভারসিয়ার একদিনও ধরতে পারে না।
‘‘জঙ্গলের মধ্য হইতে এখনও কোন কোন দিন কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ডাক-হরকরা?
দীনু উত্তরে প্রশ্ন করে, টায়েন(টাইম) ঠিক আছে বাবু?
হাসিতে হাসিতে ওভারসিয়ার রাস্তার উপর আসিয়া বলে, ঠিক আছে রে। তোর কিন্তু এক দিনও দেরি হ’ল না দীনু’’।
সরকারের ডাক ঠিকমত পৌঁছে সময়মত দেয়া,এ যে বড় মস্ত কাজ।দীনু এ কারণে বেশ গর্ব বোধ করত।নোটন চোকিদারকে বলত-‘ ‘এ বাবা তোমাদের চৌকিদারি কাজ লয় যে, ঘরে শুয়েই জানালা থেকে দুটো হাঁক মেরেই খালাস, চাকরি হয়ে গেল! এ হ’ল সরকারী ডাকের কাজ, এক মিনিট দেরি হ’লেই-- বাস, হাতে হাতকড়া’’।
এক শ্রাবনের রাতে বটগাছের তলায় ডাকাত আসিয়া দীনুর মেল ব্যাগটি কেড়ে নিতে চায়। কণ্ঠ শুনে দীনু চিনতে পারে ডাকাত আর কেউ নয় তার নিজের ছেলে নিতাই।লাঠির আঘতে নিতাই দীনুর মাথা ফাটিয়ে দেয়।তবু দীনু সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখে সরকারের ডাক।
পরদিন হাসপাতালে সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট সাহেব দীনুকে দেখতে আসেন।
‘‘সাহেব বলিলেন, খুব বাহাদুর তুমি। সরকার তোমার ওপর খুশী হয়েছেন। তুমি যে নিজের মাথা দিয়েও সরকারের ডাক বাঁচিয়েছে, এর জন্যে তুমি রিওয়ার্ড-- মানে পুরস্কার পাবে’’।
এরপর পুলিশের বড় সাহেব এসে দীনুকে জেরা করলে দীনু স্বীকার করে ডাকাতি করতে এসেছিল তারই ছেলে নিতাই।
‘দীনু বিহ্বলের মত চাহিয়া থাকিতে থাকিতে বলিল, হুজুর, আমার ছেলে নেতাই’।
যতদূর মনে পড়ে এখানেই পাঠ্যবইয়ের গল্প শেষ হয়েছিল।এই গল্প থেকে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যে কর্তব্য এবং নিষ্ঠার কাছে আর সব তুচ্ছ,এমনকি নিজ পুত্রও।
তারাশঙ্করও কি সেটাই বলতে চেয়েছিলেন?বড়বেলায় এসে গল্পের বাকিটুকু পড়ে মনে হয়েছে ডাক হরকরা গল্পটি কর্তব্যনিষ্ঠা নয় বরং দীনুর আত্মোপলব্ধির গল্প।
নিতাই নিরুদ্দেশ।কেউ তার খবর জানে না।পাড়ার লোকে দীনুকে ডাকে যুধিষ্টির।পোস্ট অফিসেও দীনুর সম্মান বেড়ে গেছে।নতুন পোস্টমাস্টার এলেই জিজ্ঞাসা করে,দীনূ কে?
একদিন পোস্টমাস্টার দীনুকে ডেকে বলেন ডাকে করে সাউথ আফ্রিকান জাহাজ কোম্পানি থেকে দীনুর নামে পাঁচশো টাকা এসেছে।সেই ডাকের বস্তা পিঠে নিয়ে হরিপুর পোস্ট অফিসে পৌঁছে দীনু।সেখানকার পোস্টমাস্টার দীনুর টিপসই নিয়ে চিঠি খুলে দীনুকে পাঁচশো টাকা বের করে দেন আর খামের ভেতরের চিঠিটা পড়ে দেখেন নিতাইয়ের সংবাদ সেখানে।নিতাই জাহাজে খালাসীর করত, মারা গেছে সে।তার সঞ্চিত অর্থ কোম্পানি দীনুর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।দীনুর চোখের জল গড়িয়ে মাটিতে পরছিল।
‘‘থাকিতে থাকিতে অকস্মাৎ তাহার মনে হইল, উঃ, এমন সংবাদ এই দীর্ঘকাল ধরিয়া নিত্য নিত্য কত সে বহিয়া আনিয়াছে। কত-- কত-- কত-- সংখ্যা হয় না। মনে হইল, আজ পর্যন্ত যত রোদনধ্বনি সে শুনিয়াছে, সে সমস্ত দুঃসংবাদ সে-ই বহন করিয়া আনিয়াছে।
চোখের জল মুছিয়া সে ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমি আর কাজ করব না বাবু, কাজে জবাব দিলাম’’।
মূল গল্পটা এখানেই শেষ হয়।
ক্লাস সেভেনে গল্পের পুরোটুকু দিলে দীনুর উপলব্ধিটুকুর কিছুই বুঝতাম না।তাই জায়গামত কেটে গল্পটা ছোট করে আমাদের মূল্যবোধের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল আবার একই সাথে তারাশঙ্করের লেখার সাথেও পরিচয় করানো হয়েছিল।
আগ্রহী পাঠকদের জন্য পুরো গল্পটা মন্তব্যে দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৬