খিলাফত। মধ্যযুগ ও অধুনিক যুগের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। মধ্যযুগের পৃথিবীতে যেসব উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যের উত্থান হয়েছে তার মধ্যে একাধিক সাম্রাজ্য পরিচিত ছিল ‘খিলাফত’ নামে। প্রশ্ন হল খিলাফত কী? সহজ ভাষায় খিলাফত মানে হল ইসলাম ধর্ম প্রভাবিত রাষ্ট্রব্যবস্থা। মধ্যযুগের ইউরোপে যেভাবে ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিল ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ সেভাবে ইসলাম ধর্মের প্রভাবে আরব অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল ‘খিলাফত’ সাম্রাজ্য। একসময় এ সাম্রাজ্য তিন মহাদেশজুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল।
পশ্চিম ইউরোপের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্ব ছিল ৮০০ সাল থেকে ১৮০৬ সাল পর্যন্ত। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি খিলাফতের স্থায়ীত্ব ছিল ৬৩২ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। ইউরোপের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য যেরকম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল একটিমাত্র সামাজ্য ছিল না তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি খিলাফতও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল একটিমাত্র সামাজ্য ছিল না।
ইউরোপীয় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য হল একের পর এক গড়ে ওঠা কতগুলো সাম্রাজ্য যেমন-ক্যারোলিঞ্জিয়ান সাম্রাজ্য, অটোনিয়ান সাম্রাজ্য, স্যালিয়ান-ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্য, হার্বসবাগ সাম্রাজ্য প্রভৃতি সাম্রাজ্যের সমষ্টি। অন্যদিকে ইসলামি খিলাফত হল খিলাফতে রাশেদা, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসীয় খিলাফত, উসমানীয় খিলাফত প্রভৃতি সাম্রাজ্যের সমষ্টি।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের এসব সাম্রাজ্য ছিল প্রধানত বিভিন্ন রাজবংশের হাতে গড়ে ওঠা রাজতন্ত্রী বা সামন্ততন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের মতই খিলাফতের ইতিহাসও রচিত হয়েছে মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্থান ও পতনকে কেন্দ্র করে। তবে ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের’ ইতিহাসের গতিধারার সাথে ‘খিলাফতের’ ইতিহাসের কিছু মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ খ্রিষ্টধর্মের মূল ভিত্তি ছিল না। খ্রিষ্টধর্মের মূল ভিত্তি ছিল চার্চ সংগঠন যা এ সাম্রাজ্যের জন্মের প্রায় আটশ’ বছর পূর্বে গড়ে উঠেছিল। চার্চ সংগঠন কয়েকটি অংশে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল ক্যাথলিক চার্চ। ক্যাথলিক চার্চের প্রধানকে বলা হতো পোপ। ৮০০ সালে ক্যাথলিক পোপই ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের’ ধারণাটি সৃষ্টি করেছিলেন। তখনকার পোপ তৃতীয় লিও ফ্রাঙ্ক সম্রাট শার্লামেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে খ্রিষ্টান সাম্রাজ্য হিসেবে ধর্মীয় স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন।
পোপ শার্লামেনের মাথায় খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যের অধিপতির মুকুট তোলে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই পোপ কর্তৃক ‘পবিত্র রোমান সম্রাটের’ মাথায় মুকুট তোলে দেওয়ার রীতি চালু হয়। ‘পবিত্র রোমান সম্রাটের’ পোপীয় অভিষেকের এ রীতিটি একটি ধর্মীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং এর মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র ও চার্চ- এ দুটি আলাদা সংগঠনের যৌথ কর্তৃত্ব। পোপ হতেন ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের’ ধর্মীয় প্রধান আর পোপ কর্তৃক অভিষিক্ত সম্রাট হতেন এ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক প্রধান।
মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বে এধরণের কোন যৌথব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না। ইসলামি দুনিয়ায় ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য চার্চের মতো কোন ধর্মীয় সংগঠন গড়ে ওঠেনি। মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বাইরে আলাদা কোন ধর্মীয় সংগঠন গড়ে তোলেননি। অবশ্য ইসলাম ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক পদ্ধতির তেমন কোন প্রয়োজনীয়তাও নেই। কারণ ইসলাম ধর্মের আরাধনা রীতি খ্রিষ্টধর্মের মতো এতটা যাজকনির্ভর নয়। তাই মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য যাজক সংগঠনের উপস্থিতি অপরিহার্য নয়।
এ কারণে ইসলামি দুনিয়ায় চার্চের মতো কোন শক্তিশালী যাজকতন্ত্র গড়ে ওঠেনি। ইসলামি দুনিয়ার সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল রাষ্ট্রের হাতে। এ রাষ্ট্র হল খিলাফত রাষ্ট্র। ইসলামি দুনিয়ার ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক- উভয় ধরণের কর্তৃত্বের অধিকারী হতেন খলিফা। খলিফা অন্য কারও কাছে অভিষিক্ত হতেন না এবং অন্য কারও কাছে তাকে ধর্মীয় জবাবদিহিতা করতে হতো না। ধর্মবেত্তাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যা গ্রহণে খলিফা বাধ্য থাকতেন না। তাই ইসলামের ইতিহাসের কতিপয় সেরা ধর্মবেত্তার ব্যাখ্যাও তাদের সমসাময়িক খলিফারা গ্রহণ করেননি।
যদিও মধ্যযুগে কয়েকজন জনপ্রিয় ইসলামি ধর্মবেত্তার জন্ম হয়েছিল, তাদের কোন ক্ষমতার ভিত্তি ছিল না। কোন কোন সময় পশ্চিম ইউরোপের ক্যাথলিক পোপ যেভাবে অবাধ্য সম্রাটকে ধর্মচ্যূত ও ক্ষমতাচ্যুত ঘোষণা করতে পারতেন সেভাবে ইসলামি ধর্মবেত্তারা স্বৈরাচারী খলিফাদেরকে পদচ্যুত করতে পারেননি। উল্টো এসব ‘ইমাম’ বা ধর্মবেত্তারা খলিফার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার হয়েছিলেন। খিলাফতের ইতিহাসে কখনোই ইসলামি ধর্মবেত্তারা খলিফার কর্তৃত্বের সমান্তরাল কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারেননি।
খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে যেভাবে চার্চ ও রাষ্ট্র একে অপরের পরিপূরক অথবা প্রতিদ্বন্ধী ছিল ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে সেরকম কিছুই নেই। ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মের এ পার্থক্যের ভিত্তি হল এ দু’ধর্মের উত্থানপর্বের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা। রোমান সাম্রাজ্যে আবির্ভূত খ্রিষ্টধর্মের প্রাথমিক তিনশ’ বছর কেটেছিল রাষ্ট্রীয় অত্যাচার-নিপীড়ণ ও হুমকির মুখে। তখন এ ধর্মের মানুষের সামনে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কোন সুযোগই ছিল না। একসময় রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের দয়ায় খ্রিষ্টানরা মুক্তি পায়, কিন্তু সাথে সাথেই তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় জড়িয়ে পড়েনি।
এর কারণ খ্রিষ্টানরা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার হওয়ায় তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ও প্রার্থনার রীতিনীতি বিকশিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে দূরে, আধ্যাত্মিক নির্জনতায় অথবা গোপনে। রাজনৈতিক জীবনের বাইরে এসে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুবাদে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল ধর্মযাজকদের অরাজনৈতিক সংগঠন চার্চ। চার্চের ধর্মগুরুরা খ্রিষ্টানদের মধ্যে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজ করতেন।
রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের যুগ শেষ হওয়ার পরও চার্চ সরাসরি রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হয়ে যায়নি। রোমান সম্রাটরাও চার্চকে রাষ্ট্রীয়করণের প্রয়োজন বোধ করেননি এবং তারা বাইরে থেকেই এ সংগঠনকে সহায়তা করে যেতে থাকেন। একসময় চার্চের সম্পত্তিও বৃদ্ধি পায়। এভাবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি এক স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে চার্চের অগ্রযাত্রা চলতে থাকে। একসময় চার্চ রাষ্ট্রের সমান্তরাল শক্তিতে পরিণত হয়। এমনকি কোন কোন সময় এ সংগঠনের প্রভাব রাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
অন্যদিকে ইসলামের উত্থান ঘটেছিল এমন এক ভূখণ্ডে যেখানে কোন রাষ্ট্রই ছিল না। ইসলামের নবীর মৃত্যুর পর মুসলমানরাই এ ভূখণ্ডে রাষ্ট্রের জন্ম দেন এবং এ রাষ্ট্র এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে শীঘ্রই ছড়িয়ে পড়ে আরবের চারদিকে। ইসলামপূর্ব আরবের সমাজ ছিল গোত্রবাদী। তাই ইসলামের উত্থানপর্বে (নবীর সময়ে) মুসলমানদেরকে কোন রাষ্ট্রীয় হুমকির মধ্যে পড়তে হয়নি; সে সময়য়ে মুসলমানদের যুদ্ধগুলো ছিল মূলত বৈরী গোত্রগুলোর সাথে। এসব গোত্রের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করে মুসলমানরা নিজেদের একটি শক্তিশালী সমাজ গড়ে তোলেছিলেন যা ‘উম্মাহ’ নামে পরিচিত ছিল। ‘উম্মাহ’ শব্দের অর্থ হল ‘সম্প্রদায়’।
নবীর সময়ে ‘উম্মাহ’ কোন রাষ্ট্র ছিল না; আবার এটি প্রচলিত ধারার কোন গোত্রও ছিল না। এটি ছিল মূলত এক ধরণের গোত্রীয় সমন্বয়বাদী সমাজব্যবস্থা। আরবের প্রচলিত গোত্রবাদী সমাজের সাথে এর অনেক বেমিল ছিল। উম্মাহ ছিল নৈরাষ্ট্রবাদী সমাজব্যবস্থার এক নতুন উদাহরণ। উম্মাহ কোন সরকারব্যবস্থা দ্বারা শাসিত ছিল না, এর জেলা বা প্রদেশভিত্তিক কোন বিভাগও ছিল না, উম্মাহর অধীনে কোন রাজনৈতিক প্রশাসন ছিল না, কর আদায়ের জন্য কোন স্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো ছিল না, বেতনভোগী স্থায়ী সেনাবাহিনীও ছিল না এবং কোন জেলখানাও ছিল না। তাই তখনকার উম্মাহ কোন অর্থেই রাষ্ট্রবাদী সমাজ ছিল না।
ইসলামের নবী মক্কা শহর থেকে মদিনায় হিযরতের পর উম্মাহ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর পূ্বে মদিনার প্রধান দুটি গোত্র বানি আওস ও বানি খাযরাজ গোত্রের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার জন্য তিনি সালিশ নিযুক্ত হয়েছিলেন। আরবের গোত্রবাদী সমাজের একটি রীতি ছিল যে, দুটি বিবাদমান গোত্র তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজন অনুভব করলে তারা কাউকে সালিশ হিসেবে নিযুক্ত করত। মহানবী মদিনার দুটি গোত্রের বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সফল সালিশী ভূমিকা পালন করেন। ফলে দুটি গোত্রই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং এবং তাকে মদিনায় স্বাগত জানায়।
উম্মাহ গঠনে এরাই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মদিনা শহরের বুকে একটি গোত্রীয় কনফেডারেশন হিসেবে উম্মাহ সমাজের’ যাত্রা শুরু হয়। আইন নয়, বরং চুক্তিই ছিল এ সমাজের মূল ভিত্তি। উম্মাহ সমাজ যতটা না ছিল ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি ছিল সামাজিক তাৎপর্যমণ্ডিত। এ কারণে মদিনার ইহুদিরাও প্রথমদিকে উম্মাহ সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ড. মফীজুল্লাহ কবীর তাঁর ‘ইসলাম ও খিলাফত’ বইয়ে বলেন:
“বনি আওস ও বনি খাযরাজের আহ্বানে মদিনায় হিযরত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি (মহানবী) মদিনায় একটি স্বস্তি-ব্যবস্থা স্থাপন করার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মদিনা গঠনতন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রথমে আনসার ও মুহাজিরগণকে একটি ‘উম্মাহ’ (সম্প্রদায়) বলে অভিহিত করলেন। মক্কা ও মদিনার মুসলমানগণ ধর্মের ভিত্তিতে একটি সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে পরস্পরকে রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে দায়ী হল।
গোত্রীয় আনুগত্য, যার ভিত্তি ছিল রক্তসম্পর্ক, এ রক্ষা-ব্যবস্থায় তা নিতান্তই গৌণ স্থান অধিকার করল। মুসলমানগণ মুখ্যত একে অপরকে রক্ষার জন্য পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ হল। মুসলমানরাই মদিনার স্বস্তি-ব্যবস্থার প্রাণস্বরূপ ছিল। কিন্তু দূরদর্শী রাজনীতিকের মতো হযরত দেখতে পেলেন যে, মদিনা শহর ও এর আশেপাশে বহু ছোট বড় ইহুদি সম্প্রদায়ও বসবাস করছে।
তিনি (মহানবী) বুঝতে পেরেছিলেন যে, মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়সমূহকে বাদ দিয়ে মদিনায় কোন স্বস্তি-ব্যবস্থা কায়েম করা যাবে না। তাই তিনি ইহুদিদেরকে তাঁর রক্ষা-ব্যবস্থায় শামিল করে নিলেন এবং মদিনা গঠনতন্ত্র অনুসারে ইহুদিগণকেও উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত করা হল। এখানে উম্মাহর তাৎপর্য রাজনৈতিক; ধর্মের সঙ্গে এর কোন যোগাযোগ ছিল না।”
এভাবে মদিনা শহরে যে নতুন নিয়মভিত্তিক সমাজব্যবস্থা চালু হয় তা পরবর্তীতে আরবের বুকে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। গোত্রবাদী সমাজের চিরায়ত নিয়মের স্থলে ইসলাম যেসব নতুন সামাজিক নিয়ম চালু করে তা আরবের বহুদাবিভক্ত গোত্রবাদী সমাজকে এক বিশাল ঐক্যবদ্ধ সমাজের পথে নিয়ে যায়। ইসলামের নিয়মানুযায়ী বিভিন্ন গোত্রগুলোর পারস্পরিক বিরোধ মিটিয়ে তাদেরকে এক বিশাল শক্তিতে পরিণত করেছিলেন মহানবী।
সে যুগের যুদ্ধে অস্ত্রের চেয়ে দৈহিক শক্তিই ছিল বেশি কার্যকর। তাই ইসলামের ছায়াতলে এসে যখন সকল আরব গোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল তখন তারা হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি। এ সামরিক শক্তি গড়ে উঠেছিল মূলত মহানবীর মৃত্যুর পর। মহানবীর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় খিলাফত রাষ্ট্র। খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহের রাষ্ট্রবাদী সমাজে উত্তরণ ঘটে ।
এ নবগঠিত আরব রাষ্ট্র তখনকার পারস্য সাম্রাজ্য এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে তছনছ করে দেয়। এর কারণ এ দুটি সাম্রাজ্যই তখন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল। ৬০২ সাল থেকে ৬২৭ সাল পর্যন্ত চলে আসা পারস্য-বাইজেন্টাইন যুদ্ধে এই দুই সাম্রাজ্যই পর্যুদস্থ হয়ে গিয়েছিল। তাই ৬৩২ সালে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পরের দিনই খলিফা আবু বকর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন।
৬৩২ সালের ৮ জুন মহানবীর সাথে সাথেই তাঁর সাহাবীরা খিলাফত রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন এবং নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে হযরত আবু বকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। মহানবীর জীবদ্দশায় কখনও নেতা নির্বাচনজনিত কোন সংকট সৃষ্টি হয়নি। এর কারণ তখনকার উম্মাহ সমাজে নবীই ছিলেন আপাদমস্তক নেতা; সকল কাজে নেতৃত্ব দিতেন তিনিই এবং সকল প্রশ্নেরও সমাধান আসত তাঁর কাছ থেকেই।
তাঁর জীবদ্দশায় মুসলমানদের মধ্যে বড় ধরণের কোন রাজনৈতিক মতবিরোধের ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু ইসলামের নবীর মৃত্যুর পরপরই মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের প্রশ্নে মতবিরোধের সূচনা হয়। প্রাথমিকভাবে মুসলমানদের এ মতবিরোধের সূরাহা হলেও পরবর্তীতে আবার নতুন মতবিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন।
একসময় মহানবীর সাহাবাদের মধ্যে জমল যুদ্ধ, সিফফীনের যুদ্ধ ও খাওয়ারিজ যুদ্ধের মতো ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছিল। এ তিনটি যুদ্ধে প্রায় নব্বই হাজার সাহাবী ও তাবেঈনদের প্রাণ ঝরে গিয়েছিল। এসব ঘটনা ছিল মূলত রাষ্ট্রবাদী সমাজে উত্তরণের অনিবার্য পরিণতি। এসব সংকটের মূলে ছিল ‘রাজনৈতিক সংকট’ যা মুসলমান সমাজকে ‘উম্মাহ’ হতে ‘রাষ্ট্রে’ উত্তরণের রক্তাক্ত পথে চালিত করেছিল।
উম্মাহের রাষ্ট্রে উত্তরণের এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল মহানবীর মৃত্যুর পরপরই। মহানবীর মৃত্যুর পর মুসলমানদের মধ্যে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় সেটি হল, উম্মাহ এবার কোন পথে যাবে? কে দেবে এই উম্মাহর নেতৃত্ব? আর কীভাবেই বা নির্বাচিত হবে এর নেতৃত্ব? তৎকালীন অনারব রাষ্ট্রবাদী সমাজে কিংবা আরব গোত্রবাদী সমাজের নেতৃত্ব নির্ধারণের যেসব পদ্ধতি প্রচলিত ছিল তা মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না।
কারণ মুসলিম উম্মাহ আরব ঐতিহ্য অনুযায়ী গোত্রবাদী সমাজের নিয়মে পরিচালিত ছিল না; আবার এটি প্রচলিত রাষ্ট্রবাদী সমাজের মতোও ছিল না। তাই ৬৩২ সালে মহানবীর মৃত্যুর পর উম্মাহ এক গভীর সংকটের মুখোমুখী হয়। আরব উপদ্বীপের ক্ষয়িষ্ণু গোত্রবাদী সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা এই উম্মাহের সামনে গোত্রীয় সমাজের নিয়মে ফিরে যাওয়ার কোন পথ ছিল না। আবার অনারব রাষ্ট্রবাদী সমাজগুলোও এই উম্মাহর জন্য কোন আদর্শ ছিল না। ইসলামের দৃষ্টিতে তৎকালীন পৃথিবীর রাষ্ট্রবাদী সমাজগুলো ছিল একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
কিন্তু রাষ্ট্রবাদী কিংবা গোত্রবাদী সমাজের কোন বিকল্পও তখন উম্মাহের সামনে ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা এক সরল প্রকৃতির রাষ্ট্রবাদকেই বেছে নেন এবং উম্মাহ পরিণত হয় এক নব্য ইসলামি রাষ্ট্রে। নৈরাষ্ট্রবাদী সমাজ থেকে রাষ্ট্রবাদী সমাজে উত্তরণের এ পর্বে উম্মাহ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠলেও দুর্বল হয়ে পড়ছিল এর আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি এবং আধ্যাত্মিকতার স্থলে রাজনীতিই সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিল।
ইসলামে রাষ্ট্রগঠন কিংবা না গঠনের ব্যাপারে সরাসরি কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতই হুকুমাত গঠন করা এবং না করার বিষয়টি মুসলমানদের সিদ্ধান্তের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র বা হুকুমাত গঠন করতে গেলে তা কোন মডেলের হবে সেটিও মুসলমানদেরই সিদ্ধান্তের বিষয়। এসব ক্ষেত্রে সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মুসলমানদের সিদ্ধান্ত নির্ধারণ এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পথ খোলা রয়েছে।
তাই খিলাফত গঠন এবং খলিফা নির্বাচনের বিষয়টি মুসলমানদের একটি জাগতিক সিদ্ধান্তের বিষয় হিসেবেই দেখা দিয়েছিল। সাহাবীদের মধ্যে খিলাফতসংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টিও ছিল জাগতিক বিরোধ। এটি কোন ধর্মীয় বিরোধ ছিল না। খিলাফত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রবাদী সমাজে উত্তরণের ক্ষেত্রে মুসলমানরা একই সাথে বিপুল সম্ভাবনা এবং ক্ষমতাসংক্রান্ত প্রকট জাগতিক সমস্যা- দুটোরই মুখোমুখী হয়েছিলেন।
উম্মাহর রাষ্ট্রবাদী সমাজে উত্তরণের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল মহানবীর মৃত্যুর সাথে সাথেই। ক্ষমতা বা নেতৃত্বের প্রশ্নে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও দেখা দেয় সেদিন থেকেই। উম্মাহর নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রশ্নে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সংকটের সূচনাও হয় সেদিন থেকেই এবং মূলত এ সংকটের মধ্য দিয়েই উম্মাহর রাজনৈতিক ইতিহাসের সূচনা হয়। মহানবীর পর নেতা নির্বাচনের প্রশ্নে মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধের কারণ হল মহানবী কর্তৃক তাঁর উত্তরাধিকারী না রেখে যাওয়ার ঘটনা।
অধিকাংশ মুসলমানের মতে, মহানবী কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যাননি। যেহেতু মহানবীর সময়ে উম্মাহর মধ্যে প্রচলিত কায়দায় কোন রাষ্ট্রকাঠামো কিংবা ক্ষমতাকাঠামো গড়ে ওঠেনি সেহেতু কাউকে তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাওয়ার কথাও নয়। কিন্তু অন্ততপক্ষে তাঁর আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম থেকেই গুরুতর হয়ে দেখা দেয়। মহানবীর মৃত্যুর সাথে সাথেই সবার মনে যে প্রশ্নটি সবার আগে দেখা দেয় সেটি হল, কে হবেন উম্মাহর এখনকার আধ্যাত্মিক নেতা?
উম্মাহর আধ্যাত্মিক নেতাই যে আশু ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে উঠবেন তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। আধ্যাত্মিক নেতৃত্বই যে উম্মাহর রাজনৈতিক নেতৃত্বে রূপ নিবে তা মুসলমানগণ মহানবীর মৃত্যুর প্রথম দিনেই উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তারা নেতা নির্বাচনের প্রশ্নে যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন এবং উম্মাহর নেতার পদটি কে অলংকৃত করবেন সে প্রশ্নে মুসলমানদের তিনটি দলের তিন ধরণের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে যাওয়ার পূর্বে দুটি বিষয়ের আলোচনা করা যাক।
প্রথমত, মুসলিম উম্মাহের নেতার উপাধীর ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা যাক। মুসলিম উম্মাহের প্রধানের জন্য মোট তিনটি উপাধী প্রচলিত হয়েছিল। কিন্তু ইসলামে যেহেতু ‘হুকুমাত’ বা ‘রাষ্ট্রবাদের’ কোন স্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেহেতু এসব উপাধীও সরাসরি ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ অর্থে ইসলামে স্বীকৃত নয়। কোরআনে বা হাদীসে ‘রাষ্ট্রপ্রধানের’ কোন উল্লেখ নেই। ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য যে তিনটি উপাধী প্রচলিত হয়েছে তা কোরআন বা হাদীস দ্বারা নির্ধারিত নয়। এ তিনটি উপাধী হল: আমীরুল মুমিনীন, ইমামুল মুসলিমুন ও খলিফাতুল মুসলিমুন। এর মধ্যে ‘খলিফা’ উপাধীটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে।
‘খলিফা’ শব্দের অর্থ হল ‘প্রতিনিধি’। কোরআনে ‘খলিফা’ বলতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সকল মানুষকে বোঝানো হয়েছে; ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানকে বোঝানো হয়নি। আবার কিছু কিছু হাদীসে ‘খলিফা’ বলতে ‘উম্মাহর প্রতিনিধি’ বা ‘প্রধান ধর্মীয় নেতা’ বোঝানো হয়েছে; সরকারপ্রধানকে বোঝানো হয়নি। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন খলিফার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: “মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর পর যারা তাঁর আদর্শ ও দাওয়াত প্রচারণার দায়িত্ব পালন করেন তাদেরকেই বলা হয় খলিফা”। ইবনে খালদুনের এই সংজ্ঞায় খলিফার রাজনৈতিক পরিচয়টি প্রাধান্য পায়নি। খলিফা বলতে ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধানকেই বোঝানো হতো এবং কখনো একই সাথে একাধিক ব্যক্তি খলিফা হতে পারতেন না।
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন সেটি হল ইসলামের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি। আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি যে, মহানবী কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করে যাননি। তিনি নিজেকে শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই তাঁর পরে ইসলামের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য অন্য কোন নবীর আগমণের অবকাশ ছিল না। পূর্ববর্তীতে ইসরাইলীদের মধ্যে একের পর এক নবী এসে ধর্মীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করতেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মে এ পথ বন্ধ থাকায় ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার চালু রাখার একমাত্র পথ ছিল স্বয়ং মহানবী কর্তৃক উত্তরাধিকারী মনোনয়নের একটি ধারা চালু করে যাওয়া; কিন্তু তা হয়নি।
খ্রিষ্টধর্মে অনুরূপ একটি ধারা চালু রয়েছে। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী রোমের পোপরা হযরত যিসাসের কাছ থেকে পাওয়া ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার বহন করে আসছেন। ক্যাথলিকরা দাবী করেন স্বয়ং হযরত যিসাসের কাছ থেকে ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন তাদের প্রথম পোপ সেইন্ট পিটার। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনুরূপ একটি বিশ্বাস পোষণ করে কেবল শিয়ারা। শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী মহানবীর পর আর কেউ নবী না হলেও তাঁর মৃত্যুর পরপরই ধর্মীয় ইমামতির একটি সিলসিলা চালু হয়ে যায় আর হযরত আলী ছিলেন এ সিলসিলার প্রথম ইমাম।
তাদের বিশ্বাস, ইসলামের নবী হযরত আলীকে ইসলামের ইমামতির দায়িত্ব প্রদান করে যান; হযরত আলী এ দায়িত্ব প্রদান করে যান তাঁর পুত্র হযরত হাসানকে, হাসান তাঁর ইমামতির উত্তরাধিকার দিয়ে যান ছোট ভাই হোসেনকে। এভাবে ইসলামের ইমামতির একটি ধারা সৃষ্টি হয়। অবশ্য ইমামদের সংখ্যার ব্যাপারে সকল শিয়ারা একমত নন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন সাতজন ইমামের পর এ ধারাটি বন্ধ হয়ে যায় আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন বারোজন ইমামের পর ধারাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তবে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই শিয়াদের ইমামতির ধারায় বিশ্বাস করেন না। এ অংশটির নাম ‘সুন্নী’। সুন্নীরা বিশ্বাস করেন মহানবী কাউকেই তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি। তিনি এ বিষয়টি মুসলমানদের সিদ্ধান্তের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। মহানবীর উত্তরাধিকারী নির্বাচনের এখতিয়ার উম্মাহর হাতে অর্পিত হওয়ার ব্যাপারটিকে অনেকে আধুনিক গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের মিল হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তবে গণতন্ত্রই হোক আর রাজতন্ত্রই হোক- এ সম্পর্কে সরাসরি ভালো-মন্দ কোন কিছু ইসলামে বলা হয়নি।
মহানবী কর্তৃক কোন উত্তরাধিকারী না রেখে যাওয়ার ব্যাপারটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার। হযরত উমর সর্বপ্রথম এ ব্যাপারে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর এ বিবৃতির পূর্বে কেউ কেউ মনে করতেন মহানবী হয়ত হযরত আবু বকরকে তাঁর উত্তরাধিকারী রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত উমার তাঁর মৃত্যুর পূর্বে এ ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন: “আমি যদি খলিফা নিয়োগ করে যাই তাহলে বুঝে নিও যে, যিনি (মহানবী) আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিলেন তিনিও খলিফা নিয়োগ করে গিয়েছিলেন। আর যদি আমি ব্যাপারটি মুসলমানদের স্বাধীন বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়ে যাই তাহলে বুঝে নিও যে, যিনি (মহানবী) আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ছিলেন তিনিও ওটা তাদের স্বাধীন বিবেচনার ওপর সোপর্দ করে গিয়েছিলেন।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৪৯)
এ বক্তব্য প্রদানের পরবর্তীতে হযরত উমার কখনোই তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে কাউকে খলিফা মনোনীত করেননি এবং এ অবস্থাতেই মৃত্যবরণ করেছিলেন। এ ঘটনা থেকে হযরত উমারের বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা দাঁড়ায় তা হল মহানবীও হযরত আবু বকরকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি। মহানবীর মৃত্যুর সময়ে তাঁর কোন পুত্র সন্তানও জীবিত ছিলেন না। তাই মহানবীর মৃত্যুর পর উম্মাহর নেতা নির্বাচনের প্রশ্নে একটি জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
মহানবী মৃত্যুবরণ করেছিলেন মদিনায়। সেখানে তাঁর দু’ধরণের অনুসারীদের নিয়ে তিনি অবস্থান করছিলেন। তাঁর অনুসারীদের এ দুটি দল হলো: আনসার ও মুহাজির। মদিনার স্থানীয় অধিবাসী মুসলমানদেরকে বলা হত আনসার। এরাই একসময় মক্কা থেকে আগত মুসলমানদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, যারা মক্কা বা অন্যত্র থেকে হিজরত করে মদিনায় এসে বসবাস করছিলেন তাদেরকে বলা হত মুহাজির। মহানবীর মৃত্যুর পর নেতা নির্বাচনের প্রশ্নে আনসার ও মুহাজিররা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
প্রথমত, আনসাররা দাবি করেন যে, ইসলামের দুর্দিনে তারা মহানবী ও মুহাজিরদেরকে আশ্রয় দিয়ে ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই নেতৃত্বের পদ তাদেরই প্রাপ্য। মহানবীর মৃত্যুর পর তারা খাযরাজ গোত্রের প্রধান সাদ বিন উবাইদার নেতৃত্বে বনু সায়েদা গোত্রের ছাদযুক্ত চত্বরে জমায়েত হন। সেখানে তারা সাদ বিন উবাইদাকে খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে জোটবদ্ধ হন।
দ্বিতীয়ত, মুহাজিরদের একটি অংশ হযরত আলীর বাড়ীতে ঐক্যবদ্ধ হন। হযরত আলী ইবনে আবু তালিব ছিলেন মহানবীর সন্তানতুল্য। মহানবীর একমাত্র জীবিত সন্তান বিবি ফাতেমার স্বামী ছিলেন তিনি। তাই হযরত আলীর সমর্থকরা তাকেই মহানবীর একমাত্র ন্যায্য উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করেন। যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহর মতো বিশিষ্ট সাহাবীরা হযরত আলীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, মুহাজিরদের আরেকটি বড় অংশ ঐক্যবদ্ধ হয় হযরত আবু বকর ও হযরত উমারের নেতৃত্বে। উসাইর ইবনে হুদাইরের নেতৃত্বে বনু আবদুল আশহাল গোত্রও তাদের সাথে যোগ দেয়। এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর ও উমার খবর পেলেন আনসারী সাহাবারা সাদ বিন উবাইদার নেতৃত্বে বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে আলাদাভাবে জোটবদ্ধ হয়েছেন। এই জটিল পরিস্থিতি নিরসনের জন্য হযরত আবু বকর ও উমার বনু সায়েদার চত্বরে আনসারী সাহাবীদের সাথে বোঝাপড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
এ প্রসঙ্গে ইসলামের প্রথম ইতিহাস সংকলক ইবনে ইসহাক বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ইনতিকালের পর আনসারী সাহাবীদের একটি দল বনু সায়েদার ছাদযুক্ত চত্বরে জমায়েত হয়ে সাদ ইবনে উবাইদার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হল। .......এই সময় এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর ও উমারের কাছে এসে বলল, “আনসারদের দলটি বনু সায়েদার চত্বরে জমায়েত হয়ে সাদ বিন উবাইদার নেতৃত্বে আলাদাভাবে জোটবদ্ধ হয়েছে। এমতাবস্থায় তোমরা যদি মুসলমানদের ঐক্য বজায় রাখার প্রয়োজন অনুভব কর তাহলে তাড়াতাড়ি তাদের কাছে যাও। নচেৎ অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। অথচ এখনও পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাফন দাফনও সারা হয়নি। তাঁর পরিবার এখনও তাকে রুদ্ধদার গৃহে সংরক্ষণ করছেন।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৫২)
এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে হযরত উমার বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ইনতিকালের পর আমরা খবর পেলাম যে, আনসারগণ আমাদের বিরোধীতা করছেন। তারা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে তাদের গণ্যমান্য মুরব্বীদের নিয়ে সমবেত হলেন। অন্যদিকে আলী ইবনে আবু তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও তাদের সমর্থকগণ আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলেন।
আর অনেক মুহাজির এসে জমায়েত হলেন আবু বকরের কাছে। আমি আবু বকরকে বললাম, “আপনি আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আনসার ভাইদের কাছে চলুন।” .....অতঃপর আমরা বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে গিয়ে হাজির হলাম। .....আমরা দেখতে পেলাম, তারা আমাদেরকে আমাদের মূল আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করতে চাইছে এবং জোরপূর্বক নিজেদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে।
আমি এর জবাবে চমৎকার একটি বক্তৃতা তৈরী করলাম এবং তা আমার নিজের কাছে অত্যন্ত যুৎসই মনে হয়েছিল। আমি আবু বকরকে শোনাতে চাইলাম। .....আবু বকর বললেন, “উমার! তুমি কিছু বলো না।”..... তিনি তাদের কথার এত সুন্দরভাবে জবাব দিলেন যে, আমি অনেক সময় ধরে চিন্তা ভাবনা করে যে বক্তৃতা তৈরী করেছিলাম- যাতে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম, তাঁর উপস্থিত বক্তৃতায় এর একটি কথাও বাদ তো গেলই না বরং এর চেয়েও ভাল কথা তিনি বললেন।
তিনি বললেন, “তোমরা নিজেদের মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী ও অবদান সম্পর্কে যা বলেছ তা যথার্থ বলেছ। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, এই কুরাইশ গোত্রের অবদান না থাকলে আরবরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারত না। তারা আরবদের মধ্যে মধ্যম ধরণের বংশীয় মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের আবাসিক এলাকাও সমগ্র আরব জাতির মধ্যস্থলে অবস্থিত। আমি তোমাদের সবার জন্য (কুরাইশদের মধ্য থেকে) এ দু’জনের যে কোন একজনকে পছন্দ করব। তোমরা এদের মধ্যে যাকে পছন্দ কর তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হও ও বাইআত কর”।
একথা বলে তিনি আমার ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহর হাত ধরলেন। আবু বকরের এই ভাষণের পর আনসারদের একজন বললেন, “আমরা আরবদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তায় যেমন নির্ভরযোগ্য, মান মর্যাদায়ও তেমনি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমাদের পক্ষ থেকে একজন এবং তোমাদের (কুরাইশদের) পক্ষ থেকে আর একজন আমীর হোক।” এরপর প্রচুর বাকবিতণ্ডা হল এবং বেশ চড়া গলায় কথাবার্তা হতে লাগল। আমার আশংকা হল যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের দুই গোষ্ঠী মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটি বিভেদ বা কলহের সৃষ্টি হয়ে না যায়।
আমি সকল বিতর্কের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে তৎক্ষণাৎ বললাম, “হে আবু বকর, আপনার হাতখানা বাড়িয়ে দিন।” তিনি বাড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাত ধরে বাইআত করলাম। এরপর মুহাজিররা বাইআত করলেন। তারপর আনসাররাও বাইআত করলেন। এরপর আমরা সাদ বিন উবাইদাকে বকাঝকা করতে আরম্ভ করলাম। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে তাদের একজন বললেন, “তোমরা সাদ বিন উবাইদাকে কোণঠাসা করে দিলে।” আমি বললাম, “আল্লাহই সাদ বিন উবাইদাকে কোণঠাসা করলেন।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৫৪-৩৫৫)
হযরত আনাস ইবনে মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে যুহুরী জানান: বনু সায়েদা গোত্রের চত্বরে খিলাফতের প্রাথমিক বাইআত গ্রহণের পরদিন হযরত আবু বকর মসজিদের মিম্বরে বসেন। সেখানে হযরত উমর হযরত আবু বকরের নেতৃত্বের সমর্থনে এক বক্তব্য প্রদান করেন এবং উপস্থিত লোকজনকে হযরত আবু বকরের কাছে বাইআত গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “তোমরা তাঁর কাছে বাইআত করে তাকে খলীফা বা আমীর হিসেবে গ্রহণ কর।” তখন লোকেরা দ্বিতীয়বার তাঁর হাতে বাইআত করল। এটিই ছিল বনু সায়েদা চত্বরের বাইআতের পর সার্বজনীন বাইআত। (সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা: ৩৫৬)
হযরত আবু বকরের খলিফা হওয়ার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের নিজেদের একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এ রাষ্ট্র পরিচিতি লাভ করে খিলাফত নামে। মদিনায় খিলাফত গঠনের খুবই অল্প দিনের মধ্যে পুরো আরব উপদ্বীপ এর আওতায় চলে আসে। আরব উপদ্বীপে অবস্থান সুসংহত হওয়ার পর পরই উপদ্বীপের বাইরে মুসলমানদের সামরিক অভিযান শুরু হয়। ৬৩৩ সালে তৎকালীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা দুটি সাম্রাজ্যের সাথে ইসলামি খিলাফতের আনুষ্ঠানিক সংঘর্ষ শুরু হয়।
রোমের পতনের পর যে দুটি উল্লেখযোগ্য সভ্যতা প্রাচীন যুগের ঐতিহ্য নিয়ে কোনমতে টিকে থেকেছিল সেগুলো হল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং পারস্যের সাসানিদ সাম্রাজ্য। ৬০২ সালে এ দুটি সাম্রাজ্য এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে প্রথমদিকে পারসিকরা বিজয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের গতিরোধ করতে সক্ষম হন। ৬২৭ সালের মধ্যে পারসিকরা অধিকৃত অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু ভয়াবহ যুদ্ধ এ দুই সাম্রাজ্যের ভিত্তিই নড়েবড়ে করে দিয়েছিল। ফলে আরব মুসলমানদের আক্রমণের মুখে এ দুই সাম্রাজ্যের সমরশক্তি কোন কাজে আসেনি। আরব মুসলমানরা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। অন্যদিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের আরব প্রদেশগুলোও মুসলমানদের পদানত হয়। বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের হাত থেকে যে অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করেছিলেন সেগুলো আবার হাতছাড়া হয়ে যায়। আনাতোলিয়া অর্থাৎ তুরস্ক ছাড়া সকল প্রাচ্যদেশীয় প্রদেশ বাইজেন্টাইনদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
আরবের ইসলামি খিলাফতের উত্থানের পর কেবল ইউরোপীয় অংশেই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ৬৩২ সালে আরব উপদ্বীপে ইসলামি খিলাফত জন্ম নেয়। ইসলামি খিলাফতের পূর্বে আরব উপদ্বীপে কোন রাষ্ট্র ছিল না। সেখানকার সমাজ ছিল অনুন্নত গোত্রবাদী সমাজ। গোত্রীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে সবসময়ই যুদ্ধ-কলহ লেগে থাকত। ইসলাম ধর্ম সেখানকার অসংখ্য আরব গোত্রকে পারস্পরিক যুদ্ধ থেকে সরিয়ে এনে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের পথ দেখায়।
এতদিন পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের বেদুইন যোদ্ধাদের বিপুল সামরিক শক্তি হারিয়ে যেত কেবল লাগাতার গোত্রীয় যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্যেই । ইসলাম ধর্ম এক ঐক্যবদ্ধ আন্তঃগোত্রীয় সমাজকাঠামোর মধ্যে বিপুল সামরিক শক্তির সমাবেশ ঘটায়। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে মরুচারী আরবরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, তাদের হাতে যে সামরিক শক্তি রয়েছে তা দিয়ে কোন সাম্রাজ্য জয় করে ফেলা সম্ভব।
ইসলামের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর তারা এ অসম্ভবকে সম্ভব করে। ৬৩২ সালে ইসলামি খিলাফত গঠনের পরদিনই খলিফা আবু বকর বাইজেন্টাইন প্রদেশ সিরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে এক বিজয়ের ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করন। এরপর একের পর এক বিজয় আসতে থাকে মুসলমানদের হাতে। ৬৩৪ সালে খলিফা আবু বকরের মৃত্যুর পর নতুন খলিফা হন হযরত উমার।
খলিফা উমারের সময়ে ইসলামি খিলাফতের সবচেয়ে বড় বড় বিজয় অভিযানগুলো সম্পন্ন হয়। পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে কাদেসিয়ার যুদ্ধে এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে ইয়ারমুকের যুদ্ধে আরব মুসলমানদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। মুসলমানরা পারস্যের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয়। বাইজেন্টাইন প্রদেশ সিরিয়া-ফিলিস্তিন ও মিশরে তাদের স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মুসলমানরা তুরস্ক এবং বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টানটিনোপল বিজয় করতে ব্যর্থ হন।
৬৪৪ সালে খলিফা উমারের মৃত্যুর পর নতুন খলিফা হন হযরত উসমান। উসমানের শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে মুসলমানদের বিজয় অভিযান স্তিমিত হয়ে আসে। কারণ সম্ভাব্য সকল সমৃদ্ধ এলাকাই মুসলমানদের দখলে চলে এসেছিল। সহজে জয় করার মতো আর কোন উল্লেখযোগ্য দেশ ছিল না। ইউরোপ ও ভারতে প্রবেশ করা তখন মুসলমানদের জন্য সম্ভব ছিল না। কনস্টানটিনোপল ছিল প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত এমন এক শহর যা দখল করা ছিল খুবই কঠিন।
তাই খলিফা উসমানের শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে খিলাফতের অর্থনীতিতে বেশ মন্দাবস্থা দেখা দেয়। যুদ্ধ-অর্থনীতির সমৃদ্ধি থেকে হঠাৎ এই মন্দাবস্থা দেখা দেওয়ায় ইসলামি খিলাফত বড় ধরণের অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখোমুখী হয়। এই সংকট একপর্যায়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। ৬৫১ সাল থেকে খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
খিলাফতের দুই প্রভাবশালী শাসক পরিবার- উমাইয়া ও হাশেমীদের বিরোধ এবং বেদুইন যোদ্ধাদের বেকারত্বজনিত অসচ্ছলতা ছিল এ বিদ্রোহের মূল কারণ। ইতিহাসের একটি অমোঘ নিয়ম হল, যখনই কোন সাম্রাজ্য সফলতার তুঙ্গে ওঠেছে তখন থেকেই এর অবক্ষয়েরও সূচনা হয়েছে। ইসলামি খিলাফতও এর ব্যতিক্রম নয়। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে এ সাম্রাজ্য সফলতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ায় এর অভ্যন্তরীণ মন্দা ও সংকটের সূচনাও হয়েছে খুবই দ্রুত।
সম্ভাব্য সকল দেশ জয়ের পর মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে যে বিরোধে লিপ্ত হন তার মর্মান্তিক পরিণতি হল খলিফা উসমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। ৬৫৬ সালে বৃদ্ধ খলিফা উসমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিদ্রোহী মুসলমানরা। এরপর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তাতে নব্বই হাজার মুসলমান সৈন্যের প্রাণ ঝরে যায়। পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে এর সিকিভাগ মুসলমান সৈন্যও নিহত হননি।
৬৫৬ সাল থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত হযরত আলীর খিলাফতের পুরো সময়টিই কেটেছে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধে হযরত আলী তাঁর প্রতিদ্বন্ধী খলিফা মুয়াবিয়ার হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত না হলেও কূটনীতিতে তিনি মুয়াবিয়ার কাছে হেরে যান। ফলে হযরত আলীর মৃত্যু পর্যন্ত খিলাফত দুই ভাগে বিভক্তই থেকে যায়। ৬৬১ সালে হযরত আলীর মৃত্যুর পর তাঁর অধীনস্ত এলাকায় খলিফা নির্বাচিত হন তাঁর পুত্র হযরত হাসান। হাসান মাত্র ছয় মাস খলিফা ছিলেন।
হযরত হাসান খলিফা হওয়ার পর নিশ্চিত পরাজয়ের আশংকায় মুয়াবিয়ার সাথে আপোষ করতে বাধ্য হন এবং মুয়াবিয়াকে একমাত্র খলিফা হিসেবে মেনে নেন। সেদিন থেকেই ঐক্যবদ্ধ উমাইয়া খিলাফতের সূচনা হয়। ৭৫০ সাল পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য স্থায়ী ছিল। ৭৫০ সালে শেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের পতনের পর আব্বাসীয় খিলাফতের অভ্যদয় ঘটে।
১২৫৮ সালে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান বাগদাদ দখল করে আব্বাসীয় খিলাফত ধ্বংস করেন। তবে মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যে আব্বাসীয় খিলাফতের পুনর্জন্ম হয়। বাগদাদের পতনের পর মিশরের মামলুক সুলতান সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি মামলুক সাম্রাজ্যে আব্বাসীয় খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। তবে এ খিলাফতের হাতে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে না। খলিফার হাতে কেবল ধর্মীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।
১২৬১ সালে কায়রোতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে আব্বাসীয় খিলাফতের নতুন যাত্রা শুরু হয়। রাষ্ট্র এবং খিলাফতের এ বিভক্তি ছিল অনেকটা ইউরোপের ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ এবং ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো। ইসলামের ইতিহাসে ধর্ম এবং রাজনীতির পৃথকীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এটি।
মিশরের মামলুক সাম্রাজ্য যতদিন টিকেছিল ততদিন সেখানকার আব্বাসীয় খিলাফতও টিকেছিল। ১৫১৭ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের হাতে পতনের পর মিশরভিত্তিক মামলুক সাম্রাজ্য এবং আব্বাসীয় খিলাফত- দুটোই হারিয়ে যায়। মামলুক সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে উসমানীয় সুলতান মক্কা-মদিনাসহ আরব উপদ্বীপের কর্তৃত্ব লাভ করেন। পবিত্র নগরীগুলো হাতে আসায় এবং মামলুক সাম্রাজ্যের আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটায় উসমানীয় সুলতানের নিজেকে খলিফা ঘোষণার পথে আর কোন বাধা থাকল না।
তাই ১৫১৭ সালে উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা ঘোষণা করেন। উসমানীয় খিলাফতের রাজধানী হয় ইস্তাম্বুল। সুলতান প্রথম সেলিমের পুত্র সুলতান সোলায়মান ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের খুবই বিখ্যাত সম্রাট। তবে উসমানীয় সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্রাট ছিলেন সুলতান মাহমুদ ফাতিহ। তিনি ১৪৫৩ সালে কনস্টানটিনোপল জয় করে ইউরোপে উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্থায়ী ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল শাসন চলেছিল শত শত বছর ধরে। তবে পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে এক পর্যায়ে মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থার স্থলে আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজের অভ্যুদয় হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে উসমানীয় সাম্রাজ্য ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। শিল্পবিপ্লব ও পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে যে অর্থনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হয় তাতে সেসব দেশ প্রভূত উন্নতি সাধন করলেও উসমানীয় সাম্রাজ্য ছিল তা থেকে অনেক পিছিয়ে। তাই এক পর্যায়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তির মুখে বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিংশ শতকের গোড়ায় সমগ্র বিশ্বসভ্যতা এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি হয়। পুঁজিবাদী দেশগুলো বিশ্ব-বাজার ও উপনিবেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বেঁধে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম অংশীদার ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ১২৯৯ সাল থেকে চলে আসা উসমানীয় সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে আর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয় নিশ্চিত হয় ১৯১৭ সালে।
১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে দেখা গেল উসমানীয় সাম্রাজ্যের হাতে কেবল আনাতোলিয়া অর্থাৎ বর্তমান তুরস্ক অঞ্চলটুকু বাকী রয়েছে। এ অঞ্চলটুকু নিয়ে তুরস্ক একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। খিলাফত কিংবা সাম্রাজ্যের আর কোন বাস্তব অস্তিত্ব রইল না। ১৯২৪ সালের ১ মার্চ আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তফা কামাল পাশা খলিফা পদটি বিলুপ্ত করেন। শেষ উসমানীয় খলিফা ও সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল মজিদকে পদচ্যুত করে সপরিবারে সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়।
ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা উসমানীয় রাজপরিবারের বংশধররা এখনও তাদের মধ্যে একজন ‘প্রধান ব্যক্তি’ নির্বাচিত করে থাকেন। তাদের সবার মধ্যে যিনি বয়সে সবচেয়ে প্রবীণ হয়ে থাকেন তাকেই উসমানীয় রাজপরিবারের প্রধান ব্যক্তি নির্বাচিত করা হয়। তবে এ পরিবার আর কখনও রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেনি। উসমানীয় খিলাফতের পতনের পর ঔপনিবেশিক ভারতের স্বাধীনতাকামী নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এবং মহাত্মা গান্ধী খিলাফত আন্দোলনের সূচনা করেন।
তারা উসমানীয় খিলাফতের পতনকে ব্রিটিশরাজের একটি চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী নেতা ও জেরুজালেমের গ্রান্ড মুফতি হাজ আমিন হোসাইনীও উসমানীয় খিলাফতের পতনকে ব্রিটিশরাজের একটি চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। হাজ আমিন হোসাইনী খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্রিটিশ শাসিত জেরুজালেমে একটি সম্মেলনের আয়োজনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
১৯২৬ সালে মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রান্ড মুফতির উদ্যোগে আরেকটি সম্মেলন ব্যর্থ হয়। মিশরের সম্মেলনটি পণ্ড করার জন্য আরব উপদ্বীপের শাসক আব্দুল আযীয ইবনে সউদ ১৯২৬ সালের একই সময়ে মক্কায় আরেকটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। ব্রিটিশের সহায়তায় এ সম্মেলনটি সফল হয়। এ সম্মেলনে খিলাফত প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে আরব উপদ্বীপে সউদ পরিবারের শাসনকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
আব্দুল আযীয ইবনে সউদ কথা দেন যে, আরব উপদ্বীপকে তিনি নিজের সম্পত্তি না বানিয়ে সকল মুসলমানদের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করবেন। তবে খুব শীঘ্রই তিনি নিজের অবস্থান পাল্টে ফেলেন। ১৯৩২ সালে আরব উপদ্বীপে সউদ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তিনি নিজের ক্ষমতাকে সুসংহত করেন। তখন থেকে সৌদি আরব একই নিয়মে চলে আসছে।
সৌদি রাজারা কখনও নিজেদেরকে খলিফা ঘোষণা করেননি। অন্যান্য আরব দেশগুলোতেও অনেক সময় অনেক শক্তিশালী ও জনপ্রিয় শাসকের আবির্ভাব হলেও তারা কেউ নিজেদেরকে খলিফা ঘোষণা করেননি। ইসলামি খিলাফতের ১২৯২ বছরের ইতিহাসকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়। অবিতর্কিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত খিলাফতসমূহের সময়কাল ও রাজধানী শহরের নামগুলো নীচে উল্লেখ করা হল।
খিলাফতে রাশেদা (মদিনা/কুফা) : ৬৩২-৬৬১ সাল
উমাইয়া খিলাফত (দামেশক/ হাররান) : ৬৬১-৭৫০ সাল
আব্বাসীয় খিলাফত (কুফা/বাগদাদ/রাকা/সামারা) : ৭৫০-১২৫৮ সাল
আব্বাসীয় খিলাফত (কায়রো) : ১২৬১-১৫১৭ সাল
উসমানীয় খিলাফত (ইস্তাম্বুল) : ১৫১৭-১৯২৪ সাল
লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৪০