গল্প লিখি না, এভাবেই ভাবি, যেনবা লিখি না এমন ভাবলেই লিখতে ইচ্ছে হবে, আর হঠাৎ শুরু হয়ে যাবে নতুন কোনো গল্প। রোজ সকাল থেকে ক’ঘন্টা এভাবে ভেবে ভেবে অবশেষে যখন কলম ধরি, তখন আমার ঘুম আসে। প্রচন্ড ঘুম! ঘুমে টইটুম্বুর আমি যখন এলিয়ে পড়ি, তখনই কেউ যেন সন্তর্পণে আমার পাশে দাঁড়ায়, হাত ধরে, তারপর টানতে টানতে নিয়ে চলে। চলে যেতে থাকে, দূরে, অনেক দূরের অচেনা কোনো দেশে, যেখানে নদী নেই। আমি চলতে চলতেই ঘুমিয়ে পড়ি আরও, আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমের মধ্যেই জেগে উঠি যখন, দেখি, গল্প লেখা শুরু হয়ে গেছে, যেটা খুব সম্ভবত আরেকটা নতুন স্বপ্ন, যা আমি আগেও দেখেছি বহুবার, কিংবা কখনোই দেখেনি। সত্যিকার অর্থেই তখন বিশ্বাস করি, আসলেই আমি গল্প লিখি না, বরং স্বপ্ন দেখি, যারা সেই হাতের আদলে এসে আমাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় অচেনা দেশ, অচেনা ঘর ও অন্ধকার এক টেবিলে, যেখানে জোর করে আমাকে বসিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় ধারাল ছোরা। আমি আনমনেই ছোরাটা আঁকড়ে ধরে লিখতে শুরু করি, আর আমার হাত যততত্র কেটে গিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে রক্ত। রক্ত আর রক্ত! রক্তে রক্তে ভেসে যায় ঘরের মেঝে, যার ভেতর মনের আনন্দে সাঁতার কেটে বেড়ায় অসংখ্য পোকা, ধীরে ধীরে যাদের পাখা গজায়, আর কিছুক্ষণ তারা ঘর ও আমার মাথার চারপাশে উড়াউড়ি করে অবশেষে ঢুকে পড়ে পাতায়!
যে কোনো গল্প শুরুর প্রাক্কালে আমার প্রচন্ড ঘুম আসে, এবং খুব শীঘ্রই তা ভেঙেও যায়। আমি অসহায় বোধ করি, আশপাশ, এদিক-ওদিক তাকাই। কাউকে যেন খুঁজি, খুঁজতেই থাকি, অথচ পাই না। আসলে আমার চারপাশে কখনোই কেউ থাকে না বা ছিল না। অসহায় বোধটা তার নিজস্ব স্বভাবে বাড়তে বাড়তে অপর বেলায় গিয়ে পৌঁছায়। আমি উঠে দাঁড়াই, একটু বাহির চাই। যদিও একটু বাহির মানেই আরও একটু বেশি ভেতর। তাছাড়া আজকাল বাড়ির বাইরে যেতে আমার কেন জানি ভয় করে। মনে হয় বাইরে বেরুলেই ঘুমিয়ে পড়ব, কিংবা আশপাশে থাকা মানুষগুলো পোকা-মাকড় হয়ে উড়ে এসে ঢুকে পড়বে আমার ভেতর। তারপরও বেরুতেই হয়, বেরুতে হয় এজন্য যে, গল্প না লিখতে লিখতে অভ্যাস এমন হয়েছে যে, আজকাল মানুষ অথবা পোকা, যে কোনো একটা না দেখে থাকতে পারি না। বহুবার পোকা ও মানুষ বিষয়ক ভাবনা আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, আমি মানুষ অপেক্ষা পোকা পছন্দ করি বেশি, বিশেষ করে সেইসব পোকা, যারা রক্তের ভেতর মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে কাটতে পাখা গজিয়ে নেয়।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবারই আমি বাম দিকে যাই। ডান দিকে একটা নদী আছে, সেটা মনে থাকে না বলেই বাম। অথচ বাম দিকে কিছুদূর এগিয়ে দেখি, সত্যি সত্যিই ডানদিকের নদীটাকে ভুলে গেছি। ভুলে যাওয়া ব্যাপারটা আমার অনেক আগের, তবে নতুন করে পুনরায় যার কাছে শিখেছিলাম, তার নাম অনেক চেষ্টা করেও এখন আর মনে করতে পারি না। শুধু এটুকু মনে পড়ে সে একজন নারী, যে কখনও আমার না লেখা গল্পগুলোর নায়িকা হতে পারেনি, এবং ডানদিকের সাথে, নদীর সাথে, যার নিবিড় সম্পর্ক আছে। ফারুক একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুই নদীর ধারে যাস না কেন, বল তো?’ আমি ওর প্রশ্নে সরাসরি ওর চোখে তাকাই, কিছু পোকা ওর মাথার আশেপাশে উড়ছিল, খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল ওর মুখ। কিছুক্ষণ পর যখন ও আমাকে জোরে ধাক্কা দিল, আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘তোদের মত ফিরতে পারি না যে’। এবার ও আমার দিকে তাকিয়ে, সম্ববত মাথায়, হয়তবা অনুরূপ কিছু পোকা আমার মাথার চারপাশেও উড়ছিল, আর আমাকে দেখাচ্ছিল বিভৎস।
বস্তুত, আমি কোনোদিনই পারিনি ফিরতে, সেটা বাম হোক কিংবা ডান। ডান দিকে যদিও যাই না, অথচ বাম দিকে গিয়ে শেষ কবে ফিরেছি মনে নেই। হয়তবা আমি কোনো দিক থেকেই ফিরতে পারি না কিংবা চাই না, অথচ ফেরার নেশাটাকে জাগিয়ে রাখার জন্য ডান-বাম পৃথক করে বার বার বামের দিকে যত এগোয়, দেখি ডান দিক আমাকে টানছে সবসময়। আমি অস্থির হয়ে উঠি, আরেকটু জোরে, ক্রমশঃ জোরে, বামে, আরও বাম দিকে এগিয়ে যাই। একসময় দেখি সম্পূর্ণ ডানে এসে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে সেই নদীটা সামনে দিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছে আর আমি তার পিছু নিয়েছি।
বেশ কিছু বছর একটা কষ্ট দিনরাত নিজের ভেতরে লালন করে, ভয়ানক থেকে ভয়ংকর করে তুলে দেখেছি, কষ্ট আসলেই ভীষণ নিরীহ, ওর তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। শুধু ঘরের এককোণে পড়ে থেকে তেল ফুরিয়ে আসা বাতি যেভাবে শেষ হয়ে আসার মুহূর্তে দপদপ করে জ্বলে উঠে অনিবার্যভাবেই নিভে যায়, বেশির ভাগ কষ্টই খুব সাধারণ রূপ থেকে জন্ম নিয়ে প্রকোপ হবার সাথে সাথেই সেভাবে নিভে আসে। শুধু ঘর বলে, দপ করে ওঠার শব্দ কানের ভেতর, মাথার ভেতর, মনের ভেতরে দিন-রাত বাজতে থাকে, ফলতঃ মনে হয় বেঁচে থাকা কষ্টকর! অথচ ব্যাপারটা ভাবলেই আমার হাসি পায়, কেন না কষ্টে মানুষ কখনোই মারা যায় না, অথচ তারপরও সারাক্ষণ মারা যাব, মারা যাব ভাব।
যে কোনো গল্প লেখা শুরু হলে আমি কিছুটা হলেও শংকিত হয়ে উঠি, কারণ আমি জানি আমার গল্পের নায়ক ছাড়া বাকি সবাই অবশ্যম্ভাবীরূপে মারা যাবে। কিছু কিছু গল্পে আমার গল্পের নায়িকারা একদম শুরুতেই মারা যায়, আর তখন কেন জানি গল্পটা লিখে যেতে ভাল লাগে। নায়িকাবিহীন গল্পগুলো খুব সরল হয়, যেনবা সত্যিকারভাবেই বাকি চরিত্রগুলো হেসে-খেলে, যে যার উল্লাসে স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তখন গল্পের ভেতর একটা অনন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়, আর আমি চুপচাপ আর কিছু না লিখে তা উপভোগ করতে থাকি।
যে গল্প শেষ হয়ে যায়, সেটা কোনো গল্পই নয়। চাক্রিক বৃত্তে কোনো কিছুর-ই শেষ হবার জো নেই, চাইলেও তা সম্ভব নয়, আর আমি তা ভাল করে জানি বিধায় কখনও গল্প লিখি না। অথচ ঘরের ভেতরে দিন-রাত ওভাবে বসে থাকলেই গল্পে বাস করা মানুষজন এসে হানা দেয়, আমার সাথে কথা বলে, জ্বালাতন করে, তাই আমাকে ঘর ছেড়ে বেরুতেই হয়, এবং বেরিয়ে বরাবরের মত বাম দিক, কেবল বাম দিক ঠিক রেখে এগিয়ে যাই। নানাবিধ ভাবনা, বহু রকমের পোকা, মানুষের মুখ, সবুজ ঘাস, গাছ-পালা, পাখি এসব নিয়েই বামদিকটা ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসে। আমি সেই অন্ধকারের ভেতর হাতড়ে ফেরার মতো একটু একটু করে এগোয়, কারণ আরেকটু সামনেই মন্দির। মাথা নোয়ানো যদিও আমি কখনোই শিখে উঠতে পারিনি, তবুও মন্দিরের কাছে এলেই মাথাটা কেমন করে জানি নুয়ে আসে। কেন আসে, সে কারণ খুঁজি না, কারণ গল্প না লেখার ইচ্ছেটা যখন থেকে আমার ভেতর বাসা বেঁধেছে, তখন থেকেই প্রশ্ন ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে চেয়েছি। প্রশ্ন মানেই অনেক জটলা, হট্টগোল, আঁধারের ভেতরে অসংখ্য শরীর আর হাত, যার সবগুলোই সবগুলোকে আপ্রাণ আঁকড়ে ধরতে চায়।
মন্দিরের সিঁড়িতে প্রায় প্রতিদিনই বসে থাকি। বসে থাকি, যেনবা একটা পাথর হয়ে মন্দিরের সাথে সেটে গিয়ে সম্পূর্ণ মন্দির বোধে ডুবে থাকা। ক্রমেই মন্দির চত্বর ভরে ওঠে মানুষে, শাঁখ বাজে, পূজা-অর্চনা হয় আর প্রসাদের অলৌকিক ঘ্রাণ যখন নাকে এসে লাগে তখন চমকে উঠি, পাথরটা আচমকা ভেঙে গুড়িয়ে যায় একটা বাক্যে, ‘এমা! তুমি এখানে, কখন এলে’? এদিক-ওদিক তাকাই, হঠাৎ মনে পড়ে তাই তো, আমি এখানে কেন, আমি তো যাচ্ছিলাম, বামে। কিন্তু কোথায়? আবারও তাকাই আশেপাশে আর হতভম্বের মতো সিঁড়ি থেকে উঠে দিশাহীন হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে পৌঁছায়, সেটা আমার ঘর ছাড়া কিছু নয়। অথচ আমি তো ফিরে আসিনি, তাহলে? আসলে কেউ-ই আসেনি, কিংবা আমিও হয়ত বাইরে যাইনি। বারান্দায় কিছুক্ষণ বসি, জোরে জোরে শ্বাস নিই। সন্ধ্যার ঠিক পর পর-ই পৃথিবীর যে গুমোট কান্না আঁধারের পরতে পরতে ধীরে ধীরে মিশতে থাকে তা শুনতে পাই, এবং যারা তা শুনতে পায়, তাদের কেউ-ই বাকি জীবনে আর ঘরে ফেরে না। উন্মুক্ত প্রান্তরে, দিক চিহ্নহীন বোধ ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত কান্না ভুলে দিনের প্রথম যে হাসি, তার লোভেই তারা ফেরে না। আমিও ফিরিনি, অথচ যে ফিরে এল সে কে? প্রশ্ন শুরু হলেই কাঁপতে শুরু করি, ভয় পাই আর পুরোনো কোনো গল্প হঠাৎ শুরু হয়ে তার একটিমাত্র চরিত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে, ডান-বাম কোনো কিছু না ভেবে সোজা নদীর দিকে।
আমি শুয়ে পড়তে চেষ্টা করি, হয়ত শুয়েও পড়ি এসকময়। অসমাপ্ত গল্পগুলো আর কোনদিনই শেষ হবে না এমন ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো ভারী হয়ে উঠলে বুঝতে পারি, খুব সন্তর্পণে আমার পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। না, আমি তার মুখ দেখতে পাই না, চাইও না। বিগত বছরগুলোয় আমি সত্যিকার অর্থেই কোনো মুখ দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। তাছাড়া যে কোনো মুখের দিকে তাকালেই আমার চোখে ভেসে ওঠে অজস্র পোকা, যারা মুখ থেকে উড়ে এসে আমার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে একসময় মাথার ভেতর ঢুকে পড়ে। তাই দেখি না, চাইও না। অবয়বের ভেতরে সেভাবে তো কিছু থাকতে পারে না, তাহলে কেন এই অবয়ব সম্বলতা? আমার পাশের মানুষটির মুখ না দেখলেও স্পষ্ট বুঝতে পারি সে খুব পরিচিত কেউ। আমি আশ্বস্ত হই, সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে, কিছু বলে না, কোনো শব্দ করে না, শুধু গল্প লেখার সেই ধারাল ছোরাটা টেবিল থেকে তুলে এনে ঘুমন্ত হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে ওর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজেই শুয়ে পড়ে, এবং ঘুমিয়ে যায়। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে একভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে ওর প্রশান্ত ঘুম দেখি, দেখি হাসি লেগে থাকা গভীর মুখ, আর একটা হাত আর কখনও গল্প লিখবে না বলে আচমকা জেগে ওঠে!