বাংলাদেশে সাড়ে খোলাফায়ে রাশেদিন- ইউনুসের সরকার আসার পর থেকে আজ অব্দি দেশ নিয়ে এখানে সেখানে যা অনুমান করেছি, তার কোনটিই সত্যিই হয়নি। লজ্জায় একারণে বলা ছেড়ে দিয়েছি। এই যেমন প্রথমে ডঃ ইউনুস ক্ষমতা নেয়ার পর ভেবেছিলাম ছয়মাসের মাথায় অসুস্থতার অজুহাতে তিনি পদ ছেড়ে চলে যাবেন। আমার লেখায় আমার কথায় আওয়ামীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন বা অপ্রত্যক্ষ সমর্থন প্রকাশের পরও, সত্যি বলছি, যখন ইউনুস সাহেব ক্ষমতা নিলেন, অধিকাংশ মানুষের মত আমিও খুশি হয়েছিলাম, কারণ তাঁর মত বিশ্ববিখ্যাত, শিক্ষিত ও যোগ্য কেউ এযাবৎ বাংলাদেশের দায়িত্বে আসেনি। এবার নতুন কিছু হবে- এটিই তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। আর এ বিশ্বাস থেকেই ভেবেছিলাম, তাঁর মত বিশ্ববরেণ্য একজন মানুষ এককভাবে এই চোরের খনিতে গিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। তাই পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থতায় পতিত হওয়ার আগেই তিনি বিরক্ত হয়ে সরে যাবেন। আমার অনুমান মিথ্যে প্রমানিত হয়েছে।
এরপর ভেবেছিলাম, হাসিনার পতনের পর সমাজের যে সমস্ত শক্তি নিজেদের শক্তিশালী ভাবছে, মুক্ত মনে করছে, তাঁদের অনেকের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। এরা মোটাদাগে সরাসরি মূলধারার কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নয়, এরা দুনিয়াব্যাপী সেই বিপথগামী সন্ত্রাসবাদী আদর্শের প্রতি প্রেমাসক্ত যা ধর্মতন্ত্রে বিশ্বাসী, যারা মনে করে একটা একরৈখিক (monolithic) ইসলামিক সমাজই আমাদের মুক্তি দিতে পারে। বাংলাদেশে যারা এই তন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের অনেকেই সহজসরল মানুষ যারা সহিংস নয়, কিন্তু এর খুবই ক্ষুদ্র অংশ মনে করে যে, ওইরকম ইসলামি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সহিংস পথ অবলম্বন করা ইসলামসম্মত। হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে এই ক্ষুদ্র অংশ চাপে থাকে, এবং একারণেই শত দুর্নীতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বাটপারি নির্বাচন স্বত্বেও বহু মানুষের সমর্থনে সে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে।
ভেবেছিলাম অভ্যুত্থানের পর যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত সবকিছু ধ্বংস, মাজার ভাঙ্গা, হিন্দু অত্যাচার বাদই দিলাম, এছাড়া পথে ঘাটে মোরাল পুলিশিং শুরু হয়েছে তাতে করে আত্মঘাতী বোমাবাজি শুরু হতে বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যারা বোমাবাজি করবে সবাই জেল থেকে মুক্ত এবং প্রকাশ্যেই তারা সবকিছু করতে পারলে গোপনে বোমাবাজির প্রয়োজন নেই। কিন্তু উগ্রবাদিতা এমন এক বস্তু, প্রশ্রয়ে এদের শুধু বাড়ন্তই হয়। আজ হোক কাল হোক, স্বরূপে বোমা নিয়ে এর ফিরবেই। আসছে পহেলা বৈশাখেই এটি শুরু হয় কিনা সেই সন্দেহ আমার আছে।
জার্মানির বিখ্যাত এক কবি ইয়োহান উলফাগাং ফন গ্যোটে, তাঁর এক বিখ্যাত কবিতার নাম “দ্য সর্সার্স অ্যাপ্রেন্সটিস” (The Sorcerer's Apprentice), ডিসজনির মিকি মাউস যারা দেখেছেন তাঁরা জানবেন এই চরিত্র সম্পর্কে। এই কবিতায় এক বৃদ্ধ জাদুকর তাঁর কারখানায় কাজ করার জন্য এক বালক শিষ্যকে নিয়োগ দেন। তাঁর কাজ হল নদী থেকে পানি নিয়ে আসা। শিক্ষানবিশ শিষ্যটি এই কাজ সহজ করার জন্যে জাদুকরের শিখিয়ে দেয়া একটি মন্ত্র পড়ে ঝাড়ুকে বশ করে পানি আনার জন্যে। কিন্তু ঝাড়ুকে থামানোর মন্ত্র সে জানত না। এদিকে ঝাড়ু পানি আনতে আনতে কারখানা ভাসিয়ে দিচ্ছে। রাগে ক্ষোভে ছাত্রটি ঝাড়ুকে আঘাত করে দুভাগ করে ফেলে। দুভাগ হয়ে ঝাড়ুটি দুটি ঝাড়ুতে পরিণত হয়, এবং কারখানা প্লাবিত করে ফেলার উপক্রম করে। এরপর জাদুকর ফিরে আসলে মায়াজাল ভেঙ্গে ঝাড়ুকে থামায়। এর থেকে শিক্ষা হল, এমন ক্ষমতা নিয়োনা, যা তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
উগ্রবাদকে প্রশ্রয় পাওয়া দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় ডঃ ইউনুস হল ওই নির্বোধ অবুঝ অথচ নিষ্পাপ শিষ্য, যিনি কিনা বেশি ভাল করতে যেয়ে এমন লেজেগোবরে করে ফেলছেন যে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার আয়োজন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি প্রশংসাযোগ্য কিছু ভাল কাজ করতে পারলেও উগ্রবাদ থামানোতে ব্যর্থতার মূল্য না জানি দিতে হয় পুরো দেশকে।
কারণ নতুন বাংলাদেশে ধর্মতন্ত্রে বিশ্বাসীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছে। দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি অন্যায় অবিচার বাংলাদেশে ছিল, আছে, সামনেও হয়ত বহুদিন থাকবে। কিন্তু এর সাথে নতুন করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মত দৈনন্দিন ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ পড়তে যাচ্ছে কিনা সেটি অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষকে ভাবতে হবে।
বার্লিন থেকে
জাহিদ কবীর হিমন
২৭ মার্চ ২০২৫
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৪৬