মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সম্প্রতি ‘মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধকৌশল ও সামরিক শক্তি বিন্যাস’ শিরোনামে একটি নথি প্রকাশ করে। এতে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত সেক্টর ও তার অধীনে বিভিন্ন বাহিনীর সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের এই হিসাব অনুযায়ী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজারের বেশি নয়।
এরশাদের শাসনামলে প্রথম তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা করে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫৪ হাজারের কিছু বেশি। জোট সরকারের গঠিত জাতীয় কমিটির অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১। স্বাধীনতার পর থেকে এভাবেই চলছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে ‘সংখ্যাযুদ্ধ’।
ফোরাম জানিয়েছে, ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার পর কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা নির্ধারণে ১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত একটি কর্মশালা হয়। এতে গোটা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে পরিকল্পনা ঠিক করা হয়। এই সেক্টরগুলোতে সেক্টর বাহিনীর (সেনা, নৌ, বিমান, ইপিআর, পুলিশ) মোট সদস্য করার পরিকল্পনা করা হয় ১৮ হাজারের কিছু বেশি। আর গেরিলা সদস্য নিয়োগের পরিকল্পনা করা হয় মোট এক লাখ ৪৩ হাজার।
৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও মুক্তিযুদ্ধের এস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে কয়েক হাজার কম হবে। কারণ, প্রতিটি বাহিনীতে যে সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, পরে তার চেয়ে কম মুক্তিযোদ্ধা এসব বাহিনীতে ছিল। তাঁর ধারণা, ১১টি সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কোনোভাবে দেড় লাখের বেশি হবে না।
অবশ্য এই নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট নামের আরেকটি বাহিনী ছিল। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের এই বাহিনীর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। দেশের ভেতর আরও কয়েকটি ছোট ছোট বাহিনী যুদ্ধ করেছে, যার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১০ হাজার। এর বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আরেকটি গেরিলা বাহিনী প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।
অথচ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদন আছে আরও ৬০ হাজারের বেশি। কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, এ তথ্য কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এত মুক্তিযোদ্ধা কখনো ছিল না। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের সনদ দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা ছিল এক লাখ ২৮ হাজার থেকে এক লাখ ৩২ হাজারের কিছু বেশি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর গত ৩৯ বছরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। কাজেই বছর বছর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধির হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম যে হিসাব দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তেমনই হওয়ার কথা।’ তাহলে তালিকায় এত বেশি মুক্তিযোদ্ধা কীভাবে এলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বিভিন্নভাবে তালিকায় নাম তুলেছেন। আমাদের কাছে ৫২ হাজার ৫০০ জনের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি করেছি। যদি দেখি কোনো অমুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠিয়েছেন, তাহলে আমরা তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেব। যদি প্রমাণিত হয় তিনি প্রতারণা করেছেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহম্মদ চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনটি বাহিনী যুদ্ধ করেছে। এগুলো হচ্ছে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত মুক্তিফৌজ বা এমএফআর, বেসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত ফ্রিডম ফাইটার বা এফএফ এবং মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত বিএলএফ। এর বাইরে দেশের ভেতর বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি ছোট ছোট বাহিনী যুদ্ধ করেছে।
আমীন আহম্মদ চৌধুরী জানান, ভারতের ৮২টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মোট এক লাখ ৩২ হাজার এফএফ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। আর সামরিক বাহিনীর যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১৭ হাজারের কিছু বেশি। এর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধরত বিভিন্ন বাহিনীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ফরম পূরণ করেছিলেন। ’৭৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই তালিকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়। ’৮৩ সালে এই ফরমগুলোর আলোকে একটি তালিকা করার উদ্যোগ নেন আমীন আহম্মদ চৌধুরী। সে সময় ৬৯ হাজার ৫০৯টি ফরম থেকে তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ফরমগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো থেকে তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি।
গোড়ায় গলদ: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর প্রতিস্বাক্ষর করা সনদ তৎকালীন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সনদ দেওয়ার সময় নাম-ঠিকানা বসিয়ে দেওয়া হতো। এই সনদ বিতরণের ক্ষেত্রে সে সময় নানা অনিয়ম হয়েছে। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে সে সময় সনদ নিয়ে গেছেন। ওই সময় প্রায় তিন লাখের বেশি সনদ বিতরণ করা হয়। কিন্তু তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তালিকা করা হয়নি।
যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রথম দুই তালিকা: মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল আহাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের সবাইকেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই তালিকায় এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তৎকালীন মহাপরিচালক আ জ ম আমিনুল হককে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের আহ্বায়ক করা হয়। তিনি সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি ভোটার তালিকা করেন। বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ওই তালিকায় নাম তোলেননি। এই তালিকায় নাম ছিল ৮৮ হাজার।
যাচাই-বাছাই করে একমাত্র তালিকা: ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম জাতীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করে এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়। আরেক দফা যাচাই-বাছাইয়ের পর এক লাখ ৫৪ হাজারের কিছু বেশি মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা করা হয়। এই তালিকা মুক্তিবার্তা নামে পরিচিত। এই তালিকাটিকেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম বিতর্কিত মনে করে সংশ্লিষ্ট মহল।
তবে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সময় সিদ্ধান্ত হয়, এরশাদের জাতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকা, ’৯৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভোটার তালিকা ও মুক্তিবার্তার মধ্যে দুই জায়গায় যাঁর নাম পাওয়া যাবে, তাঁকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ধরা হবে। এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আবার বেড়ে এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনে দাঁড়ায়। তবে এই নীতিমালার বাইরে আরও অনেকের নাম ঢোকানো হয়। জোট সরকারের গঠিত জাতীয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১।
বর্তমান সরকারের আমলে যা হচ্ছে: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কাছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্তির জন্য ৬০ হাজারের বেশি আবেদন পড়েছে বলে জানা গেছে।
সরকার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানোর পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম তোলার হিড়িক পড়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমিটির কাছে আবেদন করার নিয়ম ছিল। উপজেলা ও জেলা কমিটির যাচাই-বাছাইয়ের পর আবেদন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে আসার কথা। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ওই কাউন্সিলে তা অনুমোদনের কথা। কিন্তু এ নিয়ম মানা হয়নি। আবেদনকারীরা সরাসরি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কাছে আবেদন করে সনদ নিয়েছেন।
আবেদনকারী কোন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কোন সেক্টরে ও কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন—এসব বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক আবেদনই অসম্পূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, একজন আবেদনকারী তাঁর আবেদনপত্রে এমন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন, সে নামে কোনো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পই ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছিলেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। এরপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে। তদন্তে নানা অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই কর্মকর্তাকে মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানোর পর অনেকেই সনদ নিতে আসছেন। বিষয়টি অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছে যে দুই বছর চাকরি বাড়ানোর জন্য হয়তো অনেকে আসছেন। এখন প্রযুক্তির যুগ, নকল কাগজপত্র বানিয়ে নিয়ে আসা সহজ। তবে আমরা বিষয়গুলো শক্তভাবে দেখছি। প্রধানমন্ত্রীও নজর রেখেছেন যেন কোনো অমুক্তিযোদ্ধা প্রতারণা করে সনদ নিতে না পারে।’
তবে কাউন্সিলের অনুমোদন করা নতুন ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে অনেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন। একটি সংগঠনের প্রধান জানান, কয়েক মাসের মধ্যে এ উদ্যোগের ফল জানা যাবে।
সেক্টর কমান্ডার সফিউল্লাহ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা নেওয়ার জন্য প্রতারক ধরনের কিছু লোক এসেছে। এমনকি কিছু রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তালিকা যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন আছে। এখন এগুলো করবে কে? সেক্টর কমান্ডার, সাব-সেক্টর কমান্ডার ও কমান্ডারদের অন্তর্ভুক্ত না করলে এই যাচাই-বাছাই কোনোভাবেই সঠিক হবে না।
ওয়াসেক বিল্লাহ্
প্রথম আলো