পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হয়েছে প্রায় চার দশক হলো। কিন্তু পাকিস্তানের স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের এখনো বাংলাদেশ সৃষ্টির ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’র পাঠ দেওয়া হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী ডন পত্রিকা গতকাল ১৬ ডিসেম্বর তাদের ওয়েবসাইটে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এতে তারা দেখিয়েছে, পাকিস্তানের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের কী ধরনের ভ্রান্ত পাঠ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে।
নবম ও দশম শ্রেণীর পাকিস্তান স্টাডিজ বইয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে হিন্দু শিক্ষকদের ভূমিকা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের একটি বড় অংশ ছিলেন হিন্দু। তাঁরা এমন সব সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন, যা বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল।’
পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার পেছনে বিভিন্ন ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ও কাজ করেছিল উল্লেখ করে ওই বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে তখন ছিল প্রায় এক কোটি হিন্দুর বাস। তাঁদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল ভারত। হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে ভারতই চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে। অনেক হিন্দু ভারতের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে; কেননা পাকিস্তান তাদের ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দিয়েছিল। আবার যুক্তরাষ্ট্রও চাইছিল, পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হোক। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসনকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় রাশিয়া।’
ডন-এর নিবন্ধন অনুযায়ী বাংলাদেশ সৃষ্টি নিয়ে দশম ও একাদশ শ্রেণীর বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘চূড়ান্তভাবে শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিল সামরিক সরকার। আর এই অভিযানে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এল জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবকেরা। রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে পুরোনো বিবাদের শোধ নিতে এই সুযোগ কাজে লাগাল তারা (জামায়াত)।’
ডন লিখেছে, তবে কোনো বইতেই পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা এবং গণহত্যার উল্লেখমাত্র করা হয়নি। এ ছাড়া ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের কী পরিমাণ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার উল্লেখও নেই ওই সব পাঠ্যবইয়ে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনমনীয় অবস্থানের উল্লেখও করা হয়নি বইয়ে।
ইতিহাসের এ ধরনের বিকৃতিকে ‘প্রহসন’ হিসেবেই অভিহিত করেছেন দেশটির শিক্ষক উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক আব্বাস হুসাইন। তিনি বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করছি।’
শিক্ষার্থীদের এ ধরনের ভুল ইতিহাস পড়াতে শিক্ষকদের কেমন লাগে, জানতে চাইলে আব্বাস হুসাইন বলেন, ‘শ্রেণীকক্ষে কী পড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে বেশির ভাগ শিক্ষকই উদাসীন। শ্রেণীকক্ষে আমাদের কল্পকাহিনিই পড়াতে হচ্ছে, যার সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার বাস্তবতার মিল নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে সেটা খুশি মনে মেনে নিতেই হচ্ছে।’
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পারভেজ হুদবয় বলেন, ‘পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকৃত ইতিহাস পড়াতে হলে তাদের বলতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানিরা কেন নিজেদের প্রবঞ্চিত ভাবতে শুরু করল এবং কেন তাঁরা স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য লড়াই করল। তা না করে আমরা শিক্ষার্থীদের কীসব গাঁজাখুরি “ষড়যন্ত্র তত্ত্ব” পড়াচ্ছি।
সূত্র : প্রথম আলো।