সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েই সুখানুভূতির সাথে দুঃখের আলাপ দিতে এলাম!
আমার বরাবরই বদনাম আছে, আমি নাকি ছিদ্রান্বেষণ করি!
বলা হয় মানুষের বা যে কোন প্রাণির শারীরিক উপাদানে মাটি, পানি, বায়ু, আগুন (উত্তাপ, অক্সিজেন দহন) এগুলো থাকে। এগুলো কেবল বেঁচে থাকা প্রাণি নয়, সারা ব্রহ্মান্ডের সকল কিছুর জন্যই অত্যন্ত জরুরী উপাদান!
বেঁচে থাকা বা টিকে থাকার এই উপাদানগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে জীবন ক্ষতির মুখে পড়ে, এই প্রিয় পৃথিবী থেকে শুরু করে সারা বিশ্বব্রহ্মান্ড বিপদে পড়ে।
এই যেমন এখন শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকার অন্যতম দূষিত উপাদান হলো বায়ু, এরপর বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগের দূষিত পানি। বর্ডার এরিয়ার নদীগুলোর পানি শুকিয়ে যাবার আশংকা!
অন্যান্য নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকভাবে কমে গেলেও দূষণ মারাত্মকভাবে চোখে পড়ে। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের খাল-বিলগুলো হয় ভরাট হয়েছে অনেক জায়গায়, নয়তো অবৈধ দখলের কবলে, নয়তো অনেক পলিথিন, অব্যবহৃত জিনিসপত্র পড়ে থাকে পানিতে, বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য অপসারিত হয় নদী, খালে।
এই ২০২৪ সালেও যেটা আজব লাগে, সেটা হলো এখনো অনেক গ্রামে কাঁচা পায়খানা আছে, যেগুলোর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা খালে গিয়ে পড়ে! ২০২২-এ একটা জনশুমারী হয়েছিল, সেখানে একটা প্রশ্ন স্পষ্ট ছিল, বাড়ির টয়লেট কি কাঁচা না পাকা? খুবই অবাক করার মতো পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে প্রাথমিক জরিপে, এটা নিয়ে সরকারী তথ্য প্রকাশ না হওয়া সঠিক সংখ্যাটা উল্লেখ করা যাচ্ছে না। কিন্তু বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টয়লেটই এখনো কাঁচা!
আমি অষ্টগ্রাম মিঠামইন হাওড় অঞ্চলে নৌকায় যাবার সময়ে নিজ চোখে দেখেছি খালের পাড়ের এই অনাকাংখিত দৃশ্য! তবে সেই দৃশ্য অনেকটা ঢাকা পড়ে দৃষ্টিনন্দন নানান রং-এর টেউটিন দিয়ে গড়া বাড়িগুলো দেখে। একটা হোয়াইট হাউজও দেখেছিলাম!
আমার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন খচখচ করে, আচ্ছা, এই যে হাওড়গুলোতে যে পর্যটন বোটহাউসগুলো চলে, তাদের পরঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা কিরূপ? কিভাবে এটা ম্যানেজ করেন, এক বেলা বা দুই রাতের জন্য? অনেকেই হাওড়ের পানি দেখলেই লাফ দিয়ে পড়েন সাঁতার কাটতে। আমার মনে এই সংকোচ! এই পানিতে নামা যাবে? বলবেন যে, আমার শুচিবায়ু আছে, কেবলি দোষ ধরার স্বভাব!
সত্যিই আমি মনের এই খচখচানি এড়াতে পারি না! এবার কেউ এও বলতে পারেন, নিজে তো সাঁতার পারে না! তাই অন্যদেরকে অনুৎসাহিত করে।
নারে বাবা, ব্রক্ষপুত্রে যখন বেড়াতে গেছি, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন ছেলেরা ঝাঁপ দিয়ে নেমে গোসল করে, সাঁতার কাটে। সেখানে কিন্তু এ কথা একবারও মনে আসেনি!
আবার আমাদের বাড়ির পুকুরে যখন চাচারা নেমে গোসল করে, নানা শারীরিক কসরত দেখায়, চিংড়ি বা মাছ ধরে, আমার একবারও এ কথা মনে পড়ে না, কারণ আমি জানি যে আমাদের বাড়ির টয়লেট পাকা!
তবে চিরাচরিত নিয়মে বাড়ির পুকুর ঘাটে থালা বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া এসব এখনো চলে। কিন্তু অনেকে আজকাল এটাতেও বাধ সাধেন, তারা হয়তো বেশি শহুরে বলে।
তবে বন্যা হলে সবই সর্বনাশ! সেটা তো আর কারো নিয়ন্ত্রণে নেই!
এই শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়েও পানির অনেক সমস্যা হয়, তাই তাদের নিত্যদিনের গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন সবই ভীষণ অসুবিধার মধ্যে পড়ে। অনেক দূরে পাহাড়ি ঝিরি থেকে পানি আনতে হয়, এই শুষ্ক মৌসুমে যা খুবই অপ্রতুল!
টয়লেট প্রসংগ বারে বারে আসাতে, আমার আরো কিছু কৌতুহলের কথা এখানে শেয়ার করি। আমি মনে মনে ভাবতাম মহাকাশযানে মহাকাশ্চারীরা টয়লেট কিভাবে করে, পানি নিচে কিভাবে পড়ে? অভিকর্ষ তো নেই! পরে ইউটিউবে তার একটা বিশেষ ব্যবস্থা দেখেছি।
এই ঢাকায় অনেকগুলো পুলিশ বক্স দেখেছি, একটা নাটকে দেখেছি ট্রাফিক নারী পুলিশদের নানান অসুবিধা। সেই সাথে পাবলিক টয়লেট এই বক্সগুলো থেকে অনেক দূরে থাকে। তাই নারী পুলিশদের আরো অসুবিধায় পড়তে হয়। এটা নিয়ে একসময়ে অনেক আলোচনা উঠেছিল। কিছু পুলিশ বক্সে পরবর্তীতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টয়লেট তৈরি করা হলেও এখনো ট্রাফিক নারী পুলিশের এই সমস্যা পুরোপুরি কাটেনি। লক্ষ্য করে দেখবেন, রাস্তায় নারী পুলিশ খুবই কম দেখা যায়!
এটা যে শুধু নারী পুলিশের সমস্যা, তা নয়। অনেক নারী যাত্রী, যারা নিয়মিত রাস্তায় নানা কারনে চলাফেরা করেন, পাবলিক টয়লেটে যেতে এখনো অনাগ্রহী থাকেন, কিছু পাবলিক টয়লেট ইজারা দিয়ে ভাল করে চালানোর একটা প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, সেটা আরো অনেক অনেক দরকার। এছাড়া প্রেগন্যান্ট মহিলা, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী মহিলা, শিশুদের জন্য অনেক জায়গাতেই কোন ভাল ব্যবস্থা নেই।
এটা নিয়েও আলোচনা শুনেছিলাম ২০২৩ এর ৮ই মার্চ নারী দিবসে। ব্লগার সাবরিনাকে আমরা অনেকেই চিনি, সেই চট্টগ্রাম থেকে তিনি সেই প্রোগ্রামে এসেছিলেন এই টয়লেট সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে, বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিবন্ধীবান্ধব টয়লেট না থাকার কারনে কি অসুবিধায় পড়তে হয়। তারা এটা নিয়ে নানান হাসপাতালে অনেক চেষ্টা করেছেন।
সেদিন এক অনুষ্ঠানে অপি করিমও এইরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির কথা শেয়ার করেছেন।
যাক, আবার বায়ু দূষণের কথায় আসি। আজ এই কয়দিন ঢাকার বাতাসে দূষন মাত্রাতিরিক্ত হবার যে শর্ত, বাতাসে সে পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড আছে। গুলশানে এই এয়ার আইকিউ স্কোর সবচেয়ে বেশি, ২৩১। কোন কোন দিন মিশর এগিয়ে থাকলেও ঢাকা বেশিরভাগ দিনই প্রথম হচ্ছে এই দৌড়ে! দিল্লী আর ইসলামাবাদের নাম শুনে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার অবকাশ নেই, আফগানিস্তানের বাতাসের গতিবেগের দিক নিয়ে সমালোচনা করেও পার পাওয়া যাবে না, নিজেদের ক্ষতি থেকে নিজেদেরকেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
বাধ্য করতে হবে ইটের ভাটাগুলোকে ঢাকা থেকে আরো দূরে সরানোর, একসময় পরিবহন সেক্টরে অনেক নজরদারি হয়েছিল, ২০ বছর পুরোনো গাড়ি সব জোর করে সরানো হয়েছিল, নাজমুল হুদার আমলে। ঢাকার রাস্তাঘাট খনন ও মেরামত কাজ এসময়েই বেশি চলে, সেখানে কি কি যেন পরিবেশবান্ধব নিয়ম আছে, খননের সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গই বলতে পারবেন কি সেগুলো? অবশ্যই মানতে হবে।
ঢাকার রাস্তায় প্রচুর ধূলো উড়ে, বরাবরের অভিযোগ, বেশির ভাগ সময়েই ঢাকায় বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলাকে দায়ী করা হয়, বালুর ট্রাক, সিমেন্টের ট্রাককে দায়ী করা হয়। আর কত? বাড়ি ঘর তো অন্যান্য দেশেও বানানো হয়! তাহলে আমাদের এতো ধূলো কেন ওড়ে?
দুইদিন না যেতেই ঘরের সব আসবাবপত্রে ধূলোর গাঢ় আস্তরণ পড়ে। ডাস্ট এলার্জিতে আমি বরাবরই ভুগি এই শুষ্ক মৌসুমে, নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা দিনে দিনে। বিদেশে থাকলে এমন হয় না।
কি যাদু আছে বিদেশে?
গেল কয়েক বছর হাজার চিৎকার দিয়েও সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি দুপুর একটায় ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ময়লা নেয়ার কাজটা থামাতে পারিনি, রাতে নিতে পারিনি। আজকাল রাস্তায় বেরোলে এটা তেমন একটা দেখা যায় না! অনেকটা সকালেই এসে ময়লা নিচ্ছে। অফিস করতে বেরোলেই মেজাজ খারাপ হতো, রিকশা মিরপুর ১০ নম্বরে ঠিক ময়লার ডিপোর সামনেই থামাতো! উফ! কি অসহ্য ছিল সেই দিনগুলো। সত্যি বললে হয়তো পাগল ঠাওরাবেন! উত্তর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র সাহেবকে কনভিন্স করার জন্য বিমানবাহিনির অফিসাররা পর্যন্ত হাত লাগিয়েছেন এই কাজে, অনেক অনুরোধ করেছিলেন মেয়র সাহেবকে, কানেই তোলেননি!
ঐ যে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন এর কাঁচা টয়লেট, সবাই ডিবির হারুন স্যারের অনেক বদনাম করেন। তিনি পর্যন্ত নিজের এলাকার এই সমস্যা সমাধান করতে নেমেছিলেন। আজো লেগে আছেন এটার পিছনে। কিন্তু কিছুতেই এগুলো সুরাহা হয় না! খোদ সাবেক প্রেসিডেন্ট এর বাড়ি সেখানে হওয়া সত্ত্বেও, কিছু কিছু উন্নয়ন আছে, কিছুতেই করা সম্ভব হয় না, কেন?
কোথায় থমকে থাকে সবকিছু?
আরো চেষ্টা হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলের জমিগুলোর লবনাক্ত সমস্যা দূর করার। কি হলে যে এর ভাল সমাধান, সেটা কেউ খুঁজে পেল না। জোয়ারের পানি বা জলোচ্ছ্বাস হলেই লবনাক্ত পানি ঢুকে পড়ে চাষের জমিগুলোতে। লবণাক্ততার কারনে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়, ফসল উতপাদনও কমে যায়!
ইদানীং আরেকটা কথা শুনতে পাচ্ছি, রাসায়নিক সারের বেশি ব্যবহারের ফলেও জমির মাটি বিষাক্ত হয়ে পড়ে, বৃষ্টির পানিতে সেগুলো ধুয়ে গিয়ে পাশের জলাশয়গুলো বিষাক্ত হয়ে পড়ে!
একটা চেষ্টা হয়েছিল বন্যায় যেন বাড়ি ঘড় বারে বারে না ডুবে, নলকূপ যেন পানির নিচে বারে বারে পড়ে না যায়, তাই উঁচু করে দোতলা বাড়ি করা, নিচতলা খালি রেখে, কাঠের হতে পারে, ইটের হতে পারে, নলকূপও উঁচু করে বসানো শুরুতেই, গভীর নলকূপ বসানো উত্তরাঞ্চলগুলোতে, যাতে এই শুকনো মৌসুমে সেচের পানির অভাব না হয়, এখানেও নানান প্রতিবন্ধকতা।
ফি বছর সাঁওতাল পাড়ায় বা উত্তরের কৃষকদের এই পানি নিয়ে মারামারি, কাটাকাটি, খুনোখুনি লেগে যায়!
প্রায় শুনবেন এখানে ওখানে আগুন লেগে যাচ্ছে, কোথাও ইলেকট্রিক শক সার্কিট, কোথাও রান্নার চুল থেকে, কোথাও ভূতে লাগায়! মানে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, বলা হয় নাশক্তয়া, শত্রুতা! অনেক অনেক ক্ষতি এইসব থেকে, এ ধরনের দুর্ঘটনায় বায়ু দূষণও ঘটে, বাতাসে ছাই-এর পরিমাণ বাড়ে। জান মালের ক্ষতি তো রইলোই।
আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং! সেটা তো বিজ্ঞজনেরা এতো ভাল করে বর্ণনা করেন যে!!! আমাদের আর কি বলার আছে। শুনেছি ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলগুলো ডুবে যাবার আশংকা! ইতিমধ্যে আমরা চট্রগ্রাম, কক্সবাজারের বন্যা দেখতে পাচ্ছি, পানি নাকি সমুদ্রে সহজে নিষ্কাশন হয় না! তাই বৃষ্টির পানি তাড়াতাড়ি সমুদ্রে যেতে পারে না। পূর্ণিমা, অমাবস্যা হলে তো ঘোরতর বিপদ! ভিষণ জলাবদ্ধতা তৈরি করে।
নোয়াখালীতে চারপাশ উঁচু, মাঝে থালার মতো শহর, তাই সেই ছোটবেলা থেকেই জলাবদ্ধতার ভেতর দিয়েই বড় হয়েছি! সেখানে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তেমন কোন ইস্যু হিসেবে দেখিনি! আবার নোয়াখালী দক্ষিনাঞ্চলে অনেক নতুন নতুন চর জেগেছে, সেটা আরেক বাংলাদেশ! আরেক নতুন আশার আলো! কিছু অঞ্চল ডুবে গেলেও আল্লাহই কিছু বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে!
আর শব্দ দূষণ! সেটা মৌলিক দূষণ না বলে এই লেখায় আর বেশি লিখলাম না। অযথা হর্ন বাজানো উচিত না, এটা আমরা সবাই জানি! ওই যে যাদুর নগরী, বিদেশ, সেটা কোরিয়ায় দেখেছি, গাড়ি মানুষের পিছনে হেঁটে হেঁটে চলে, ভুলেও হর্ন বাজায় না। বেশি বিরক্ত হলে ড্রাইভার বেরিয়ে এসে সামনের ধীর স্থির বেলাইনে হেঁটে চলা মানুষকে অনুরোধ করে দয়া করে সঠিক লেনে চলার জন্য!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭