বাসে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিয়ে নিত্য যে সমস্যাগুলো হয়, তারই একটা খন্ড চিত্র ফুটে উঠেছে মৌনোতার পোস্টে। বাসের কিছু আসন শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকা ভাল উদ্যোগ, কারণ আমাদের মতো জনবহুল দেশে বাসে অত্যধিক ভিড়ে এবং হঠাৎ করে ব্রেক কষা বা হঠাৎ গাড়ি ছাড়া অবস্থায় তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া কঠিন। এক্ষেত্রে বাসচালকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। বাইরের দেশে বয়স্ক এবং প্রেগনেন্ট নারীদের জন্য সাবওয়ে ট্রেনগুলোতে কিছু আসন সংরক্ষিত থাকে। আবার প্রতিবন্ধীরা যাতে সহজে বাসে, ট্রেনে উঠতে পারে, বা বিভিন্ন বহুতল ভবনে উঠতে পারে তার জন্য বিশেষভাবে ঢালু প্রবেশপথ তৈরী করা থাকে। নিঃসন্দেহে যারা শারীরিকভাবে কিছুটা অক্ষম তাদের জন্য এজাতীয় ব্যবস্থাগুলো সহায়ক।
কিন্তু আমাদের দেশে উপরে উল্লেখিত সুবিধাগুলোর সবগুলো নেই। আবার বাড়তি যেটা আছে সেটা হলো বাসে সুস্থ-সবল নারীদের জন্যও আলাদা কিছু আসনের ব্যবস্থা। মানে আমি বলতে চাচ্ছি শিশু ও প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি সাধারণ অর্থে নারীদের জন্যও আলাদা আসন। যদিও এটা মনে হয় শুধু রাজধানীতে আছে, অন্য কোন শহরে মনে হয় আলাদা ব্যবস্থা নেই। এখানে নারী বলতে আলাদা করে কোন প্রেগনেন্ট বা বয়স্ক নারী নয়, সবল নারীদের জন্যও এ বাড়তি ব্যবস্থা প্রযোজ্য।
এখন কথা হলো কেন সুস্থ, সবল নারীদের জন্য এ ব্যবস্থা আমাদের দেশে করতে হলো? কারণটা আমরা সবাই জানি। আমাদের কিছু অতি ভদ্র পুরুষ নাগরিক আছেন যারা বাসের গতির তারতম্যের সাথে সাথে অযথাই নারীযাত্রীর গায়ের উপরে হেলে পড়েন। নারীদের গায়ের যেখানে সেখানে হাত দিতে তাদের রুচিতে বাঁধে না। এ ভোগান্তি প্রতিনিয়ত নারীদের সহ্য করে যেতে হয়। আমাদের নারীদের পথ চলতে প্রতিনিয়ত হাজারো ভোগান্তি, ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই পাড়ার ছেলেদের টিজিং, রিকশাভাড়া ঠিক করতে গেলে ভাড়া বেশী দিতে হয়, বাসে উঠতে গেলে প্রথমেই হেলপার কর্তৃক গায়ে হাত দিয়ে সাদর সম্ভাষণ, সবসময় কিছু পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি, এরপরের কিছু কথা আগেই উপরে বলেছি।
তো, এজন্যই কিছু সীট নারীদের জন্য বরাদ্দ, তাও আবার বাসের ইঞ্জিনের কাছাকাছি গরম সীটগুলো, যেহেতু সে সীটগুলো দরজার কাছাকাছি হয়। এতে নারীদের জন্য সুবিধা হয়, কিন্তু তাতে অসুবিধাও কম হয় না। ইঞ্জিনের কাছে আসনগুলো গরমের সময়ে যে কি পরিমাণ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা ঐ আসনগুলোতে যারা বসেন তারা মাত্রই জানেন। তবুও আমাদের কাছে পুরুষকর্তৃক ভোগান্তির স্বীকার হবার চেয়ে গরমকর্তৃক ভোগান্তি অনেক শ্রেয়। আসলে ঐখানে কোন আসনই থাকা উচিত নয়। এবং এজন্যই অনেক নারী সংরক্ষিত আসনগুলো খালি থাকলেও কখনো কখনো পুরুষ আসনে গিয়ে বসেন। আবার কিছু ইগোসম্পন্ন নারী ভাবেন আমি কি অক্ষম? আমি কি প্রতিবন্ধী, আমার কেন ঐ আসনে বসতে হবে?
সত্যি কথা বলতে গেলে আমার নিজেরও মাঝে মাঝে ঐ অনুভূতি হয়, কেন পুরুষদের দোষে আমাকে ঐ গরমের আজাবের মধ্যে গিয়ে বসতে হবে? তবুও বাধ্য হয়ে বসি।
একবার নীলক্ষেত থেকে বাসে উঠে ইঞ্জিনের পাশের সীটে বসেছিলাম আমি আর আমার আরেক বান্ধবী। তখন সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যাপারটা ছিল না। আরেকটি আসন খালি ছিল, এক লোক উঠে সেখানে বসলো, বলাই বাহুল্য আমাদের খুব মেজাজ খারাপ আর অস্বস্তি হলো। অন্যসব আসন পূর্ণ ছিল কিনা মনে নেই। আমরা যখন বাসে চড়ি তখন সাধারণ সারিতে যে ডাবল সীটগুলো থাকে সেখানে কিছু খালি ছিল । একসারিতে ভার্সিটির আরো দুটো মেয়ে ছিল। তারা আমাদের অবস্থা দেখে বলে উঠলো, আপনারা কেন ওখানে বসতে গেলেন? এদিকে তো সীট খালি ছিল। কে বলেছে মেয়ে হলেই ওখানে বসতে হবে? বেশী নিরাপদ থাকতে গেছেন, এবার বোঝেন। আসলে ডাবল সীটে বসেও নিরাপত্তা নেই, যেসব পুরুষেরা দাঁড়িয়ে যায়, তারা বসে থাকা নারীদের উপর হেলে দাঁড়ায়। আমরাও বুঝলাম আসলে কোন জায়গাই নারীদের জন্য স্বস্তি নেই। তখন একটা ব্যাপারই মনে হতো নারীদের জন্য যদি আলাদা বাস থাকতো, বা একেবারে আলাদা একটা সারির সবগুলো সীট......। যাক্, এর অনেকদিন পরে যাও বা নারীদের কিছু আলাদা আসনের ব্যবস্থা হলো, তাতেও বিপত্তি কমে না, কিছু না কিছু সমস্যা থেকেই গেল। আমাদের মতো গরীব দেশে মেয়েদের জন্য আলাদা দুয়েকটি বাসের ব্যবস্থা হলেও এটা যে বেশ খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, সেটাও একটা কথা। কিন্তু আসল কথা যেটা হলো আমরা কি নারীদের আলাদা বাসের ব্যবস্থার কথা বলবো নাকি পুরুষদের মনমানসিকতা উন্নতির জন্য সামাজিক প্রচারণা জোরদার করবো।
এ প্রসঙ্গে এবার বিশ্বশান্তির মন্তব্যের ব্যাপারে আসি। প্রথম যে আপত্তিকর কথা তিনি বলেছেন সেটা হলো পতিতাদের নিয়ে। তিনি পতিতাদের জন্য আসন ছাড়তে নারাজ। আমি বলি পতিতা কি গায়ে লেখা থাকে? যদিও তাদের কিছু বেশভূষা দিয়ে চেনা যায়? এখন কেন তাদের প্রতি আমাদের এ ঘৃণা? সেটা কি ধর্মীয় দিক থেকে হারাম পেশায় জড়িত বলে? যদি তাই হয় তাহলে যারা "পতিত", তাদের চেনার উপায় কি? তারা কি হারাম কাজ করছে না? তাদের পাশে আপনি কেন বসবেন? তারা তো আরো বেশী ঘৃণিত হবার কথা। এ প্রসংগে আরেকটা তর্ক এসে যেতে পারে, "পতিতা" পাওয়া যায় বলেই কি পুরুষরা "পতিত" হয়, নাকি পুরুষের "পতিত" হবার চাহিদা থেকে "পতিতা"র জোগান দেয়া হয়? স্বাভাবিক যেকোন মানুষই দ্বিতীয় কারণের সাথে একমত হবেন। জ্বী হ্যাঁ, আমাদের দেশসহ বেশীরভাগ দেশেই "পতিত" পুরুষদের চাহিদা মেটানোর জন্যই "পতিতা"র আমদানী বা জোগান দেয়া হয়। এর জন্য দালাল হয় "পতিতা"র। বিভিন্ন অসহায় নারীদের মিথ্যা লোভ দেখিয়ে, শহরে বা বিদেশে নানারকমের চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে অভাবী নারীদের পাচার করা হয়। বর্তমান বিশ্বে মনে হয় অস্ত্রব্যবসার পরেই শিশু ও নারীব্যবসা সবচেয়ে জমজমাট ব্যবসা। তবে অধুনা কিছু পুরুষব্যবসাও শুরু হয়েছে, সেটা নারী সমধিকার আন্দোলনের কারণে নাকি পুঁজিবাদী বিশ্বের কারণে, সেটা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। আবার কিছু ধনীশ্রেণী নারীরাও স্বেচ্ছায় এ পেশায় আসছে, বিভিন্ন জরীপে দেখা যাচ্ছে। সেটাও কি আসলে নারীর সমঅধিকারের ধারণা থেকে আসে, নাকি বর্তমান বিশ্বের ভোগবিলাসে মত্ত হবার প্রবণতা থেকে আসে, সেটাও গবেষণার ব্যাপার। এখানে কোন একটা নির্দিষ্ট কারণ নির্দিষ্টভাবে বলে দেয়া কঠিন ব্যাপার। তবে পুরুষব্যবসাটা কি এখনই খুব প্রকট আকার ধারণ করেছি কি? যদিও এই নারীব্যবসা, পুরুষব্যবসা কোনটাকেই নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের বাড়তে দেয়া উচিত না, কিন্তু তাই বলে এসব "পতিতা" বা "পতিত"দের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে দিয়ে, তাদেরকে সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে ঘৃণা করাটাকে আমি ঘৃণা করি।
এবার আসি বিশ্বশান্তির আরেকটি মন্তব্য যেটা ফিলিপিনের নারীদের উদাহরণ দিয়ে বলা, মেয়েদের আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে যাবার প্রেক্ষাপট থেকে নারীদের বেশী বেশী বাইরে গমন থেকে উদ্ভূত সৃষ্ট সমস্যা থেকে বাস-ট্রেন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ার দরকার হচ্ছে.........এ কথাটাকে একেবারে ফেলেও দেয়া যায় না, আবার এর সাথে সমাজের কিছু নারীদের কেন "পতিতা" হতে হয় সেটারও একটা ব্যাখ্যা চলে আসে। সেটা হয়তো বিশ্বশান্তি লক্ষ্য করেননি।
কেন আজকের বিশ্বে নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়? সহজ কথায় এর মূল কারণ হলো পুরুষের স্বেচ্ছাচারীতা। এরপর দারিদ্র্যতাও একটা বড় কারণ।
প্রথমে আমি দারিদ্র্যতার কথা বলতে চাই। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলে বা শহরেরও কিছু কিছু অঞ্চলে জনগণের আর্থিক অবস্থা মারাত্মক রকমের শোচনীয় পর্যায়ে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধগতির কারণে ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক খরচের উচ্চমূল্যের কারণে বর্তমান সময়ের একজন স্বামী বা পিতা বা ভাইয়ের পক্ষে পুরো একটা পরিবারের, যার সদস্য সংখ্যা হয়তো দশ-বারো ছাড়িয়ে যেতে পারে, তাদের ভরণপোষণ করা সম্ভব হয় না। আমাদের চারপাশে জমির পরিমাণ কমে গেছে, খালে-বিলে সেরকম মাছ পাওয়া যায় না, ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগী পালনের ক্ষমতাও সবার থাকে না, তাহলে আর উপায় কি থাকে? মা- মেয়েকে শহরে পরের বাড়িতে কাজ করতে পাঠাও বা গার্মেন্টেসে কাজে পাঠাও বা অমুক লোক বলেছে বিদেশে শেখদের বাড়িতে কাজ করতে পাঠালে অনেক টাকা রোজগার হবে, পরিবারে আর অভাব থাকবে না। বলেন এরপরও নারীরা ঘরে বসে থাকবে, যখন হাতের কাছে কিছু রোজগারের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, খালি পেটে ঘরে বসে থাকলে কেউ তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে না। এভাবেই একসময় দালালদের হাতে পড়ে অনেক নারী পাচার হয়, হয় দেহপসারিণী। এসব কথা কি আসলেই বিশ্বশান্তি জানেন না? বা যারা পতিতাবৃত্তি হারাম পেশা, এদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দাও, এদের জানাযা পড়ো না এসব কথা বলেন, তারা কি এসব নারীদের মুখে সসম্মানে দুমুঠো খাবার তুলে দেবার কোন উপায় করতে পারেন?
আমাদের নোয়াখালী-কুমিল্লা অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে, "মেয়েরা ঘর থেকে বেরোলে হয় বেশ্যা, পুরুষে হয় বাদশা।" নারীবাদীরা এ কথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠবেন, নারীরা পেটের ধান্দায় বেরোলেই কি বেশ্যা হয়? যত্তসব পুরুষতান্ত্রিক কথা। আসলে কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটা পুরুষতন্ত্রীয় সত্য কথা। এবং এ মনমানসিকতা থেকে আমরা আজো মুক্তি পাইনি। তাইতো আজো নারীপাচার, নারী ব্যবসা, পথে ঘাটে নারীদের উত্যক্ত করা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এর থেকে আশু মুক্তি সম্ভব কিনা সেটাও সন্দেহের ব্যাপার। যদিও আমরা আশা করেই যাচ্ছি, ধর্মের বিভিন্ন বিধি-বিধানের কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছি, তাতেও কি কিছু কমছে। যতদিন মানুষের পেটের জ্বালা মিটবে না, এর থেকে মুক্তিও নাই। তাইতো নারীরা বাধ্য হচ্ছে ঘরের আরামের জায়গা থেকে অধিক বিপদসংকুল জায়গায় বের হতে, এ ধরণের নারীর সংখ্যাই বেশী।
এবার আসি অপেক্ষাকৃত সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের কথায়। মৌনোতার পোস্টে মূলত এসব নারীদের বাসে যে ভোগান্তি হয় সেটা নিয়েই আলোচনা ছিল। আমাদের ধর্মীয় সমাজের অনেক পুরুষেরই এসব নারীদের ব্যাপারে ক্ষোভ আছে। না, এ নারীদের না খেয়ে থাকতে হয় না। এদের স্বামী বা পিতা বা ভাইদের সামর্থ্য আছে এদের ভরণপোষণ করার। এ নারীরা চাইলে ঘরে বসে থাকতে পারে। কিন্তু কেন তবুও এ নারীরা বাইরে বেরোচ্ছে। এবার আমরা সেদিকে একটু আলোকপাত করি। সমাজের এ অংশের নারীদের একটা বিরাট অংশ নারীরা হচ্ছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নিশ্চয়ই আজকের যুগে নারীশিক্ষার প্রয়োজন নেই একথা কট্টর আলেমরাও বলবেন না, তালেবান বাদে। তাই এর জন্য অবশ্যই নারীদের বাইরে যেতে হয়, রাস্তায় হাঁটতে হয়, রিকশায় চড়তে হয়, বাসে চড়তে হয়। আর এ বয়সী নারীরাই বেশী ইভ-টিজিং-এর স্বীকার হয়, হেনস্তার স্বীকার হয়। পথে ঘাটে লক্ষ্য করে দেখবেন অল্প বয়সের মেয়েরাই বা যাদের দেখে অবিবাহিত মনে হয় তারাই হেনস্তার স্বীকার হয় বেশী। এরপর আসে নারী অভিভাবকদের অংশ। আজকাল ঢাকা শহরসহ অন্যান্য জেলাশহরগুলোতে বাচ্চাদের একা একা স্কুলে পাঠানো নিরাপদ নয় অনেক কারণেই, বাবারা অফিস নিয়ে ব্যস্ত। শেষ পর্যন্ত মা গৃহিনী হলেও বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেয়ার কাজটা বেশীরভাগ মাকেই করতে হয়। ঢাকা শহরে এ চিত্রটা ব্যাপকভাবে দেখা যায়। অনেক সময় বাচ্চার স্কুল দূরে হবার কারণে এসব মায়েদের বাসেও চড়তে হয়, যথারীতি পুরুষদের পাপিষ্ঠ হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়। এরপরই আসে চাকুরীজীবি নারীদের প্রসংগ, এ সংখ্যা কিন্তু এখনো শতকরা হারে অনেক কম। আবার এদের নিজেদের হাতে কিছু পয়সা থাকার কারণে অনেক সময় ট্যাক্সক্যাব বা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে মাঝে মাঝে ঝামেলার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন। আবার তুলনামূলকভাবে এরা সমাজের অন্যান্য অংশের নারীদের তুলনায় সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী, স্পষ্টভাষী, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী হয়ে থাকে। তাই এরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি দীপ্ত পদক্ষেপে চলতে পারে, কোন পুরুষ কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চাইলে কিছু প্রতিবাদ করারও ক্ষমতা রাখে, তবুও আমি বলবো সমাজে এ অংশ অনেক কম। এখন আশা যাক্, এ মেয়েদের কেন চাকুরী করতে হবে? লেখাপোড়া শেষ করেছ, এবার ঘরে বসে সন্তান মানুষ করো, সংসার দেখভাল করো......। কিন্তু আমার প্রশ্ন আজকের সমাজে গৃহিণী হলেই কি শুধু ঘরে বসে থাকা যায়? বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া , বিভিন্ন দরকারী জিনিস-পত্র কেনা, কাপড়-চোপড় কেনাকাটা বিভিন্ন কারণেও এ গৃহিনীদের ঘর থেকে বেরোতে হয়। বরং এ ক্ষেত্রে চাকুরীজীবি নারীদেরই বরঞ্চ দৈনিক রাস্তায় চলাফেরার সুযোগ কম। কারণ, একবার সকালে অফিসে ঢুকলে বিকেলে অফিস ছুটির পর ছাড়া আর বেরোনোর সুযোগ তেমন নেই, এরা দরকারী কেনাকাটা বেশীর ভাগ সময়ই ছুটির দিনে করে থাকেন।
এখন কথা হলো সমাজে চাকুরীজীবি নারীর সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে এবং এটা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু কেন? এটার কারণ হিসেবে যতটা না নারীদের ভোগবিলাসিতার কথা আসে তার চেয়ে বেশী আসে পুরুষের স্বেচ্ছাচারীতার কারণে। প্রথমটাও একটা কারণ, কিন্তু পরেরটা মূল কারণ। আমাদের সমাজসহ প্রায় সারাবিশ্বেই পরিবারে মূলত পুরুষদের উপর আর্থিক দায়িত্ব দেয়া আছে। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই অনেক পুরুষ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে, পরিবারে নারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তাদের মতামতের কোন মূল্য দেয় না, বিভিন্ন রকমের শারীরিক-মানিসিক অত্যাচারের স্বীকার হয় নারীরা। এখানে আর উদাহরণ টানার দরকার মনে করছি না, এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের আশেপাশে, পত্রিকার পাতায় দেখছি। তাই তো আজ নারীদের ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা যে একমাত্র সমাধান না, সেটাও আজকের সমাজে দেখা যাচ্ছে। কারণ, নারীর হাতে টাকা থাকলে পরিবারের কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার মর্যাদা রক্ষা হচ্ছে বটে, তার মতামতের কিছু মূল্যায়ন হচ্ছে সেও ঠিক, কিন্তু সমস্যা যে জায়গায় থেকে যাচ্ছে সে হচ্ছে পুরুষদের মনমানসিকতা পরিবর্তন করার কোন উদ্যোগ বা প্রচারণা সেভাবে করা হয়নি। তাই আজো নারীদের প্রকৃত অবস্থার তেমন কোন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। যে নারী ঘরে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাইরে বেরোলো, সে আরো দশটা পুরুষের টার্গেট হলো, সে এখানেও ভোগের সামগ্রীরূপেই বিবেচিত হতে থাকলো। তাই তো আজ শ্লোগান হচ্ছে নারীকে মানুষ ভাবতে শেখা, ঘরে বাইরে সব জায়গায়। কি পিতা হিসেবে, কি স্বামী হিসেবে, কি ভাই হিসেবে, কি কলিগ হিসেবে, কি পথচারী হিসেবে যে অবস্থান থেকেই নারীদের দিকে তাকাননা কেন, শ্রদ্ধার চোখে তাকান। নারীরা ঘরে থাকলেও তাকে সম্মান করুন, প্রয়োজনে বাইরে থাকলেও তাকে সম্মান করুন।
অনেকক্ষণ শুধু পুরুষদের নিয়ে কথা বললাম। এবার শেষে কিছু নারীদের করণীয় সম্বন্ধেও বলে যাই। আমি নারী ঘরে-বাইরে নিজের সম্মান রক্ষার্থে নিজেকেও সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের এমনভাবে চলা উচিত নয়, যেটা আমাদের ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ করে বা পুরুষের মনে দুঃসাহসের উদ্রেক ঘটায় আমাদের উত্যক্ত করার। নারীর উন্নয়নের মাপকাঠি পুরুষ নয়, মানুষ। পুরুষেরা যে অন্যায়গুলো করে সেগুলো আমরা করতে পারা মানে কিন্তু আমাদের উন্নতি নয়, বরং সেটা আমাদের আরো অবনতির দিকে ঠেলে দেয়া। পুরুষরা সমাজে যে অন্যায় সুযোগগুলো নিচ্ছে, সেগুলো আমরাও নিতে পারাটা আমাদের উন্নতি না, বরং সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায় দূর করতে পারার মধ্যেই আমাদের মুক্তি। পুরুষরা টিজ করছে, তাই আমিও টিজ করবো, এর মধ্যে কোন উন্নতি নাই। নারী-পুরুষের পোশাকের পার্থক্য কমিয়ে আনলেই যে আমরা উন্নত হয়ে গেলাম, তা নয়। বরং যার যার ক্ষেত্রে শালীন পোশাকই আমাদের কাম্য। বরং পুরুষরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও আমাদের জ্ঞানকে সেভাবে শাণিত করি, সঠিকভাবে উন্নতি করি।
আজ নারীরা যে শুধু কিছু সামর্থ্যের জন্যই বা ভোগ-বিলাসের জন্যই রোজগার করছে তা নয়, নিজের অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগও সে দেখতে চাচ্ছে, নিজের শেখাটাকেও সমাজে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। সমাজে নারী অধিকার ঠিকভাবে দিতে জানতে হলে নারীদের সমস্যা, চাহিদাগুলোও জানতে হবে, কি হলে নারীদের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব সেটাও ঠিকভাবে বুঝতে হবে। তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, অর্থনৈতিক পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে সকল ধরণের নীতি-নির্ধারণী ক্ষেত্রে নারীদের পক্ষে কথা বলার জন্য নারীদেরও অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
তবে আমরা যাই করি না কেন, আমাদের পরিবার, সন্তান এরাও আমাদের উপর নির্ভরশীল এটাও আমরা ভুলে যাবো না। তাদের প্রতিও আমাদের যে দায়িত্ব আছে, সেটাকে আমরা অবহেলা করবো না। একজন মা তার সন্তানের কাছে শুধু মা-ই না, তিনি একাধারে শিক্ষক, চিকিৎসক, বন্ধু সবকিছু। একজন স্ত্রী তিনি শুধু স্ত্রীই নন, তিনি পরিবারের একজন ম্যানেজার, একজন পরিচালক, তিনি স্বামীর একজন বন্ধু, পরামর্শদাতা, সাহায্যকারী, সান্ত্বনাদানকারী। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দ্বারাই সমাজের ভাল অবস্থা তৈরী হতে পারে।