বাংলা! হাজার বছর আগের যে ভাষা- আমরা কথা বলি, গান গাই, প্রিয় মানুষটিকে আদরের সম্ভাষণ জানাই কিংবা আবেগের স্নিগ্ধ প্রকাশ ঘটাই! আমরা বাংলাদেশি আর এদেশের চৌদ্দ কোটি মানুষের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা- বাংলা। যুগে যুগে সিদ্ধাচার্য, চন্ডীদাস, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলরা এসে কালে কালে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আজ আমাদের প্রাণের ভাষার সাহিত্য পৃথিবীর প্রথম সারিতে ঠাই করে নিয়েছে। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন কত বাংলামায়ের দামাল সন্তান। তাইতো আমরা স্বাধীনভাবে মায়ের ভাষায় প্রাণখুলে কথা বলতে পারছি।
ইন্দো-আর্য ভাষা, সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। বাংলার উদ্ভব ঠিক কত সালে সেটা গণনা করা যায় নি। তবে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাদের শেষ প্রান্তে এসে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে যে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর উদ্ভব ঘটে, তাদের মধ্যে বাংলা একটি। কোন কোন ভাষাবিদ তারও অনেক আগে, ৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, বাংলার জন্ম হয় বলে মত পোষণ করেন। বাংলা ভাষার ইতিহাসকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
1. প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০ খ্রিস্টাব্দ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) — লিখিত নিদর্শনের মধ্যে আছে চর্যাপদ।
2. মধ্য বাংলা (১৪০০–১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) — এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নিদর্শন চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।
3. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে) — ক্রিয়া ও সর্বনামের সংক্ষেপন (যেমন তাহার → তার; করিয়াছিল → করেছিল)
এক পর্তুগিজ মিশনারি পাদ্রি বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান ও ব্যাকরণ রচনা করেন ১৭৪২ সালে। ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড নামের এক ইংরেজ প্রাচ্যবিদ বাংলার একটি আধুনিক ব্যাকরণ লেখেন, (A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮)) যেটি ছাপাখানার হরফ ব্যবহার করে প্রকাশিত সর্বপ্রথম বাংলা গ্রন্থ। বাঙালিদের মাঝে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা। তাঁর গ্রন্থের নাম "Grammar of the Bengali Language" (১৮৩২)।
বাংলাদেশের একমাত্র স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা এবং ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা হল বাংলা এবং অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে স্বীকৃত সরকারি ভাষা হল বাংলা। এছাড়াও সিয়েরা লিওনে সম্মানসূচক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা।
১৯৫১–৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত "ভাষা আন্দোলনের" ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র উর্দু ভাষাকেই সাংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল প্রচুর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তুমুল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ এ সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন জানান যে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তই মেনে নেওয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ওঠে। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং-মিছিল ইত্যাদি বেআইনি ঘোষণা করে। । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ আরো অনেকে। এই ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই ধারণাটির জন্ম হয় এবং এ ধারণাই পরবর্তীতে বিভিন্ন বাঙালি জাতীয়তা আন্দোলন, যেমন ৬ দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণা যোগায়। এ আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগনের কাছে গৌরবজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবেও সুপরিচিত। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
অন্তর্জালেও আজ বাংলার সুদিন শুরু হয়েছে। জনপ্রিয় অনেক লেখকের বই ডাউনলোড করা যাচ্ছে নেট থেকে। উইকিপিডিয়াতে বাংলা ভাষার অবস্থান ৪০তম। এখানে বাংলা ভাষার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, বাংলা বর্ণের উৎপত্তি, বাংলাদেশ বিষয়ক খবর, বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের জীবনী থেকে শুরু করে সবই আছে। উন্মুক্ত এবং বৃহত্তম এই তথ্যভান্ডার বাংলা ভাষাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাপিডিয়া হচ্ছে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষ। আমাদের দেশের প্রকাশিত বাংলা পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণও বাংলাতে প্রকাশিত হয়। বাংলায় প্রথম ব্লগ সামহ্যোয়ারইনব্লগের পাশা পাশি এখন অনেক ব্লগেই আমরা আপন ভূবন তৈরি করতে পারছি। এছাড়া project gutenberg এর আদলে তৈরি হচ্ছে অনলাইন বাংলা সাহিত্য আর্কাইভ।
বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন বিশ্বের কাছে আমাদের নতুন পরিচয়ে পরিচত করেছে। রক্তঝরা একুশ নিয়ে আমাদের উম্মাদতার কমতি নেই। কিন্তু তবুও বাংলা আজ হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার অগ্নিবাণে ভগ্ন। এখনও রাষ্ট্র ও সরকারের কোন কোন বিভাগ ও স্তরে বিদেশী ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমানে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্প্রচারিত টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আর একটি বিদেশী ভাষা অর্থাৎ হিন্দি ভাষার নীরব আগ্রাসন শুরু হয়েছে। যেখানে আমরা পুরো পাকিস্তানে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে প্রচলিত ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিইনি সেই বাংলাদেশে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রভাবিত হিন্দি ভাষার দ্বারা আবার আগ্রাসনের শিকার হতে যাচ্ছি। সরকারসহ সকল স্তরের জনগণকে বিদেশী ও ভিন্ন সংস্কৃতি প্রভাবিত হিন্দিভাষা ও হিন্দি সংস্কৃতির নয়া আগ্রাসনের ব্যাপারে এখনই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। বিগত এক হাজার বছর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলা ভাষা আজ আমাদের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ আজ বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বাংলা ভাষা বিকাশের ধীরগতির পাশাপাশি চলছে হিন্দি ভাষার সরব আগ্রাসন। তাই সরকারি উদ্যোগে বাংলা ভাষার বিকাশ ও তা সর্বস্তরে চালু করার পাশাপাশি দেশে অন্য যে কোন বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। অবশ্য সরকারি উদ্যোগের সাথে সাধারণ জনগণকেও বাংলা ভাষা ও আমাদের সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে যে কোন বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে।
‘একুশে আমাদের পরিচয়’ এই শ্লোগান নিয়ে ৫২’র ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমী আয়োজন করে আসছে অমর একুশে বই মেলা। দিনে দিনে সেই বই মেলা এখন বাঙালির মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে মননশীলতার প্রতীকে। প্রাণের টানে মোরা ছুটে যাই বই মেলায়। অনেক রক্তের বিনিময়ে ভাষার মর্যাদা ও স্বাধীনতা পেয়েছি। এই স্বাধীনতাকে সুসংহত করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি সংরক্ষন ও চর্চা করা- ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এটি অনেক আবশ্যক। আমরা সংগ্রাম করে আমাদের যে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি তা আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে হবে। আর সেজন্য চলুন বাংলা মা কে বুকে নিয়ে এগিয়ে যাই। ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন ছুড়ে ফেলে আপন আলয়কে বাংলার নিচ্ছিদ্র দূর্গ হিসেবে গড়ে তুলি।
পরিশিষ্ট: বীরবাংগালির ভাষা-সংস্কৃতির ওপর শুধু আগ্রাসনই নয় পাশাপাশি আমাদের সার্বভৌমত্বেও আজ ভারতের নগ্ন থাবার আচড় পড়েছে। বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি রক্ষায় আজ সবার সক্রিয়তা আবশ্যক। চলুন! ভারতীয় পণ্য বর্জন দিয়েই শুরু করি দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে বুক উচিয়ে চলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩২