ফেব্রুয়ারী মাসে আমার মধ্যে একধরণের মিশ্র অনূভুতির জন্ম হয়। এই মাসে আমি ভাষা শহীদদের কথা স্মরণ করি। যাদের অবদান ছাড়া পরিস্থিতি হয়তো এখনকার থেকে অন্যরকম হত। হয়তো বাংলাদেশেরই জন্ম হতোনা। হয়তো বাংলা ভাষা অবহেলিত কোন ভাষা হিসেবে পড়ে থাকতো। ভাষা শহীদদের ত্যাগ, সাহস,স্বাধীনচেতা মনোভাব আর ভাষার প্রতি আবেগের কথা চিন্তা করে আমি শিহরিত হই।
সেই সাথে একধরণের আনন্দের অনূভুতিও আমাকে ঘিরে ধরে। ফেব্রুয়ারী মাস বইমেলার মাস। একটা কৌতুকের বই পড়তেও যে সারা বছর নিতান্তই অনাগ্রহী থাকে সেই বাঙ্গালীও এই মাসে অন্তত একটা বই কেনে। বইমেলার ভেতরের ও বাইরের আড্ডা গুলোতে বইয়ের আলোচনা হয়। এত সুন্দর পরিবেশ বছরের আর কোন মাসটাতে পাওয়া যায়??
এবারের বইমেলা অবশ্য অন্যান্য বছরের মত ছিলোনা। ফেব্রুয়ারী মাসের একটা বড় অংশ শাহবাগেই থাকাতে অন্যন্য বছরের মত এবার বইমেলাতে ঘনঘন ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ভয় হচ্ছিল এবার মনে হয় কোন বই-ই কেনা হলোনা মেলা থেকে! অবশেষে গতকালকে কিছু বই কিনে আনলাম।
১। দেয়াল-হুমায়ূন আহমেদ
সম্ভবত সব ধরণের বইয়ের পাঠকদের চাহিদার শীর্ষে আছে এই বই। হুমায়ুন আহমেদ যারা পছন্দ করেন এবং করেন না, তাদের সবারই লিস্টেই এ বই আছে মনে হয়। লেখকের শেষ উপন্যাস বলে কথা। প্রকাশক ও এ সম্পর্কে ভালোই অবগত আছেন। বই এর প্রচ্ছদে বড় বড় করে লিখে ক্রেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে এটি হুমায়ূন আহমেদে্র শেষ উপন্যাস।
প্রকাশের আগেই যে পরিমাণ আলোচনার ঝড় উঠিয়েছে এ বই শেষ পর্যন্ত তাই কিনে ফেলতেই হল। আনিসুজ্জামানের লিখা ভূমিকা পড়ে জানলাম মেজর ফারুকের বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা, সে পরিকল্পনায় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও ওসমানীর জড়িত হওয়া, পরিকল্পনার সাফল্য, খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতালাভ, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, কারাগারে চার নেতা হত্যা, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী- জনতার বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের মুক্তিলাভ ও ক্ষমতাগ্রহণ, খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল হুদার হত্যা এবং তাহেরের ফাঁসি ইতিহাসের এইসব আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে উপাখ্যানটি। যেসমস্ত বিষয়বস্তু নিয়ে এই উপন্যাস গড়ে উঠেছে সেগুলোই যথেষ্ট এই উপন্যাসকে সমালোচিত করে তোলার জন্য। কিন্তু লেখকটি হুমায়ূন আহমেদ বলে কথা। তাই আনিসুজ্জামান স্বীকার করে নিয়েছেন- “সমালোচক যা-ই বলুক না কেন, আমি জানি, হুমায়ূন আহমেদের অন্য বইয়ের মতো দেয়ালও পাঠকের সমাদর লাভ করবে।“
২। অবিশ্বাস্য- সৈয়দ মুজতবা আলী
গত বছর থেকে সৈয়দ মুজতবা আলী পড়া শুরু করেছি। তার ধারাবাহিকতায় এবার ও লেখকের বেশ কিছু বই কেনে ফেললাম। ‘অবিশ্বাস্য’ মুজতবা আলীর একটি উপন্যাস যার মূল বিষয় ধর্ম ও ধর্মের অন্যান্য অনুষঙ্গ, নৈতিকতার সঙ্কট ও তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা, পাপবোধ ও আত্মগ্লানি কে বিভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতন একজন নির্ভরযোগ্য লেখক এ বিষয়গুলোকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা জানার জন্যই বইটি কিনে ফেলা।
৩। ভবঘুরে ও অন্যান্য- সৈয়দ মুজতবা আলী
এবার ইচ্ছা ছিলো সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণ সমগ্র ধরণের কোন বই থাকলে তা কিনে ফেলবো। কিন্তু তা পাওয়া গেলোনা বিধায় আলাদা ভাবে এই বইটি কিনলাম। ১৬০ পৃষ্ঠা বইয়ের ৮৫ থেকে ১৬০ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ভবঘুরে নামক রচনাটি। এটি মূলতঃ লেখকের পদব্রজের কাহিনী নিয়ে লেখা। বইয়ের বাকি অংশে রয়েছে লেখকের অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৃষ্টি যাতে লেখক তার স্বভাব সুলভ রসিকতার সাথে কিছু বিষয় আলোচনা করেছেন। বলা বাহুল্য আকারে ক্ষুদ্র হলেও লেখা গুলোর গুরুত্ব কিন্তু কোনভাবেই ক্ষুদ্র নয়। এর আগে ‘চতুরঙ্গ’ বইটি নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। এ বইটিতেও ‘চতুরঙ্গ’ এর মত বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে।
৪। হিটলার- সৈয়দ মুজতবা আলী
যদিও হিটলার একটি জীবনীগ্রন্থ জাতীয় রচনা কিন্তু এখানে হিটলারের পূর্ণাঙ্গ জীবন আলোচিত হয়নি। সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর পাঠকদের জন্য বেছে বেছে এই নাৎসী নেতার জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ গুলোই তুলে ধরেছেন। এই বইয়ের ভূমিকায় লেখা আছে- “হিটলার গ্রন্থটি পাঠকালে একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। লেখক যে প্রচুর পড়াশোনা করেছেন, নানা সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, একজন একনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী গবেষকদের মত এক তথ্যের সঙ্গে অনেক তথ্যের তুলনা করে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছেন.........মুজতবা আলীর পড়াশোনার গভীরতা ও ব্যাপকতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। তিনি উত্তম জার্মান ভাষা জানতেন, তাই সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি মূল পাঠের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন।“
এই বই কেনার জন্য এরপরে আর কোন দ্বিধাবোধ করি নাই।
সৈয়দ মুজতবা আলীর এ বইগুলো বের হয়েছে স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে।
৫। শিকারী পুরুষ+ওল্ড ইয়েলার- ফ্রেড জিপসন/রকিব হাসান
প্রতি বইমেলাতেই নিয়মিত ভাবে সেবা থেকে কিছু কেনা হয়ই। আর সেবার অনুবাদ বাদে অন্য কোন অনুবাদে তেমন একটা ভরসা পাইনা। বইটা কেনার সময় ভেবেছিলাম রকিব হাসানের অনুবাদ করা কোন শিকার কাহিনী হবে হয়তোবা। কিন্তু এখন বাসায় এনে দেখছি উপন্যাস দুটির আওতা আরো ব্যাপক। ‘শিকারী পুরুষ’ এর আসল নাম ‘দ্য হাউন্ড ডগ ম্যান’।
৬। ফাঁদ(আগাথা ক্রিস্টি/রকিব হাসান)+আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস(আর্নেস্ট হেমিংওয়ে/নিয়াজ মোর্শেদ)+পারচেজ অব দ্য নর্থ পোল(জুল ভার্ন/শামসুদ্দীন নওয়াব)
হেমিংওয়ের ‘আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ এর লোভেই বইটি কিনে ফেলা। এখন এই বইটিই পড়ছি। আপাতত যা বুঝলাম তা হচ্ছে- এই উপন্যাস এর কাহিনী বিবৃত হয়েছে ফ্রেডরীক হেনরীর বয়ানে যার বর্তমান কাজ হচ্ছে যুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ আর যুদ্ধাহত সৈনিকদের ফ্রন্ট থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে আসা। জাতীয়তায় সে মার্কিন নাগরিক হলেও কাজ করছে ইটালিয়ান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে। এর মধ্যে এলো প্রেম। পালিয়ে চলে এলো সে ফ্রন্ট ছেড়ে। এক একটি পাতা পড়ছি আর যুদ্ধের বিভীষিকা দেখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।
আগাথা ক্রিস্টির ফাঁদ ও পরা হল। আগাথা ক্রিস্টির লেখা এই প্রথম পড়লাম। বইএর পরিবেশ টা খুব পছন্দ হল। ভয়ঙ্কর তুষারঝড়, বাইরের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নতুন এক দম্পতি আয় রোজগারের জন্য সৌভাগ্যক্রমে পাওয়া একটি বাড়িতে বোর্ডিং হাউসের ব্যবসা খুলে বসলো। কিন্তু খুন গুলো কে করছে? কেন করছে? ক্লাসিক।
৭। মানুষিকতা- রায়হান আবীর
এটি মূলতঃ মুক্তমনা ব্লগের বই। শুদ্ধস্বরে গিয়েছিলাম অপরবাস্তবের খোঁজখবর নেয়ার জন্য। পরে এই বইটি কিনলাম। এই ধরণের বইগুলো পড়তে ভালো লাগে। চিন্তার অনেক খোরাক পাওয়া যায়। এই বইটির আলোচ্য বিষয় অবশ্য মনে হচ্ছে শুধুই নাস্তৈক্যবাদ নয়। তার সাথে সাথে চলতি আরো অনেক প্রসঙ্গ ও উঠে এসেছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে।
আর...
হুমায়ূন আহমেদের বইটা কিনতে গিয়ে বইএর পোড়া ধ্বংসস্তূপ্টি দেখলাম। আহারে! কতগুলো বই ছাই হয়ে গেলো! বাংলাদেশের এমনিতেই নড়বড়ে এক প্রকাশনা শিল্প। এর মধ্যে যদি এতো বড় ক্ষতি হয় তা কি মেনে নেয়া যায়। সকালে আনিসুল হকের এ সম্পর্কিত কলামটি পড়লাম। তাঁর মতন আমিও চাইনা এমন কোন অমানুষকে দেখতে যে এইরকম একটা জঘন্য কাজ করতে পারে। বইএর সাথে কার রয়েছে এতো শত্রুতা!! একটা স্টল দেখলাম ব্যানার টাঙ্গিয়েছে পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ স্টল শিরোনামে। অন্তত একটা বই তাদের থেকে কিনে নেওয়ার জন্য মিনতি করছে তারা। মনে আনন্দ নিয়ে বইমেলায় প্রবেশ করেছিলাম, বের হলাম এক ধরণের বিষাদের সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:২৯