বলাকায় আজ ১২টা ৩০ এর শোতে দেখে এলাম দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মুভি “চোরাবালি”।
অনেক ব্যাপারেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, কিন্তু শুধু সেগুলোর কথা বলে গেলে অন্যায় করা হবে।আর বাংলা মুভিকে ঢালাও ভাবে খারাপ বলার একটা প্রবণতা আমাদের আছে, সেটা বাদ দিয়ে হলে গিয়ে নিজে মুভি দেখে নিজের মন্তব্য করা উচিত বলেই মনে করি। যাই হোক, কাহিনী বলে দিয়ে মুভি দেখার আনন্দ নষ্ট করে দিতে চাই না, নিজেই দেখবেন এবং হলে গিয়ে দেখবেন অবশ্যই।
আমার দৃষ্টিতে মুভিটার কিছু দিক তুলে ধরছি-
***যা ভালো লেগেছে-
১) ঝকঝকে প্রিন্ট, ঠিকঠাক ক্যামেরার কাজ, মুভির অর্থপূর্ণ একটা নামকরণ।
২) শহিদুজ্জামান সেলিম – মঞ্চের অভিনেতারা বড়পর্দায় কি ধরণের দুর্দান্ত কাজ করার সামর্থ্য রাখেন সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন এই ভদ্রলোক। প্রয়াত হুমায়ূন ফরিদীর অসুস্থতার কারণে এই রোলটা আসে সেলিমের কাছে এবং তিনি পরিচালকের আস্থার পূর্ণ প্রতিদান দিয়েছেন। সেরা খল-অভিনেতা কিংবা পার্শ্ব-অভিনেতা নয়, সেরা অভিনেতার পুরষ্কার তার প্রাপ্য, কারণ সিনেমার মূল চরিত্রেই তিনি ছিলেন, সিনেমার তথাকথিত নায়ক – নায়িকারা কেউ তার ধারে কাছে আসতে পারেন নি।
৩) ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটা চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান – রেদওয়ান রনিকে ধন্যবাদ এই রোলটার মাধ্যমে বাংলা সিনেমার অন্যতম শক্তিশালী এই অভিনেতাকে খল চরিত্রে আবার দেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে।
৪) সুমন(ইন্দ্রনিল) এর অতীতের কাহিনীর অংশটুকু – আমার কাছে পুরো মুভির সবচেয়ে প্রাণবন্ত অংশ লেগেছে ওইটুকু। আর যে ছোটো ছেলেটা অভিনয় করেছে ইন্দ্রনিলের ছেলেবেলার চরিত্রে তার অভিনয় দেখে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম – চমৎকার সাবলীল অভিনয় করেছে ছেলেটা!
৫) মুভির স্টার্টিং বেশ ভালো ছিল, সাথে আইয়ুব বাচ্চুর “কেয়ারফুলি কেয়ারলেস” গানটা বেশ দারুণ একটা থ্রিলারের আমেজ দিচ্ছিল। তবে গানটার সাথে সাথে নাম না দেখিয়ে পুরো গানটার দৃশ্যায়ন করলে আরও ভালো লাগতো।
৬) শেষ দিকের ছোট্ট একটা টুইস্ট! দুর্দান্ত না হলেও মজার ছিল বেশ ব্যাপারটা!
***যা ভালো লাগেনি-
১) আইটেম গান আর নাচ। একদমই অপ্রয়োজনীয় লেগেছে পুরো ব্যাপারটা। হিন্দি আইটেম গানে নায়িকাদের “চিকনি”/”জওআনি”/”ঝান্ডু বাম”/”ফেভিকল” বলাটা যেমন শোনায় তারচাইতেও হাজার গুণে শ্রুতিকটু লেগেছে “ভিজিয়ে দে” শীর্ষক গানটা শুনতে। এর তুলনায় “কমন জেন্ডার” মুভির কিংবা “আমাদের গল্প” টেলিফিল্মের আইটেম সংগুলোও ভালো ছিল!
২) নায়ক-নায়িকার অতি দুর্বল চরিত্রায়ন এবং আরও দুর্বল অভিনয়। এই প্রথম জয়া আহসানকে কোনও চরিত্রে অতি অভিনয় করতে দেখলাম মনে হল। খুব স্বল্প পরিসরের রোল ছিল, কিন্তু জয়া একদমই হতাশ করেছেন। রনি বলেছেন নায়ক চরিত্রে দেশের কাউকে মানানসই লাগেনি। মুভির প্রথমার্ধে ইন্দ্রনিল বেশ ভালই, অনুভূতিহীন এক খুনির চরিত্রে তাকে ভালই লাগছিল। কিন্তু যখন থেকে ইমোশনাল অংশ শুরু হল তখন থেকেই তার অভিনয় হতাশা দিতে থাকল। মুভিতে ইন্দ্রনিলের ভয়েস ডাবিং করেছেন শতাব্দী ওয়াদুদ(গেরিলা মুভিতে ভিলেনের ডাবল রোল করেছিলেন)। যদি সুমন(ইন্দ্রনিলের করা চরিত্র) এর রোলটার আর একটু গভীরতা থাকত তাহলে আমার ধারণা শতাব্দী ওয়াদুদ দারুণ অভিনয় করতে পারতেন এই চরিত্রে। শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনীলের রোলটা “কুল” এর মডেল হয়ে গেছে, নায়ক আর হতে পারেনি।আর প্রযোজক সালেহিন স্বপন সাহেবের অভিনয় নিয়ে কিছু না বলাই মনে হয় ভালো, প্রযোজকরা অভিনয় করবেন এটা বোধ হয় ইদানিং নিয়মে পরিণত হয়ে যাচ্ছে!
৩) কারও হাত বেঁধে রেখে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া, আর খাওয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথেই হাত খুলে দিয়ে তার সাথে আড্ডা দেয়াটা একটু বেশি হাস্যকর হয়ে গেছে।আর ঠাণ্ডা মাথার একজন খুনির সাথে তেমন কোনও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিকের হঠাৎ প্রেম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও দৃষ্টিকটু ছিল।
৪) মুভির প্রথমার্ধ মোটামুটি টানটান হলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে অনেকক্ষণ কাহিনী একেবারেই ঝুলে গেছিল। শেষটাও গতানুগতিক বাংলা সিনেমাই তো হয়ে গেল-“অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিল” মার্কা। অথচ গ্যাংস্টার থ্রিলারগুলোর সমাপ্তি সাধারণত এরকম না হওয়াই উচিত। কিংবা কে জানে, দর্শক যা ভাবছিল তার উল্টো করাটাই হয়ত রনির সবচেয়ে বড় টুইস্ট ছিল!
৫) গানগুলো একদমই ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়নি, আইয়ুব বাচ্চুর “কেয়ারফুলি কেয়ারলেস” ছাড়া একটা গানের কথাও এখন আর মনে পড়ছে না!
৬)আরেকটা বিষয় চোখে লেগেছে- মুভির পোস্টারে সেলিমের খুব স্বল্প পরিসরে উপস্থিতি। মুভির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন সেলিম, অথচ আইটেম নাচের নায়িকা কেও মনে হয় তার চাইতে বেশি জায়গা দেয়া হয়েছে পোস্টারে।
সব মিলিয়ে-
রেদওয়ান রনির কিছু কাজ দেখেছি আগে ছোটোপর্দায়, বিশেষ করে রনি আর ফাহমির করা “হাউসফুল” ভীষণ পছন্দের ছিল, সেজন্যে হয়ত রনির কাছ থেকে প্রত্যাশাটা একটু বেশিই ছিল, তাই বেশ খানিকটা হতাশই হয়েছি। তবে রনি চেষ্টার কমতি রাখেননি সেটা মানতে হবে- সুদর্শন নায়ক-নায়িকা, শক্তিশালী খলনায়ক, আইটেম গান, রোমান্স, হ্যাপি এন্ডিং – সবই ছিল, কিন্তু কাহিনীটা জমজমাট ছিল না,অন্তত দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে।প্রথম ছবি ছিল, এর পর রনি আরও পরিণত এবং গোছানো কাজ করবেন এই প্রত্যাশা রইল।
আর যারা বলছেন এই মুভি বাংলা সিনেমায় নবজাগরণ নিয়ে এসেছে(বলাকার শেষের ৪ সারি বাদে বাকিসব সিট খালি ছিল) কিংবা সেলিমের অভিনয় “দ্যা ডার্ক নাইট” এর জোকারের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গেছে(!) তাদের বলব এত আশা বাড়িয়ে দেবেন না, হলে গিয়ে তাহলে অন্যদের হতাশ হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে।মুভি হিসেবে “চোরাবালি” মাঝারি গোছের, গতানুগতিক সিনেমার তুলনায় কিছু দিক থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে, কিন্তু রনি নিজেই হয়ত সামনে এর চাইতে আরও ভালো কাজ উপহার দেবেন।
যারা এখনও দেখেননি অনুগ্রহ করে হলে গিয়ে নিজে দেখুন, নিজেরও ভালো লাগবে, আমাদের মুভি ইন্ডাস্ট্রির ও প্রচার এবং প্রসার ঘটবে।