ধর্ষিতা (২০) এক যুবতী বলেন, "মুলাদীতে গণধর্ষণের শিকার হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে আমাকে আদালতের নির্দেশে বরিশাল মেডিকেলে ফরেনসিক পরীক্ষা করতে বলা হয়।ফরেনসিক পরীক্ষা কি এবং কিভাবে করতে হয় তাও বুঝতাম না। মামলার স্বার্থে এবং পরিবারের চাপে মেডিকেলে ফরেনসিক পরীক্ষা করাতে আসি। কিন্তু সেখানে ঘটে দুঃসহ এক ঘটনা।"
ধর্ষিতা আরো বলেন, "ফরেনসিক ডাক্তারের কক্ষে ঢুকে দেখতে পাই পুরুষ ডাক্তার বসে আছে। সে আমাকে কিছু প্রশ্ন করে পরনের জামা কাপড় খুলতে বলে। প্রথমে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পরি। কিন্তু পরীক্ষার স্বার্থে নিরুপায় হয়ে আমি পরনের জামা কাপড় খুলতে বাধ্য হই। পুরুষ ডাক্তার শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। এ সময় মনে হয়েছিল আরেকবার ধর্ষিত হচ্ছি।খুবই দুঃসহ যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তারের কক্ষ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হই। প্রথম ধর্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় ওই দৃশ্য ভুলতে পারলেও দ্বিতীয় ধর্ষনের (পরীক্ষা) কথা সারা জীবন মনে থাকবে।"
এমন তীক্ত অভিজ্ঞতার কথা বললেন মুলাদীতে গনধর্ষণের শিকার হয়ে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসিতে) চিকিৎসা এবং ডাক্তারী পরীক্ষার নিতে আসা ওই যুবতী ।
একইভাবে চিকিৎসা নেয়া আগৈলঝাড়ার ধর্ষিত গৃহবধূকে (২৮) পরীক্ষা করে শের-ই- বাংলা মেডিকেল হাসপাতালের ফরেনসিক ডাক্তার আদিলুজ্জামান। ধর্ষিতার বয়স এবং ধর্ষিণ পরীক্ষার করার জন্য তাকে পরীক্ষার জন্য ডাক্তারদের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল।
কোতয়ালী মডেল থানার -৮১ নং মামলার ভিকটিম ধর্ষিতা (৩০) জানান, ওই রুমে নিয়ে আমাকে নগ্ন করে স্ত্রী লিঙ্গে আঙ্গুল দিয়ে টেনে হেঁচড়ে দেখে ডাঃ বেলায়েত হোসেন।
নগরীর পুরান কয়লা ঘাট এলাকার মেয়ে ধর্ষিত যুবতী ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য গেলে তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে দিয়েছিল।
খোজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে কোন মহিলা ডাক্তার নেই। ধর্ষিত হওয়ার পর আবার পুরুষ ডাক্তারের কাছে সম্পূর্ন নগ্ন অবস্থায় পুরো শরীর পরীক্ষা করে অপরাধ প্রমাণের সনদ গ্রহণ করতে হয় শিশু, কিশোরী, যুবতী ও নারীদের। এই রীতি শুধুমাত্র নারীর প্রতি অবমাননাই নয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা পরিপন্থী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের জনগনের অর্ধেক নারী এবং প্রতি বছর দেশের ১৪টি সরকারী এবং ৫টি প্রাইভেট হাসপাতালে প্রায় ৫০ ভাগ ধর্ষিতা ভর্তি হয়। তবে কেন এ ক্ষেত্রে কোন মহিলা ডাক্তার পাওয়া যায় না।
চলতি বছরে বরিশাল মেডিকেলে কিশোরী, যুবতী ও প্রাপ্তবয়স্কসহ মোট ১৩৪জন নারীকে ধর্ষিণ ও বয়স পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক পুরুষ ডাক্তারের কাছে নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল। অপরদিকে ময়না তদন্ত করার জন্য অপমৃত্যুসহ অন্যান্যভাবে মৃত্যু হওয়া ২০৭টি লাশের খোঁজ পাওয়া যায়। মৃতদের মধ্যে ৫৫জন মহিলা। এই লাশগুলো সব পুরুষ ডাক্তার দ্বারা ময়না তদন্ত করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে বর্তমানে ফরেনসিক বিভাগে ৪জন পুরুষ ডাক্তার রয়েছে। এরা হলেন- সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ রফিকুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আকতারুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক ডাঃ আদিলুজ্জামান ও প্রভাষক ডাঃ মোঃ দেলোয়ার হোসেন। অবশ্য ৯ মাস পূর্বে একজন মহিলা ডাক্তার ফরেনসিক বিভাগে যোগদান করলেও ১ মাসের মধ্যে তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ফরেনসিক বিভাগে দক্ষ মহিলা ডাক্তারের জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ নারী আন্দোলসহ বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন করলেও এখন পর্যন্ত কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি।
ফরেনসিক বিভাগের সাবেক একজন সহযোগী অধ্যাপক জানায়, এ ক্ষেত্রে সেবার মানসিকতা থাকতে হবে। নিজকে ধর্মভীরু মনে করতে হবে। সৎভাবে প্রভাব মুক্ত থাকতে হবে। তার পরেও ফরেনসিক বিভাগে নারী ডাক্তার থাকলে ভাল হত বলে মন্তব্য করেন তিনি’।
বরিশালের নারী নেত্রী প্রতিমা সরকার জানান, এ নিয়ে বহু আন্দোলন করেছি এবং বর্তমানেও করছি। কোন কোন ধর্ষিতার পরীক্ষার জন্য একাধিক ডাক্তারের কাছে তাকে নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে হয়। এটি যে কত কষ্টকর তা নারী ছাড়া কেউ বুঝবে না। এ ব্যাপারে দ্রুত সমাধান চান সকলেই।
রাহাত খান, বরিশাল থেকে :