somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পলাশী ট্রাজেডি : প্রেক্ষিত আজকের বাংলাদেশ

২৩ শে জুন, ২০১০ রাত ৯:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পলাশী ট্রাজেডি : প্রেক্ষিত আজকের বাংলাদেশ
ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

তেইশে জুন, পলাশী; আমাদের জাতিসত্তার রক্ত কণিকার সাথে মিশে থাকা একটি দিন; একটি নাম। পলাশী বিপর্যয় বা পলাশী ট্রাজেডি নিছক একটি ঘটনা বা দূর্ঘটনা নয়, ইতিহাসের বাক ঘুরানোর একটি দিন- যে দিনকে সামনে রেখে হৃদয়ের অবিরত রক্তক্ষরণের মধ্যেও শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করার প্রেরণা পাওয়া যায়। যেদিনটি বাংলার মানুষকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তোলে, পিছনে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে এবং ভবিষ্যত পথ রচনার অনিবার্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। পলাশীর আম্রকানন শুধু ভাগীরথী নদীর তীরের একফালি জমি নয় বরং স্বাধীনতার সতত আকাংখা, প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর-জগৎশেঠ গংদের মোকাবেলায় স্বাধীনতা রক্ষা করার দৃপ্ত অঙ্গীকার। এ দিনটি নবাব সিরাজ উদ দৌলার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও বহু পূবেই স্বয়ং সম্রাট আকবর কর্তৃক মুসলিম ঐতিহ্যে র্শিকবাদী চেতনার সংমিশ্রণের মাধ্যমে ‘দীন-ই-এলাহী’ নামক অনৈতিকতা, অনৈক্য ও বিভ্রান্তির যে বীজ বপন করা হয়েছিল ক্রমশ তা ঘাতক ব্যাধির ন্যায় মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়ে প্রবেশ করে গোটা মুসলিম সাম্রাজ্যকে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেব সারাজীবন ব্যাপী সর্বশক্তি নিয়োগ করে অসুস্থ মানসে সুস্থতার চিকিৎসাসেবা দিয়ে বিপর্যয়কে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ যদি তাঁর মত নৈতিকমান সম্পন্ন ও বিচক্ষণ হতেন তবে হয়তো ভারত ও বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হত।

পলাশীর পটভূমি

ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে পর্তুগীজরাই প্রথম দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এসেছিল মসলার গন্ধের সূত্র ধরে। তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের সূত্র ধরে এ অঞ্চলে বাণিজ্য করার মানসে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে রানী এলিজাবেথের সনদ নিয়ে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কোলকাতায় আসে। সমসাময়িককালেই ডাচ ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শ্রীরামপুরে, ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চন্দননগরে এবং ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চঁচুরায় কুঠি স্থাপন করলেও মূলধন ও বাণিজ্যের পরিমাণের ক্ষেত্রে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। সম্রাট জাহাঙ্গীর সর্বপ্রথম ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানীকে সুরাট বন্দরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি দেন কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় তারা ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে তা নির্মাণ করে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্রাটের সুনজর পাবার আশায় ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস রো ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর দূতরূপে নির্ভেজাল বাণিজ্যনীতি নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন এবং আজমীর, মাণ্ডু ও আহমদাবাদে তিন বছর অবস্থান করেন। সে সময় তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে কোন বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন না করতে পারলেও ব্যবসায়িক পথ খানিকটা সুগম করেন। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৬৪৪-৫০ খ্রী.) সম্রাট শাহজাহানের কন্যার অসুস্থতার সুবাদে সুরাটের ইংরেজ চিকিৎসক গাব্রিয়েল বাউটন সম্রাটের কাছাকাছি আসার সুযোগ লাভ করেন এবং সম্রাটকন্যাকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এ সুযোগে চিকিৎসাসেবার কৃতজ্ঞতা হিসেবে তিনি সম্রাট শাহজাহানের নিকট থেকে ইংরেজ কোম্পানীর জন্য বাংলায় আংশিক বাণিজ্যের অধিকার সম্বলিত একটি শাহী ফরমান আদায় করেন। পরবর্তীতে ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিন বছর যাবৎ ঐ চিকিৎসক বাংলার সুবেদার শাহাজাদা শাহ মুহাম্মদ সুজার পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োজিত থাকেন। তারই অনুরোধে শাহী ফরমান অনুধাবন না করেই শাহ সুজা মাত্র তিন হাজার টাকা বার্ষিক নজরানার বিনিময়ে তাদেরকে বাংলায় বাণিজ্যের অনুমতি দেন। এ অধিকার বলেই তারা ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে প্রথম কুঠি স্থাপন করে বাংলার বিভিন্ন বন্দরে বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্যের সূত্রপাত করে। পরবর্তীতে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে তারা বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। অতঃপর তারা ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা এবং ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে মালদহে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে শাহাজাদা আজিম-উস-সানের সুবাদারী আমলে (১৬৯৭-১৭০৩ খ্রি.) মাত্র ১৬,০০০/- (ষোল হাজার) টাকার বিনিময়ে জব চার্নকের প্রচেষ্টায় কোম্পানী সূতনটী, গোবিন্দপুর ও কোলকাতা নামক তিনটি গ্রামের জমিদারী সনদ লাভ করে এবং ঐ বছরই ইংল্যান্ডের তৎকালিন রাজা উইলিয়ামের নামানুসারে কোলকাতায় ‘ফোর্ট ইউলিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করে।

ইতোমধ্যে কোম্পানি বাণিজ্যের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে এবং শাসক ও কোম্পানির মধ্যে পরষ্পর বিরোধী অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে দন্দ্ব শুরু হয়। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দ্বন্দ নিরসন কল্পে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে একটি শান্তিচুক্তি করে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর রাজ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হলে ইংরেজ কোম্পানি সুযোগ সন্ধানীনীতি গ্রহণ করে এবং ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে ফারুখশিয়ার মসনদ অধিকার করলে কোম্পানি তাঁকে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক সুবিধা সম্বলিত ফরমান লাভ করে।

এ দিকে বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খান কোম্পানিকে ভূসম্পত্তি লাভ, নিজস্ব মুদ্রা প্রচলন এবং করমুক্ত অবাধ বাণিজ্যের অনুমতি দানে অসম্মতি জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ফারুকশিয়ারের ফরমানকে অস্বীকৃতি জানান। তার পরবর্তী সুবাদার সুজাউদ্দীন খান (১৭২৭-৩৯) এবং আলীবর্দী খানও (১৭৪০-১৭৫৬) একই নীতি আলম্বন করেন। ইংরেজ কোম্পানি মোগল সম্রাটদের নিকট থেকে বাণিজ্যিক সকল সুযোগ সুবিধা অর্জন করতে পারলেও বাংলার সুবেদারগণ দক্ষতার সাথে অতি কৌশলে কোম্পানির সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিলেন। কিন্তু ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সে কৌশলী রাজনীতির অবসান ঘটে এবং নবাব সিরাজ উদ দৌলার সময় চতুর্মুখী সমস্যার কারণে পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে।

পলাশী : একটি অনিবার্য ট্রাজেডি

‘পর শত্রুর চেয়ে ঘর শত্রুই মারাত্মক’ নবাব সিরাজ উদ দৌলার জীবনে তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে। দূর্বল মোগল সম্রাটদের নিকট থেকে অবাধ সুযোগ সুবিধা পাবার পরও বাংলার স্বাধীন নবাবগণ দক্ষতার সাথে দৃঢ় হস্তে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিলেন, যা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সিরাজ উদ দৌলা বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হবার পরই ঘরের শত্রুরা ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। নবাবের খালা ঘসেটি বেগম পূর্ণিয়ার ফৌজদার শওকত জঙ্গকে মসনদে বসানোর জন্যে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। মীর জাফর আলী খান সে ষড়যন্ত্রে একাত্মতা ঘোষণা করে। রাজবল্লব, উমিচাঁদ, নবকুমার, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র প্রমূখ কেউবা সরাসরি প্রকাশ্যে আর কেউবা বাহ্যত নবাবের প্রতি আনুগত্য ও মিত্রতা রেখে গোপনভাবে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে নবাবকে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎখাত করার মিশন নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে মেতে ওঠে। ইংরেজরা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের একটি সুযোগই অনুসন্ধান করছিল।

বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুমান করে ইংরেজ কোম্পানি নিজেদের ভবিষ্যত প্রস্তুতি হিসেবে ১৭৫৬ সালের মাঝামাঝি নবাবের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফোর্ট ইউলিয়ামকে সামরিক সাজে সজ্জিত করতে শুরু করে। নবাব সিরাজ উদ দৌলা সামরিক প্রস্তুতির বিষয়ে সতর্ক করে দূর্গদেয়াল ভেঙ্গে পরিখা বন্ধ করা এবং রাজকীয় কোষাগার আত্মসাত করে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের নিকট আশ্রিত কৃষ্ণবল্লভকে ফেরত দেয়ার জন্য যথাক্রমে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল এবং গভর্নর ড্রেককে নির্দেশ দেন। কোম্পানি এ নির্দেশকে অস্বীকার পূর্বক নবাবের প্রেরিত প্রতিনিধি নারায়ন সিংহ ও খাজা ওয়াহিদকে অপমান করে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেয়। নবাব এ প্রতিশোধ কল্পে ঐ সালের ১৩ জুন কোলকাতা অবরুদ্ধ করে ২০ জুনের মধ্যে কোলকাতাকে ইংরেজমুক্ত করেন।

কাশিমবাজার এবং কোলকাতার পতনের খবর মাদ্রাজ ও ইংল্যান্ডে পৌঁছলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল মুর্শিদাবাদে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ মর্মে তারা তথাকথিত নবাবঘরানার প্রধান ব্যক্তিদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সে সূত্রেই নবাব দরবারের ইংরেজ প্রতিনিধি উইলিয়াম ওয়াটস ও লিউক স্ক্রেফটনের মাধ্যমে ১৭৫৭ সালের ৪ জুন মুর্শিদাবাদের এক গোপন কক্ষে মীর জাফর ইংরেজদের সাথে একটি গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, নবাব সিরাজ উদ দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করে মীর জাফরকে নবাব মনোনীত করা হবে; কোলকাতার ক্ষতিপূরণ বাবদ মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানিকে ১০০ লক্ষ, ইউরোপীয়দেরকে ৫০ লক্ষ, হিন্দুদেরকে ২০ লক্ষ এবং আর্মেনীয়দেরকে ৭ লক্ষ টাকা দেবেন। জগৎশেঠ, ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লব, সেনাপতি রায়দূর্লভ, নন্দকুমার, শিখ ব্যবসায়ী উমিচাঁদ প্রমুখ ছিলো ষড়যন্ত্রের মধ্যমনি।

চুক্তির কার্যকারিতা লাভ করার জন্য ইংরেজ কোম্পানি বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে। নবাব সিরাজ মীর জাফর সম্পর্কে সন্দিহান হলেও মীর জাফর দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করার নিমিত্তে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করে। নবাব সরল বিশ্বাসে সে শপথের বিশ্বস্ততায় অবশেষে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মীর জাফরকে সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের মোকাবেলায় প্রেরণ করেন। সেই হীন নীচমন বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর স্বাধীনতার উজ্জ্বল সূর্যকে ধুরন্দর ক্লাইভ ও ওয়াট্সদের হাতে সমর্পন করে নির্লজ্জভাবে। হতভাগ্য নবাব বিহার সীমান্তে রক্ষিত তাঁর বিশ্বস্ত বাহিনীর সাহায্যে শেষ চেষ্টা চালানোর প্রয়াসে ব্যর্থ হলে পালিয়ে যাবার সময় পথিমধ্যে ধৃত হয়ে মুর্শিদাবাদেই ফিরে আসেন। অবশেষে তাঁরই পিতামাতার আদরে লালিত বিশ্বাস ঘাতক মোহাম্মাদী বেগের হাতে তিনি শহীদ হন। শহীদ হন নবাব আর অস্তমিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই গেয়ে ওঠেন-

পলাশী ! হায় পলাশী !
এঁকে দিলি তুই জননীর বুকে
কলংক-কালিমা রাশি
হায় পলাশী!
পলাশী পরবর্তী বাংলা

পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় প্রকারান্তরে ইংরেজদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। নবাব (?) মীর জাফর ইংরেজের ক্রীড়নকে পরিণত হন। বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালের দেওয়ানী লাভের মধ্য দিয়ে ইংরেজদের পুরোপুরি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে বাংলায় ব্যাপক লুন্ঠণ ও শোষণ চলে। ১৭৫৭-১৭৮০ সালের মধ্যে মাত্র ২৩ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ড বা ৬০ কোটি টাকা। ১৯০০ সালে এর সমমূল্য দাড়ায় ৩০০ কোটি টাকা। তাহলে ২০০৮ সালে এর মূল্য কত হাজার কোটি টাকা হবে তা হিসেব সাপেক্ষ বিষয়। এছাড়া পলাশীতে বাংলার সূর্য অস্তমিত হবার পর পরই ঘোর আঁধারের সুযোগে মীর জাফর নবাবের হীরাঝিল প্রাসাদ লন্ঠণ করেন। হীরাঝিলের প্রকাশ্য ধনভাণ্ডারে সঞ্চিতসম্পদের মধ্যে ছিল ৩২ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, দুই সিন্ধুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, ৪ বাক্স হীরা জহরত, ২ বাক্স চুনি-পান্না প্রভৃতি মূল্যবান পাথরসহ এবং ১ কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্য মুদ্রা ও ৮ কোটি টাকা। এভাবে নগদ অর্থ লুন্ঠণের পাশাপাশি রাজস্ব বিভাগ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং অধিক মাত্রায় রাজস্ব আদায়ের জন্য কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। অন্যান্য বিদেশী বণিকদের বিতাড়িত করে ইংরেজরা নিজেদের ইচ্ছেমত মূল্যে পণ্য ক্রয় বিক্রয় শুরু করে, এমনকি কৃষকদের পণ্য উৎপাদন মূল্যের চেয়ে পণ্যমূল্য হ্রাস পায়। ফলে লবন শিল্প, তাত শিল্প, চিনি শিল্প ও রেশম শিল্পসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবন চলার পথ বন্ধ হয়ে আসে। অন্যদিকে বাংলার মুসলমান অভিজাত শ্রেণীকে সামরিক বাহিনী, রাজস্ব আদায় ও বিচার বিভাগের চাকুরী থেকে পদচ্যুত করার কারণে তারাও ক্রমাগত দারিদ্রের কোটায় নেমে পড়ে। শিক্ষা-সংস্কৃতি সব কিছুতেই মুসলমানগণ হয়ে পড়ে পশ্চাদপদ। ইংরেজদের খাজনা, নির্যাতন এবং হিন্দু জমিদারদের গুদামজাতকরণ নীতির পরিণতি হিসেবে ১৭৭৬ সালে পরিকল্পিত দূর্ভিক্ষের কবলে পড়ে বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারায়।

পলাশী ও আজকের বাংলাদেশ

১৭৫৭ সালের বাংলা এবং ২০১০ সালের বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কিছু সামঞ্জস্যতা প্রত্যক্ষ করা যায়। সেদিনের মতো আজও দেশের ভিতরে-বাইরে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। ইতিহাসের যে কোন সময়ের চাইতে এই ষড়যন্ত্র এখন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে চলছে নিরন্তর অপচেষ্টা। এই অপচেষ্টার লক্ষ্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে গলাটিপে হত্যা করা নয়; বরং এই দেশ ও জাতির অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সহজ পন্থায় বিকিয়ে দেয়া; যেন বাংলাদেশ নিজেই সিকিমের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য হয়। আর বাংলাদেশের সচেতন জনগণ যদি তা নাও বাস্তবায়ন করতে দেয়, তাহলে অন্তত বাংলাদেশকে আর একটি পলাশীতে ঠেলে দেয়া অথবা জলন্ত ইরাক-ফিলিস্তিন কিংবা বসনিয়ায় পরিণত করা। এ ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদের তল্পিবাহকরা শুধু যে রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ তা নয়। বরং তারা শেকড় কেটে দিচ্ছে অর্থনীতি, শিল্প ও ইতিহাসের। ছড়িয়ে দিচ্ছে সন্ত্রাস; উপড়ে নিচ্ছে আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। এ জন্যই আধিপত্যবাদের কাছে যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদেরকে ‘বরেণ্য ব্যক্তি’ হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য নেয়া হয়েছে নানা ব্যবস্থা। আর যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোষহীন দুর্নীতি না করেও তাদের অনেকের ভাগ্যে নেমে আসছে জেল জুলুমসহ বহুবিধ লাঞ্চনা। এমন কি দেশপ্রেমিক জননেতাদের কাউকে আজীবনের জন্য পঙ্গু করে ফেলে রাখারও অপচেষ্টা চলছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। কবি আল মাহমুদের ভাষায়-

এসেছে যে অন্ধকার পুনর্বার বাংলার ললাটে
সে লজ্জা স্মরণ করে হাত তুলে দাঁড়ায় সে জাতি
দুই শতাব্দীর গ্লানি জমা আছে হাটে মাঠে বাটে
সিরাজের লাশ নিয়ে হেঁটে যায় মিরনের হাতি
......................................................
হাতির পায়ের শব্দে দ্যাখো চেয়ে কারা হেঁটে যায়
এতো মুর্শিদাবাদ নয় । এই গজ এখন ঢাকায়।

পলাশী বিপর্যয়ের পরে সারা বাংলাদেশ যখন শোকে মুহ্যমান, তখন উপমহাদেশে মাত্র একটি শহরে ইংরেজদের পক্ষে বিজয় মিছিল বের হয়েছিল; সে শহরটির নাম কোলকাতা। আজ এই মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরে যে ‘খ্যাতি ভিখারী’ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এরাও সেখানকারই আশির্বাদপুষ্ট। তার চায় বলেই আমাদের জমিনে জন্ম হয় একজন দাউদ হায়দারের, একজন তসলিমা নাসরীনের। তারা চায় বলেই আমাদের বুদ্ধিজীবিরা (?) বলেন, ’৪৭-এর ভারত বিভাগ ছিলো ভুল। তারা চায় বলেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক লেখেন, বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর দরকার নেই, বলেন আরও অনেক কিছু। কার স্বার্থে জন্ম হয়েছিল শান্তিবাহিনী ও বঙ্গসেনার; সর্বহারা, জনযুদ্ধ, জেএমবিসহ দেশের শান্তিবিঘ্নকারী সন্ত্রাসী বাহিনী কোন আধিপত্যবাদের আশির্বাদে লালিত তা দেশবাসীর কাছে দিনের সূর্যের মতোই পরিস্কার। বেরুবাড়ি, আঙ্গর পোতা দহগ্রাম, তিন বিঘা কড়িডোর ও দক্ষিণ তালপট্টিতে দখলদারীত্ব, সীমান্ত আইন ভঙ্গ করে নোম্যান্স ল্যান্ডে কাটা তারের বেড়া ও পর্যবেক্ষন টাওয়ার তৈরি, যখন তখন নিরীহ বাংলাদেশীকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা ও অপহরণ, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ৫৪টি নদীর পানি প্রত্যাহার করে নদী মার্তৃক বাংলাদেশকে মরুভূমি করে ফেললেও সেভেন সিস্টারের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঠেকাতে আজ তাদের জন্য চাই ট্রানজিট-কড়িডোর; স্বাধীনতার ৩৮ বছর ধরে তা আগলে রাখতে সক্ষম হলেও বর্তমানে তার খানিকটা ইতোমধ্যে লুণ্ঠিত হবার খবরকেও উড়িয়ে দেয়া যায়না। সংস্কৃতির আকশ মাটিতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। আজ আমাদের দেশে তাদের সবগুলো টিভি চ্যানেলের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকলেও আমাদের একটি টিভি চ্যানেলও সে দেশে প্রবেশ করতে পারেনা। বন্যার স্রোতের মতো ঢুকছে মদ-গাঁজা, ফেনসিডিল-হিরোইনসহ প্রজন্ম ধ্বংসকারী মরণাস্ত্র মাদক, ঢুকছে বিকৃত গ্রন্থ, রপ্তানী করছে মগজ ধোলাইকৃত বুদ্ধিজীবি। জনতার শেষ ভরসা দেশের সশস্ত্রবাহিনীসহ দেশ বাঁচানোর মৌলিক মাধ্যমগুলোর কোনটাই আজ ষড়যন্ত্রের বাইরে নয়।

পলাশীর প্রেক্ষাপটের সাথে বর্তমানের এই মিলের কারণেই পলাশী স্মরণের প্রয়োজনীয়তা অন্য যে কোন সময়ের চাইতে আজ সর্বাধিক। সেই ভুলের পর্যালোচনা না করলে দ্বিতীয় ভুলের ফাঁদে আমাদের জীবন ও জাতীয় অস্তিত্ব আজ সত্যিকার অর্থেই বিপন্ন হতে পারে। এ জন্যই ইতিহাসের এই ক্রান্তিকালে কোন দেশপ্রেমিক নাগরিক ঘরে বসে থাকতে পারে না, থাকা উচিৎ নয়। আমাদের তরুণ সমাজকে জানাতে হবে সঠিক তথ্য ও ইতিহাস, পরিষ্কার করে চেনাতে হবে শত্রু-মিত্র। আধিপত্যবাদের তল্পিবহনকারী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট কুয়াশা ও কাঁকরের দিগন্ত ভেদ করে তাদেরকে দিতে হবে সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবনের সন্ধান। সকল হীনতা, দীনতা, হতাশা ও ভীতির করাল গ্রাস থেকে জাতিকে উদ্ধার করে শোনাতে হবে আশার বাণী। তাদের সমস্ত রক্ত-মাংসে দিতে হবে যথার্থ চেতনা। তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহসী উচ্চারণই বার বার স্মরণে আসে-

সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের / খোদার রাহায় প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের
দেশের পায়ে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের / সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের।

শেষ কথা

আজ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাতাব্বরীতা, অর্থনীতির মোড়কে এনজিওদের দৌরাত্ম ও সংস্কৃতির নামে উলঙ্গপনা বাংলাদেশের আকাশ বাতাসকে দখল করে ফেলেছে। দেশের বাইরের দিকের আগ্রাসন ও ভিতরের ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে আশংকা হচ্ছে জাতি আরো একটি পলাশীর মুখোমুখি। এ দুঃখজনক প্রেক্ষাপটে পলাশী আমাদের স্বাধীনতার শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করে দিচ্ছে, স্বরূপ উদঘাটন করে দিচ্ছে বিশ্বাস ঘাতকদের। তাই সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাট শাহজাহান, ফারুকশিয়ার কিংবা নবাব সিরাজ উদ দৌলার মত উদারতা ও সরলতা নয়, আজকের মীর জাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লব, রায়দূর্লভ, নন্দকুমার, উমিচাঁদ ও ঘষেটি বেগমদের ব্যাপারে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যেন তারা আর কোন পলাশীর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে। বাংলার মাটিতে মীর জাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লব, রায়দূর্লভ, নন্দকুমার, উমিচাঁদ ও ঘষেটি বেগমদের ঠাঁই নাই, এই হোক আজকের শ্লোগান।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি,
E-mail:- mrakhanda@gmail.com
Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসরাইল ধ্বংসের পথ ‼️

লিখেছেন সরকার পায়েল, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৩:০১

এক ইরান নিয়ে আমেরিকা ইসরাইলের ঘুম হারাম কে জানে আরবে আরও কত ইরান অপেক্ষা করছে পশ্চিমাদের জন্য ‼️ আগামী নয় তারিখ ইরান তার পারমানবিক সর্বশেষ অর্জনের ঘোষণা দিবে l... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন মানুষের মূল্য কত?

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:২২

একজন মানুষের মূল্য কত?
প্রশ্নটি ব্যঙ্গার্থে হলেও, বৈজ্ঞানিকের চোখে এ প্রশ্নটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে- সেই প্রসঙ্গে না যাই।

মাথাপিছু আয় বাড়ে, দ্রব্যমূল্য বাড়ে, মূদ্রাস্ফীতি বাড়ে। কিন্তু এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাধু সাবধান! দেশে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে পলাতক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী অপশক্তি!

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:০৬

সাধু সাবধান! দেশে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে পলাতক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী অপশক্তি!

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ কর্মসূচির মিছিল, প্রথম আলো অনলাইন থেকে সংগৃহিত।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, লুটপাট, ভাংচুর এবং বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের কেটে কুচিকুচি-নিরাপত্তা চায় ভারত

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


বর্তমানে ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ৮৭০,০০০টি যার আয়তন ৯৪০,০০০ একর বা ৩,৮০৮ বর্গ কিমি জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং এস সম্পত্তির মোট মূল্য ১,০০,০০০ কোটি রুপি বা ১২ বিলিয়ন মার্কিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিডনী রোগ নিয়ে ব্লগার গণ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও সাজেশনস জানাবেন।

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৩২






আমার খুব কাছের (রক্তের), বয়স ৪৭, একজনের কিডনী সমস্যা ধরা পড়ে গত বছর জুলাইয়ে,তখন ক্রিয়েটিনিন ছিলো ৪.৩৩ ; পরে শরীর খারাপ হওয়ায় মেডিকেল ভর্তি থেকে ঔষধ সেবন করে ক্রিয়েটিনিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×