পুষ্টিকর আর উপকারী বেল ফলের সাথে আমরা সকলেই পরিচত । ইংরেজিতে বেলকে বলা হয় Wood Apple কারণ এ ফলের খোসা কাঠের মত শক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aegle marmelos Correa । বেল এর সংস্কৃত নাম বিল্ব। বেলের জন্ম ভারতবর্ষে হলেও এটা বাংলাদেশ, শ্রীলংকা , পাকিস্তান, নেপাল , মায়ানমার, ভিয়েতনাম , লাউস , কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড , মালএশিয়া, ইন্দোনেশিয়া , ফিলিপাইন , ফিজি , কেরিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ উপকূলেও জন্মে বলে জানা যায় । নিন্মে বেলের বৈশ্বিক অবস্থান দেখানো হল (গুল চিহ্নিত দাগ এলাকা) ।
ছবি-২/৩৬ : বেল ফল জন্মানোর বৈশ্বিক অবস্থান
সুত্র : Click This Link
বেল গাছ বড় ধরনের বৃক্ষ যার উচ্চতা প্রায় ১০-১৬ মিটার পর্যন্ত হয় । শীতকালে পাতা ঝরে যায়, আবার বসন্তে নতুন পাতা আসে। পাতা ত্রিপত্র যুক্ত, সবুজ, ডিম্বাকার ; পত্রফলকের অগ্রভাগ সূঁচাল। ফুল হালকা সবুজ থেকে সাদা রঙের ৪-৫টি পাঁপড়ি থাকে । ফুলে মিষ্টি গন্ধ আছে। ফল বড়, গোলাকার, শক্ত খোসাবিশিষ্ট। ফলের ভিতরে শাঁস বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত, কোয়ায় চটচটে আঠার সাথে অনেক বীজ লেগে থাকে। কাচা ফলের রঙ সবুজ, পাকলে হলদে হয়ে যায়। পাকা বেলে থেকে সুগন্ধ বের হয়। পাকা বেল গাছ থেকে ঝরে পড়ে।
বেলকে বলা হয় শ্রীফল কারণ হিন্দুদের পুজা-অর্চনায় বেলের পাতা ও ফল ব্যবহার করা হয়। হিন্দুরা বেল কাঠও পবিত্র জ্ঞান করে বিধায় কখনো বেল কাঠ পুড়িয়ে রান্না করে না।
ছবি-৩ /৩৬ : হিন্দুদের শিবপূজায় ত্রিনয়নের প্রতীক হিসাবে বিল্বপত্র ব্যবহৃত হয়।
বেল পাতা দিয়ে সমগ্র ভারতর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের শিব পুজা ছাড়াও নেপালের নেওয়ারী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বেলের সাথে কুমারী মেয়েদের বিবাহ দেয়া হয় । নেপালের কাঠমুন্ডু ভেলী এলাকায় প্রায় ৩০ লক্ষ নেওয়ারী হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস , এরা নেপালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে দেশের অপরাপর সম্প্রদায় হতে বেশ অগ্রগামী (UNDP ২০১৪) ।
ছবি -৪/ ৩৬ : নেপালের কাঠমুন্ডু ভেলী এলাকার নেওয়ারী হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমারী কন্যাদের বেল বিবাহের প্রস্তুতি
বেল বিবাহ নেপালের নেওয়ার হিন্দু কমিউনিটিতে একটি অনন্য ঐতিহ্যময় স্বতন্ত্র সংস্কৃতি । নেওয়ার সম্প্রদায়ের কন্যাদের জীবনে তিনবার বিয়ে হয়, নেওয়ারি ভাষায় " "IHI" বা ‘’বেল’’ প্রথম বিবাহ নামে পরিচিত , দ্বিতীয় বিয়েটি হয় সূর্যের সাথে যা নেওয়ারি নেপালী ভাষায় "বারা তাইগু” নামে অভিহিত এবং শেষ বিয়েটা হয় একজন মানবের সাথে যেটা তাদের আসল বিবাহ । পুজা অনুষ্ঠান করে পুরোহিতের মাধ্যমে এই বিবাহ পরিচালিত হয় ।
যৌবনারম্ভের পুর্বে নেওয়ারী কুমারী মেয়েদের সাথে বেলের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় , এই বিবাহের মাধ্যমে তাদের সক্রিয় এবং সুস্থ প্রজনন ক্ষমতা অধিগ্রহন নিশ্চিত করা হয় । বেল বিবাহ উপলক্ষে আয়োজিত পুজার জন্য মেয়েদেরকে বিভিন্ন মেক আপ, লাল কাপড় এবং বভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যময় অলংকারাদির দ্বারা নববধূরূপে সজ্জিত করা হয় ।
ছবি- ৫ / ৩৬ : লাল কাপড় পরিহিতা বিয়ের কনেকে অলংকারে সাজানো হচ্ছে
এই বিয়েতে বেল হয় বর এবং এই বেল প্রভু শিবের প্রতিনিধি হিসাবে হয় গন্য হয় , বেলটিকে হতে হয় পরিপুষ্ট , সুন্দর ও পাকা , বিয়ের পর বেলটিকে সযত্নে যথাযথ মর্যাদায় রাখতে হয় যাতে এর কোন ক্ষতি না হয় । নেওয়ারি সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয় যে, বেলটির যদি কোন ক্ষতি বা নস্ট হয় তাহলে মেয়েটির তৃতীয় বিয়ে কোন কুদর্শন ও অবিশ্বস্ত স্বামীর সাথে হবে এবং বাকি জীবনটা তার কুদর্শন স্বামীর সাথেই কাটাতে হবে । তাই নেওয়ারীরা বিবাহের পর বেলটিকে খুব সযত্নে সংরক্ষন করে রাখে ।
ছবি-৬/৩৬ : শিবকুমারের প্রতিনিধি বেল বরকে বেল বধু হাতে ধরে রেখেছে
ছবি-৭/ ৩৬ : বেল বধুকে বরন করে নেয়ার একটি দৃশ্য
এই বেল বিবাহের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো প্রতিকি ভাবে একবার প্রভু শিবপুত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে সে বিশুদ্ধ নারী থাকবে এমনকি তার বাস্তব স্বামী ভবিষ্যতে যদি মারাও যায় তাহলে সে বিধবা বলে গন্য হবেনা, কারন তার বিবাহ হয়েছে চিরঞ্জিব প্রভু শিব প্রতিনিধির সাথে ।এই বেল বিবাহ উপলক্ষে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও আমন্ত্রিতগন নববধূকে অনেক উপহার সামগ্রিও দেয় । নেপালীরা মনে করে এই বেল বিবাহ তাদেরকে অভাবমুক্ত রাখতে ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমুজ্জলে ভুমিকা পালন করে ।
বাংলাদেশে বেল বিষযক কিছু প্রবাদ বাক্য
বেল নিয়ে রয়েছে অনেক প্রবাদ বাক্য যথা ন্যরা এক বারই বেল তলায় যায় , এ প্রবাদ বাক্যের রয়েছে অনেক বড় বড় ভাব সম্প্রসারণ । অবার অনেকেই বলে থাকেন বেল পাকলে তাতে কাকের কি , এ প্রবাদ বাক্যটিকে নিয়েও রয়েছে অনেক গান ও কথন । এককালের জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি সুজন সখীর একটি গানের কলি ছিল ‘ হায়রে গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কি’ , কাওয়ার কা কা ডাকে, একে একে যদি গাছের সব বেল ঝড়ে পড়ে, তাতে দোষের কি ? ছবিতে জনপ্রিয় নায়ক শালমানের কন্ঠে গাওয়া এই গানটি সেসময়ে ফিরত লোকের মুখে মুখে ।
ছবি - ৮ / ৩৬ : পাকা বেল খাওয়ার লোভে কাওয়ার কা কা ডাকে গাছের বেল ঝড়ে গেলে তাতে দোষের কি ?
মাথায় পরার ভয়ে বেল তলায় ন্যারা দুবার না গেলেও লক্ষি হুতোম পেচা তার ছানা নিয়ে বেল গাছের ডালায় বাসা বাধে পরম নির্ভয়ে , বেলের ফুল ধরা হতে শুরু করে বেল পাকতে দীর্ঘ সময় লাগায় পক্ষীকুল সেখানে নীড় বাধে অনেকটা দুর্ভাবনাহীন ভাবে । অনেক পাখী প্রেমিক বেল গাছে কলস বেধে দিয়ে কুটুম বাখী বা ভাত শালীকেরে বাসা বাধার সুযোগ দেয় করে ।
ছবি - ৯ /৩৬ : বেলগাছের মগডালে হুতোম পেচার নীড়
কার্টুন, গল্প ও ফিকশন কাহিণীতেও বেলগাছকে নীয়ে রচিত হতে দেখা যায় যায় কত সুন্দর সুন্দর চিত্রকথা । বেল গাছ ও হাতীকে নিয়ে দেখা যায় এমনি কিছু চিত্র। জানা যায় বেল ও পাতার গন্ধ হাতীদের খুব প্রিয় । বেল তলা দিয়ে যাওয়ার পথে বেল পাতা খাওয়ার কসরত দেখে জনৈক ফটোগ্রাফার তুলে ধরেছেন মনোমুগ্ধকর কিছু চিত্রকথা ।
ছবি -১০/৩৬ :হাতীর বেল পাতা ধরার দৃশ্য
ছবি -১১/৩৬ : বেল গাছের কাছে পরাজয় মেনে বলবান হাতীর ফিরে যাওয়া
বেল ফলের গুণাগুণ
বেল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশীয় ফল। এতে প্রচুর শর্করা, প্রোটিন, ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম, লৌহ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান আছে। কাচা পাকা বেল দুটোই সমান উপকারী। পাকা বেলের শরবত সুস্বাদু। বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, এ এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাসিয়ামের মত মূল্যবান পুষ্টি উপাদান।
ছবি- ১২ /৩৬ : কাঁচা বেলের মুরুব্বা ও পাকা বেলের সরবত
বাংলাদেশে আরো এক জাতের বেল আছে, সেটা হল কতবেল , এটাও খেতে সুস্বাদু ,। বাংলাদেশে হাটবাজারে ও স্কুলের সামনে বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলের সামনে ফেরিওয়ালারা পাকা কতবেল ফেরী করে । কতবেল ফুটা করে তার মাঝে লবণ মরিচ গুড়া দিয়ে ঘুঁটে দেয় এবং তারে মাঝে একটা কাঠি দিয়ে ত্রেতার হাতে তুলে দেয় । কাঠি দিয়ে একটু একটু করে নিয়ে সেই পুরো কতবেল শেষ করতে কারো কারো আধা বেলা চলে যায় ! যারা খেছেছেন তারা বুঝতে পারবেন এর স্বাদই আলাদা।
ছবি- ১৩ /৩৬ : কতবেল গাছ এবং খাওয়া উযোগী পাকা কতবেল
বেলফুল , পাতা ও খোসায়( বেল ফলের) সুগন্ধী পারফিউম
বেলের পাতা, ফুল ও ফলের খোসা হতে বিভিন্ন ব্রান্ডের আশ্চর্যজনক সুগন্ধি হয়, এটার ঐশ্বরিক সুগন্ধ এবং চাকচিক্যময় বোতল খুবই আকৃষ্টময়, এই পারফিউম ব্যবহার সবসময় অনন্য । ম্যান এবং উইমেন সকলের জন্যই এই পারফিউম পাওয়া যায় বাজারে কিংবা অনলাইনে , সেলস প্রমোশনের জন্য এটার উপরে সারা বছর ধরে ডিসকাউন্ট একটি কমন ফেকটর ।
ছবি – ১৪ /৩৬ : পাতা , ফুল ও বেলের খোসা হতে তৈরী বিখ্যাত ব্রান্ডের সুগন্ধী পারফিউম
বেলের ভেষজগুণ
বেলের বহুবিদ ঔষধি গুণও রয়েছে। উল্লেখ্য বেলের ঔষধি গুণের বিষয় আয়ুরবেদিক পুথি পুস্তকে পাওয়া কথা( যেকোন চিকিৎসার জন্য পাঠককে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার জন্য অনুরোধ থাকল )। যাহোক, আয়ুরবেদিক সাস্রমতে (Manjeshwar et al , 2011) পেটের পীড়া, আমাশয় ও কোষ্ঠবদ্ধতায় বেল ও বেলের শরবত অত্যন্ত উপকারী। সব ফল পাকলেই তার গুণের উৎকর্ষ ঘটে, বেলের ক্ষেত্রে সেটি উল্টো। বেল কাঁচাই উপকারী। কাঁচা বেল অমৃতের সমান গুণকর। কাচা বেল ডায়রিয়া ও আমাশায় রোগে ধন্বন্তরী। বেল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ও আমাশয়ে উপকার করে। আধাপাকা সিদ্ধ ফল আমাশয়ে অধিক কার্যকরী। কাঁচা বেলের শরবত হজমশক্তি বাড়ায় এবং তা বলবর্ধক। উল্লেখ্য কাঁচা বেলকে সিদ্ধ করে নিতে হয় ।
ছবি -১৫/৩৬ : আমাসা ও ডায়রিয়ার জন্য কাঁচা বেলের সরবত
তথ্য সুত্র: Manjeshwar et al ( 2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review
বেলের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ভেষজগুণের বিবরণ নীচে দেয়া হল :
যারা মেদস্বী, গায়ে ঘামের দুর্গন্ধ বেরোয়, তারা বেল পাতার রস পানিতে মিশিয়ে তা দিয়ে শরীর মুছে নিলে দোষটি মরে যায়। বেল পাতা আগুনে সেঁকে নিয়ে ঢেকে রেখে অতঃপর থেঁতো করলেই প্রয়োজনীয় রস পাওয়া যায়।
ছবি -১৬ / ৩৬ : সিদ্ধ বেল পাতার রস গায়ে মেখে ঘামের দুর্গন্ধ দুরীকরণ
তথ্য সুত্র : Manjeshwar et al ( 2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review
ছবি - ১৭/ ৩৬ : শোথে দেহের কোন অঙ্গপ্রতংগ ফুলে গেলে বা মুখে দাগ পরে গেলে কোন চিন্তা নাই, বেল পাতার রস সমপরিমাণ মধুসহ খেতে থাকলে শোথ অচিরাৎ কমে যায়।
তথ্য সুত্র : Manjeshwar et al ( 2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review
কচি বেল টুকরা করে কেটে রোদে শুকিয়ে নিলে তাকে বেল শুট বলে।
ছবি – ১৮/ ৩৬ : বেলশুট
যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্ত্রিক ক্ষতে ভুগছেন, তারা কচি বেলের শুকনো টুকরো অর্থাৎ বেলশুট পরিমাণ মতো বার্লির সাথে একত্রে পাক করে পরে সেটি ছেঁকে নিয়ে বার্লিটা নিয়মিত খেয়ে নিলে অল্প দিনেই আলসার সেরে যায়।
ছবি – ১৯/ ৩৬ : বেলশুট সিদ্ধ ছেকা বার্লি নিয়মিত খেয়ে আলসার নিরাময়
তথ্য সুত্র : Manjeshwar et al ( 2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review
যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করেও তা মনে রাখতে পারে না, তাদেরাকে বেলের সরবত অল্প মিছরির গুঁড়ো মিশিয়ে প্রত্যহ একবার করে খেতে দিলে অল্প দিনেই তাদের স্মরণ শক্তি বেড়ে যায় এবং মেধাশক্তি প্রবল হয়। প্রতিদিন একটি করে বেল পাতা ঘি দিয়ে ভেজে চিনি সহ খেলেও স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটে।
ছবি -২০/ ৩৬ : বেলের সরবত কিংবা পাতা ঘি দিয়ে ভেজে চিনি সহ খেলে স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটে।
তথ্য সুত্র : Manjeshwar et al ( 2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review
গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল করার জন্য যতগুলো উপাদান আছে বেলফুল তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পরিমাণমত বেল গাছের ফুল মসুর ডাল ধোয়া পানির সাথে উত্তমরূপে পেষণ করে মুখমন্ডলে ব্যবহার করলে অতি অল্প দিনেই চেহারা গোলাপের ন্যায় কমনীয়, পদ্মের ন্যায় উজ্জ্বল ও পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বিকশিত হয়ে ওঠে।
ছবি ২১/৩৬ : বেল গাছের ফুল মসুর ডাল ধোয়া পানির সাথে উত্তমরূপে পেষণ করে মুখমন্ডলে ব্যবহারে চেহারা গোলাপের ন্যায় কমনীয়তা পায়
তথ্য সুত্র : Manjeshwar et al ( 2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review
বেল চাষ ও ফলন
প্রাচীনকাল থেকেই এ ফলটি ধনী-গরিব সব মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই পুষ্টি ও ঔষধি গুণ সম্পন্ন বেল গাছ রোপণ ও তা সংরক্ষণের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। এবার এই উপকারী গাছটির চাষাবাদ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক ।
উপযোগী জমি ও মাটি
বেল কষ্টসহিষ্ণু গাছ এবং যে কোনো মাটিতে জন্মাতে পারে। তবে সুনিষ্কাশিত মাটিতে ভালো হয়। পূর্ণ রৌদ্রযুক্ত স্থানে বেলের চাষ করা উচিত।
ছবি – ২২/৩৬ : শুকনো শুস্ক মাটিতেও বেল গাছ জন্মাতে ও ফল দিতে পারে
জাত নির্বাচন
বাংলাদেশে বেলের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। দেশের সর্বত্র অসংখ্য জাতের বেল দেখা যায়। যে জাতের ফলের শাঁস মোলায়েম, সুগন্ধী ও কম আঁশময় এবং ফলে বীজ থলের সংখ্যা কম তাই উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়।
ছবি -২৩/ ৩৬ : বাংলাদেশে জন্মানো বিভিন্ন জাতের বেল
বংশ বিস্তার
সাধারণত বীজ থেকেই বেলের চারা পাওয়া যায়। বীজের গাছে অনেক সময় মাতা গাছের বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকে না। এজন্য গুটি কলম অথবা কুঁড়ি সংযোজন পদ্ধতির মাধ্যমে উৎকৃষ্ট জাতের চারা উৎপাদন করতে হয় । বেল গাছের গোড়ার চারপাশের শেকড় থেকে অসংখ্য ফেকড়ি বের হয়, এগুলো মাটিসহ সাবধানে তুলে আনলেই নতুন চারা তৈরি হবে। হাতের কাছেই যারা বেল পাতা পেতে চান তারা টবেও বেলের চারা রোপন করতে পারেন ।
ছবি – ২৪ /৩৬ : টবে বেলের চারা রোপন
চারা রোপণের সময়
মধ্য আষাঢ় থেকে মধ্য শ্রাবণ পর্যন্ত চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
গর্ত তৈরি, সার প্রয়োগ ও চারা রোপণ
বাগান আকারে বেলের চাষ করতে হলে ১০ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করা উচিত। নির্ধারিত দূরত্বে ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৫০ সেন্টিমিটার গভীর গর্ত করে প্রতি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তটি আবার ভরাট করে ৮-১০ দিন পর প্রতি গর্তে একটি করে চারা রোপণ করতে হবে। চারা লাগানোর পর গর্তের মাটি ভালো করে ভিজিয়ে দিতে হয়।
পরবর্তী পরিচর্যা
ঝড়-বাতাসে চারা হেলে বা পড়ে না যায়, সেজন্য গোড়া থেকে ১০-১৫ সেন্টিমিটার দূরে একটি শক্ত কাঠি পুঁতে তার সঙ্গে চারা বেঁধে দিতে হবে। চারা অবস্থায় ১-২ মিটারের মধ্যে গজানো ডালপালা ছেঁটে দিলে কাঠামো ঠিক থাকে।
ছবি -২৫/ ৩৬ : বেলের চারার পরিচর্যা
সার ব্যবহার
চারা রোপণের পরের বছর থেকে গাছপ্রতি ১৫-২০ কেজি পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করতে হবে। সারের অভাবে অনেক সময় কচি বেল ঝরে পড়ে। তাই ফলন্ত গাছে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে কিছু ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপি সার গোড়ার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
পানি সেচ
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ফুল ও ফল ধরে। এ সময় থেকে বর্ষার আগ পর্যন্ত ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দেয়া ভালো। বড় গাছে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না বললেই চলে।
পোকা-মাকড় ও রোগ বালাই দমন
বেল গাছে সচরাচর যে পোকা দেখা যায়, তা হলো মাইট। এ পোকার আক্রমণে পাতার উপর চকচকে দাগ দেখা যায়, পাতা কুঁকড়ে বা মুড়িয়ে যায়। অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করে এ পোকা দমন করতে হবে। এছাড়া বেল গাছে তেমন মারাত্মক কোনো রোগ ও পোকা দেখা যায় না।
দেশে উন্নত জাতের বেল চাষ
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র উদ্ভাবিত এই নীচের ছবিতে দেখানো গাছে সারা বছর ফলবে বেল। জাতের নাম রাখা হয়েছে- বারি বেল-১।
ছবি – ২৬/৩৬ : দেশে উন্নত জাতের বারি বেল-১
এই বেল চাষাবাদ করে চাষিরা লাভবান হবেন বলে মনে করছেন এর উদ্ভাবক। অতীতে বীজ থেকে জন্মানো গাছে ফলন পেতে ৮-১২ বছর অপেক্ষা করতে হতো। ফলে মানুষ বাণিজ্যিকভাবে বেল চাষ করত না। এই জাতটি কলমের মাধ্যমে জন্মানো যাবে, যার ফলে মাতৃগাছের গুণাগুণ একই রকম থাকবে এবং ফল আসতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ বছর। ফল মাঝারি আকারের, প্রতিটি ফলের গড় ওজন হবে ৯০০ গ্রাম। সাত বছর বয়সী প্রতিটি গাছে বছরে গড়ে ৩৮টি করে বেল ধরবে, যার মোট ওজন ৩৪ কেজি হিসাবে হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ১৪ টনের মতো হবে । তবে গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফলনও বাড়বে।
ফল সংগ্রহ
ফুল ধরার সময় থেকে ফল পাকতে প্রায় এক বছর সময় লাগে। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে এবং পরের বছর ফেব্রুয়ারি-এপ্রিলে ফল পাকে। মাটিতে পড়ে ফেটে গেলে শাঁসে দ্রুত পচন ধরে। তাই সম্পূর্ণ পাকার পর মাটিতে না ফেলে একটি একটি করে বোঁটাসহ ফল সংগ্রহ করা উচিত।
ছবি- ২৭ / ৩৬ : গাছে পাকা বেল
বেলের বাজার
ছবি-২৮ /৩৬ : পাকা বেল হাতে নিয়ে উল্লসিত ছোট বড় সকলে ও বাজারে বেলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতা
বেলগাছের কাঠ হতে তৈরী হস্ত শিল্পজাত দ্রব্যাদি ও কাষ্ঠ খোদাই চারুকলা শিল্প কর্ম
বিভিন্ন জাতের কাঠের সাথে বেল কাঠ ব্যবহার করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তৈরী হচ্ছে হরেক রকমের নিত্য ব্যবহার্য তৈজস পত্র । এ বিষয়ে সবচেয়ে অগ্রগামী হচ্ছে চীন ও থাইল্যান্ড। আমাদের দেশও এ ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে নেই । দেশে তৈরী এ জাতীয় কিছু দ্রব্যাদি ।
ছবি- ২৯ /৩৬ : অন্যান্য জাতের কাঠের মত বেল কাঠ দিয়ে তৈরী কিছু তৈজসপত্র
বিল্বকাষ্ঠের চারুকলা শিল্প
কাঠ খোদাই করে বিভিন্ন ধরণের শিল্প কর্ম অনাদিকাল হতেই চলে এসেছে দেশে দেশে । কাঠ খোদাই শিল্প ( Carving) কর্মে সকল জাতের কাঠ ব্যবাহার করা যায়না । এর জন্য প্রয়োজন হয় সুক্ষ আশ, খুব শক্তও নয় আবার নরমও নয় এবং কাঠের রং সাদার মধ্যে হলে ভাল হয় এমন জাতের কাঠ । কাঠের এই গুনাগুনের জন্য অন্যান্য জাতের মধ্যে বেল কাঠও অন্যতম । কার্ভিং নাইফ বা টুলস দিয়ে ব্রাস উড যথা পাইন কাঠের উপর কাজ করা বেশী স্বাচ্ছন্দ অনুভব করলেও এই কাঠের সহজ লভ্যতা সকল দেশে সব সময় নেই । বেলের প্রতি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশ্বাস থাকায় এই বেলের কাঠ দিয়ে দেশে দেশে বিশষ করে ভারত , থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া সহ অনেক দেশেই কিছু কাষ্ট খোদাই শিল্পের নিদর্শন দেখা যায় বিভিন্ন লিটারেচারে । নীচে ভারত, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার দারুশিল্পিদের তৈরী কিছু বিখ্যাত কাষ্ঠ খোদাই শিল্প কর্মের ছবি দেখানো হল ।
ছবি- ৩০ / ৩৫ : কাষ্ট খোদাই শিল্প কর্ম ভারতী
ছবি - ৩১ /৩৬ : অরনেট থাই কাষ্ঠ খোদাই শিল্প কর্ম
ছবি -৩২/ ৩৬ : ফিংগার ট্রান্ক এন্ড লাই থাই উডেন কার্ভিং শিল্প কর্ম
ছবি -৩৩ /৩৬ : বিখ্যাত ওয়ার্ক অফ আর্ট অন দি স্ক্রীন অফ ইন্ডিয়া এন্ড ইন্দোনেশিয়া
বাংলাদেশে দারু কারু শিল্প
বাংলাদেশে নির্মিত ঘরের কাঠের দরজা, জানালা, খুঁটি, কড়ি, বরগা, বাক্স, খাট, পালঙ্ক, আসনপিঁড়ি, পিঠার ছাঁচ, বাদ্যযন্ত্রের খোল, পাল্কি, রথ, নৌকা, পুতুল ইত্যাদি কাঠের উপর খোদাই করা নানারকম চিত্রদ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে । পদ্ম, পাখি, পুষ্পিত লতা, চক্র ও জ্যামিতিক নকশা দারুশিল্পের সাধারণ মোটিফ। দরজা, পাল্লা, পালঙ্ক, বাক্স ও আসনপিঁড়িতে পদ্ম, চৌকাঠ, খুঁটি, খাটের পায়া ও পাল্কির বর্ডারে পুষ্পিত লতা ও জ্যামিতিক ছক; বাদ্যযন্ত্রের খোলে ময়ূর ও টিয়া এবং নৌকায় পদ্ম ও ময়ূর মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলাদেশের অনেক বনেদি ঘর ও যাদুঘরে এগুলি দেখা যায় । প্রকৃত পক্ষে গ্রামীণ বাংলার ছুতার মিস্ত্রিরাই ছিলেন এসব চিত্রকর্মের রূপকার। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ছুতার মিস্ত্রির কাজ করা সুন্দর সুন্দর দারুশিল্প কর্মের মধ্যে রয়েছে পালঙ্কে রচিত পুর্ণাঙ্গ নারীমূর্তি । হাতুড়ি, বাটালি, নরুন, হাত করাত, র্যঁদা, কুরনি, স্কেল, কাঠ পেন্সিল ইত্যাদি অতি সামান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে এসব শিল্পকর্ম তারা নির্মাণ করেছেন শত বছর ধরে ।
ছবি -৩৪ /৩৬ : বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ছুতার মিস্ত্রির কাজ করা একটি সুন্দর দারুশিল্প কর্ম ।
ছবি - ৩৫ / ৩৬ : খাট ও পালঙ্কের হেড বোর্ডে সুন্দর একটি দারু শিল্প কাজ
ছবি -৩৬/৩৬ : কাঠের উপর খোদাই করা গহনার বাক্স ।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যথা ঢাকা, জাহাঙ্গীর নগড়, রাজশাহী ও চট্রগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে স্নাতক ও ম্নাতোকোত্তর পর্যায়ে কাষ্ঠ খোদাই শিল্প কর্মের উপর পাঠ কার্যক্রম চালু রয়েছে। আশা করি এই শিল্পে অন্য অনেক কাঠের মত দেশে সহজে প্রাপ্য বিল্ব কাষ্ঠকে নিয়েও কাজ করা যেতে পারে । তাদের সফল প্রচেষ্টায় এই বেলগাছটি হতে পারে দারু কারু শিল্পের জন্য একটি সম্বাবনাময় উপাদান ।
পরিশেষে বলা যায় যে বহুমুখী গুনের অধিকারী এই বেল গাছের বিকাশ ও চাষ বৃদ্ধি পাক যথাযথ পর্যায়ে । এর যেমন রয়েছে ধর্মীয় কাজে প্রয়োগ, তেমনি রয়েছে এর খাদ্যগুন , ভেষজকর্মে প্রয়োগ ও সর্বোপরি কাষ্ঠ খোদায় চারুকলায় প্রয়োগ করে খোদাই করে রাখা যায় এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিকাশ ঘটানো যায় গ্রামীন জাত শিল্পী ছুতারদের জীবন জীবিকার জন্য নব প্রাণচাঞ্চল্য । এখানে একটি কথা বলে রাখি, উপলক্ষটা বেল নিয়ে হলেও অন্যতম আরো একটি লক্ষ্য হলো দেশে দারু চারুকলা শিল্পের বিকাশ, সে সাথে মেধাবী চারুকলা শিল্পী ও গ্রামীন ছুতারদের জন্য দেশে বিদেশে সমাদৃত অধিক মুল্য সংযোজনশীল কাষ্ঠ খোদাই শিল্প কলায় সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য সকলের সচেতনা ও সংস্লিস্টদের পৃষ্ঠপোষকতা আকর্ষন করা ।
ধন্যবাদ এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ।
সুত্র :
ছবি সুত্র : গুগল অন্তরজাল
তথ্য সুত্র :
Gutschow, Niels; Michaels, Axel & Bau, Christian (2008). "The Girl's Hindu Marriage to the Bel Fruit: Ihi and The Girl's Buddhist Marriage to the Bel Fruit: Ihi". Growing Up—Hindu and Buddhist Initiation Ritual among Newar Children in Bhaktapur, Nepal. Wiesbaden, GER: Otto Harrassowitz Verlag. pp. 93–173. ISBN 3447057521.
Manjeshwar Shrinath Baliga, Harshith P. Bhat, Nandhini Joseph, Farhan Fazal (2011), Phytochemistry and medicinal uses of the bael fruit (Aegle marmelos Correa): A concise review, Food Research International, Volume 44, Issue 7, August 2011, Pages 1768-1775
Sharma PC (2007), A Review on Bael Tree. Available at nopr.niscair.res.in/bitstream/123456789/7856/1/NPR 6(2) 171-178.pdf
উইকিপিডিয়া (২০১৭), বেল ফল, https://bn.wikipedia.org/wiki
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:২১