আসিফ ভাইয়ের কাছে দাঁত দিয়ে আখ ছিলে খাওয়াটা স্বপ্নের। কেউ আখ ছিলে কুটিকুটি করে কেটে দিলেও তিনি খেতে পারেন না। তিনি আখের রস খান। ওনার ছয়টা দাত আসল। বাকী দাত সাইকেলের নাটবল্টুর মত খুলে লাগানো যায়। কিছুদিন আগে ওনি একটা সাইকেল কিনেছেন। এখন প্রতিদিন এই সাইকেল চালিয়ে তিনি ধাণমন্ডির আড্ডায় আসেন। সাইকেলটি ওনার দাঁতের মতই সাদা। নকল দাঁত একটু বেশি সাদা হয়। আফিস ভাইয়ের চোখেও হাইভোল্টেজ চশমা। সেই চশমা আমরা চোখে দিলে কিছুই দেখি না। প্রায়ই সাইকেলটা আমি চালাই। তখন মনে হয় সাইকেলের চাকা দুটি ওনার হাইভোল্টেজ চশমা চোখ আর নাটবল্টু নকল দাঁত। সেই সাইকেলে যখন নাহিদ ভাই উঠে বসে তখন আমার মায়া লাগে। যেন একটি হাতি উঠে বসেছে ব্যাঙের পিঠে। আমাদের নাহিদ ভাইয়ের ওজন নিরানব্বই কেজি।
আসিফ ভাই বেশ নাদুসনুদুস,কিছুটা গেদুগেদু টাইপ। আমার ধারণা ওনি বউ আদরী হবেন। ওনার বউ ওনাকে আদর করে গেদুমনা বলেও ডাকতে পারে। ধানমন্ডি পনর নম্বরের সাত এ এর আড্ডা ভাঙ্গলে আমরা দুজনে একসাথেই বাসায় ফিরি। আড্ডা ভাঙ্গতে ভাঙতে রাত এগার,সাড়ে এগার। আমি রিকশায় আর আমার রিকশার আগে পিছে উনি, সাইকেলে। আসিফ ভাই কলাবাগান, আমি পূর্ব রাজাবাজার। আমি আবারও রিকশার পেছনে তাকাই। না,আসিফ ভাই আজ নেই।
নওমির ফোন।
কই তুমি?
এইতো ঢাকা আর্ট সেন্টারের এখানে।
হাঁটছো?
না,রিকশায়। তোমার জন্য কি আনব?
নাথিং।
কিছু না কেন? কিছু আনি। এই আইসক্রীম,দই,ঝালমুড়ি।
তুমি কি আমার কথা বোঝ না।
বুঝিতো,বাংলা ভাল বুঝি। ইংরেজী কম বুঝি। দুইটা ডাব আনি।
কার জন্য?
কেন তোমার জন্য।
ওফফ..আচ্ছা ডাবের ইংরেজী কি? বলতে পারলে আনবা। না পারলে আনাআনির কেইস শেষ।
এটা কি ঠিক হলো। আমি ইংরেজী কম বুঝি। তুমি তার সুযোগ নিলা।
পারবা কিনা বল?
না। নারিকেল এর কোকোনাট কিন্তু ডাবের ইংরেজী কী? তুমি বল?
টপিক ফিনিশ। নো মোর টক এব্যাউট দিস।
ওমমমমমম...কি মাতাল ঘ্রান। রিকশাভাই থামাও থামাও।
নওমি একটু উষ্ণ হয়ে উঠেছে। ফোনের ওপাশে উচ্চস্বরেই বলল,আবার কি হলো?
ঘ্রাণ। আউলা টাইপ ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ আমার পরিচিত কিন্তু কিসের মনে করতে পারছি না। আশেপাশে কোন ফুলবৃক্ষও তো দেখি না।
কোন নারীবৃক্ষ দেখো? রিকশায় চলমান কোন নারীবৃক্ষ। দেখো তোমার পরিচিত কোন নারীবৃক্ষের শরীরের গন্ধ কিনা। বাতাসে সুগন্ধি মেখে পুরোণো সৃত্মি জাগিয়ে গেছে। কয়দিন পরে আমারটাও পাবা। তখন আমি পুরোণো হয়ে যাব।
এইসব কি বল। আমি একটা শিশু মানুষ।
আচ্ছা...তুমি একটা শিশু মানুষ। আসো বাসায় আসো,কোলে তুলে দুধু খাওয়াবো আজ। কোনটা খাবা? ডান না বামপাশেরটা। তোমারতো আবার ডান বাম নিয়ে সমস্যা আছে।
ছি ছি। কি পঁচা কথা বলো। ইয়াহ.. পাইছি। কদম ফুল। আমার প্রিয় কদম ফুল। রিকশাভাই থামেন থামেন। দুইমিনিট।
রিকশা ধানমন্ডি ছয় এর ব্রিজে উপর থামে। ব্রিজের দিকে রবীন্দ্র সরোবরের গেটের বাইরে লেকের পাশে কদম গাছটি। ফুলের বুকে ফুল। যেন বাসর রাতের ঘোমটা দেয়া বউ। আচ্ছা,বাসর রাতে বউয়ের শরীরও কী এমন মাতাল গন্ধ ছড়ায়? আমি গাছটির নীচে দাড়াই। আমার ইচ্ছে করে,নিশ্বাসের সর্বশক্তি দিয়ে সমস্ত ঘ্রানে ফুসফুস ভরিয়ে রাখি।
ফোনে নওমি,কী হলো?
তাকিয়ে দেখি রিকশাভাইও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রিকশাভাই একটু ভাবনায় পড়েছে। কারে উঠায়া কোন বিপদ আনলাম।
আমি তাকে বেশি ভাববার সময় দেই না। নওমির তাড়া খেয়ে রিকশায় উঠি।
এই অসময়ে তুমি কদম ফুল কই পেলে?
কেন ? অসময় কোথায়? থাকতো নিউজিল্যান্ড। সেখানেতো ঘাস আর গরু,গাভী আর ঘাস। বাংলাদেশে এখন বর্ষা। বর্ষায় কদম ফোটে। রিকশাভাই,কদম ফুল দেখছেন না,গোল গোল?
রিকশাভাই মাথা ঝাকিয়ে বলে,কদমা ফুল।
গন্ধ পাইছেন? কেমন টান টান গন্ধ না?
হ,গন্ধ। লাক্স সাবানের মতো সুবাস।
ও আল¬াহ একি কন! কই লাক্স সাবান কই কদম ফুল!
নওমি এবার লাস্যময়ী হাসিতে দুলতে থাকে।
আমি বলি থাম। গন্ধতো পাইছে। আমার ইচ্ছা করছে সারাটা রাত যদি কদম তলায় বসে থাকতে পারতাম। আহ..
যাও কদম তলায় গিয়ে বস। ঘ্রাণ খেতে থাক। অর্ধেক পেট ভরুক আর বাকিটুকুর জন্য আমি ভাত লালশাক নিয়া আসছি।
একা একা বসব? আমিতো একা খেতে পারি না। কদমতলায় মেয়েদের খাওয়া ঠিক না। কদমগাছে জ্বীন থাকে।
তাহলে কাউকে কদমতলার ডিনারে আমন্ত্রণ কর। রাস্তায় সম্ভ্রান্ত পাগল না পেলেও পাগল ঠিকই পেয়ে যাবা।
তুমি কি আমাকে পাগল বললা?
পাগল বলছি এখনও বাকিগুলো বলি নাই।
অবস্থা খুব একটা সুবিধার না । আমি পাগল প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাই।
তবে মনে মনে বেশ ভাব হচ্ছে। যাক আমি পাগল না। পাগলের ঘ্রাণশক্তি নাই। আমি কদম ফুলের ঘ্রাণ পাইছি। নওমি খারাপ কয় নাই। কদমতলায় একজন সঙ্গী হলে মন্দ হয় না। দেশের পরিস্থিতি ভাল না।
রিকশাওয়ালা ভাই,চলেন কদমতলায় আজকের রাতটা কাটায়া দেই। কদমের ঘ্রাণতো পাইছেন,কেমন টান টান লাগছে না।
না ভাই। আমার বউ পোলাপাইন আছে। ভাই একটা কথা কই?
বলেন।
আমি কদমের ঘ্রাণ পাই নাই। আমার টান টান লাগে নাই।
এইবার নওমি মুখ চেপেও যে তার হাসি আটকাতে পারছে না তা ফোনের এপাশ থেকে শুধু শুনতে না দেখতেও পাচ্ছি। রিকশাভাই আমার দলে নাই।
মনে মনে ভাবি,কদমতলার সঙ্গী হিসেবে ব্যরিষ্টার হলে মন্দ হতো না। ব্যরিষ্টার হল আমাদের অরুপ বন্ধু। ব্যরিষ্টারের মাথায় চকচকে একটা টাক। সাত এর এ‘তে আড্ডায় কেএফসির লাল-হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোয় এই টাক ছোট্ট একটা আমস্বত্বের রুটি। একুশে জুন ব্যরিষ্টারের বিয়ে। আজ গভীররাতে কদমতলায় ধ্যানমগ্ন ব্যারিষ্টারের টাকে একটা কদম ফুল পড়বে। সকালে হলে দেখা যাবে নেপিয়ার ঘাসের মত চুল গঁিজয়েছে ব্যারিষ্টারের মাথায় । বাসর রাতে বউ সেই চুল নকল ভেবে টানাটাটি করবে। ব্যারিষ্টার এই কদমধ্যানের ঘটনা বলে নতুন বউকে চমকে দেবে।
রিকশাভাই, আপনি গাঁজা খান?
রিকশাভাই আর কথা কয় না। শুধ বামহাতে হ্যান্ডেল ধরে ডানহাতে উঁিচয়ে টাটা দিল।
এই টাটা মানে না। কিন্তু সে ডান হাতে না করল কেন? বাম হাতে বলা উচিত ছিল। গাঁজা খাওয়াতো খারাপ কাজ। বাম হাতে আমরা শুচু করি,শুচু একটি নোংরা কাজ। গাজা ভাল লোকেরাও খায়। আমার এক ভাবী বলে, গাঁজা খায় রাজারা। আমি বলতাম রাজাতো ছেলে মানুষ। তুমিতো মেয়ে। তুমি বলবা, গাঁজা খায় রানীরা।
নওমি বলল,একস্টিক জোগাড় করে দুইটান খাওয়া দাও। রিকশাওয়ালা তোমার কদম ধ্যানের সঙ্গী হবে।
আমি গাঁজা কই পামু। আমারতো কোন রাজা বন্ধু নাই।
তাইলে সোজা বাসায় আসো ইডিয়ট।
ফোন ডিসকানেক্ট।
আচ্ছা,এটাতো কখনও ভেবে দেখি নাই। আমার কেন গাঁজাখোর বন্ধু নাই। থাকলে আজকে নওমির কথাটা যাচাই করে দেখা যেত। দুইটান গাঁজায় রিকশাওয়ালা বউয়ের শরীর রেখে কদম তলায় বসে কিনা।
রিকশাওয়ালা ভাই আপনার নাম কি?
শাফিউল ইসলাম।
বাড়ি কই?
রাজশাহী।
হুম,রাজশাহীর লোকজন ভাল হয়।
বাচ্চা কাচ্চা আছে?
আছে,এক ছেলে এক মেয়ে।
বাহ! সুখী পরিবার। সরকারী স্বাস্থ্যকর্মীরা আগে ঘরে ঘরে গিয়ে বলত,ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট। দুইি সন্তানের ছবিসহ এক সুখী পরিবারের হাস্যজ্জ্বোল ছবির পোষ্টারও লাগিয়ে দিয়ে যেত ঘরের দেয়ালে।
কবিরকে এখন সামনে পেলে ঠাটায়া দুইটা থাপ্পড় দিতাম। কথায় কথায় কয়,দোস্ত সুখ নাইরে জীবনে। ইশ্বর কবে যে সুখের দেখা দেয়।
শালা,একটা বিয়া কর,দুই বাচ্চা প্রডাকশন দে। তারপর স্মাইল। ব্যাস,সুখতো তো লাইভ পিকচারসহ হাজির। সরকারি কথা,মিছা হয় ক্যামনে।
শাফিউল ভাই,আপনার রিকশা কোন জায়গার?
কলাবাগানের। আলামিনের গ্যারেজ।
কি? আল আমীনের গ্যারেজ!
কিরে ভাই? আল আমীন বিস্কুট,আল আমীন গার্মেন্টস,আল আমীন লুঙ্গি,আল আমীন কোম্পানী,আল আমীন স্টোর,আল আমীন বাস সার্ভিস,আল আমীন চায়ের দোকান। আল আমীন,আল আমীন আল আমীন শেষ পর্যন্ত আল আমীন রিকশার গ্যারেজ। আহ.. নানাজান, আমার এত পুপুলার নাম রাখলেন ক্যামনে।
কিছু কইলেন ভাই?
না।
আপনার ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করে?
করে। ছেলেটা থ্রি আর মেয়েটা ওয়ানে।
ছেলে মেয়ে বড় হয়ে কি হলে খুশি হবেন? ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার।
মানুষ। ছেলে মেয়ে দুইটারে মানুষ বানাইতে চাই। ওরা মানুষ হইলেই আর কোন চাওয়া নাই ভাই।
আমি অদ্ভুত ভাবে চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। ফুসফুস থেকে কদম ফুলের গন্ধমাখা বাতাস দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হয়ে যায় সব।
আমরা প্রাণী হয়ে জন্ম নেই। এই অবয়বটার নাম মানুষ নয়। মানুষ হতে হয়। পৃথিবীতে ’মানুষ’ বিলূপ্তপ্রায়। আমি আজ পর্যন্ত মানুষের দেখা পাইনি। শাফিউলের সন্তানেরা মানুষ হলে তা দেখার সৌভাগ্যও হয়ত আমার হবে না।##