আমার মনে নাই প্রথম কবে আমি জানতে পারি মানুষ মারা যায়। কেউ আমাকে জানিয়েছে নাকি আমি চারপাশ থেকে এই উপাত্ত সংগ্রহ করেছি সেটাও বলতে পারছি না। আমি প্রথম ঘড়ি দেখা শিখেছি কখন সেটা আমার মনে আছে। কবে আমার প্রথম দাত পড়ল সেটাও আমার মনে আছে। কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারটা আমার কিছু মনে নাই। অবশ্য প্রথম মৃতদেহ কাছ থেকে দেখার স্মৃতি মনে আছে।
আমি তখন থ্রী তে পড়ি। স্কুল শেষে বাসায় ফিরে আসছি। রাস্তার পাশে চাটাই এর ওপর রাখা লাশ একটা। সেই লাশ কিছুক্ষন আগেই স্থানীয় লেক থেকে তুলে আনা হয়েছে। লাশটা পাচ টুকরা করা। দুই হাত, দুই পা আর বাকি অংশ। একজন লোক খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে পাশের জনকে ব্যাখ্যা করছে কি কষ্ট করে সে লাশের টুকরা গুলো তুলে এনেছে। আমি মাথাটা দেখিছি। ঠোটটা ছিল তার কুচকুচে কালো। কয়েকদিন পানির নিচে থাকলে এইরকম হয় কিনা কে জানে।
ভূমিকা শেষ হল।
অনেকদিন পরের কথা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন। টিউশনি করতে যাচ্ছি পুরান ঢাকায়। রাস্তায় জ্যাম। পুরান ঢাকার গলিতে যা হয় আরকি। রিকশায় বসে দেখি রাস্তার পাশে এক ফকির শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বমি।সে বড় বড় নিঃস্বাস নিচ্ছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। বছর পাচ বা ছয়ের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা পাউরুটি। পাউরুটি থেকে ছোট ছোট টুকরা ছিড়ে মুখে পুড়ছে। বৃদ্ধের অসহায় মুখ আর ছোট মেয়েটার চোখের গভীর আগ্রহ দেখে আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ করেই ধ্বক করে উঠল। আমার মনে হল এই বৃদ্ধ মারা যাবে রাস্তার পাশে আর ছোট মেয়েটা দেখবে প্রথম মৃত্যু। আমার তখন রিকশা থেকে নেমে বৃদ্ধকে কোন একটা হাসপাতালে নেয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। আবার ঝামেলা ঘাড়ে নিতে ইচ্ছে করছিল না। দুটো বিপরীতমুখী ইচ্ছার সংঘর্ষ চলতে চলতে সময় শেষ। জ্যাম আর নেই। রিকশা চলতে শুরু করেছে। আমি ভাবলাম হয়ত বৃদ্ধের কিছুই হবে না। এখন থাকুক পড়ে। ফেরত যাবার সময়ও যদি দেখি পড়ে আছে তাহলে হাসপাতালে নেবার একটা চেষ্টা করব।
টিউশনীতে আমি কখনও একঘন্টার বেশী পড়াই না। সেদিন মন খারাপ ছিল খুব। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। আসার পথেও সেই একই জায়গায় জ্যাম। রাস্তার পাশে মানুষের জটলা। ময়লা কাপড়ে মুড়ে রাখা হয়েছে লম্বাটে কিছু একটা। কেউ না বলে দিলেও আমি জানি সেটা কি এবং কার লাশ। ছোট মেয়েটাকে দেখলাম না কোথাও। ভিড় করে থাকা লোক গুলোর মুখে বিরক্তি। হারামজাদা মরার আর জায়গা পেল না। সারা দুনিয়া থাকতে আমাদের ঘরের সামনে এসে পরে মরে আছে।
জ্যাম একসময় শেষ হয়। রিকশা চলতে থাকে। আমি হলে ফিরে আসি। সেদিন গভীর রাত্রে আমি উপলব্ধি করি আসলে আমি প্রথম বারের মত মৃত্যু দেখলাম। এর আগে আমি লাশ দেখিছি। কিন্তু মৃত্যু দেখিনি কোন মানুষের।
অবহেলায় রাস্তার পাশে মরে পড়ে থাকা বৃদ্ধের জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল। সে কি মৃত্যুর আগে কিছু বলে যেতে চাচ্ছিল? সেই ছোট মেয়েটা কি কিছু শুনে রেখেছে? বালিকাটির গভীর আগ্রহের দৃষ্টির কথা বার বার মনে পড়ছিল। আমি টের পাচ্ছিলাম বাকি জীবন আমাকে একজন অসহায় বৃদ্ধের মুখ স্মরন রাখতে হবে। আমি সে রাতে কেদেছিলাম অনেক। দুটা কারনে আমার কান্না। কেদেছিলাম এটা উপলব্ধি করে যে আমি এবং অনান্য মানুষ সবাই খুব অসহায়। দ্বিতীয় কারনটা হল আমার সাথে একজন মহান মানুষের মুল পার্থক্যটা কোথায় সেটাও সেদিন আমি প্রথম বুঝতে পারি।