২০১৭ সাল। সামু ব্লগে বিপরীতমুখী সো কলড সিন্ডেকেটওয়ালারা বিরাট বিরাট ক্যাচালে জড়িয়ে নর্তন-কুর্দন করছে। আমি শুধু দেখছি আর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ঘর সমৃদ্ধ করছি। ভাবছি আমিও একদিন…। বিশেষ করে চাঁদগাজী একাই পিগমীদের গণপিটুনি দিয়ে বাস্তুচ্যুত করার দৃশ্যগুলো দেখার মতো। বিরাট ফ্যান হয়ে গেলুম গুরুর। তাঁর উত্তরাধুনিক অপ্রচলিত কিংবা নব্য প্রসূত শব্দভান্ডার আমার ব্যবহারিক জীবনেও প্রয়োগ করতে লাগলুম। আর বিপদটা সেদিক থেকেই আসলো…?
দুদিন সামুতে ক্যাচাল নিয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকায় নিতুকে ফোন দেওয়ার সময় পেলুম না। তৃতীয় দিন উত্তরার হাউজ বিল্ডিং-এ মাস্কাট প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে নিতুকে ফোন দিলুম। সাথে সাথে গোখরা সাপের মতো ফোঁস করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হলো এবং…
‘...তুমি যদি ঐ চাঁদগাজী না পাঁ*গাজী উনার কোনো বিষয় আমার সামনে আনো। খোদার কিরা বলছি, আমাদের তিন বছরের সম্পর্কের এখানেই যবনিকাপাত’--ভীষণ রেগে নিতু বিপদসীমা অতিক্রম করা ডেসিবেলে কথাগুলো আমাকে ওভার দ্যা ফোনে শুনিয়ে দিল।
এই ভয়ঙ্কর কথা শুনে আমার ছাদ ছ্যাঁত করে গরম হয়ে গেল। আরো উচ্চ ডেসিবেলে নিতুকে বললাম, ’তুমি গুরুকে নিয়ে এরকম ‘পায়খানা’ কথার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে এখানেই তোমার সাথে আমার কেল্লাফতে। হটট… লিলিপুটিয়ান একটা’।
নিতুও দ্বিগুণ রেগে, ‘তুই লিলিপুটিয়ান। তোর পেয়ারের দোস্ত-গোস্ত-সামু-মামু-খামু সবগুলো লিলিপুটিয়ান। তোর সাথে প্রেম করাই ভুল হয়েছে। ইস, আমার কত্তগুলো হ্যাভি হ্যাভি অফার ছিল। আর আমি কিনা এতদিন একটি পিগমীর সাথে ঘুরেছি ’।
আমি এবার মোগাম্বো স্টাইলে ক্রর হেসে, ‘সেটাই তো। এখন তো তুমি মুক্ত কাউয়া। এবার ‘পিগমী’ বাদ দিয়ে হ্যাভি হ্যাভি ‘ডাইনোসর’র সাথে শুরু করো। (একটু দম নিয়ে)…এ দুশমনি বহুত মেহেঙ্গি পড়েগি, নিতু, বহুত মেহেঙ্গি’’। বলেই গাব্বার সিং স্টাইলে অট্টহাসি দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম।
যাহোক, এই ধরনের রাফ অ্যান্ড টাফ কথাবার্তা আমাদের নতুন নয়। গত একবছর ধরে অবশ্য এটি চরমে পৌঁছে গেছে। মানে যেদিন থেকে আমি সামু ব্লগে ব্লগিং শুরু করেছি তার কিছুদিন পর থেকেই আমাদের কথার পাথর ছোঁড়াছুঁড়িও শুরু। প্রথমের দিকে গুড সেন্স আর কিছুটা সাসপেন্সের মধ্যেই ছিল। এরপর এতদিন ক্লাইমেক্স পর্যায়ে ঘোরাফেরা করছিল। এখন তো মনে হচ্ছে ভায়োলেন্সের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
প্রথম প্রথম নিতু কথাগুলো মজা হিসেবেই নিত। যেমন, কোনোদিন হয়ত আমার ফোনটা ধরতে একটু দেরী হয়েছে দেখে বলে বসলাম, ‘সারাদিন কোথায় ডোডোপাখির মতো ঘুরাঘুরি করছ যে ফোনটাও ধরতে পারছ না’। শুনে নিতু হেসে দিত। আর এখন ডোডোপাখির নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে এবং মিনিমাম সাত দিন কথা বন্ধ।
২
একদিন বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টে বসে ভীষণ প্রিয় ভারতীয় ছোলা-বাটুরে অর্ডার দিয়েছি। পেটমোটা ফুলে থাকা বাটুরে দেখে মুখ ফসকে একটু জোরেই বলে ফেলেছি, ‘দেখতে একদম ডোডোপাখির মতো মনে হচ্ছে’। তারপরও হয়ত বিপদ হত না। কিন্তু মূল সর্বনাশটা করেছে পাশের টেবিলের এক ছেলে ছোকরা। আবছাভাবেই হয়ত ‘ডোডোপাখি’ শব্দটি তার কানেও গেছে। ছোকরা পাশের টেবিল থেকে উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বেশ জোরেসোরেই, ‘ভাইজান, মনে হচ্ছে সামু ব্লগে ব্লগান। ওখানে চাঁদগাজী এই ডোডোপাখি শব্দটা ভীষণ পুপুলার করেছে। আমি (ছোকরা) যদিও ব্লগের একজন পাঠক কিন্তু চাঁদগাজীর লেখার ভীষণ ভক্ত। যেভাবে পিগমীদের দৌড়ের উপর রাখে ভাবাই যায় না। আজকের ব্লগ দেখেছেন। ঝড় উঠে গেছে। চাঁদগাজী একাই সব লিলিপুটিয়ানদের গণপিটুনি দিচ্ছে’।
এই খবিশ কান্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে--উনার ভক্তদের মধ্যে এ জিনিস যদিও ব্যতিক্রম কিছু না; আমাকে দেখেও তো বুঝা উচিত আপনাদের?--বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে যাচ্ছে। আর আমি টেঁরা চোখে আমার সামনে বসা নিতুর দিকে একটু তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। আমি নিশ্চিত একটু পরেই নরকে কালা কুমকুম ভেঙ্গে আমার মাথায় পড়বে। আমি মনে মনে ঐ মগজহীন চাঁদগাজী ভক্তের পায়ে ধরছি। তুই একটু এবার থাম ভাই। আমার এতবড় সর্বনাশ তুই করিস নে?
যাহোক নানারকম হাউকাউ-ম্যাঁওপ্যাঁও শেষে বছর তিন-এর উপর হলো নিতু এখন এই লিলিপুটিয়ানের ঘরণী। সাথে বাসর রাতে বিড়াল মেরে ফেলায় বছর দুয়েকের উপর জেনারেশন আলফা-র এক ছোটা লিলিপুটিয়ান বাড়িতে প্রশ্নফাঁস জেনারেশনের নয়া সদস্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
করোনাকাল শেষ হলেও সারাদিন ব্লগে পড়ে থাকায় অফিসের বস একদিন হাতে লাল হারিকেন ধরে দিয়ে বলল, ‘আপনার মতো পিগমী’র আর অফিসে আসার দরকার নেই’। আমিও বিদ্যুতের এই আকালের দিনে হারিকেন পেয়ে খুশিতে বগল বাজাতে বাজাতে বাসায় ফিরলুম। নিতু যা বোঝার বুঝে নিয়েছে।
এখন সারাদিন বাসায় থাকি। ডোডোপাখির মতো এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করি আর ব্লগিং করি। নিতু এখন আমাকে ‘ডোডোপাখি’ নামেই ডাকে। বিরাট ভূসম্পত্তির মালিক ও ঢাকার উত্তরাতে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়ি ভাড়া। আগামী দু-চার প্রজন্মের অর্থ কষ্টের টেনশনও নাই। তাই এবার হাত-পা ঝাড়া ব্লগিং হবে। ব্লগের ছাগু, কাঠমোল্লা, অর্থনীতি-ফাইন্যান্স-টেকনোলজি-ফেকনোলজি-থিওলজি না বোঝা মগজহীনদের এবার গুরু চাঁদগাজীর আশির্বাদ নিয়ে গণধোলাই দেওয়াই হবে আমার নিত্যদিনের কাজ। এ আমার ওয়াদা!
রাতে নিতুর সাথে টেকনোলজি-ফাইন্যান্স-সায়েন্স-হাইটেক-ননটেক-ফিনটেক নিয়ে বেশ বড় আকারের বাতচিৎ হয়েছে। কারণ নিতুর নলেজ এসব বিষয়ে একেবারেই বিভ্রান্তিমূলক। অথচ ব্লগিং করার ফলে আমি এখন বলতে গেলে কিছুটা এক্সপার্ট পর্যায়ে কিংবা জ্ঞানের সর্বশেষ পর্যায়ে চলে গেছি গুরুর আশির্বাদে। সেই আমাকেই কিনা রাতের চুলোচুলিতে নিতু বলেছে, আমার নাকি এসব বিষয়ে জ্ঞান মুরগীর মগজের সমান। মিজাজটা মাইরি এতটা খারাপ হলো! এ ভয়ঙ্কর অপমানে সারারাত বাথরুমের কমোডে বসে বিড়ি ফুঁকেছি। পরদিন সকালবেলা মাথা ঠান্ডা হলে--আমি যা করি আর কী?
--ছোটা লিলিপুটিয়ানকে ডেকে বললাম, ‘দোদো বাবা, যাও তো, তোমার আম্মুকে কিচেন থেকে এখানে পাঠিয়ে দাও। আর তুমি লিভিং রুমে বসে টিভিতে ‘দোদোপাখি’র কার্টুন দেখো’।
একটু পরেই মাইক্রো-সাইজ পিগমী ফিরে এসে উচ্ছ্বসিত স্বরে, ‘আব্বু আব্বু থুনেছ, আম্মু বলছে আতকে দোদোপাকির থাথে দিং দিং কেলবে না। আগ করেচে’।
এই প্রশ্নফাঁস জেনারেশনের কথা শুনে আমি তাৎক্ষণিকভাবে বাসায় বিশেষ কিছু বিবর্তনীয় কিংবা পোস্ট মডার্ন বাংলা শব্দের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি করলুম। ওরে, নইলে যে নয়া সিনড্রোমের মহামারী ঠেকানো যাবে না রে!!!
**************************************************************************************
@আখেনাটেন-নভেম্বর/২০২২
ছবি: Pinterest
@প্রিম্যাচিউর ৭ম বর্ষপূর্তি পোস্ট। শুভেচ্ছা সামু ব্লগের সকল পিগমী, ডোডোপাখি ও লিলিপুটিয়ানদের!! যুগ যুগ জিও সামু!!!

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:৩১