চা-বাগানগুলো চির সবুজ এলাকা। উঁচু-নিচু টিলা আর পাহাড়বেষ্টিত চা-বাগানগুলো সবুজকে আরও প্রগাঢ় করেছে। সবকিছু প্রতিষ্ঠার পেছনে থাকে ইতিহাস, থাকে ঐতিহ্য। তেমনি চা-বাগান প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক সুবিশাল ইতিহাস-ঐতিহ্য। চা-বাগান প্রতিষ্ঠার সময় ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের এনেছিল। ব্রিটিশরা প্রথম যে শ্রমিকদের এখানে এনেছিল, তারা এখন আর বেঁচে নেই। রয়েছে তাদের বংশধররা। দেশের দেড় শ বছরের পুরোনো প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ চা শিল্পের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখার লক্ষ্যে টি মিউজিয়াম বা চা জাদুঘর স্থাপন করেছে চা বোর্ড। ব্রিটিশ আমলে চা-বাগানগুলোতে ব্যবহূত বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এ শিল্পের ঐতিহ্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলে স্থাপিত হলো চা জাদুঘর।
তবে চায়ের উপকারিতা, চায়ের আবিষ্কার কাহিনীসহ চায়ের এ পর্যন্ত বাংলাদেশে উদ্ভাবিত সকল প্রকার বিটি ক্লোনের উপস্থিতি জাদুঘরে থাকবে বলে জানা গেছে। জাদুঘরের জন্য এ পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলে চা-বাগানে ব্যবহূত প্রায় শতাধিক আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার আগে চা বোর্ডের দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহূত চেয়ার-টেবিলও।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলায় টি রিসোর্টের তিনটি কক্ষে এখন চা জাদুঘর করা হয়েছে। ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল রুহুল আমীন (এএফডব্লিউসি পিএসসি) এটি উদ্বোধন করেন। প্রথম দিকে রিসোর্টের একটি ভবনের তিনটি ঘর নির্ধারণ করে সে ঘরগুলোয় সংগৃহীত প্রাচীন এসব জিনিসপত্র আনার কাজ চলে। পরে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহূত চেয়ার, চা শ্রমিকদের জন্য ব্যবহূত বিশেষ কয়েন, কম্পাস, ঘড়ি, পাম্প টিউবওয়েল, খাট, টেবিল, আয়রন ব্যাম্বো স্টিক, ব্রিটিশ আমলের ফিলটার, চা গাছের মোড়া ও টেবিল, পাথর হয়ে যাওয়া আওয়াল গাছের খণ্ড, প্রোনিং দা, প্লান্টিং হো, দিকনির্ণয় যন্ত্র, ফসিল, লোহার পাপস, ঘটি, ব্রিটিশ আমলের পাখা, কাটা কুদাল, টাইপ রাইটার, কয়েন পাথরের প্লেট, লোহার ফ্রেম টেবিল, প্রনিং নাইফ, ইলেকট্রিক ফ্যান, ফর্ক, সার্ভে চেইন, রেডিও, সিরামিক ঝাড়, ডয়ারের অংশ, বাট্টার ডিল, রাজনগর চা-বাগানের নিজস্ব কয়েন, ব্রিটিশ আমলে লন্ডন থেকে আনা ওয়াটার ফিলটার, রিং কোদাল, তীর-ধনুকসহ নাম না-জানা আরও কিছু সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এখনো সংগ্রহের কাজ চলছে। স্থপতিদের দিয়ে পরিকল্পনা করে চা জাদুঘরে মূল্যবান এসব সামগ্রী রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে পাওয়া গেছে কেরোসিনচালিত ফ্রিজ, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ব্যবহূত গাড়ির চেসিস। কমলগঞ্জের দেওড়াছড়া চা-বাগান থেকে আনা হয়েছে কয়েক শ্রেণীর কয়েন, যা শুধু চা শ্রমিকদের মধ্যেই ব্যবহার হতো।
চা-বাগানের পুরোনো স্থাপনার আলোকে নকশা প্রণয়ন করে টি মিউজিয়াম ভবন নির্মাণ করা হবে। টি রিসোর্টের নামও পরিবর্তন করে রাখা হবে টি রিসোর্ট অ্যান্ড মিউজিয়াম। বর্তমানে দেশের ১৬৫টি মূল চা-বাগানে চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী যেসব বাগানে প্রাচীন ব্রিটিশ আমলের আসবাবপত্র আছে তা মিউজিয়ামে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে আলোকে বিভিন্ন বাগান থেকে প্রাচীন সামগ্রী পাঠাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বাগান কর্তৃপক্ষ। চা বোর্ড সূত্র জানায়, পর্যায়ক্রমে প্রাচীন সামগ্রী সংগ্রহের পাশাপাশি এ জাদুঘরে চা উত্পাদন থেকে শুরু করে বিপন্ন এমনকি মিনি ফ্যাক্টরিও স্থান পাবে। চা জাদুঘর হওয়ায় শ্রীমঙ্গল তথা মৌলভীবাজার জেলায় পর্যটকদের আকর্ষণ আরও বেড়ে যাবে। শ্রীমঙ্গল পর্যটনের ক্ষেত্রে জন্ম দেবে একটি নতুন অধ্যায়ের। আর এ জাদুঘর দেখে পর্যটকেরা চা শিল্পের প্রাথমিক ধারণা এখান থেকে নিতে পারবে। বিশেষ করে টি রিসোর্টের মানও এ জাদুঘর অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। এখানে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ব্রিটিশ আমলী সাহেবী কটেজ, সুইমিংপুল, উন্মুক্ত আটটি হরিণের পদচারণভূমি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে। বাংলাদেশের চা শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষদের ইতিহাস উঠে আসবে এই জাদুঘরে।
মৌলভীবাজারের মানুষ এই জাদুঘর স্থাপনের কারণে খুশি হয়েছে। পর্যটকরা যদি এখানে এসে দেশের অতীত ঐতিহ্যের সন্ধান পান এবং তা নিয়ে নিজের জানার পরিধি বাড়িয়ে নিতে পারেন, তবেই এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা পাবে।