ইতালিতে কবি
শঙ্খ ঘোষ
সেদিন ফ্লোরেন্স থেকে ট্রেন ছুটছে ত্যুরিনের দিকে
উনিশশো ছাব্বিশ সাল, ১৮ই জুন।
মধ্যপথে একবার মিলান স্টেশনে কোনও ডিউক এসে নিচু স্বরে বললেন কবিকে:
‘চোখে যা দেখছেন, সেটা সবখানি নয়। শুধু বলি
রাজনীতি নিয়ে কিছু না বলাই ভালো।
এখানে কথার কোনও স্বাধীনতা নেই। তা ছাড়া চারদিকে গুমখুন—’
আচম্বিতে ছাড়ে ট্রেন। কবির কপালে পড়ে ভাঁজ।
তবে কি কোথাও হল সত্যি কোনও অবিমৃশ্য ভুল?
মনে হয়েছিল খুবই যোগ্য নেতা, তৎপর, দেশব্রতে পরম আকুল,
মনে হয়েছিল যেন শিল্পীর দু’চোখে দেখা শিল্পীও সে।
সবই ঠিক। তবে কেন অত ভোরে লুকিয়ে আসেন ঘরে বেনেদেত্তো ক্রোচে?
তবে কেন অনেকেরই চোখেমুখে চাপা এত ভয়?
ত্যুরিনের কথাশেষে এবার রঁলার কাছে কবি ভিলন্যভে।
হতবাক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে রঁলা বসে ভাবছেন: হতে পারে? এ কি হতে পারে?
মননের মুক্তিকথা যাঁর কাছে শুনতে চাই আজ
শুনতে চাই কর্মপথে বোধের স্বরাজ
তিনি কি এমনই দৃষ্টিহীন?
তাঁকে তো জানাতে হবে কীভাবে প্রবাসী আজ ইতিহাসবিদ সাল্ভেমেনি
কেনই-বা জুরিখে আছেন পড়ে নিগৃহীত নির্বাসিত সালভাদোরি
মুখ চিরে দিয়ে যাঁর প্রতিবাদফলচিহ্ন ক্ষতে-রক্তে গাঁথা
আড়ালে আড়ালে দেশে কীভাবে ছড়ানো আছে বিভীষিকা আর স্বেচ্ছাচার
তাঁকে তো বোঝাতে হবে এ এমন সময় বাঁচার
যখন নেতারা চলে প্রকাশ্যেই হামা দিয়ে লুম্পেনের তর্জনীসংকেতে
এ এমন সময়, যখন
শুধুই চিৎকারশব্দে যে-কোনও আকাট মিথ্যে সুঘোষিত সত্য হয়ে ওঠে
এ এমন সময়, যখন
আইনের শাসনহীন গোটা দেশে একনায়কের ইচ্ছা একমাত্র আইন
এ এমন সময়, যখন
এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় নিরপরাধের মাংসে ঘাতকেরা নিত্য করে হোম—
সেসব দেখেননি আপনি কবি
আপনি শুধু দেখেছেন উৎসবের সমারোহে উন্মুখর প্রসাধিত রোম!
স্তব্ধ রঁলা আর ক্ষুব্ধ বন্ধুদল।
শ্রোতার কপালে ভাঁজ। তবে তো দেখায় তাঁর সত্যি কোনও থেকে গেছে ভুল!
দৃষ্টিবদলের কথা বিশ্বকে জানাতে হবে ভেবে
লজ্জাতুর ব্যথা নিয়ে আরও একবার কবি হাতে তুলে নিলেন কলম।
—শারদীয় দেশ, ১৪২১