যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন্দ্র করে সারাদেশে সহিংতা ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রমণের টার্গেট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবীতে আন্দোলনে যোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টা প্রতিরোধে আক্রমণকারীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে দেশে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিতে সারা দেশে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। (সূত্র দৈনিক প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৩, ১ম পৃষ্ঠা)
যখন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তখন উপজেলা পর্যায়ে প্রতিরোধে কথা মনে পড়েছে দেশের কর্তা ব্যক্তিদের। তথাকথিত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তারা দেশের শাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূতই থাকে, উপজেলা পর্যায়ে প্রস্তুতির দরকার হয় না।
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবী ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর ৬ দফার হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ১৯৭১-এ দেশের জন সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। ধারণা করি ৬৬ সালে জন সংখ্যা কম বৈ বেশি ছিল না। এখন বাংলাদেশে জন সংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি এবং যে কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা ৬ দফার মূল চেতনার পরিপন্থী। জেলার মানুষ কি স্ব-শাসিত? জেলায় যিনি সরকারের পক্ষে শাসন কার্য পরিচালনা করেন সেই জেলা প্রশাসক তো স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত নন। তার জবাবদিহিতা স্থানীয় জনসাধারণের কাছে নয়। যদিও কেন্দ্রের সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত। বিদেশী শাসনাধীন দেশে প্রশাসকরা ভিন্ন দেশ থেকে এসে এদেশে শাসন করত এখন প্রশাসক নিজ দেশেরই অন্য এলাকা থেকে আসেন যিনি কার্যত স্থানীয় মানুষের কাছে ভিন দেশী।
এখানে মনে রাখা দরকার ৬ দফায় অঙ্গ রাজ্যের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে কোনো অঙ্গ রাজ্য নেই। তাই আমি ৬ দফার হুবহু অনুকরনের কথা বলছি না। ৬ দফায় কেন্দ্র এবং স্থানীয় শাসনের ক্ষমতা ভাগা ভাগির যে চেতনা রয়েছে তার সৃজনশীল বাস্তবায়নের কথা বলছি।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দেশের শাসন ব্যবস্থা কেমন থাকে তার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে আইন প্রনেতারা দেশের আইন প্রণয়নসহ কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নির্বাচনী এলাকার অঘোষিত প্রশাসকের কাজ করেন। এলাকার বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি ঠিক করেন। যদিও দুনিয়াতে অগ্রসর দেশে এরকম শাসনের অস্তিত্ব আর নেই। পাশের দেশ ভারতেও স্থানীয় শাসনের আলাদা কাঠামো আছে।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসন কাঠামোতে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত চেয়ারম্যান আছে। কিন্তু উপজেলা প্রশাসনে তার এলাকার জনগণের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করার কোনো ব্যবস্থা নেই।
উপজেলা পর্যায়ে জন প্রতিনিধি নির্বাচিনের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে যাদিও অনির্বাচিত ভিন্ন এলাকার উপজেলা নির্বাহী অফিসারই এখনও উপজেলার মূল প্রশাসক।
উপজেলার পর জেলায় মাঠ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর আছে কিন্তু এখানে নির্বাচিত জন প্রতিনিধির কোন ব্যবস্থা নেই।
প্রশনিকভাবে বিভাগকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসাবে বিবেচনা করা হয় না এবং এখানেও কোনো আর কোনো নির্বাচিত জন প্রতিনিধির ব্যবস্থা নেই।
এধরনের শাসন ব্যবস্থার ফলে সরকারের স্তরে সাধারণ জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন রকম দেশ বিরোধী সমাজ বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ, স্থানীয় বিভিন্ন দ্বন্দ্ব সংঘাত মোকাবেলায়, নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে জনগণের নিজস্ব ভূমিকার্যত বিকল থাকে।
আবার সংকটময় পরিস্থিতিতে জনগণের সাথে প্রতিরোধ গড়ার জন্য সংসদ অধিবেশন সমাপ্ত করে সংসদ সদস্যদের এলাকায় যাওয়ার জন্য সুযোগ করে দেওয়া হয়েছ। অথচ কার্যকর স্থানীয় শাসন থাকলে এভাবে সংসদ বন্ধ করে সংসদ সদস্যদের এলাকায় যেতে হত না।
আবার দেখুন ৬৫ যুদ্ধে আমরা অনুভব করেছিলাম পূর্ববঙ্গ কতটা অনিরাপদ। তেমন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে মানুষ কতটা নিরাপত্তাহীন। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা নিরাপদ নই। সমস্যায় নিপতিত হয়ে আমাদের এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়তে হচ্ছে। আর যদি এই পরিস্থিতি থেকে আমরা যদি কার্যকর স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করি তাহলে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্র আরও একধাপ অগ্রসর হতে পারব। যে ব্যবস্থায় সমস্যায় পতিত হয়ে প্রতিরোধের আশ্রয় খুঁজতে হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৫:৪০