ডিসক্লেইমারঃ
১। ২০০৯ এর ২৫ই ফেব্রুয়ারীতে বিডিআর এর ঘটনায় আমি হারিয়েছি আমার আপন চাচাত ভাই (লেঃ কর্নেল), ২জন ক্লোজ ফ্রেন্ড (মেজর), ২ জন প্রিয় প্রতিবেশীকে (১জন লেঃ কর্নেল, ১ জন মেজর,)। এদের কারোই আমি বিস্তারিত পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নই।
২। কর্নেল গুলজারের ছবি এবং আমর চাচাত ভাই ও ফ্রেন্ড ছাড়া বেশ কিছু অপ্রাকাশিত ছবি প্রকাশ করা হবে। যাদের ছবি প্রকাশ করছি সেইসব হতভাগাদের লাশ তাদের সন্তান, স্ত্রী ও আত্মীয়দের দেখতে দেওয়া হয়নি তখন। যারা শেষ বারের মত তাদের প্রিয়জনকে দেখতে পায়নি ৫ বছর পর তারা এখন সেই প্রিয়জনের ছবিগুলো দেখবে।
===========================================
২৫ তারিখ সকাল ৮:৪৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর এক ফ্রেন্ড আমাকে প্রথম ফোন করে ঘটনা জানায়। সংক্ষেপে ঘটনা বলে জিজ্ঞাসা করে ***** স্যার (আমার চাচাতো ভাই) কোথায়? জানালাম, উনিতো ভোরেই পিলখানার উদ্দশ্যে বেরিয়ে গেছে। সে আর কিছু না বলে শুধু বলল তুই এখুনি পিলখানায় চলে আয়।
আমার চাচাত ভাই ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এবং আমাদের বাসায় উঠেছিলেন। ওইদিন সকালে শুধু এক কাপ চা খেয়েই বেরিয়ে যান উনার ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়ে। দরবার হলের অনুষ্ঠানের বিশেষ এক দায়িত্ব ছিলো তার উপর। তাড়াহুড়া করে সকালের নাস্তাটাও করেনি।
ভাইকে আমি ফোন করছি তো করছি, রিং বেজেই চলেছে............... বাসার কাউকে তখনও কিছু বলিনি। আমি তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরুচ্ছি, এমন সময় আরেক ফ্রেন্ড ফোন করে জানায় পিলখানার দরবার হলে ৫০ জনের মত সিনিয়র অফিসার শুট ডাউন। শুনে আমার সারা শরীর হিম শীতল হয়ে গেল। তাকে জানালাম, আমি পিলখানার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। নিউ মার্কেটের সামনে পৌছেই এক র্যাবের গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখি আমার মহল্লার এক র্যাব অফিসার, সিনিয়র মেজর, (ওরও এক আত্মীয় মারা গেছে ঐ ঘটনায়)। ওকে দেখেই ট্যাক্সি থেকে নেমে ওকে ইশারা দিতেই দৌড়ে আসে। তাকে জানালাম ভাইয়ের মোবাইলের এতক্ষণ রিং বাজছিলো কিন্তু এখন ফোন অফ। সে নির্বিকার আমাকে জানালো ****** স্যার (আমার চাচাতো ভাই) এর আশা ছেড়ে দেন। প্রথম তার কাছে জানতে পারি আমাদের পরিচিত কারা কারা ভিতরে আছে। এর মধ্যে আমার আরও কয়েকজন আর্মি ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা হয়। ঘটনা কি ঘটেছে বুঝতে আর বাকি রইলো না।
এর ভিতর কিভাবে যেন আমার পরিচিত কয়েকজন জেনে যায় আমি পিলখানায় আছি। একটার পর একটা ফোন আসা শুরু হয়। যাদেরকে বলা প্রয়োজন মনে করেছি তাদেরকে সত্য কথা বলছি। কিন্তু কাঊকে কাঊকে এড়িয়ে গেছি। ঐ সময় আমিও কেমন যেন অনুভতিহীন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানি, তাদের কাছের লোকটি নেই কিন্তু নির্বিকারে তাদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই বোনদের বলে যাচ্ছি উনি ভালো আছেন/আছে, একটু আগে আমার সাথে কথা হয়েছে............ এমন মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছিলাম নির্বিকারে।
টিভিতে লাইভে আপনারা যেভাবে সাংবাদিকদের মিথ্যাচার দেখছিলেন, আমিও ঠিক একিভাবে মিথ্যা বলে যাচ্ছিলাম আমার পরিচিত জনদের। কিছুক্ষণের ভিতর আমার মোবাইলে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আশা শুরু করলো। কল করে বলে “অমুক আপনার ফ্রেন্ড হয় না? আমি তার , চাচা, মামা, খালাতো বোন, মামাতো বোন............... আমার হাসবেন্ডের নাম লেঃ কর্নেল ****** আমার ছেলে/ভাই/ভাতিজা মেজর *****, ক্যাপ্টেন ***** আমিতো ওকে ফোনে পাচ্ছি না......... আপনিতো পিলখানায় আছেন............ একটু দেখবেন ও কোথায় আছে, কেমন আছে? একটু খোজ নিয়ে জানাবেন, প্লিস।“
আর আমি শূয়রের বাচ্চা, ইতর, হিজড়া নামক মানুষটি সবাইকে মিথ্যা বলে যাচ্ছিলাম। আমি এমন ভিরু, কাপুরুষ হয়ে গিয়েছিলাম যে কাউকে বলতে পারিনি যে আপনার স্বামী, ভাই, ছেলে আর জীবিত নাই। যে কোন ভাবেই হোক আমি প্রতি মিনিটে নিহতদের আপডেট নামের তালিকা দেখছিলাম। পিলখানার ভিতর থেকে কেউ একজন প্রতিনিয়ত নিহতদের নাম প্রকাশ করে যাচ্ছিল সরকারের একটি বিশেষ সংস্থার কাছে। আমার সামনেই নামগুলো নোট করে নিচ্ছিলো সেই সংস্থার একজন। পিলখানার এই গেইট থেকে ঐ গেটে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে দুই টিভি সাংবাদিকের খপ্পরে পড়ি। আমি তাদের একটিও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাইক্রফোন সরিয়ে দিয়ে আমি আমার পথে যেতে থাকি। টিভিতে লাইভে ঐ দৃশ্য আমার পরিচিতজন কয়েকজন আমার চেহারার অভিব্যাক্তি দেখে বুঝে ফেলে, বিশেষ করে আমার স্ত্রী নিশ্চিত বুঝে ফেলে। সে ঘরে কান্নাকাটি শুরু করে, এতে ঘরের সবাই বুঝে ফেলে আমার ভাই আর নেই। ওদিকে চাচা, চাচী আমার বাসায় ফোনের পর ফোন করতেছে। আমার ঘর থেকে কেউ সদুত্তর দিতে পারছে না, সুধু উত্তর দিচ্ছে ‘জাতির নানা’ পিলখানায় আছে। ওর সাথে কথা হয়েছে, সব ঠিক আছে।
পিলখানায় উদ্ধার কাজ শুরু হওয়ার মুহূর্তে যে কয়জন পিলখানার ভিতরে যাওয়ার সুজুগ পেয়েছিলো আমি তাদের একজন। যে কোন উপায়ই হোক আমি ভিতরে ঢুকেছিলাম। তার অনেক আগেই জেনে গিয়েছিলাম/বুঝেছিলাম আমি কাদেরকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঢুকেছিলাম শুধু আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের লাশ খুজতে। লাশ খুজতে খুজতে পাগলপ্রায় অবস্তা আমার। এর মধ্যে খবর পাই কিছু লাশ মিটফোর্ডে মর্গে নিয়ে গেছে। ছুটে যাই সেখানে। মর্গে গিয়ে দেখি সরকারী বাহিনীর বিশেষ কিছু লোকজন ছাড়া অন্যদের প্রবেশ নিষেদ। এক পরিচিত অফিসারের সহায়তায় আমি মর্গে ঢুকি। জীবনের প্রথম মর্গে ঢুকি। লাশগুলো কিছু উপড় হয়ে আছে কিছু কাত হয়ে আছে। ৬-৭টা লাশ উলটিয়ে দেখতে গিয়ে প্রথম পাই আমার প্রতিবেশী সিনিয়র ভাইয়ের (লেঃ কর্নেল)। তার চেহারা দেখে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। সাথে সাথে মর্গে থেকে বেরিয়ে পড়ি।
পিলখানায় ও হাস্পাতালে দৌডাদৌডিতে অনেক হতভাগা নিহতের আত্মীয় সজনের কাছে চেনা মুখ হয়ে যাই। তখন এক হতভাগা নিহতের আত্মীয় এসে একটা ছবি দিয়ে বলে লাশটা আইডিন্টিফাই করার অনুরোধ করে। এর মধ্যে আরো কয়েকজন ছবি, নাম ও রেঙ্ক লিখে চিরকুট দেয়। আবার ঢুকে ভাইয়ের লাশ খোজা শুরু করি, একপর্যায়ে পেয়েও যাই। ভাইয়ের লাশ পেয়েও আমি কিভাবে যেন নির্বিকার ছিলাম। অনুভুতিহীন হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা ছবি ও নাম দেখে কিছু লাশ আইডিন্টিফাই করার চেষ্টা করলাম। বেশিরভাগ লাশের নেমপ্লেট ছিল না। হঠাৎ মাথায় এলো মোবাইল দিয়ে কিছু ছবি তুলে বাইরে আত্মীয় স্বজনদের দেখালে হয়তো চিনতে পারবে, আমিতো ছবির সাথে লাশের কোন মিল খুজে পাচ্ছিলাম না। বেশ কিছু ছবি তুললাম সরকারী বিশেষ সংস্থার লোকদের চোখ ফাকি দিয়ে। আবার বাহির হয়ে দুজনকে ছবিগুলো দেখাচ্ছিলাম, পাশ থেকে এক মহিলাও ছবিগুলো দেখছিলো যা আমি খেয়াল করিনি। হঠাৎ ধুপ করে আওয়াজ শুনে পাশে ফিরে দেখি এক মহিলা মাটিতে পড়ে আছে। তার সাথের লোকটি জানালো আমার ঐ ছবিগুলোর মধ্যে ঐ মহিলার স্বামীর ছবি ছিলো।
২৬শে ফেব্রুয়ারি মাঝ রাতে বাসায় ফিরি। এই দুই দিন খেয়েছিলাম ২টা কলা আর ২ পিস ব্রেড। তার পর মাসখানেক কিছু খেতে পারিনি। আগামী ফেব্রুয়ারির ২৫ ও ২৬ তারিখে অনেকের বাসায় আমাকে দাওয়াত দিবে মৃত্যু বার্ষিকীর মিলাদ মাহফিলে। গত ৪ বছরও যাইনি, আগামীতেও যাব না। যে সব অফিসারদের স্ত্রী কন্যা, পুত্রদের ২৫ তারিখ সন্ধ্যায়ও বলেছিলাম উনি জীবিত আছে তারা জানে যাদের প্রিয় মানুষটির মৃত্যু হয়েছে ২৬ তারিখে। আমার মিথ্যা কথার উপর ভিত্তি করে তারা ২৬তারিখ মৃত্যু বার্ষিকী পালন করে। সেইসব পরিবারের মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার আজ হয়নি। আমার নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই বিভীষিকাময় ‘ঘটনা’ এবং ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ হয়তো একদিন কেউ না কেউ প্রকাশ করবে।
সেদিন একটা কথা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম যে ঘরের মালিক যদি নিজের ঘর জ্বালিয়ে দিতে চায় তাইলে প্রতিবেশী সেই আগুন নেভাতে পারে না। সেদিন র্যাব-১ এর দুই পিকআপে ১৬ জন ছিলো। তাদের কমান্ডিং অফিসার বার বার তার মহাপচালিকের কাছে অনুমতি চাইছিলো একশানে যাওয়ার। কিন্তু হায় অনুমতি মিলেনি। ঐ অফিসারকে দেখেছি দাঁত কিড়মিড় করে বার বার তার মহাপরিচালকের কাছে বলছে, "স্যার, পারমিট মি পারমিট মি।" যদি অনুমতি মিলতো তাইলে এত অফিসারের প্রাণহানি হত না। অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ অফিসারকে উদ্ধার করে বাঁচানো সম্ভব ছিলো। অনেক অফিসার গুলিবিদ্ধ হয়েও রাত পর্যন্ত জীবিত ছিলো। জীবিত অবস্থায়ই তাদের মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো। র্যাব নিজস্ব সোরচে আগেই খবর পেয়েছিলো এবং প্রস্তুতি নিয়েই পিলখানা গেইটে অবস্থান নিয়েছিলো সকাল সাড়ে আটটায়। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসএমজি’র গুলির আওয়াজ শুনেছে। র্যাবের ঐ দুটা টিমই যথেস্ট ছিলো ভিনদেশী ১২ জন হায়েনাকে প্রতিহত করার। এত ট্যাঙ্ক, কামান আর হেলিকাপ্টারের দরকার ছিলো না। সেদিন র্যাব-১ যদি একশানে যেতে পারতো সারা দুনিয়ার সামনে ভিন্ন কিছু উম্মচিত হত।
আপনারা বিভিন্ন মিডিয়ায় যে সব ঘটনা, পৈচাশিক ঘটনার কথা শুনেছেন তা আমার দেখার সাথে মিলে না। ছবিগুলো দেখে কি আপনারা বলতে পারেন, যাদেরকে মারা হয়েছে তারা পাগল পশু ছিলো নাকি যারা এভাবে মেরেছে তারা পাগল পশু ছিলো???
উপরের ছবিটি ডিজি শাকিলের। যাকে জীবিত অবস্তায় মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিলো, যার কারনে উনার চোখ দুটি বের হয়ে আসছিলো (সি এম এইছ এর এক ডাক্তারের অভিমত) গুলি খাওয়ার পর অনেকে জীবিত ছিলো যারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাটি চাপা দেওয়ার পর। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেলে মানুসের চোখ বেরিয়ে আসে।
নিচের ছবিটা দেখুন; পৈচাশিকতা এবং নৃশংসতার সঙ্গা নতুন করে শিখুন।
ছবিগুলো এতো বিভৎস যে ১মবার দেখে আর ২য় বার দেখতে ইচ্ছে করছেনা। ছবিগুলো দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
সূত্র ও ছবি: ফেইসবুক