ফেইসবুকে মধ্যে মধ্যে শিশির ভাইকে পাই, টুকটাক কথা বলি। আমি একদিন বল্লাম আমি একটি আর্টিকেল লিখতে চাই আপনার এ বিষয়টি নিয়ে, উনি সানন্দে গ্রহণ করলেন। নীচে তার লেখা এবং পাঠানো ছবির কিছু অংশ প্রকাশ করছি

আশরাফ শিশিরঃ
আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাবনা শহরে। চাকুরীজনিত কারনে বাবা-মা ঈশ্বরদীতে চলে গেলেও একপাল বন্ধু-বান্ধব রেখে আমি প্রিয় পাবনাকে ছেড়ে যাইনি। তাই অনেকটা কাস সিক্স থেকে আমি বাড়ির বাইরে। একবার ছুটিতে ঈশ্বরদীতে গেলে বাবার সাথে সেখানে একটি মসজিদে জুম্মার নামায পড়তে যাই। সবাই বলে এই মসজিদের নাম "প্রোস কোয়ার্টার মসজিদ"। আমি তখন বড় হচ্ছি, আমার বয়স ১২ বছর। সেক্স বুঝিনা। সেক্স বুঝিতো প্রোস বুঝিনা। ওই এলাকার সুশীল সমাজ ও মৌলবাদীরা এক হয়ে প্রোস কোয়ার্টার ভেঙ্গে সেখানে একটি মসজিদ গড়ে তোলে, আর ওই প্রভাশালী মানুষগুলোই আশ্রয়চু্যত পতিতাদের দখল করে নেয়। আসলে আমার সিনেমার গল্প সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায়। আমার প্রিয় শহর থেকে একসময় আমাকে চলে আসতে হয় বিশ্রী নগরী ঢাকায়, নটরডেম কলেজে। কিন্তু লোরকার মত তখন আমার দৃষ্টি অবধারিত সত্যকে খুঁজে ফিরতে শুরু করেছে , " হা ঈশ্বর, চারিপাশে এতগুলো আয়না নিয়ে কেন জন্ম হল আমার?" লেখাপড়া শিকেয় তুলে দিয়ে আমি তখন লিটল ম্যাগাজিন-আজিজ মার্কেট-শাহবাগ করে বেড়াচ্ছি। তখন ভাবতে শুরু করেছি " ভাবছি ঘুড়ি হব ঘুমদের দেশে ঘুমে ঘুমে ঘুমাঘুম যেন ঘুমদৌড়..."। আমি লিখতে শুরু করি আমার উপন্যাস " পেট, রুটি ও জল অথবা পেট্টিওটিজম", এর একটা সংপ্তি রুপ ছোটগল্প হিসাবে "প্রতিভূ" এর ২য় খন্ডে ছাপা হয়। তারপর বছর ১২ আগে পাবনা শহরের শেষ সীমানায় একটা চায়ের দোকানে লম্বা একজন ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা হয়। ছেঁড়া জুতো- ছেঁড়া কোর্ট-প্যান্ট পড়া একজন ভদ্রলোক যিনি শুদ্ধ বাংলাভাষায় কথা বলেন তিনি ওই চা-দোকানে কাজ করেন। দিনে ১০/৫ টাকা বখশিশ পান। রাতে বিআরটিসির একটা নষ্ট-পুরনো জীপে শুয়ে থাকেন। আমি তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলি। জানতে পারি তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের একজন পরিচালক- একজন অভিনেতা ছিলেন। কোন এক কারণে তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তার নাম আব্দুর রাজ্জাক। আমি তখন নানা কারণে মানসিক বিপর্যয়ের ভেতরে আছি। রাজ্জাকের সাথে সখ্যতা হলে প্রতিদিন তার চোখ চকচক করে, বলেন, "শিশিরদা, তুমি একটা সিনেমা বানাও, আমি তোমার সাথে থাকবো"। আমি রাতে ঘরে ফিরি প্রচন্ড হতাশা নিয়ে। মনে মনে বলি, "রাজ্জাক ভাই, আমার চাল-চুলো কিছুরই ঠিক নেই, আমি কিভাবে সিনেমা বানাবো?" তারপর একদিন এইসব ক্ষুদ্রতা-সীমাবদ্ধতা আর একটি পিঁপড়া আমাকে দিয়ে একটি ১০/১৫ মিনিটের স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে নেয়, আমি এর নাম দিয়ে দিই "আমরা একটা সিনেমা বানাবো"। আর ২০০৯ এ এসে আমার হারিয়ে যাওয়া পান্ডুলিপি " পেট, রুটি ও জল অথবা পেট্টিওটিজম" ও সচেতনভাবে "আমরা একটা সিনেমা বানাবো" এর পেটের ভেতরে ঢুকে গিয়ে বিশ্রীভাবে হা করে থাকে প্রকাশিত হওয়ার জন্য। আর তাই সম্পূর্ণ সাদাকালোয় রঙ্গিন স্বপ্নের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকে না। আর সব রঙের মতই সাদাকালোর প্রতিও আমার ভালবাসা অপ্রতুল। আমার রঙ নিয়ে খেলা করতে ভাল লাগে। আমার লেখাগুলোতেও এর বহিঃপ্রকাশ থাকে। আমি চাই আমার প্রতিটি চলচ্চিত্রে একটি করে বিশেষ রঙের প্রাধান্য থাকুক। তাই "আমরা একটা সিনেমা বানাবো" সাদাকালো। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি রঙিন বর্ধিত কলেবরে শিল্প-সাহিত্যকে বেঁধে দিলেই যে তা শিল্পোত্তীর্ণ হবে তা নয়, তাই " বাংলাদেশের দর্শক এত বোকা নয়" এই মর্মার্থ বুঝে নিয়ে আমি একটি জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছি, যেখানে মানুষ তার নিজস্ব রঙ খুঁজে নেবে। আর ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুসারে যেহেতু আমরা জানি যে স্বপ্নের রঙ হয় সাদাকালো, তাই "সম্পূর্ণ সাদাকালোয় নির্মিত একটি রঙিন স্বপ্নের চলচ্চিত্র" ষ্ট্যান্ট নিতে আমাদের বাঁধেনি। ভাল চলচ্চিত্রের জন্য আমি লড়াই করতে চাই, ক্রিকেটে পেস বোলার যেমন বল করার আগে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়, আমিও তাই চেয়েছি। কারণ, লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যোদ্ধা কাউকে মা করে না...বিষয়টি হাস্যকর এবং মজার। এবং অবশ্যই গর্বের। আমি লিটল ম্যাগাজিনের লোক। প্রথাগত মিডিয়া যারা শিল্পিকে বেশ্যা বানিয়ে দেয় আমি তাদের মুখে পেচ্ছাব করি। ২০০২ সালে আমরা কয়েকজন তাজমহল রোডে আমাদের মেসের ঠিকানায় "চলচ্চিত্র কেন্দ্র" নামে একটি চলচ্চিত্রবিষয়ক সংগঠন দাঁড় করাই। বেশ কিছুদিন দণি ভারতে অবস্থান করায় এবং অন্য সদস্যদের নানাবিধ সমস্যার কারণে ওই সংগঠনটির কার্যক্রম চালু রাখা যায়নি। ২০০৫ এ বাংলাদেশে ফিরে এসে ছা-পোষা কেরানীর চাকুরীর পাশাপাশি আমি চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার জন্য ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকি। ২০০৭ এ "FACEBOOK" নামে একটি অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে "আমরা একটা সিনেমা বানাবো" এর একটি গ্রুপ দাঁড় করাই। সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করি। প্রথমে সবাই এটাকে ফাজলামী অথবা একধরণের ধান্দাবাজী মনে করে আমার গোষ্ঠি উদ্ধার করতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য কিছু তরুণ, উদ্যমী সদস্য জুটে যেতে সময় লাগে না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা ১০০০০ এর কোঠায় পৌঁছে যায়। কেউ অভিনয় করতে চায়, কেউ ডিরেকশন দিতে চায়, কেউ স্ক্রিপ্ট... সব মিলিয়ে দারুণ এক অভাবনীয় সাড়া পড়ে। নিয়মিত মিটিং, ফিল্মশো ছাড়াও সংগঠনের অকালপ্রয়াত একজন সদস্যের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত "সাইফুজ্জামান সোহাগ ফিল্ম আরর্কাইভ" এক নতুন মাত্রা যোগ করে। মিডিয়া যেভাবে শিল্প নিয়ে বেসাতি করতে চায় তা আমি কখনোই মেনে নিতে পারিনি। তাই আমি একটি "দাঁড়াবার জায়গা" তৈরি করতে চেয়েছি। এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা সারা বাংলাদেশে অল্টারনেটিভ শো-কেস তৈরি করতে চাই। আমরা চাই দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে সুস্থ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য উদ্যমী নির্মাতা যেরকম উঠে আসবে তেমনি কুশীলবরা্ও। আমরা চাই মিডিয়া যেন আমাদের গ্রাস করতে না পারে। আমরা মিডিয়াকে গ্রাস করতে চাই। আমরা শিল্প করতে চাই, ছেনালী নয়। এই চলচ্চিত্রে প্রায় দুই বাংলার ২৫০জন অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করছেন। এদের বেশীরভাগই ঢাকায় এবং পাবনায় ( যেখানে শু্যটিং করা হয়েছে) একাধিক অডিশনের মাধ্যমে এই চলচ্চিত্রে সংযুক্ত হয়েছেন। তাই হরিজন থেকে ব্রাম্মণ , অনেককেই দেখা যাবে এই চলচ্চিত্রে। অনেক খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। আরো কয়েকজনের নাম আপাততঃ চমক হিসাবে গোপন রাখতে চাইছি। আশা করছি, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তি পাবে "আমরা একটা সিনেমা বানাবো"
