প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলা খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের মত দেশে যেখানে মানুষের জীবনের কোনও গ্যারান্টি নেই, সেখানে এরকম ঘটনার সম্মুখীন হওয়া আরও স্বাভাবিক। কিন্তু এরকম প্রচণ্ড শোকে মানুষ কিরকম আচরণ করতে পারে? কি হতে পারে তাঁদের প্রতিক্রিয়া? কিভাবেই বা তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কেউ? এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা, এ ক্ষেত্রে পাঁচটি স্তর বা স্টেজের ভিতর দিয়ে যেতে পারে কেউ (Five Stages of Grief)।
১। উৎপত্তিঃ
Elisabeth Kübler-Ross নামে একজন আমেরিকান সাইকাইয়াট্রিস্ট ১৯৬৯ সালে একটি বই লেখেন যার নাম "On Death and Dying"। এই বইয়ে তিনি প্রথম তুলে ধরেন মৃত্যুর মুখোমুখি বা জীবন পরিবর্তনকারী কোনও ঘটনার ভিতর দিয়ে গেলে মানুষ সাধারণত কি কি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। Click This Link
২। এই পর্যায়গুলো কি কি?
প্রথম হতে শেষ পর্যায়গুলো হচ্ছেঃ
(১) অস্বীকার বা অননুমোদন (Denial)
(২) ক্রোধ বা রাগ (Anger)
(৩)দরকষাকষি (Bargaining)
(৪) হতাশা (Depression)
(৫) স্বীকার করে নেওয়া বা মেনে নেওয়া (Acceptance)
এবারে এই পর্যায়গুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেখা যাকঃ
(১) অস্বীকার বা অননুমোদন (Denial): প্রিয় কারও মৃত্যুসংবাদ বা নিজের বড় কোনও ব্যাক্তিগত ক্ষতি বা চরম দুঃসংবাদ শোনার পরে আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া কি? "কি! না এটা হতে পারে না!" "আমি বিশ্বাস করি না!" "আমি ঠিক আছি। আমি মোটেই ভেঙ্গে পড়ছি না!" ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে Denial বা অস্বীকার করা ঘটনাটি।
কিন্তু কেন এরকম হয়? অনেকে মনে করেন এটা ইভল্যুশন বা বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত একটি ক্ষমতা। ব্রেইন যতটুকু গ্রহণ করতে পারে, তা সে গ্রহণ করে। তাই এ ধরণের শক সামলাতে পারে না বলেই আমাদের ব্রেইন পুরো ঘটনাকেই অস্বীকার করে।
তবে যত সময় যায়, আমাদের মস্তিষ্কে আস্তে আস্তে এই ঘটনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে এবং ধীরে ধীরে আমরা তা গ্রহণ করা শুরু করি। http://grief.com/the-five-stages-of-grief/
এর উদাহরণ হতে পারে কারও মৃত্যুসংবাদ। অথবা কোনও রোগীকে প্রথম চিকিৎসার অযোগ্য রোগের কথা জানালেও একই প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। তবে আরও ভিন্ন ধরণের ঘটনা দেখা যায়। কোনও শিশুকে তার বাবা-মা ডিভোর্সের কথা জানালেও শিশুর একই Denial দেখা যেতে পারে।
(২) ক্রোধ বা রাগ (Anger): Denial পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে প্রচণ্ড ক্রোধ বা রাগ। "কেন আমার এরকম হবে?" "আমার তো এটা পাওনা নয়!" "কাকে দায়ী করা যাবে এ জন্য?" "এটা ভয়াবহ অন্যায়!" ইত্যাদি সব প্রশ্ন এবং তার সাথে ক্রমশ প্রচণ্ড ক্ষোভের জন্ম হয় আমাদের ভেতর।
একইসাথে লক্ষণীয়, আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু এই ঘটনাকে বাস্তব বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। অর্থাৎ আর কিন্তু আমরা Denial স্টেজে নেই।
এই পর্যায়ে মানুষ উত্তেজিত হয়ে ভাংচুর করতে পারে, কাউকে আঘাত করার চেষ্টা করতে পারে, এমনকি নিজের ক্ষতি করারও চেষ্টা করতে পারে। Click This Link
এই কারণেই খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, রোগী মারা যাওয়ার পর চিকিৎসককে আক্রমন বা তাকেই দোষারোপ করা। এটা সারা বিশ্বেই দেখা যায়। এমনকি উন্নত বিশ্বে এই ব্যাপারে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়ে থাকে (তবে আমি কোনভাবেই বলছি না ডাক্তারের ভুল থাকে না)।
(৩) দরকষাকষি (Bargaining): ক্রোধপরবর্তী স্টেজ হচ্ছে Bargaining। এ পর্যায়ে আমরা এই ক্ষতি, মৃত্যু বা loss এড়াতে বিভিন্ন রকম দরকষাকষি শুরু করি। সেটা হতে পারে নিজের সাথে, ডাক্তারের সাথে অথবা অন্য কারও সাথে। এ পর্যায়ে আমাদের মাথায় আসেঃ "আমার সব টাকা দিয়ে দেব এটা এড়ানোর জন্য!" "আমি আরও কিছু বছর বাঁচার জন্য যে কোনও কিছু করবো!"
একইসাথে কোনও ঘটনা ঘটার আগে কি কি করা উচিত ছিল এই ধরণের চিন্তা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে। যেমনঃ "যদি আরও আগেই ওই চিকিৎসা করাতাম!" "যদি ওইদিন তাকে গাড়িতে যেতে না দিতাম!", অর্থাৎ বিভিন্ন If Only জাতীয় চিন্তায় আমরা আছন্ন হয়ে পড়ি। (এ সময়েই দেখা দেয় বিভিন্ন ঐশ্বরিক শক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া বা মানত করা ইত্যাদি। ধর্ম ব্যবসাও তাই এইগুলো কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে।)
এটাও কিন্তু ব্যাখ্যা করা অসম্ভব না। এ পর্যায়ে আমাদের ব্রেইন চেষ্টা করে কোনভাবে এই ঘটনাটা reverse করতে। অর্থাৎ টাকা, ক্ষমতা ইত্যাদি দিয়ে কোনভাবে এই ঘটনা আটকানো যাবে বা যেত, এভাবে চিন্তা করা শুরু করে আমাদের মস্তিষ্ক।
(৪) হতাশা (Depression): এ পর্যায়ে বিশাল হতাশা আমাদের গ্রাস করে। "কি মানে জীবনের?" "কেন এই জীবন আমাকে টানতে হবে?" "তাঁকে ছাড়া আমার জীবনের অর্থ কি?" এই ধরণের সব প্রশ্ন আমাদের মনে ভিড় করে।
হতাশা বা ডিপ্রেশনের সব সিম্পটম-ই দেখা যায়। অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, আলস্য সবই দেখা যেতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া এ পর্যায়ে চিকিৎসার খরচ ও অন্যান্য বৈষয়িক ভাবনা দেখা দিতে পারে। এই সময়েই আপনজনের সান্নিধ্য এবং মানসিক নির্ভরতা খুবই দরকার।
এখানে মনে রাখা দরকার, লম্বা সময় ধরে চলে আসা হতাশার সাথে এই হতাশার কিন্তু পার্থক্য আছে। প্রিয় কারও মৃত্যু ইত্যাদি একটি অত্যন্ত হতাশাজনক ঘটনা এবং এ কারণে এ সময় হতাশা একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া মাত্র। বরং তা দেখা না গেলে অনেক সময় চিকিৎসকরা ধরে নেন, রোগী এখনো Denial স্টেজে আছে।
(৫) স্বীকার করে নেওয়া বা মেনে নেওয়া (Acceptance): এটাই হচ্ছে শেষ পর্যায়। এ পর্যায়ে আসলেই আমরা মেনে নেই বাস্তবতা। "আমি টিকে থাকতে পারবো।" "সব ঠিক হয়ে যাবে।" "মেনে নিয়ে আমাকে এগিয়ে যেতে হবেই!" - এ সবই এ পর্যায়ের চিন্তা। আর এই পর্যায়ে আসতে পারলেই একজন মানুষ এগিয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, বিভিন্ন স্টেজের ভিতর দিয়ে যাওয়াটা একটা ইভলুশনারি প্রক্রিয়া। এই পর্যায়ে গিয়ে আমরা আস্তে আস্তে টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করি।তা না হলে, বিভিন্ন ট্রমার পরে বেঁচে থাকা বা এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো।
এই ষ্টেজগুলির ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ
>> সবাই এই ষ্টেজগুলির ভেতর গিয়ে পর্যায়ক্রমে নাও যেতে পারে। অর্থাৎ আগে-পরে হতে পারে ষ্টেজগুলো। কেউ কেউ কোনও স্টেজ স্কিপও করতে পারে।
>> কে কোনও স্টেজ পার করতে কত সময় লাগবে তার একেবারেই কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই।
>> ড্রাগ অ্যাডিক্টদের জন্য ডিনায়াল একটি সাধারণ ঘটনা।
>> এই থিওরি আবিষ্কার হয়েছিল মৃত্যুপথযাত্রীদের (যেমন ক্যান্সার পেসেন্ট) উপর গবেষণায়। তবে বর্তমানে বাবা-মার ডিভোর্স থেকে শুরু করে ব্রেক আপ সব কিছুর ক্ষেত্রেই এই থিওরি প্রয়োগ করা হয়।
৩। ব্যাক্তিগত মতামতঃ
আমার মতে এই ৫টা পর্যায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, আরও বড় পরিসরেও দেখা যায়। যেমন তারেক মাসুদের মৃত্যু। মৃত্যুর পরে প্রায় সবারই প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল অবিশ্বাস।
তারপরেই দেখা গেল প্রচণ্ড ক্রোধ। ক্ষমতায় থাকা লোকেরাও জানে, এই স্টেজটির কথা। তারা অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সবাইকে নিয়ে আসতে হবে Acceptance স্টেজে। তাই কালক্ষেপণ থেকে আরও অনেক উপায়ে কিছু সময় পার করাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য থাকে। আসলেই কি আমরা এখন সবাই চলে এসেছি না তীব্র শোকের শেষ পর্যায়ে?
সবাইকে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।