ফিরে আসা আবার ইকো পার্ক ট্রেইলে- ১ম পর্ব
বালিঝুরি প্রবেশ করতেই পথের পাশে ছোট একটি চায়ের দোকানে বসে থাকা বালিঝুরির মেম্বার সোহরাব ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। তনময় ও আরিফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, গতবারের সঙ্গী হাসনুল ভাই, শহিদুল্লাহ ও আলমের সমন্ধে জানতে চাইল। তাঁর আতিথিয়তায় চা খেতে খেতে তাঁদের কুশল জানালাম। তিনি সেই রাতটা তাঁর বাড়িতে থাকার জন্য খুব অনুরোধ করলেন এবং পরদিন নিজে ও তাঁর ছেলে দুই মোটর সাইকেলে করে আমাদের মধুটিলা পৌঁছে দেবার আশ্বাসও দিলেন। অপারগতার কথা জানিয়ে আগামীতে কোন এক সময় শুধু তাঁর বাড়িতে বেড়ানোর আশ্বাস দিয়ে আবার রওনা হলাম গাজনির পথে।
সোমেশ্বরি নদীর ব্রিজ পার হয়ে তাওয়াকোচার দুই পাশের ঘন গজারি, সেগুন বিভিন্ন গাছের বনের ভিতর দিয়ে দ্রুত এগুতে আরম্ভ করলাম। সন্ধ্যার আগেই গাজনি পৌছাতে হবে। যদিও ঘড়িতে তখন প্রায় বিকেল ৫টা, বনের উঁচু উঁচু গাছের কারনে বিকেলের আলো অনেকটাই ক্ষীণ। মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামতেছে। আধ ঘণ্টা হাঁটার পর হটাৎ করে তনময় পায়ে ব্যাথা বলে বসে পড়ল। বাধ্য হয়ে ২০/২৫ মিনিটের জন্য আমরাও যাত্রা বিরতি করলাম। কিছুক্ষণ পা ম্যাসেস করে, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে অবশেষে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে আরম্ভ করল। আমরাও তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে খুব ধীরে ধীরে এগুতে আরম্ভ করলাম।
চতুরদিকে জোনাকির আলো আমাদের রাতের আগমনের বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে। অনেক, অনেক জোনাকি অন্ধকারে মুক্তার মতো জ্বল জ্বল করে ভেসে বেরাচ্ছে। অনেক দিন পর একসাথে অনেক জোনাকি দেখলাম, যতটুকু মনে পড়ে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে একসাথে এই রকম অনেক জোনাকি দেখেছিলাম। দুই পাশের ঘন বনের মাঝে পথের উপর জোনাকির উড়াউড়ি আমাদের অনেকটা পথের দিক নির্দেশনা দিচ্ছিল, টর্চের আলোর খুব একটা প্রয়োজন পড়ল না। ঘণ্টা খানেক পর আমরা একটা বড় কালভারটের উপরে এসে পৌঁছলাম। জিপিএসে দেখলাম যে আমরা তাওয়াকোচা, দুধনাই পার হয়ে ছোট গাজনির মঙ্গল ঝিরির কালভার্টের উপর অবস্থান করছি। চতুর্দিকে অন্ধকার আর ঠাণ্ডা বাতাস বইতেছে, নিচে ঝিরির পানি টলটল শব্দে নেচে চলেছে, আশেপাশে জোনাকি মিটমিট করে উড়ে বেরাচ্ছে। খুব সুন্দর একটা পরিবেশ। সাথে থাকা পলিথিনটা কালভারটের উপর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম কিছুক্ষণের জন্য। কানে পানির টলটলে ছন্দ আর চোখে জোনাকির মিটিমিটি আলো ছাড়া কিছুই নাই, বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে পার হয়ে গেল, মন ও শরীর দুটোই জুরিয়ে গেল। বনের উঁচু উঁচু গাছের উপর দিয়ে চাঁদ মামা উঁকি দিতে লাগলো, জোনাকির মিটিমিটি আলোয় দেখে মনে হচ্ছিলো আকাশের সব তারা গুলো নিচে এসে মিটিমিটি করে ভেসে বেড়াচ্ছে আর তার উপর চাঁদ ভেসে উঠতেছে। বাস্তবের ক্যামেরায় এই দুর্লভ মুহূর্ত কখনও বন্দী করা সম্ভব নয়, শুধু অনুভব করা যায়, তাই মনের ক্যামেরায় বন্দী করে রাখলাম। মনে হচ্ছিলো সারা রাতটা ওখানেই কাটিয়ে দেই। কিন্তু তনময় উঠে দাঁড়াল এবং বেরসিকের মতো সামনে এগোনোর জন্য তারা দিতে আরম্ভ করল। কি আর করা, উঠে তাই রওনা দিতে হল।
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা শীতল ঝিরির কাছে এসে পৌঁছলাম, বুজলাম গাজনি আর বেশী দূরে নয়। বনের এই দিকের গাছগুলো বেশ উঁচু উঁচু তাই চাঁদের আলো ঝিরির ধারে কাছে পৌঁছাতে পারে না। গাছের ছায়ায় ঝিরিটা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু পানির টলটল ছন্দ ঠিকই ঝিরির উপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকারে মধ্যে টর্চের আলোতে অল্প পানির ঝিরিটা পার হয়ে কিছুক্ষণ হেঁটেই বড় গাঁজনির ইকো পার্কে যাওয়ার পথের কাছে চলে আসলাম। তখন প্রায় সাড়ে ৭ টা চতুর্দিক অন্ধকার, নিরব ও নিস্তব্ধ। এই সময় ইকো পার্কে যেয়ে কোন লাভ হবে না, তাছাড়া থাকারও কোন ব্যাবস্থা ওখানে করা যাবে বলে খুব একটা আশাবাদী না। তাই রংটিয়া যাওয়ার সিধান্ত নিলাম এবং সোজা পথেই এগুতে থাকলাম।
চাঁদের আলো খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। চতুর্দিক নিরব ও নিস্তব্ধ বনের উঁচু উঁচু গাছের ছায়ায় জোনাকির আলোতে আমরা এগুতে থাকলাম। বনের এই দিকে পথটা কিছুটা উঁচু নিচু। কয়েকটা উঁচু নিচু পার হয়ে আমরা কিছুটা ফাঁকা সমতল জায়গায় এসে পৌঁছলাম। পাশেই একটা টংঘর চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ বিশ্রামের আশায় টংঘরে যেয়ে উঠলাম। পিঠের বোজাটাকে নামিয়ে গা হেলিয়ে দিলাম। কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি, আধঘণ্টার একটা ভাল ঘুম হয়ে গেল। তনময়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল, আবার রওনা দেওয়ার তাড়া। ঘড়িতে ততোক্ষণে প্রায় রাত সাড়ে ৮ টা।
সমতল জায়গাটা পার হয়ে একটু উচুতে উঠে আবার ঘন বনের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। তনময় ও আরিফ অনেকটা এগিয়ে গেছে, আমি কিছুটা আস্তে ধীরে এগুতে লাগলাম। চারিদিকে অন্ধকার ও নিস্তব্ধ, নিজের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না, যদিও ভয় পাওয়ার কথা কিন্তু মোটেও ভয় পাচ্ছিলাম না। কারন ঢাকাতে এই পরিবেশে হাটার সময় ছিনতাইকারীর এর আতঙ্কে অস্থির থাকতে হত যা ঐখানে ছিল না। একটাই ভয় সেটা হাতির আক্রমণ, কিন্তু সেটাও এই সময়ে না আরও কয়েক সপ্তাহ পরে ধান পাঁকা বা কাটার সময়ে। ভালই লাগছিল একা একা হাঁটতে, মনে হচ্ছিলো সম্পূর্ণ এই একাকীত্তের নীরব পরিবেশটা শুধুই আমার জন্য, এটা কারো সাথে শেয়ার করার জন্য না। মনে মনে নিঃসঙ্গতার একটা পরম তৃপ্তি অনুভব করলাম, যা কোন কাগজে কলমে বা কোন ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে হেঁটে চললাম। নিসব্ধতা ভাঙ্গিয়ে এক সময় দূর থেকে মোটর সাইকেলের আওয়াজ ও হর্নের মৃদু আওয়াজ কানে ভেসে আসতে লাগলো। বুজলাম লোকালয়ের অনেকটা কাছে চলে এসেছি। জিপিএসে দেখলাম গান্ধিগাও অবস্থান করছি। আর কিছুটা এগিয়ে গেলেই নকশি হয়ে রংটিয়া। কিছুক্ষণ হেঁটে গান্দিগাওয়ের শেষ প্রান্তে এসে বেইলি ব্রিজ পার হয়ে নকশি পৌঁছলাম। একটু দূরে তনময় ও আরিফ একটা মুদি দোকানে ছোট সাদা কাল টিভি দেখাতে ব্যাস্ত। আমাকে এগুতে দেখে তারাও সামনের দিকে পা বাড়াল। কিছুক্ষণ হেঁটে নকশি বিজিবি ক্যাম্প পার হতেই পিছন থেকে ডাক পড়ল। ক্যাম্পের সিকিউরিটি আমাদের পরিচয় জানতে চাইল। পরিচয় দিয়ে জানালাম যে আমরা গাজনি থেকে এসেছি এবং রংটিয়া যাচ্ছি। সে ক্যাম্পের একটু ভিতরে যেয়ে ডিউটি অফিসারকে জানাতেই সে সায় দিল, বাহিরে এসে আমাদের সাথে আলাপের কোন প্রয়োজনবোধ করল না। অতএব আমরাও আবার সামনে এগুতে আরম্ভ করলাম।
প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে আমরা রংটিয়া বাজারে এসে পৌঁছলাম। তখন প্রায় রাত ১০ টা, দু একটা দোকান ছাড়া বেশীরভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। একটা চায়ের দোকান খোলা পেলাম। চা খেতে খেতে দোকানওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম, আশেপাশে কোন মাঠ বা স্কুল আছে কিনা থাকবার জন্য। দোকানওয়ালা জানালেন বাজারের পিছনেই রংটিয়া স্কুল সেখানে থাকতে পারি। অনুমতির জন্য স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবকে খোঁজ করে জানতে পারলাম যে তিনি ঝিনাইগাদি উপশহরে থাকেন, হয়ত স্কুলের দপ্তরিকে বললেই সে কোন একটা ব্যাবস্থা করে দিতে পারবে। দোকানওয়ালা আমাকে দপ্তরির বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য তার দোকানের ৮/১০ বয়সী একটা ছেলেকে আমার সাথে যেতে বলল। তাঁকে আরও অনুরোধ করলাম বয়ে আনা খিচুড়ির প্যাকেটটি রান্নার ব্যাবস্থা করে দিতে। দোকানওয়ালা লোকটি আমাদের রান্নার ব্যাবস্থা করে দেয়ার জন্য আশ্বস্ত করে নিচেই ব্যাস্ত হয়ে পরলেন রান্নার জন্য। আমি তাঁকে খিচুড়ির প্যাকেট বুজিয়ে দিয়ে তনময় ও আরিফকে দোকানে রেখে দপ্তরির বাড়ি রওনা হলাম। দপ্তরিকে তার বাড়িতে পেলাম না, তার ছেলেকে সব জানাতেই সে বেড়িয়ে পড়ল বাবার খোঁজে, আমিও আবার ফিরে এলাম দোকানে। ততোক্ষণে দোকানওয়ালা লোকটি একজন মহিলাকে ডেকে এনে আমাদের খিচুড়ি রান্নার সব ব্যাবস্থা আরম্ভ করে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলের দপ্তরিও হাজির, তাঁকে সব জানিয়ে থাকার ব্যাবস্থা করার সাহায্য চাইতেই সে আশ্বস্ত করে তার সাথে স্কুলে যেতে অনুরোধ করলেন। প্যাকেটের গায়ে খিচুড়ি রান্নার প্রণালীটি পড়ে রান্নায় সাহায্য করার জন্য আরিফকে দোকানে রেখে আমি ও তনময় ব্যাকপেক ও তাঁবু নিয়ে দপ্তরির সাথে স্কুলে গেলাম। দপ্তরি স্কুলের দুইটি রুম খুলে দিলেন, আমরা একটি রুমে আমাদের ব্যাগপত্র রেখে গরমের কারনে খোলা মাঠে তাবুতে থাকাব ঠিক করলাম। অতপর দপ্তরিকে বিদায় জানিয়ে আমি ও তনময় স্কুলের মাঠে তাঁবু খাঁটিয়ে স্কুলের টিউবওয়েলের পানিতে ফ্রেস হয়ে আবার চায়ের দোকানে ফিরে এলাম। ততোক্ষণে রাত প্রায় পৌনে ১১টা, দোকানেও গরম গরম খিচুড়ি রেডি। সারাদিন পর তিনজনই বেশ গোগ্রাসে খেলাম, দোকানওয়ালাকেও আমাদের সাথে শেয়ার করতে বললাম, কিন্তু সে আগে আমাদের খাওয়া শেষ করতে বললেন। আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাঁকে খাওয়ার অনুরোধ করে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাবুতে রওনা হলাম।
ততোক্ষণে প্রায় রাত সাড়ে ১১ টা, জিপিএসে দেখলাম প্রায় ৩৩ কিমি পথ পারি দিয়েছি একদিনে। এইভাবে এগুতে থাকলে আর দুইদিনে অনায়াসে হালুয়াঘাট পৌঁছান সম্ভব এইভেবে আশ্বস্ত হলাম।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১২