somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প

১৯ শে আগস্ট, ২০১২ ভোর ৪:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকক্ষণ ধরেই নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে আছি । কখন এই যাত্রার শেষ হবে... বাস থেকে নামব । আজ অন্যান্য দিন থেকে ভীড় কম বলা যায় না কি না জানি না; ঢাকা শহরটা দিন দিন ক্যামন হয়ে যাচ্ছে চারিদিকে শুধু মানুষের ঢল। ছুটির দিনেও রক্ষা নাই। আজকেও বাসে বিন্দুমাত্র পা রাখার জায়গা নেই । গরম খুব বেশি পড়ে নি এটাই রক্ষা । অনেকেই বাদড় ঝোলা হয়ে আছে । আজ শুভ দিন কিনা কে জানে ? রাস্তার জ্যাম কম ছিল। মীরপুর ১০ নম্বর থেকে বাসে উঠেছি, ঠিক ঘড়ি ধরে ৪৫ মিনিট । এরকম ঝামেলামুক্ত ঢাকা দেখে আবার খটকা লাগে সব ঠিক আছে তো ?

শাহবাগে নেমেছি কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না । সত্যি বলতে হাতে বিশেষ কাজ নেই । ভাল করে বললে নিরুদ্দেশ যাত্রা । বাস থেকে নেমেই শরীরটা ঝাড়া দেই । শরীর ঘেমে স্যাত স্যাত করছে । বরাবরের মত পি.জি. হাসপাতালের চারপাশে অনেক ভীড় । মানুষের চোখে মুখে হতাশা, অপেক্ষা আর চরম ব্যস্ততা। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে,“জীবনের এত সংগ্রাম সংঘাতের মধ্যে এ অসুস্থতা মানুষকে পেছনে ফেলতে চায় । এত ঝামেলার মধ্যেও মানুষের বেঁচে থাকার এত প্রবল ইচ্ছা কেন ? তাকে তো মরে যেতেই হবে । এত আয়োজন কিসের জন্য তাহলে ?

সকালে কখনোই নাস্তা করি না, তবে চা সিগারেট খাই । আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি। রাস্তা পার হবার জন্য সিগন্যাল দিয়েছে কোন দিকে যাব এখনও ঠিক করিনি । সকাল দশটা কুড়ি এখন। দোকানদাররা তাদের ফুলবাগিচা সাজাচ্ছে । কেনার জন্য কেউ উপস্থিত হয়েছে বলে মনে হয় না । তবে এই পাগলামিটা আমি করেছি একসময় । এখানকার দোকানদার সজল ভাই আমার পরিচিত বলে রক্ষা পেয়েছিলাম ।

ঘটনাটা না বললেই নয় । অনন্যার আঁকা ছবিগুলো যাবে প্যারিসে । আমি একটা কাজে ছিলাম ঢাকার বাইরে । সজল জানে আমি শুনলে কাজ ফেলে চলে আসব তাই ও জানতে দেয়নি। সকাল সাতটায় ঢাকায় পৌঁছে শুনি এই সুসংবাদ । ঠিক ছুটে গিয়ছি ওর উত্তরার বাসার সামনে, হাত ভর্তি লাল গোলাপ সবগুলো যেন আনন্দে চোখে তাকিয়ে আছে অনন্যার মুখের দিকে শুধু একটু মুচকি হাসি দেখার জন্য । ও চোখ মুছতে মুছতে বারান্দায় এসেছে । এসে খালি বলল “তুমি-?”
-হ্যা ! এতবড় একটা খবর তুমি ওয়েট করলা কিভাবে ?
-আসলে আমি অনেক স্যরি !! স্যারদের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ক্যাম্পাসের সবাই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে ছিল । সামনের সপ্তাহে যেতে হবে প্যারিসে। বিশ্বাস করো সময় কিভাবে কাটছে বুঝতে পারছি না । স্যরি বাবা ! স্যরি,স্যরি,স্যরি! বলো,মাফ করেছ ??
-ফুলগুলো তোমার জন্য । তোমার কি বাইরে বের হওয়ার ইচ্ছে আছে ?
-এত সকালে তাজা ফুল কোথায় পাইলা ?
-সজল ভাইয়ের ঘুম ভেঙ্গে এনেছি । হা হা !
-তুমি কখনো বদলাবে না ।

কে জানি আমার প্যান্ট ধরে টানছে । মেজাজ খারাপ হচ্ছে ।
কিরে,কি চাস ?
-ভাইয়া ফুলের মালা নেন না । একটা মালা নেন ।
-আমি মালা নিয়ে কি করবো রে?
-কেন,আপারে দিবেন ।
- আপা তো চলে গ্যাছে দাম কত রে ?
-দুই টাকা একটা । আপনি এক জোড়া নেন তিন টাকা নিমু ।
-কেন রে ? আমার বেলায় কম যে । বকুলের মালা তো ভালই বানিয়েছিস ।
-মেয়েটা মুচকি হেসে বলল না ভাইয়া ,আফনি ফাষ্ট কাস্টমার তো তাই ।

আজকে চায়ের দোকানে যাব আরো পরে। বারোটার পর আড্ডা দেয়ার লোক পাওয়া যাবে। ভাবলাম রাস্তার ফেরিওয়ালা কারো কাছ থেকে কিছু কিনে ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বসব । পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে এক চাচাকে পেলাম। একটা গোল্ডলিফ আর প্লাস্টিকের গ্লাসে চা । ডিপার্টমেন্টের ফার্ষ্ট গেটটা পার হয়ে হাতের বামদিকে যাই লম্বা সিড়ি আর গাছের ছায়ায় বসি । খুব পরিচিত জায়গা। আমাদের চারু ও কারু কলা বিভাগ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ছোট অংশে এর অবস্থান হলেও,এই ভিন্ন্ জগতে সময় কাটানোর মজাই আলাদা । অনেক রঙ্গিন আর স্বপ্ন বিভোর সময় কাটে এখানে, জীবনের সব দু:খ ব্যস্ততাই ভুলে যাই কিছুক্ষনের জন্য ।
আমি গ্রাজুয়েশন করেছি বছর খানেক হয়ে যাচ্ছে,তবু নিজেকে সবসময় চারুকলার ছাত্র মনে হয়। এই ভালোবাসাটা হয়ত আসে ভেতর থেকে । সিগারেট শেষ করেই আবার একটু হাঁটব ভাবছি । রাস্তায় হাঁটারা আনন্দ কি সবাই পায় ? পেটে যখন ক্ষুধা,অসুস্থতা,এবং ব্যস্ততা । সব পথিক হাঁটার মজা পায় না । আসলে এটার মাঝে অসাধারণ কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে । রাস্তায় হাঁটলে পথের সাথে অনেক কথা হয়, আশে পাশের মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা যায়, ধুলোবালি আর গাছের সাথে যোগাযোগ হয়, ভাল একটা সময় কাঁটে তখন মাথায় অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর বের হয়ে আসে । বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারলাম না । কেন জানি মনে চাইল শহীদ মিনারটার কাছে কিছু সময় কাটাই । বসলাম,আবার সেই চা আর সিগারেটের ধোয়াঁয় । আজকে দুপুরে খাব কোথায় ? হোটেলে গেলেই হয়। না পকেটে যে টাকা আছে তাতে বাস ভাড়া হবে । না হলে, এখান থেকেই বাসায় হেঁটে যেতে হবে ।
হাতের কাছে একটা পত্রিকা ধুলোয় পড়ে আছে । এসব জায়গায় অনেক মানুষ আসে, বসে পত্রিকা পড়ে রেখে চলে যায় । পত্রিকা উল্টে পাল্টে দেখলে সময়টা খারাপ যায় না । হঠাৎ চোখ পড়ে “ডিজাইনার চাই” নামে বিজ্ঞাপন। যতটা আনন্দ পেয়েছিলাম তা মাটি হল যখন দেখলাম আবেদনের শেষ তারিখ.. হায় !! আসলে এই চাকরি গুলোতে আবেদন করাই কি সব? চাকরি তো হতে হবে । নইলে এত আয়োজন এত পরিশ্রম সব মাটি ।
প্রথমবার যখন যাই ইণ্টারভিউ দিতে অনেক আশা করে সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে গেলাম । ইন্টারভিউ শেষ করার পর বুঝলাম, আমি এখন জগৎ সংসারের কঠিনতম রাস্তায় আছি। ওখানে প্রথম পাঁচ মিনিট পর বুঝলাম আমার চাকরি হচ্ছে না। আসলে ওরা “ঘুষ”খেয়ে একজনকে চাকরি আগেই দিয়ে দিয়েছে,এখন শুধু দেখানো ইন্টারভিউ । সব বারই যে এক হয়েছে তা না । এক জায়গায় এক এক সমস্যা । কমার্শিয়াল যুগ, কেউ ছাড় দেয় না । কেউ মামা চাচাকে ধরে,কেউ ঘুষ দিয়ে, কেউ দুই নাম্বারি করে চাকরি জোগাড় করছে । তবে আমার যে সব বন্ধু ভাল কাজ জানত সবারই গতি হয়েছে ,একমাত্র আমি ছাড়া । কারো কারো স্কলারশিপও হয়েছে বিদেশে ।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটা লাইন মনে পড়ছে “ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,বড় ধরনের ইতিহাস ধরে না তাতে। দু একটা টিউশনি আর কিছু পত্রিকায় খন্ডকালীন কার্টুনিস্ট হিসেবে চলছে গত এক বছর ধরে । একবার চিন্তা করেছিলাম এ্যাড ফার্ম দিব বন্ধুরা মিলে কিংবা ফ্যাশন হাউজ । কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত একাই রয়ে গেলাম, যে ইনভেস্ট করতে পেরেছে বা ভাল গ্রুপ পেয়েছে ঢুকেছে। নিজের রাস্তা সহজ করেছে ।
মাথা খুব ব্যাথা করছে । তার আরো একটা কারণ আছে খুব খিদে লেগেছে । বাজে দু’টা । বসে বসে অনেকটা সময় কেটে গেছে খেয়ালই করিনি । ফুফুর বাসাটা একটু কাছে হলেই হেঁটে যেতাম । যেতে হবে শ্যামলী । পাভেলের কাছে গেলে কেমন হয় ? এই একটাই ভরসা যার কাছে র্নিলজ্জের মত সব কিছু বলে ফেলতে পারি । ওর ইন্টার্নি চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । হাজার হলেও স্কুল জীবনের বন্ধু। পাভেলের খোজেঁ রওনা হই। অনেক খোঁজাখুজির পর বাপধনকে খুজেঁ পেলাম ।
-“কিরে দোস্ত তোকে তো খাঁটায় মারতছে”
-আমার আর নতুন কি ? ঢাকা মেডিকেলে এই দশাই হবে । তোর খবর কি হঠাৎ এইদিকে?
বল কি হইছে, দুপুরে খাইছিস তো ? মুখ শুকনা কেন ?
-ভাল লাগতেছিল না আর কি ?
-আরে চল দুই বন্ধু জটিল একটা খাওয়া দিয়ে আসি । তোর বাসায় সবাই কেমন ? আন্টি আপু কেমন ?
-আছেরে ভাল । তবে আব্বার শরীরটা ভাল না । বিছানায় পড়ে আছে ।
-তোরে বলছি না এখন আরাম করবে। এই বয়সে শারীরিক সমস্যা একটু হবেই । মন ভাল থাকলে সব ঠিক । তুই খালি খালি চিন্তা করিস ।

আমরা রিকশায় করে আমাদের অতি প্রিয় মতি ভাইয়ের দোকানে খাইতে যা্ই । পুরানো ঢাকার ওই রান্না মায়ের হাতের পর সেকেন্ড বেস্ট । রিকশা্য় চড়তে ভালই লাগে যদি রাস্তা ফাঁকা হয় । খুব ফাঁকা না হলেও আরামেই পৌঁছলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে পাভেল ছুটছে হাসপাতালে আবার । আমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে বরাবরের মত ভাড়াটা দিয়ে গেছে রিকশাওয়ালাকে । বলেছে- “ওকে শাহবাগের মোড়ে নামিয়ে দেবেন” –বন্ধু আমার সে কি কান্না ঠিক কয়েক মাস আগেই । আন্টি অনেক অসুস্থ ছিলেন ,আনা হল রাজশাহী থেকে ঢাকায় । আমার এখনোও মনে আছে আন্টি কতো যত্ন করে আমাদের তুলে খাওয়াতেন । ঢাকা মেডিকেলে শেষ বারের মত আন্টিকে দেখি । সেই সময় সান্তনা দেয়ার ভাষাটুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য ।এতবড় ছেলে হাউমাউ করে কান্না করল বাচ্চাদের মত । নিজে এপ্রন পড়ে নিজের মাকে হাসপাতালে মারা যেতে দেখেছে । আসলে কোন কোন পরিস্থিতিতে মানুষের কিছুই করার থাকে না । না হলে পাভেল তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করত তার মাকে আটকে রাখার জন্য। তিনি ছাড়া পাভেলের আপনজন আর কেউ নেই। সব আত্নীয় আমেরিকায় থাকে। এই একটা ছেলেকে কাছ থেকে দেখেছি,যার আমেরিকান পাসপোর্ট কিন্তু একবারের জন্য দেশ ছাড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও নেই ।
চায়ের দোকানে বসে আছি অনেক সময় হল । পাভেলকে বলেছিলাম সময় করতে পারে নি । নিলয় আর শফিক এসেছে । নিলয় একটা GSM কোম্পানীতে চাকরি করছে । শফিক আমার মতই ভবঘুরে।
-কিরে বাকী একটাকেও তো দেখছি না, সব ব্যস্ত নাকি ?
-নিলয়: মামা চাকরীর ঠেলা তো লাগেনি বুঝবা না । একটু ফাঁকা নাই....... জীবন শেষ । কি লাইফ কাটাইছি আর এখন …
-শফিক : দোস্ত কাইল একটা বাউল কনসার্ট আছে । বাট নতুন একটা মিউজিশিয়ান কম্পোজ করেছে গানগুলা। ফাটাফাটি ! নেট থাইকা শুনলাম ।
-নিলয় : তোগো দোস্ত টাইম হবে । আমি এখানে জাস্ট এক ঘন্টার লাইগা আইছি। মাস্টার্স করার জন্য দেশের বাইরে যাব । মেলা পেইনের মধ্যে আছি, কিছু সামলায় ঊঠতে পারতেসি না।
-ভালো তো ব্যাটা । বুয়েট থেকে পাস করা পোলাপাইন যদি দেশের চাকরি না করস, মেধা তো যাইব গা । তেমন আনন্দে থাকাও আজকাল কঠিন হয়ে গ্যছে রে।
-নিলয় : ব্যাপার তো জানস না । পাগলের মত খাটি । স্যালারি বেশি না । বলে যে নতুন ঢুকছ কয়েক বছর চাকরি কর,দেখব। আরে অ্যামনে কতদিন ।
-শফিক : দোস্ত আমি তো চাকরীই পাই না । তুই আবার পাইয়া কস ভালো না ।
সন্ধ্যার সময় মেঘ ডাকছে । বৃষ্টি নামবে বোধহয় । ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমাদের আসর ভাঙ্গে । একসময় ছিল যখন কি ঝড় বা বৃষ্টি আমরা পনের-বিশজন এখানে স্বপ্নে বিভোর । জীবনের ব্যস্ততায় সময় আমেদের আলাদা করে দিয়েছে । এক শহরে থেকে সবাই অনেক দূরে, কেউ কাউকে ছুতে পারি না । শুধু স্মৃতি পড়ে থাকে ।
আবার ছুটতে হবে,বাস ধরতে হবে তাড়াতাড়ি না হলে বৃষ্টির সময় বাস পাওয়াই কষ্ট হবে । চারুকলার পাশ দিয়ে যেতেই মনে পড়ে পুরোনো দিনের কথা । কতো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি,কখনো পহেলা বৈশাখ,পহেলা ফাল্গুন, বিভিন্ন বিশেষ দিনগুলো নিজের হাতে অনুষ্ঠানের প্লান করেছি,স্টেজ সাজানো এবং উপস্থাপনা করেছি । কত সময় কেটেছে কবিতা মজলিসে, জল রং আর প্যাস্টেলে, গাছের ছায়ায় ছোট ক্যানভাসে । এখন দূরে রোদ ছায়ায় খেলা করে ফেলে আসা সময়গুলো ।
কাল বিন্দুর জন্মদিন । আমার থেকে বয়সে বড় হলেও এখনো আমার ছোট্ট আপু । গতবার জন্মদিনে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তাকে উয়িশ করতে । রাতে ফেরার পর আপু বলে, “তোর জন্য চটপটি করে রেখেছি, ঠান্ডা হয়ে গেছে, গরম করে দেই” আমার খুব পছন্দের খাবার চটপটি । মাকে বললাম,“কি ব্যাপার?” মা আমাকে বলেন,“আজকে তোর ছোট আপুর জন্মদিন” আমি সেদিন আপুকে বলেছিলাম,“এই তো ভার্সিটি শেষ করেছি । তারপর চাকরি করব । তোকে নিয়ে সামনের জন্মদিনে অনেক ঘুরব, রাস্তায় দাড়িয়েঁ দুজন ফুচকা খাবো, একটা গিফট কিনব, ঠিক আছে? তারপর একটা রাজপুত্র দেখে তোর বিয়ে দিব।”আপু খালি হাসে । আসলেই ওর বিয়ের একটা ব্যবস্থা করা দরকার । কতদিন আর বাসায় থাকবে? মেয়েদের তো বিয়ে করতেই হবে ।আমাকে বলে,“ভাইয়া তোর যেদিন চাকরি হবে,সেদিনই বিয়ে করব। দেখিস তুই।”
অবশেষে বাসে উঠেছি, খুব খারাপ অবস্থা একফোটা জায়গা নেই পা রাখার । এই প্রচন্ড ভীড়ে কেন অনন্যার কথা মনে হচ্ছে ? ও পাশে নেই তো ? কীভাবে থাকবে ? একটা সময় যখন ক্লাস শেষ করে দুজন উত্তরা যেতাম ।আমি যেতাম শুধু ওকে বাসায় পৌছে দিতে । বাসে দুজন দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করতাম । বাসের অন্য সবাই এমনভাবে তাকাতো যেন এখনই নামিয়ে দিতে পারলে খুশী হত ।আমরা দু’জন আরো হাসতে থাকি মুখ চেপে রেখে । সারাটা পথ সবাইকে বিরক্ত করেছি । ও বিয়ে করে ভা্লই করেছে । করবেই বা না কেন? আমার জন্য কত অপেক্ষা করবে, কতবার ঘর থেকে বের হয়ে আসবে? আমি তখন ৩য় বর্ষের ছাত্র । বাবার পেনসনের পয়সায় সংসার চলে। ওই মুহুর্তে বিয়ে করার মত দু:সাহস আমার ছিল না। বড় ব্যবসায়ীর মেয়ে অনন্যা । ও শুধু আমার সাথে থাকার জন্য বাসে করে বাসায় ফিরত । উচ্চাভিলাসীতা যে পাহাড়ের চূড়ায় ওর অবস্থান, আমি নিতান্তই অসহায় সেখানে । আমার সব বন্ধুরা বলেছিল তোরা খালি বিয়ে কর, আমরা বাকিসব দেখব । অনন্যার জন্য আমেরিকান পাত্র দেরী করতে রাজী না । অনার্স এর বাকীটুকু দরকার হলে আমেরিকায় হবে । সে মুহূর্তগুলো আমি যে ভিতর থেকে কতটুকু কষ্টে সামলেছিলাম, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না । দীর্ঘ তিন বছরের এতগুলো স্মৃতি নিয়ে সম্ভবপর স্তব্ধ নির্বাক হয়ে থেকেছি । ওর সাথে আমি শেষ দেখাটাও করতে যাই নি । গেলে হয়তো ওর চোখের দৃষ্টি, হাতের স্পর্শ আমায় ফিরে আসতে দিত না । আমাকে তখন নিষ্ঠুর হতে হয়েছিল অনেক ভেবেছি .. মনে হয়েছে যে, এটা এখন সম্ভব না ; কখনোই না । তবে অপরাধবোধে ভুগেছি অনেক ।
হঠাৎ আবিস্কার করি, আমি বাস থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি, বৃষ্টির পানির ছোয়া আমায় জাগিয়ে তোলে । কেমন যেন লাগছে, মনে হচ্ছে অনন্যা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে । বলছে -“অ্যাাই ” কথাটা কেন এত স্পষ্ট ?
আমি হাঁটতে শুরু করি । আব্বা আম্মা নিশ্চয়ই আমার জন্য অপেক্ষা করছে । ছোট আপু আমাকে রেখে কখনোই খায় না, যতো রাতই হোক । ওর জন্য হলেও বাড়ি ফিরতে হয় ।
বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমেই বড় হচ্ছে । তুমুল বেগে বর্ষা নামছে । বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । আমার চোখে কেন জ্বালা পোড়া করছে ?? কি হল ? আমি কাঁদছি কেন, কার জন্য ? প্রতি মাসে যখন বাবার মার জন্য কয়েক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়, তখন তার মলিন মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে.... আমি বাবার হাতে কখনোই টাকা তুলে দিতে পারিনি । বাবা বলেন,“তুই ছেলে মানুষ,পরে দিস যখন চাকরি করবি” এই ছেলেমানুষী আর কতকাল আটকে রাখবে। মা তো মুচকি হেসে আমার সমস্ত কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়। কাল ছোট আপুর জন্মদিনে আবার আমাকে প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গতে হবে। আমি হাঁটতে থাকি । প্রচন্ড বর্ষায় আমার চোখের পানি বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যায় । এভাবে আমিই নই অনেকই বোধ হয় হাঁটছে অতৃপ্ত জীবন পথে । অন্ধকারে ডুবে গেছে শহর,কারেন্ট নেই । আমার পায়ের গতি বাড়ছে, দ্রুত গতিতে হেঁটে চলছি আমি । কিন্তু এই পথের শেষ কোথায় ?? আমি তো জানি না ....

[ আমার এই গল্পটা বাংলাদেশের সকল বেকার যুবকদের জন্য যারা প্রতিনিয়ত হতাশাভরা জীবন কাটাচ্ছে। আমাদের সমাজেরই শক্তি এরা, তবে কেন এরা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে ?
আমাদের কি কিছুই করার নেই??
রাতের রাস্তায় অনেক লাইটপোস্ট স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। লাইটপোস্টের মৃদু আলোয় কিছুটা অন্ধকার দূর হয় এটাই আমাদের স্বপ্ন আর ভোরের আলোতে শুরু হয় জগতের নিষ্ঠুরতা। শুরু হয় স্বপ্নভঙ্গের গল্প... ]
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একজন মানুষের মূল্য কত?

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:২২

একজন মানুষের মূল্য কত?
প্রশ্নটি ব্যঙ্গার্থে হলেও, বৈজ্ঞানিকের চোখে এ প্রশ্নটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে- সেই প্রসঙ্গে না যাই।

মাথাপিছু আয় বাড়ে, দ্রব্যমূল্য বাড়ে, মূদ্রাস্ফীতি বাড়ে। কিন্তু এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাধু সাবধান! দেশে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে পলাতক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী অপশক্তি!

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:০৬

সাধু সাবধান! দেশে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে পলাতক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী অপশক্তি!

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ কর্মসূচির মিছিল, প্রথম আলো অনলাইন থেকে সংগৃহিত।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, লুটপাট, ভাংচুর এবং বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের কেটে কুচিকুচি-নিরাপত্তা চায় ভারত

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


বর্তমানে ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ ৮৭০,০০০টি যার আয়তন ৯৪০,০০০ একর বা ৩,৮০৮ বর্গ কিমি জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং এস সম্পত্তির মোট মূল্য ১,০০,০০০ কোটি রুপি বা ১২ বিলিয়ন মার্কিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকান কোম্পানিতে ভাংচুর ও ড্যফোডিল ইউনির শিক্ষিকা চাকুরিচ্যূত করায় কাদের উপকার হচ্ছে ?

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১১





ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে গতকাল দেশব্যপী বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ফেসবুকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহন করার পোস্টগুলো দেখে মনে একটা শংকা তৈরী হয়েছিল যে, এই উপলক্ষে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিডনী রোগ নিয়ে ব্লগার গণ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও সাজেশনস জানাবেন।

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৮ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:৩২






আমার খুব কাছের (রক্তের), বয়স ৪৭, একজনের কিডনী সমস্যা ধরা পড়ে গত বছর জুলাইয়ে,তখন ক্রিয়েটিনিন ছিলো ৪.৩৩ ; পরে শরীর খারাপ হওয়ায় মেডিকেল ভর্তি থেকে ঔষধ সেবন করে ক্রিয়েটিনিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×