বিএনপি-জামাতের ঐক্য যে আওয়ামী লীগ শাসনামলের কোনো এক সময়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে, তা রাজনীতির সাধারণ বুঝ থেকে অনুমান করতে একটুও অসুবিধা হচ্ছিল না। তবে কখন, কোন ইস্যুতে, কিভাবে হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত কিছু বলার ক্ষেত্রে সমস্যা তো ছিলই। বিএনপি-জামাত জোট সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতা-অপকর্ম-দুষ্কর্মের খেসারত দিতে গিয়ে বিগত নির্বাচনে ভরাডুবি ও বিধ্বস্ত হয়। এতে বিশেষভাবে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি ও জামাত সর্বৈব পরাজয়ের জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করে। বিএনপির তৃণমূলের নেতাদের পক্ষ থেকে বলা হতে থাকে, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নেয়ার কারণে বিএনপির জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। আর জামাতের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে হাওয়া ভবনের দুর্নীতির প্রশ্নটা তোলা হয়। একপক্ষ ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এর ভাবমূর্তি আর অন্য পক্ষ ‘সৎ লোকের’ ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামাত আমির গোলাম আযম গংদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা হয়েছে বলেও জানা যায় না। এখন যতোটুকু জানা যায়, হরতাল কর্মসূচি সামনে রেখে মূলত খালেদা জিয়ার উদ্যোগেই বিএনপির সঙ্গে জামাতের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
একটু খেয়াল করলেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, বিএনপি ও জামাতের মিলন ও বিরহের পালাবদলের খেলা ধারাবাহিকভাবেই চালু রয়েছে। জরুরি আইন চালুর সময়ে খালেদা জিয়ার পুরো পরিবারসহ বিএনপি যখন চরম দুর্বিপাকের মধ্যে, তখন জামাত সুকৌশলে বিএনপি থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। জরুরি আইনের শেষ পর্যায়ে জামাত নেতাদের নিয়ে যখন টানাটানি শুরু হয়, তখন আবার দুই দল কাছাকাছি আসে। আর নির্বাচনের সময় তো দুই দল ৪ দলীয় জোট করে এক সঙ্গেই নির্বাচনে নামে। প্রকৃত বিচারে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় থাকাকালীন তারেক জিয়া পরম আহ্লাদে জামাতকে আত্মীয় বলে সম্বোধন করে বুকে বুক জড়িয়েছিলেন। এই কথাটাই হচ্ছে সর্বৈব সত্য। ভাবাদর্শগতভাবে এই দুই দল পরস্পরের বন্ধনে আবদ্ধ। তাই বলা যায়, সময় সময় যে বিএনপি ও জামাত দল দুটোতে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তা মান-অভিমান কিংবা রাজনৈতিক কৌশলজাত। রসুনের মতোই দুই দলের গোড়া ও আগা এক জায়গাতেই রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বিএনপির আবির্ভাব আর জামাতের পুনরায় আবির্ভাব একই সময়ে হয়েছে। সামরিক ফরমানে রাজনৈতিক দলবিধি ঘোষণা করে সেনাশাসক জিয়া যেমন নিজের দলে প্রতিষ্ঠা করেন, তেমনি সংবিধান সংশোধন করার প্রেক্ষিতে জামাতও রাজনৈতিক দল হিসেবে লাইসেন্স পায়। জামাতকে দল করার পুনরায় সুযোগ করে দেয়ার পেছনে সেনাশাসক জিয়ার যে পরিকল্পনা ছিল তা যেমন সুদূরপ্রসারী, ঠিক তেমনি তাৎক্ষণিক। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের মূল চেতনা, যা সংবিধানের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তাকে নস্যাৎ করে পাকিস্তানি আমলের দ্বিজাতিতত্ত্বের চেতনাকে বাস্তব অনুযায়ী যথাসম্ভব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য থেকে যেমন মুসলিম লীগের নব্য সংস্করণ ি সেবে বিএনপি গঠন করা হয়; ঠিক তেমনি জামাতকেও দল করার অধিকার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশকে পুনরায় ‘মিনি পাকিস্তানে’ রূপান্তরিত করার দুরভিসন্ধি এর পেছনে কাজ করে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের মাত্র ৫ বছরের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী দল ও ব্যক্তিদের দল গঠনের অধিকার দিয়ে সেনাশাসক জিয়া প্রকৃত অর্থে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, যার উদ্দেশ্য ছিল একদিকে মূলধারার রাজনীতিকে কোণঠাসা করা আর অন্যদিকে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা।
ইতিহাসের বিচারে সেনাশাসক জিয়ার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম বড় অপরাধ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের দল করার অধিকার প্রদান করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় অপরাধকেই গৌরবান্বিত বা গ্লোরিফাই করা হয়ে থাকে। জিয়া নাকি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা! সামরিক আইনের মধ্যে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে দলটিকে লাইসেন্স দিয়ে দল করার প্রক্রিয়াকে যদি বলা হয় গণতন্ত্র; তবে বোধকরি গণতন্ত্রের সংজ্ঞাকেই করতে হয় পরিবর্তন। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে দল করতে অধিকার দেয়া তো গণতন্ত্র হতেই পারে না। বস্তুতপক্ষে জামাতকে দল গঠন করার উপরোল্লিখিত সুদূরপ্রসারী কারণ ছাড়াও রয়েছে আশু রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কারণ। জনগণের রায়ের মাধ্যমে নয়, ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারসাম্য সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত-নিরঙ্কুশ-চিরস্থায়ী করা ছিল সেনাশাসক জিয়ার উদ্দেশ্য। আওয়ামী লীগকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও কোণঠাসা করে যদি বিএনপির বাম দিকে অবস্থান গ্রহণ করাতে হয়, তবে ডান দিকে দল ও শক্তির অবস্থান গ্রহণ করানো তার প্রয়োজন ছিল। এই আশু রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকেও জিয়া জামাতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। বামকে ডানের সঙ্গে আর ডানকে বামের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে নিজে ভারসাম্যমূলক ও নিরাপদ অবস্থানে বসে মজা লুটা ছিল জিয়ার আশু উদ্দেশ্য।
তদুপরি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য জিয়ার প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর। দলের মধ্যে তিনি যেমন বাম সুবিধাবাদীদের নিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য ডান সুবিধাবাদীদের নেয়ার প্রয়োজন ছিল। জামাতসহ সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধাপরাধী দলগুলোকে দল গঠনের সুযোগ না দিয়ে জিয়া যদি এদের নিজ দলে সংঘবদ্ধ করতেন, তবে কিন্তু জনগণকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ তিনি পেতেন না। যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের নিজ দলে নেয়ার জন্যও জামাত ও মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলকে লাইসেন্স প্রদানের প্রয়োজন ছিল। আসল সুবিধাবাদীদের আলাদা করে দলে নেয়ার লক্ষ্য থেকেই তা করতে হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, সেনাশাসক জিয়া যদি জামাত, মুসলিম লীগকে দল গঠনের সুযোগ না দিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করতেন এবং সকল যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার-আলবদরদের যদি দলে নিয়ে নিতেন, তবে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে তার ভাবমূর্তি সামনে রাখতে পারতেন না।
এতোটা আশু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জিয়া জামাতকে দল গঠনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন যে তা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা কথা আছে যে, রাষ্ট্রপতি জিয়া কখনো জামাতের সঙ্গে ঐক্যজোট করেননি, ঐ দলটিকে ক্ষমতাসীনও করেননি। এটা করেছেন খালেদা জিয়া। ঘটনাপ্রবাহ বিবেচনায় তা সঠিক। জিয়া জামাতকে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জামাতকে নিয়ে খেলে মূলধারার রাজনীতিকে নির্বাসিত করে নিজে মূলধারার নায়ক বনতে চেয়েছিলেন। সামরিক বাহিনী যেহেতু তার রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত-নিরঙ্কুশ-দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ছিল, তাই জামাতকে তার জোটসঙ্গী হিসেবে নেয়ার প্রয়োজন ছিল না। এই শক্তি জিয়ার পেছনে থাকার কারণেই জামাতকে তিনি তার রাজনৈতিক খেলায় ব্যবহার করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছিলেন। তবে জামাত ঐ অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে থাকতে চাইবে কেন? আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য যে দলটির জন্য অবারিত, সেই দলটি খেলার ঘুঁটি হয়ে থাকতে চাইবে কেন? সে দল চাইবে সরাসরি খেলতে। বস্তুতপক্ষে জামাত প্রাপ্ত সুযোগের যথাযথ সদ্ব্যবহার করে নিজের শক্তিকে সংহত করতে তৎপর থাকে। এদিকে বিএনপিও আর ক্ষমতাসীন দল থাকে না। প্রত্যক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর সমর্থন বিএনপির ওপর থেকে উঠে যাওয়ার অর্থাৎ বিএনপি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি-জামাত আন্তঃসম্পর্কের উপরোল্লিখিত প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
দেশে দ্বিতীয় পর্বের সামরিক শাসন শুরু হয়। এই পর্বে জামাত প্রাপ্ত সুযোগের সম্পূর্ণটা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে। সামরিক সমর্থন হারিয়ে বিএনপিও আর এক নম্বর দল হিসাবে থাকতে পারে না। এই পর্যায়ে জামাতকে সঙ্গে না রেখে বিএনপির উপায় থাকে না। তবে প্রাপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামাত সুকৌশলী হয়ে ওঠে এবং শক্তি ও সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজেকে জাতে উঠানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের মধ্যে গণতন্ত্র তথা ভোটের রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তনের আন্দোলনকে সফল করার জন্য সকল বিরোধীদলের ঐক্য করার অপরিহার্যতা জামাতকে জাতে ওঠার সুযোগ করে দেয়। জামাত ভেবেছিল, কোনোক্রমে যদি মূলধারার জোট ১৫-দল তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন কিংবা একমঞ্চের আন্দোলনে থাকা যায়, তবে যুদ্ধাপরাধী কিংবা রাজাকার-আলবদরদের দল হিসেবে তার কলঙ্ক ও দুর্নাম ঘুচে যাবে। জামাত এই কৌশল নিয়ে ধোয়া তুলসিপাতা হয়ে যাবে বলে মনে করেছিল। আশির দশকে এরশাদ স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে এবং নব্বুইয়ের দশকের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার আন্দোলনের ভেতর সুকৌশলে অংশগ্রহণ করে জামাত ভেবেছিল কলঙ্ক ও অপরাধের দায় বুঝি মোচন করা সম্ভব হলো। বিএনপিও ভেবেছিল, জামাতের দায়মুক্তি হয়ে গেছে। তাই সরাসরি জোট করতে অসুবিধা নেই।
এইভাবে বিএনপি-জামাত আন্তঃসম্পর্ক তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে। বিএনপির আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠে জামাত। বিএনপির সঙ্গে জামাতের ঐক্য হয়ে ওঠে বাস্তব এক বিষয়। দূরত্ব কখনো যদি সৃষ্টি হয়, তবে তা মান অভিমানের কিংবা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে লোক দেখানোর জন্য করা হতে থাকে। প্রকৃত বিচারে জিয়া যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামাতকে দল করার সুযোগ দেন, সেই উদ্দেশ্য যে কয়েক দশক পর আজ ভিন্নরূপ নিবে অর্থাৎ বিএনপি যে জামাতের সঙ্গে ঐক্যজোট করতে বাধ্য হবে, তা দুইয়ে দুইয়ে যোগফলের মতোই ভবিতব্য ছিল। পাপ ও কলঙ্ক, সংকীর্ণতা ও অন্ধত্ব, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রতাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে খেলতে চাইলে তা যে একদিন বিষধর শক্তিশালী সাপ হয়ে ছোবল দিয়ে লালন-পালন কর্তাকেই আঘাত করবে, তা ইতিহাসই বলে দেয়। যে জামাতকে নিয়ে বিএনপি খেলেছে, সেই জামাত আসলে এখন বিএনপিকে নিয়ে খেলছে। আর এই খেলায় পড়ে বিএনপিকে এখন যুদ্ধাপরাধী দলের কলঙ্ক সরাসরি ঘাড়ে নিতে হচ্ছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার দেলোয়ার বলেন যে, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার আমরাও চাই তবে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে করতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যেন তা না করা হয়।’ যুদ্ধাপরাধী দল ও আলবদর-রাজাকার নেতাদের সঙ্গে ঐক্য করে, আন্দোলনে তাদের সাহায্য চেয়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমরাও চাই’ বলাটা কৌতুক বিবেচিত হতে বাধ্য। বিএনপি জনগণকে হয় অন্ধ নতুবা বোকা ভাবে কিন্তু জনগণের কাছে হয়ে যায় ভাঁড়। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জামাতের আলবদর-রাজাকার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে পুনরায় প্রমাণ করে দিলেন, যুদ্ধাপরাধী জামাতের প্রকৃত রক্ষাকর্তা হচ্ছে বিএনপি। এই অভিযোগ ও দায় থেকে বিএনপির রক্ষা পাওয়ার আর কোনো উপায় নেই। বিএনপি এখন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিন অভিযোগে অভিযুক্ত। প্রথমত: যুদ্ধাপরাধী দল ও ব্যক্তিদের দল গঠনের অধিকার দেয়া। দ্বিতীয়ত: এদের ক্ষমতাসীন দল করে গাড়িতে-বাড়িতে পতাকা ওড়াতে দেয়া তৃতীয়ত: জাতি যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দোরগোড়ায় তখন তাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে বিচারে বাধা প্রদান করা।
প্রকৃতপক্ষে বিএনপি নিজেকে বিধ্বস্ত ও ছত্রখান অবস্থা থেকে পুনরুত্থান ঘটাতে জামাতকে সঙ্গে চায় আর তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এজন্য বিএনপির পক্ষ থেকে তথ্যপ্রমাণের কথাটা তোলা হচ্ছে। খন্দকার দেলোয়ার বামপন্থী রাজনীতি করতেন, পরে বিএনপি করছেন, ‘সুপুত্র’ পবনের পিতা তিনি, এসব কি তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয়! গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদী-সাইদী গংরা যে হানাদার পাক বাহিনীর সহায়তা করেছে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, লুটপাট-হত্যা-অগ্নিসংযোগÑধর্ষণের মতো পাপ কাজ করেছে, তার প্রমাণের জন্য কী তথ্যের প্রয়োজন আছে! তবে এজন্য বিএনপির মাঠ গরম করার প্রয়োজন নেই। যথাযথ প্রমাণও রয়েছে এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই বিচার হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, তাই তার কাছে হয়ত যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের তথ্য প্রমাণ নেই। কিন্তু তখনকার বামপন্থী নেতা খন্দকার দেলোয়ারের কাছে তথ্যপ্রমাণ থাকবে না, এটা কেমন কথা! খন্দকার দেলোয়ার সেই সময়ের কথা স্মরণে আনলেই তো হয়। নাকি অতীত সব ভুলে বসেছেন রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে!
কথায় বলে, কাচের ঘরে বসে ঢিল দেয়া আত্মহননের নামান্তর। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নাকি বিচার করা হবে? এটা বলার আগে বিএনপিকে জবাব দিতে হবে, কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৪ বছর জামাতকে দুধকলা দিয়ে পোষা হয়েছে। গাড়িতে-বাড়িতে জাতীয় পতাকা পর্যন্ত তুলতে দেয়া হয়েছে। আর এখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে জামাতকে ডেকে আন্দোলনে মাঠে নামতে অনুরোধ করা হচ্ছে। জামাতের যুদ্ধপরাধী নেতারা এবং দলটি যখন উঠবে উঠবে করছে বিচারের কাঠগড়ায়, তখন দলটিকে মাঠে নামতে প্ররোচনা দেয়া হচ্ছে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে? রগকাটা দল, যে দল বলেছিল ‘বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’ যে দল একদিকে যুদ্ধাপরাধী আর অন্যদিকে উগ্র জঙ্গিবাদীদের আশ্রয়স্থল, সেই দলকে মাঠে নামতে অনুরোধ করার অর্থ কী? ক্ষমতায় পুনরায় আরোহন যদি হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, তবে জামাতের সঙ্গ-পথ ছাড়া কি বিএনপির গণতন্ত্রসম্মত পথ নেই। একদিকে অরাজকতা-নৈরাজ্য আর অন্যদিকে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের চরম ভ্রান্তি-ক্ষতিকর-সর্বনাশা পথ ছাড়া কি অন্য পথ আর বিএনপি দেখতে পায় না। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি ঐ পথ দেখতেও পাবে না, কারণ ঘোলা পানিতে মৎস্য শিকার করে করেই বিএনপি দলটি এ পর্যন্ত প্রতিটিবার ক্ষমতাসীন হয়েছে।
বিএনপি এবারে কিন্তু আরো একটি সুযোগের অপব্যবহার করলো। প্রথমবার রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার পর বিএনপি সুযোগ পেয়েছিল, রক্তাক্ত-ঘৃণ্য হত্যা ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পথ পরিত্যাগ করে সঠিক পথে আসার। সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও জনগণ জিয়া হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। ঐ সুযোগ বিএনপি সদ্ব্যবহার করা দূরে থাক, তখন আরো ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত পথে গেছে বিএনপি। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েছিল গৌরবময় আন্দোলনের অংশীদার হয়ে ’৯১-এর নির্বাচনে বিজয়ী হতে পেরে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের সহনশীলতা ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার পথে বিএনপি যায়নি। ’৯৬-এর একদলীয় নির্বাচন করে দলটি ঐ সুযোগের কবর দিয়েছিল। তৃতীয়বার বিএনপি-জামাত জোটের দুঃশাসনের পটভূমিতে জরুরি আইনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা সুযোগ করে দিয়েছিল বিএনপিকে সঠিক পথে চলতে। বিএনপি কিন্তু অভিজ্ঞতার আগুনে পোড় খেয়ে এবারে গণতন্ত্রসম্মত পথে ঘুরে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু ইতিহাসের তৃতীয় সুযোগও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর দল বিএনপি গ্রহণ করলো না। নিঃসন্দেহে এটাই জাতির জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। ইতিহাস বলে, ইতিহাসে কোনো দল বা জাতির জন্য সুযোগ আসে ঘুরেফিরে। ঘটনা প্রবাহ রেখে যায় অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা। সেই অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা প্রথমবার না নিলে তা হয় বোকামির নাটক। দ্বিতীয়বার না নিলে হয় প্রহসনের নাটক। আর তৃতীয়বার না নিলে হয় বিয়োগান্তক নাটক। বিএনপি আবার জামাতকে কাছে টেনে নিয়ে যে পরিত্যক্ত-ঘৃণিত-ভয়াবহ পথে গেলো, তাতে বিয়োগান্তক নাটক যে বিএনপির জন্য অপেক্ষা করছে তা ইতিহাসের গতিধারা থেকে সুস্পষ্ট। আর বিএনপির ঘাড়ে পা রেখে জামাত যেভাবে উড়তে চাইছে, তাতে পিপীলিকার পাখারই নামান্তর হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস এখন বিএনপি-জামাত দল দুটোর করুণ বিয়োগান্তক পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে এক সঙ্গে যে দুটো দলের জন্ম ও পুনর্জন্ম হয়েছে, এক সঙ্গেই বোধকরি খেলাও সাঙ্গ করবে।
শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।