আজকে ভাল লাগতেছে না কিছুই। মনটা খুব খারাপ। আসলেই মনটা খারাপ। একজনের থেকে একটা কাহিনী শুনলাম। তার নিজের জীবনের কাহিনী। আসলে বাস্তবতা বড় কঠিন। আর, মাঝে মাঝে হাবিজাবি যাই হোক, একটু কিছু লিখি বলেই বোধহয় উনার প্রতিটা শব্দের পিছনের কষ্ট গুলো টের পেলাম। প্রতিটা বর্ণের পেছনের কষ্টগুলো আমার সামনে নানান বর্ণ নিয়ে হাজির হল।
আসলেই খুব কষ্ট পেলাম।
অমুকের গার্লফ্রেন্ড তমুকের সাথে চলে গেছে বা পাড়ার মাস্তানরা দামী মোবাইল নিয়ে গেছে এইসব নাকি কান্যার সমস্যা না। সরাসরি চোখ খুলে নিয়ে যাওয়ার কাহিনী। মায়ের সামনে তার দুই ছেলের চোখ খুলে নেয়ার কাহিনী। তিন মাসের একটা মেয়ে ছিল তার পেট বেয়োনেট দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবার কাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর আর কখনও ফেরত না আসার কাহিনী। আর নিষ্ফল আক্রোশে পুকুরের মাঝে ডুব দিয়ে থাকা সেই মহিলার চোখের পানিতে রক্তের প্রতিবিম্ব, সব কিছুই আমার চোখে ধরা পড়ল। কারণ, আমাকে বলার সময়েও উনার চোখে অশ্রু ছিল। পুকুরে মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ দুটো বের করে সে দেখেছে, তার ছেলেদুটোর চোখ খুবলে নেয়া হল। রাজাকাররা করেছে এসব। পাকিস্তানীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে রাজাকাররা, মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কাছে। পাকিস্তানীদের লাইন (একটা জাত, একটা নিচু জাত, যাদের রক্ত এখনও বর্তমান, যাদের জন্য বাংলাদেশের রমণীরা প্ল্যাকার্ড উঁচায় স্টেডিয়ামে,”প্লিজ ম্যারি মি।”) দূর থেকে দেখেই মহিলা পুকুরে লুকায়। তিনমাসের বাচ্চাকে কেউ কিছু বলবে না ভেবে আর পানিতে আনেনি তাকে। খাটেই বাচ্চাটার উপর বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিল।
সেই পিচ্চী মেয়েটা বেঁচে গিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হলেও সত্য। সেই মেয়েটা বেঁচে গিয়েছিল। আসলে কথাটা বোধহয় খুব বেশি সত্য না। মেয়েটা বেশি দিন বাঁচে নি। মারা গিয়েছে, পাকিস্তানী কুত্তাদের হাতে না, বাংলাদেশীদের হাতে। যৌতুক দিতে পারে নি, তাই তার স্বামী(!!!!!!! বলতে মুখে থুতু জমে) তাকে মেরে ফেলে। মেরে ফেলে মানে কী, কুপিয়ে খুন করে।
এ ব্যাপারে বেশি কিছু জানি না। মহিলা বলতে যেয়ে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল আমার সামনেই।
সেই কুত্তার বিচার হয়েছে। অনেক পরে, কিন্তু হয়েছে। ফাঁসী। কিন্তু অতদিনে এই মহিলা পাগল হয়ে গিয়েছিল। তার মেয়ের উপর অনেক অত্যাচার করা হয়। সব কিছুই শোনে সে কোর্টে। মেয়ের জামাই (হ্যাঁ সে পাকিস্তানী না, সে বাংলাদেশী) প্রতিদিন মেয়েকে অত্যাচার করত, যেন সে তার মায়ের কাছে টাকা চায়। একবার নিয়ে এসেছিল অবশ্য, সাড়ে তিন হাজার টাকা। ১৯৯১ সম্ভবত, একজন দরিদ্র মহিলা যে মানুষের বাসায় কাজ করে পেট চালায়, তার থেকে তার মেয়ে তার জামাইকে সড়ে তিন হাজার টাকা এনে দেয়। এই মেয়েটা ত নিজেই বোঝে সে কী করল, তাই সে আর আসে নি। প্রতিদিন জামাই শ্বাশুড়ী(সেও ত একটা মেয়ে!!) মেয়েটার উপর অত্যাচার করেছে। মেয়েটা মায়ের কাছে টাকা চাইতে ফেরত আসে নি। মেয়েটার যাওয়ার জায়গাও নেই। প্রতিদিন কষ্ট করে ধুঁকে ধুঁকে তার মা তাকে এ পর্যন্ত বড় করেছে, তার মার থাকার জায়গা নেই, সে কোথায় যাবে! স্বামীর(!!থুঃ) ঘরেই পড়েছিল। তাকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। সব কিছুই কোর্টে বেড়িয়ে আসে। এই মহিলা শোনে। নিজের মেয়েকে কীভাবে মারা হয়েছে তা শোনে। সে নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলে, চোয়াল ভেঙ্গে ফেলে। তাকে বেঁধে রাখা হয় বেশ কিছুদিন।
এরপর আর কী !! পৃথিবী নিজের গতিতেই ঘুরেছে অনেক দিন। এই মহিলাও সুস্থ হয়েছে। একজনের বাসাতে কাজও পায়। আর হ্যাঁ, তার কাছে আরও একটা দায়িত্ব বর্তায়। তার নাতনি। তার মেয়ের ১ বছরের শিশু। তার নাতনি। যাকে একটা এতিমখানায় দেয়া হয়, আর মহিলা খুব এক বড়লোকের বাসায় চাকরী পায়। চাকরী আর কি, গৃহপরিচারিকা, বুয়া।
সব মিলিয়ে ১২টা বছর তার কাটে ওখানে। যাদের বাসায় কাজ করে তাদের সাথে শর্ত একটাই, কোন টাকা লাগবে না তার। শুধু নাতনির এতিমখানায় বেতনটা দিতে হবে। ড্যাম বড়লোক ত , ছেলে মেয়েকে সময় দেয়ার সময় নেই বাড়ির মালিকের। ৯ বছরের একটা ছেলেকে ১২ বছর ধরে পালে সে। আর, ছোট্ট একটা মেয়ে, সে আসার কয়েকদিন পরে যার জন্ম। তাকে বলা হল, এই মেয়েটাকে তুমি পালো, বড় কর নিজের পায়ে হাঁটা পর্যন্ত। পাঁচ হাজার টাকা পাবা, আমরা সময় দিতে পারব না ওকে। নিজের নাতনিকে রেখে সেই মেয়েকে লালন পালন করে সে।
চলে আসার সময় তাদের কাছে ৮০০ টাকা পায়, দেয় নি। সেই পাঁচ হাজার টাকার কথা উনাদের মনে ছিল না। আসলে গৃহকর্ত্রী কয়েকটা সংগঠন চালান, সমাজ সেবা করে সেসব সংগঠন। উনার মনে না থাকতেই পারে। কিন্তু যার পাওনা তার মনে থাকলেও সে কিছু বলে নি। এই মহিলার ভাষায়,”একটা শিশু হইল ফেরেশতা, ওরে বড় করছি। টাকার দাবী ক্যামনে করি?” ঢাকায় চলে আসে মহিলা, আসার আগে এতিমখানায় তার নাতনীকে দেয়ার জন্য ৩,৫০০ টাকা যা তার সম্বল দিয়ে আসে সেই ছেলের হাতে। যাকে সে ডাকত আব্বু, যাকে ১২ বছর বড় করল। সেই টাকাটা তার নাতনীর নামে করা ব্যাংক একাউন্টে জমা দিতে বলে আসে।
আমার আব্বু আজকে খবর নিছে। একটা টাকাও জমা দেয় নি সেই ছেলে। ৪ মাস হয়ে গেছে। মহিলা আমার কাছে প্রায়ই ওই ছেলের জন্য দুঃখ করে, বলে “হেই ঘরেও একটা নাতি আছে, হেরে ডাকতাম আব্বু।” সে ফোন করে সেই ছেলের কাছে, “আব্বু কেমন আছ? তোমার বইনে কেমন আছে?”
একটা মানুষের জীবনে এত বেশি কষ্ট কী করে থাকে? এত বেশী? মহিলা একেবারেই বয়স্ক। সারাদিন কাঁদে, তার কিছু হলে তার নাতনীকে দেখবে কে? এতিমখানায় তার নাতনী। এসএসসি পাশের পর সেখান থেকে বের করে দিবে, কোন কথা নেই, সোজা বের করে দিবে। এটাই নাকি ওখানকার নিয়ম।
মহিলা প্রায়ই কাঁদে।
কেমন যেন লজ্জা লাগল, আমিও উনার সাথে কেঁদে ফেলেছি।
আপনি বাংলাদেশী না? এত গর্ব কীসের আমাদের? এই মহিলাটাকে এক বিন্দু ছাড় দিতে পেরেছি আমরা? যেভাবে যে পেরেছে শুষে খেয়েছে। পাকিস্তানীদের জন্য স্টেডিয়ামে প্ল্যাকার্ড উঁচানো ঠিকই আছে,কারণ আজ নিজেদের প্রতি ঘৃণা হয়। আমরা রাজাকারদের ভোটও দেই, তারা দেশের মন্ত্রীও হয়। গরীবের টাকা মারা মানুষগুলো সমাজ সেবার নামে ভাঁওতাবাজী করে আর যৌতুকের জন্য আমরা মানুষকে কুপিয়ে খুনও করি। মেয়েটাকে খুন করে তার জামাই আর শ্বাশুড়ি। মা আর ছেলে মিলে খুন, নাইস টিমওয়ার্ক !!! ছিঃ ছিঃ।
[ পুরোটুকুই সত্যি কাহিনী। আর এক বিন্দুও বাড়িয়ে চড়িয়ে বলা হয়নি।]