...পাকিস্তান আর্মির ছোড়া মর্টারের গোলা থেকে স্প্লিনটারগুলো যখন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ডানহাঁটু ও কাঁধে বিঁধে, তখন তার বামকাঁধে আহত সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া। গোলার আঘাতে নূর মোহাম্মদ শেখ থুবড়ে সামনের দিকে পরেন। বাম হাত, বাম পা সচল। ডান হাত কিছুটা` নাড়াতে পারেন। তবে ডান পা হাতুর নীচ থেকে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে হাঁটু, পাজর আর কাঁধ থেকে।
তারিখ ছিল ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। সময় সকাল সাড়ে নয়টা। স্থান যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রাম।
ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ছিলেন গোয়ালহাটি ক্যাম্পের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সৈনিকদের একজন। ১২ বছর হয়ে গেছে ইপিআর-এ যোগদান করেছেন। চাকরীর শুরু থেকে দিনাজপুর সীমান্তে ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বীরত্বের জন্যে 'তকমা-ই-জং' ও 'সিতারা-ই-হারব' অর্জন করেছেন। জানতেন শত্রুপক্ষকে একবিন্দু ছাড় দিলে কি হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যতক্ষণ সম্ভব আটকে রাখবেন পাকিস্তান আর্মিকে যাতে গোয়ালহাটির পাশেই সুতিপুরের মূল ঘাঁটিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ পান নিজেদের গুছিয়ে নেবার।
সেদিন নূর মোহাম্মদ ছিলেন একটা স্ট্যান্ডিং পেট্রোল টিমের নেতৃত্বে। দায়িত্ব ছিল সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানী আর্মি এগিয়ে এলে সেই খবর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল ঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়া ও প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাতে তারা মূল ঘাঁটিতে সরাসরি আক্রমণ করে বসতে না পারে। পাঁচজনের দল ও মাত্র তিনটি অস্ত্র দিয়ে তা প্রায় অসম্ভব তবে তাদের মনবল ছিল প্রবল।
পাকিস্তানী আর্মি নূর মোহাম্মদের পেট্রোল টিমকে তিন দিক থেকে আক্রমণ করেছিল। তাদের ধারনা ছিল এই স্ট্যান্ডিং পেট্রোল টিমে লোকবল অনেক। তাই নূর মোহাম্মদ দলের দুইজনকে দ্রুত ক্যাম্পে যেয়ে খবর দিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনি সহ বাকী দুইজন অবস্থান পরিবর্তন করে করে গুলি করছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানী আর্মিকে বিভ্রান্ত করা।
কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত করা গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হন। তার কাছেই ছিল পেট্রোল টিমের এক মাত্র লাইট মেশিনগান। সেখান থেকে গুলো বন্ধ হলে পাকিস্তানী আর্মি বুঝে নেয় প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয়েছে। নূর মোহাম্মদ ধীরে ধীরে ক্রল করে নান্নু মিয়ার কাছে যান। দেখেন নান্নু মিয়া বেচে আছেন। নান্নু মিয়ার লাইট মেশিনগান তুলে নিয়ে গুলি ছোড়তে থাকেন। কিছু পাকিস্তানী সেনাকে নিস্তেজও করেন বোধহয়। পাকিস্তান আর্মি গুলি থামায় এবং একটু পিছিয়ে যায়।
নূর মোহাম্মদ এই সুযোগে নান্নু মিয়াকে কাঁধে করে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান আর্মি একটু পিছিয়ে তাদের অবস্থান নির্ণয় করে নিয়ে মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তারই একটা গোলা নূর মোহাম্মদের ডান দিকে এসে পরে, হাঁটু, পাজর আর কাঁধে স্প্লিনটার বিঁধে ।
হাঁটু, পাজর আর কাঁধের রক্তক্ষরণ নিয়ে বেশীক্ষণ বাঁচবেন না বুঝতে পেরেছিলেন নূর মোহাম্মদ। লাইট মেশিনগানের মূল্য জানতেন নূর মোহাম্মদ। তিনি সহযোদ্ধা মোস্তফাকে লাইট মেশিনগানটি দেন এবং বলেন নান্নু মিয়াঁ ও মেশিনগান নিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যেতে। নিজের কাছে রাখেন একটি রাইফেল। থেমে থেমে কয়েকটি গুলি করেন। কিন্তু শরীর থেকে অবিরত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে পরেন একসময়।
পাকিস্তানী সেনারা এগিয়ে আসে তারপর। পায় ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখকে একটা গাছের গোড়ায়। তখনও তিনি জীবিত তবে নড়বার শক্তি ছিল না। পাকিস্তানী সেনারা বেয়নেট দিয়ে নূর মোহাম্মদের চোখ দুটো ও ঠোট উপড়ে ফেলে। এরপর রাইফেলের বাট দিয়ে মাথার খুলি ভাঙ্গে এবং ঘিলু বের করে আনে।
*তথ্য সুত্রঃ
বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এর জীবনী
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ
**ব্যক্তিগত ব্লগেও প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১১:১৫