প্রিয় শহর তিলোত্তমা,
কেমন আছো তুমি? জানি ভালো নেই। প্রতিদিন খবরের কাগজে, দূরদর্শনের সংবাদে তোমার একটু আধটু খবর পাই। বর্ষার জল প্রতিনিয়ত তোমার শরীরের একেক অংশ ডুবিয়ে দেয়। তারপর আবার চৈত্রের কাঠফাটা রোদে তোমার বুকে ফাটল ধরে। তোমার খুব কষ্ট হয় নিশ্চয়ই। কত বছর পেরিয়ে গেল তোমাকে ছেড়ে এসেছি। তবু আজও তোমার প্রতি তীব্র এক টান বোধ করি। তুমিই তো আমায় বন্দী খাঁচা থেকে বের করে পাখা মেলে উড়তে শিখিয়েছ। ভেবে রেখেছি, আবার কোনদিন ফিরলে সারাদিন প্রিয় বাহন রিকশা নিয়ে তোমার বুকে উড়ে বেড়াবো। ছুটে যাব আপনজনদের কাছে। সেই শিয়া মসজিদ, নবোদয়, তাজমহল রোডে। এসব রাস্তায় প্রতিদিন রিকশায় কত যাওয়া আসা হত। কত পরিচিত পথ, কত আপন! আচ্ছা, আমার পুরানো সেই চিলেকোঠাটা কি আগের মত আছে? পাকিস্তানী আমলে তৈরি দোতলা বাড়ি। বিশাল বড় ছাদ আর তার কোণে ছোট্ট একটা কামরা। ছিমছাম করে সাজিয়ে নিয়েছিলাম নিজের মত করে। একটা চৌকি, একটা আলমিরা আর একটা পড়ার টেবিল। ব্যস। ছাদে টবে গোলাপ, তুলসীর চারা লাগিয়েছিলাম। বন্ধুরা হাসত আর বলত "তুই আর জায়গা পেলি না। শেষ পর্যন্ত ছেলেদের মত চিলেকোঠায় থাকা শুরু করলি!" অথচ সেই চিলেকোঠাই ছিল আমার এক টুকরো স্বর্গ। শহুরে ব্যাস্ততার ফাঁকে, যানযট আর বাসের ভীড় ঠেলে, সারাদিনের কাজ শেষে আমার আমিকে নিজের মত করে পাওয়া। বিকেলে এক মগ কফি হাতে এলোচুলে ছাদের রেলিং ঘেঁষে হাঁটা, গোলাপের ঘ্রাণ নেয়া, তুলসী পাতায় হাত বুলিয়ে দেয়া। ছাদে আগে থেকেই একটা মেহেদী গাছ ছিল। সেই গাছ নিজেকে রিক্ত করে মাঝে মাঝে হাত রাঙ্গাত। শুনেছি সেই চিলেকোঠা এখন ফাঁকা। বাড়িটা ভেঙ্গে আধুনিক সব সুযোগ সুবিধাসহ বহুতল বাড়ি করা হবে। এমন পুরানো ধাঁচের বাড়ি আর রাখা যায়না। আমার সেই আদরের গোলাপ আর তুলসী গাছ কি এখনো আছে? তোমার বুকে বাস করা মানুষগুলো মনে হয় তোমাকে আর তিলোত্তমা থাকতে দেবেনা।
সেই রায়ের বাজারের ট্যানারি মোড়টা এখনো আগের মত?? কী লক্কড় ঝক্কর রাস্তা, পুরো রাস্তায় রিকশার ঝাঁকুনি! কতশত বার যে সরকারের মুন্ডুপাত করতাম সংস্কার না করার জন্য। অথচ এখন কত আপন লাগে সে রাস্তা। সেই যে ডানদিকের কোনায় একটা ফলওয়ালা বসত, একটু সামনে বামদিকে একটা হাড্ডিসার ভিক্ষুক বসত, তার পাশেই একটা মুচি। তারা কি এখনো আছে? গাউসিয়ার ঘিঞ্জি জায়গায় পেয়ারাভর্তা বিক্রি করত যে লোকটা? বন্ধুরা মিলে কেনাকাটা শেষে সেই পেয়ারাভর্তা খেয়ে সে কী তৃপ্তি পেতাম! কিংবা সলিমুল্লাহ হলের সামনের ফুল বিক্রেতারা? পহেলা বৈশাখে কিংবা বাসন্তী অনুষ্ঠানে সেখান থেকে তাজা বেলী ফুলের মালা কিনে খোঁপায় গুঁজে দলেবলে রমনা বটমূলে যেতাম। হয়তো তারা কেউ নেই। কে জানে কোথায় গেছে! আজ এত বছর পর সব হয়তো অনেক বদলে গেছে। কেবল রাস্তা-ঘাট আর দালানগুলোই আগের মত আছে।
তিলোত্তমা ঢাকা,
কেমন আছে সেই স্মৃতিবিজড়িত প্রাণের লেক, রবীন্দ্র সরোবর? যেখানে একসময় ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে, ঘুরে কাটিয়েছি। আবার সে পথ ধরে হাঁটলে তারা কি আমার পদচিহ্ন, পদধ্বনি চিনতে পারবে? বলবে,'আরে তুমি সে না? সেই যে কতবছর আগে প্রতিদিন আমার বুকে হেঁটে যেতে?' আমিও স্বোচ্ছ্বাসে উত্তর দেব, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঠিক চিনেছ। আমি সেই।' আচ্ছা গাছগুলো কি আমায় চিনতে পারবে? দু'রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াগুলো? কয়েকটি রক্তলাল পাঁপড়ি কি আমায় স্বাগত জানাবে? কিংবা দোতলা বাড়ির সামনের কাঠগোলাপ গাছটা? একটি ফুটন্ত কাঠগোলাপ কি টুপ করে সামনে পড়বে? আহ, সবকিছুর জন্য কী মায়া জন্মে আছে বুকের ভেতর! এতদিন টেরই পাইনি। অথচ এসব তো তুচ্ছ জড়বস্তু। আর হারিয়ে যাওয়া আপন মানুষগুলো? প্রাণের মানুষগুলো? তাদেরতো শত চাইলেও ফিরে পাওয়া যায়না। রিকশা নিয়ে হুট করে দেখতে যাওয়া যায়না। কখনো বিধাতা পথ রুখে দেয় নয়তো আত্মাভিমান এসে পথ রুখে দাঁড়ায়। আচ্ছা দালান, রাস্তা আর গাছেদের কি স্মৃতি থাকে? মায়া থাকে? আমার মত? মানুষের মত? ইশ আমি যদি ইট সুরকীর তৈরি দালান হতাম! নাহয় পিচঢালা রাস্তা! কিংবা একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা নির্বিকার গাছ! তবে আমার কোন রাগ, ঘৃণা, হিংসা, লোভ থাকতোনা। সুখদুঃখের বোধ থাকতোনা, কোন স্মৃতি থাকতোনা আর মায়া থাকতোনা। আমি কত সুখী হতাম!
তিলোত্তমা,
আমি আবার একদিন ফিরে আসব তোমার বুকে। ধূলোমাখা পথে, ব্যস্ত মানুষের ভীড়ে। ফিরে আসব ভালোবাসার টানে, নাড়ীর টানে। ততদিন তুমি ভালো থেকো। অনেক অনেক ভালো থেকো।।
ইতি,
তোমার প্রেমে মত্ত মানবী
('অমর একুশে বইমেলা-২০১৮'তে চিঠি সংকলন 'আরাধ্য লণ্ঠন' এ প্রকাশিত)
[সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:২৬