পরদিন ভোর আসলো আমার জন্য চমক নিয়ে!সূর্যি মামা জাগার আগেই আমরা ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে তৈরি হয়ে গেলাম। বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখি আমার ট্রেক শ্যু নেই!কি কাণ্ড!কেউ নিজের মনে করে নিয়ে গেছে।অবশ্য যে নিয়েছে তাকে খুব বেশি দোষ’ও দিতে পারছিনা!মাত্রই নতুন কিনে নিয়ে আসছি।একদিনের ট্রেকিং এ জুতোর চকচকে ভাবটা কমার বদলে মনে হয় আরও বেড়েছে! কিন্তু বেচারা খুব হতাস হত যদি সে জুতার দাম টা জানতে পারত!আহারে বেচারা আমার জন্য অবশ্য ভালই হয়েছে!শুধু শুধু আর এক জোড়া স্লীপার পেছনে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম!আমার ব্যাকপ্যাকের ওজনটাও কিছু কমলো তাতে!ধন্যবাদ হে চোর বন্ধু। তবে এখানে একটা কথা বলা খুব জরুরী।আমার এতো বছরের ট্রেকিং লাইফে আমি এমনটা দেখিনি আগে।হ্যাঁ,থানচির কিছু পাড়ায় হয়তো আমরা দিন দিন ওদের মধ্যে প্রফেশনালিজমের বীজ বপন করে দিচ্ছি,সেটা আমরাই করছি।এজন্য কোনভাবেই ওরা দায়ী নয়।তাই আমার ঘটনাটিকে আমি বা আমরা নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা হিসেবেই নিয়েছি।
চলছে অভিযাত্রী দল
ইতিমধ্যে আমাদের গাইড ঝংলং চলে আসছে।পাড়ার অনেকেই চলে এসেছে আমাদের বিদায় জানাতে।সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাদের দ্বিতীয় দিনের অভিযাত্রায় নেমে পড়লাম।পাড়া থেকে নেমে ডান দিকে ছোট্ট একটা খালের মতো পেড়িয়ে নাক বরাবর পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।আমরা চলছি শেরকর পাড়ার দিকে।১০/১৫ মিনিট পাহাড় বাইতেই আমাদের সব খুলে ফেলতে হল মানে গরম কাপড় আর কি!এই কনকনে শীতেও আমরা ঘামতে শুরু করলাম।এতো তাড়াতাড়ি টেম্পারেচার ১৫ থেকে ৩৫ হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি!প্রথম পাহাড় টাই যে আমাদের এতটা চ্যালেঞ্জ জানাবে ভুল করেও ভাবিনি আমরা।৩০/৪০ মিনিট টানা উপরের দিকে ওঠার পর আমাদের থামতে হল।আমাদের অগ্নিকন্যা বেশ পিছিয়ে গেছে।নিচে ডেকেও ওর সাড়াশব্দ পাচ্ছিনা।ওর সাথে ঝংলং আছে।তাই জানি ভয়ের কিছু নেই।আমরা যাত্রা বিরতি দিলাম।ইতিমধ্যে অগ্নিকন্যাও চলে আসছে ঝংলং কে নিয়ে।আমরা বিস্কিট,খেজুর আর পানি খেয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে নিলাম পরের আকাশ ছোঁয়ার প্রত্যাশায়।
টানা ২ ঘণ্টা পাহাড় বাইছি।কিন্তু পাহাড়ের কোন কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা।মাঝে মাঝেই পাহাড়ের চূড়া মনে করে ধোঁকা খাচ্ছিলাম।নিচ থেকে হয়তো মনে হচ্ছে ওই বুঝিবা পাহাড়ের শেষ সীমানা কিন্তু বারবার আমরা ওখানে পৌঁছে আরও এরকম অনেক চূড়া দেখলাম আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় আছে। একপর্যায়ে হাল ছেঁড়ে দিলাম।বুঝতে পারলাম যা করার প্রেম করেই করতে হবে!যা আছে কপালে।সবকিছুর যেমন শেষ আছে এই পাহাড়টারও নিশ্চয় কোথাও শেষ আছে।আজ সারাদিন লেগে গেলেও তোর কপাল আমরা ঠিকই ছুঁয়ে দিব।ভালবেসেই আমরা তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব দিনভর।
এক একটা চূড়ায় পৌঁছে যখন তিন পাশে তাকাই তখন নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়!মস্ত আকাশ টা যেন এসে হামলে পড়েছে সবুজ খণ্ডের উপর।সে কি প্রেম সবুজ আর নীলে!কেউ কাউকে ছাড়তেই চায়না!একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে পরম মমতায়।যাক ওদের প্রেমে আর ব্যাঘাত না ঘটিয়েই আমরা আবার পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম।এক একটা পাহাড় বাইতে বাইতে একসময় এসে আবিষ্কার করলাম সামনে আর কিছু নেই।একদম খাঁড়া হাজার ফিট গভীর খাঁদ।যাকে বলি আমরা ডেড এন্ড।খুব হতাস হয়ে গেলাম আমরা।৪ ঘন্টা পাহাড় বেয়ে এসে যদি দেখি সামনে আর যাওয়ার পথ নেই তখন মনের অবস্থা কেমন হয়!কিন্তু আমাদের মনে একটা ক্ষীণ আশা যে আমরা কিছু নিদর্শন পেয়েছি আসার পথে যে এ পথে অনেকদিন আগে হলেও ট্রেকার আসছে।তার চিহ্ন তারা ফেলে গেছে।
এতক্ষন ঝংলং হয়তো মজা দেখছিল।হঠাৎ সে কিছুটা বাম দিকে খাঁড়া খাদের দিকে হাত তুলে দেখাল।সিয়াম ভাই ২ পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসলো।আমিও কিছুটা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসলাম।কিন্তু যা দেখলাম তাতে ভয় না পেয়ে উপায় ছিলনা।ওখান থেকে কয়েকটা গাছের তৈরি মই এর সিঁড়ি একদম খাঁড়া কয়েকশ ফিট নিচে নেমে গেছে।ছোটখাট এরকম গাছের মই বাওয়ার অভ্যাস আগেও হয়েছে।কিন্তু এটার উচ্ছতা ৩/৪ তলা বিল্ডিং এর সমান।গাছ কেটে বানানো সিঁড়ি তে কোনরকম একটা পা হয়তো পড়ে।ওটা বেয়ে নামা যে বেশ কঠিন হবে দেখেই বুঝতে পারলাম।কিন্তু কঠিন হোক যাই হোক আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।একটা পথ যেহেতু পেয়েছি ওটা বেয়ে নামতেই হবে।সে দরকার হলে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে গেলাম।কিন্তু এখানে সে সুযোগও নেই।একবার পা পিছলে গেলে কিছুক্ষণ শুন্যে ভেসে তারপর মাটির সাক্ষাত পাওয়া যাবে!যাক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম আমরা।
ঠিক হল প্রথমে নামবে অনুপ দা।তার ব্যাকপ্যাক আমাদের কাছে দিয়ে আমাদের দেওয়া সাহস নিয়ে নামতে শুরু করে দিল!প্রথম গাছ বেয়ে নামার পর নিচে এরকম আরও একটা নামতে হবে।নামছিল অনুপ দা কিন্তু হাত পা মনে হয় আমাদেরও কাঁপছিল তার সাথে সাথে।৭/৮ মিনিট পর দেখি সে ২ হাত ওপরে তুলে যুদ্ধ জয়ের হুঙ্কার ছেড়েছে।মানে তার পা মাটি খুঁজে পেয়েছে অবশেষে।তার সাথে সাথে আমাদেরও দেহে যেন প্রান ফিরে আসছে।এবার সিয়ামের পালা।সে অনুপ দা’র দেখানো পথেই নেমে গেল কোন অঘটন ছাড়াই।অগ্নিকন্যার পালা আসতেই সে সমানে হাত পা ছুঁড়তে লাগলো।মানে সে কিছুতেই মৃত্যু সিঁড়ি বেয়ে নামতে পারবেনা।প্রয়োজন হলে সে আবার ২ দিন পেছন ফিরে থানচি ফিরে যাবে তবুও সে ওটা বেয়ে নামবেনা।আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলো ঝংলং কে দিলাম নিচে নামাতে ততক্ষনে যদি কন্যার মতিগতি ফেরে।ঝংলং দেখলাম ব্যাকপ্যাক নিয়ে অনেকটা বানরের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল।এক এক করে সে সবকয়টা নিচে নিয়ে গেল।ঝংলং কে দেখে মনে হয় অগ্নিকন্যার পূর্বের স্মৃতিকথা মনে পড়ে গেল!সে বলল আমি নামছি তুই সেটা ভিডিও কর।আমি দেখিয়ে দিব আমিও পারি।বাহ !এই না হলে অগ্নিকন্যা!নিচ থেকে চিৎকার করে ওরাও সবাই সাহস দিচ্ছিল।মাঝ রাস্তায় ঝংলং প্রস্তুত দিদি কে স্বাগতম জানাতে।প্রথম মইটা সে ভালোভাবেই নেমে গেল।যদিও একটু সময় বেশি নিয়েছে।সে ব্যাপারনা।আমাদের হাতে অজস্র সময়।শুধু যাত্রা টা যেন নিষ্কণ্টক হয়।কিছুটা বিরতি নিয়ে পরের সিঁড়ি টুকোও সে নেমে গেল ঠিক অগ্নিকন্যার মতোই।আর উত্তেজনাময় পুরো অভিযানটা আমি ভিডিও তে ধারন করে নিলাম।যা হয়তো ষ্টীল ইমেজ বুঝাতে পারবেনা কতটা ভয়ংকর ছিল আসলেই ওইটুকো পথ কিন্তু ভিডিও তার অনেকটাই পারবে।
সবার শেষে আমি নামতে গেলাম।সবার দুর্দান্ত পারফর্মেন্স ইতিমধ্যেই আমার মনেও সাহস সঞ্চার করেছে কিছুটা।তাই আমার জন্যও খুব একটা কঠিন হয়নি সে পথ।কিন্তু একথা কাউকেই বলা হয়নি প্রথম উঁকি দেওয়ার পর আমার হাঁটু তে কেমন সিডর আইলা ভর করছিল!যাক,অবশেষে আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ টা আমরা ভালোভাবেই জয় করলাম তাই বিজয়ের উদযাপন টাও হয়েছিল খুল্লামখুল্লা।
প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সবুজে মোড়ানো পাহাড়ের ভাজে ভাজে ট্রেকিং করে আমরা শেরকর পাড়ার দেখা পেলাম।মাঝের কিছু গল্প অজ্ঞাত থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে হল তাই সযত্নে শুধু মনের খাতায় জমা রাখলাম!আর এমনিতেও সব কথা বলতে নেই,বিজ্ঞ জনে কহে!ওখানে এসে ঝংলং বলছে সে আর চেনেনা তাই আমরা যেন ওপাড়া থেকে আর একজন গাইড নিয়ে নেই।আমরা কারবারির সাথে দেখা করলাম।সে সানন্দে আমাদের সাথে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলে আমাদের আবদার মেটাল।কিছুক্ষণ গল্প করে যখন খাতির জমে গেল সেই ফাঁকে আসল কথাটা তুলে ফেললাম।সে তার ছেলে কে পাঠাল একজন কে খুঁজে আনতে যে পরের পাড়াগুলো ভালো চেনে এবং আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে।কিন্তু খুঁজে আনল এমন একজন কে যাকে নিয়ে পরের দিনগুলো আমাদের শুধু আফসোস করতে হয়েছে কেন তাকে আমরা সাথে আনলাম।আমাদের গাইড কে আমাদেরই রাস্তা চিনিয়ে দিতে হয়েছিল।সে গল্প নিশ্চয় আসবে বারেবারে ফিরে ফিরে।
ঘণ্টা খানেক পর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নেমে পড়লাম রাস্তার মানুষ রাস্তায়।পথ’ই যাদের ঘর তাদের পথেই মানায়।এবারের গন্তব্য দ্যোতং পাড়া।একটার বেশি বাজে ইতিমধ্যে।আমরাও জানিনা সন্ধ্যের মধ্যে আমরা ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারব কি না।না পারলেও সমস্যা নেই।আমাদের যেখানে রাইত সেখানেই কাইত।সাথে তাবু আছে।টানিয়ে ধুমসে ঘুম।সো, নো সমস্যা।আমাদের অগ্নিকন্যার সাহস,মনোবল ফিরে আসছে আস্তে আস্তে।আমাদের সাথে প্রায় সমানতালে ট্রেকিং করে যাচ্ছে।এমনিতেই কি আর ওকে আমরা অগ্নিকন্যা ডাকি!
আমাদের পানির একমাত্র উৎস
ইতিমধ্যে আমাদের সঞ্চিত পানি একবার শেষ হয়ে যাওয়ার পর শেরকর পাড়া থেকে আবার ভরে নিয়ে আসছি।পাহাড়ে গেলে যেটা আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার তা হচ্ছে পানি।ওখানকার সবগুলো পাড়াই তাই হয় কোন ঝর্ণা নয়তো কোন পাহাড়ি নদীর অববাহিকায় থাকে যেন পানির চাহিদা টা মেটানো যায়।যাইহোক,আমাদের অগ্রযাত্রা চলছে সদর্পে।ছোট,বড় বেশ কয়েকটা পাহাড় পেড়িয়ে আসছি এরমধ্যে।কিন্তু ঘুনাক্ষরেও আমরা ভাবিনি শেষ বিকেলের পাহাড়টা আমাদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে আসবে।একটু আগেই আমরা রাস্তা হাড়িয়ে ফেলেছি।আমাদের বিশেষ ভাবে অজ্ঞ গাইড নিজেই রাস্তা ভুল করে আমাদের ভুল পথে নিয়ে আসছে।পেছনে,নিচে আমরা একটা পাড়া রেখে এসেছি যেদিকে আমরা যাইনি।সেটাই ছিল মস্ত এক ভুল।যখন পাহাড় বাইতে শুরু করলাম তখনও হয়তো আমাদের হাতে ঘণ্টা খানেক ছিল দিনের আলো।তাই নির্বিঘ্নেই শুরু করে দিলাম।কিন্তু কিছুদূর উঠার পর বুঝতে পারলাম আমাদের কপালে খুব দুঃখ আছে আজ।পুরো পাহাড়ের ট্রেইল টা ধুলোয় মুড়ে আছে।যেখানে পা সেখানেই পিছলে যায়।আর পাহাড়টা এতোটাই খাঁড়া যে একবার পিছলে গেলে সোজা নিচে(নাকি ওপরে!) চলে যেতে হবে।সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ব্যাপারটা তা হল সব পাহাড়েই গাছে ভরা থাকে।যে কারনে কখনও গাছের বা লতাপাতা বেয়েও ওপরে উঠতে হয়েছে আমাদের।কিন্তু এই পাহাড়ে কোন গাছ নেই উপরন্তু ধুলো রাজ্য যেন আমাদের জন্য মৃত্যুফাঁদ হয়ে অপেক্ষায় আছে।কোনরকমে একবার পা পিছলে গেলে এই খাঁড়া পাহাড়ের কোথাও ব্যাকআপ পাবনা।কিছুদূর গড়িয়ে পড়ার পর আমাদের আটকানোর জন্য কোন গাছ নেই।এই ব্যাপারটা যখন সবার মাথায় ঢুকে গেল তখনই সবার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল।অবশেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা বিড়াল নীতি অবলম্বন করব।আমরা বিড়ালের মত দু’হাতে সামনে খামচে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে উঠবো।কিছুতেই সোজা হওয়া যাবেনা তাহলে ব্যাকপ্যাকের ওজনের ধাক্কায় হাজার ফিট নিচে চলে যেতে হবে।আমার দোস্ত বলছে,আমারে একবার অন্তত আমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দে।কথাটা আমাদের জন্যও সত্যি ছিল যদিও আমরা প্রকাশ করছিলাম না।তারচেয়ে বড় কথা ওপরে একজন পিছলে গেলে সে সবাইকে সাথে নিয়েই নিচে নেমে যাবে রোলার কোস্টারের মত।উইদয়াউট ব্রেক সোজা ওপারে!একপর্যায়ে আমরা একজায়গায় কিচ্ছুক্ষন স্থির থেকে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম। নিচে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।পেছনেও আর নামতে পারবোনা এখন।ওপরে আর কতদূর উঠতে হবে তাও বুঝতে পারছিনা।একটা সময় আমাদের ব্যাকপ্যাক কে আমাদের শত্রু মনে হচ্ছিল।কিছুতেই ওটা নিয়ে ওপরে উঠতে পারছিলাম না।ইচ্ছে করছিল ফেলে দেই।দুই গাইড কে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ব্যাকপ্যাক নিতে পারবে কিনা!ঝংলং এর কাছে আগেই অগ্নিকন্যার ব্যাকপ্যাক ছিল।তাকে পাঠালাম একটা ব্যাকপ্যাক ওপরে রেখে আসতে।আমাদের জন্য যতটা ভয়াবহ লাগছিল ওদের কাছে ঠিক ততটা না।কারন ওদের জন্মের পর থেকেই ওরা পাহাড় বেয়ে অভ্যস্ত।৬/৭ বছরের একটা বাচ্চা কে দেখেছি ১০/১২ টা তৈ পিঠে ঝুলিয়ে ৫০০ ফিট নিচে নেমে যেতে পানি আনতে।তাই আমরা জানি কাজটা ওদের জন্য খুব একটা কঠিন হবেনা।যদিও ওরাও বলছে এরকম ভয়ঙ্কর পাহাড় ওরাও আগে ওঠেনি।আর রাস্তাটার বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার কারন গয়াল নামক এক প্রানীকূল ঠিক ওই রাস্তাই ব্যাবহার করছে তাদের জগিং এর রুট হিসেবে।ওরা সদলবলে রেইস খেলে রাস্তাটাকে জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে।কতটা বেরসিক হতে পারে গয়াল সাহেবগন!
ব্যাকপ্যাক দিয়ে দেওয়ার পর অনেকটাই সহজ হয়ে গেল আমাদের জন্য।মস্ত এক পাথর যেন নেমে গেছে পিঠ থেকে।সাথে শরীরের ওপর কন্ট্রোল টাও চলে আসছে।এখানে একটা কোথা উল্লেখ করা জরুরী।যে ব্যাকপ্যাক এর ওজন হয়তো ১৫ কেজি কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেকিং করার পর সেটার ওজন একসময় ৫০ কেজি সমতুল্য মনে হয়। যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শরীরের থেকে মনের ওপর আত্মবিশ্বাস থাকা বেশি জরুরী।আমরা সেটাও ফিরে পেলাম ধীরে ধীরে এবং একসময় ঠিকই জয় করে ফেললাম দুর্গম এই পথ।কেউ না কেউ হয়তো গেছে এই পথে।তবে এটা নিশ্চিত,একবার যে যাবে সে দুঃস্বপ্নেও আর ওই স্মৃতি মনে করতে চাইবেনা আর ওদিকে গেলেও ধূলোমাটির ওই পাহাড় থেকে অবশ্যই শতহাত দূর দিয়েই যাবে।দলের সবার শেষে থাকার কারনে আর ফেলে আসা সেই চমৎকার পথ টুকো স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গেলাম সবার থেকে।ওপরে উঠে সোজা হয়েই আমি হতবাক।আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেখানে তিন তিনটা গয়াল অপেক্ষমাণ!আমার চেয়ে মনে হয় ওরা বেশি হতবাক!ওদের দুনিয়ায় আমি কোন আজিব চিরিয়া প্রবেশের ধান্দা করছি।ওরা ওটা কোনভাবেই বরদাস্ত করবেনা! আস্তে আস্তে ওদের চেহারায় সেরকম পরিবর্তন দেখলাম।বুঝতে পেরে আমিও চুপি চুপি ভাগলাম ওখান থেকে!কিছুটা সামনে দৌড়ে গিয়ে ওদের ধরলাম।গয়ালের কথা জিজ্ঞেস করতেই ওরা অবাক।ওরা দেখেইনি!কয়েক মিনিটের ব্যাবধানে হঠাৎ করে চলে এল কীভাবে যেন!
আর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দ্যতং পাড়া কে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পেলাম।ভাঙ্গা ঘরবাড়ি ফেলে সবাই চলে গেছে।কারণটাও পরিষ্কার।আশপাশে কোন ঝর্ণা বা নদী নেই যেখান থেকে পানি আনা যায়।পরে জানলাম যে পাড়া টা আমরা পেছনে ডান দিকে ফেলে আসছি ওটাই সাবেক দ্যতং পাড়া আর বর্তমানে নতুন পাড়া নামে পরিচিত।সবার অবস্থাই শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।যা খাবার দাবার আছে সাথে সব খুলে বসলাম।মনে হচ্ছিল সব খেয়ে দফারফা করে ছাড়বো।কিন্তু যেটা পারলাম সেটা হল সবার কাছে থাকা পানির স্টক শেষ করে ফেললাম।এক রাত না খেয়ে থাকা যাবে কিন্তু পানি ছাড়া একেবারেই সম্ভব না।আর আসার পথে কোন ঝর্ণা বা পানির উৎসও পাইনি যে কারনে পুরো পাড়াটাই চলে গেছে এখান থেকে।এক বিপদ পার হয়ে এসে মনে হচ্ছে আরও বড় কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছি।অবশ্য আমরা যেকোন ধরনের বিপদ মোকাবেলার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।এখন যেভাবেই হোক পানি খুঁজে আনতে হবে।আমাদের শরীরের যে অবস্থা তাতে আমাদের কারও পক্ষেই আর মুভ করা সম্ভব না।দুই গাইড কে বললাম দুই দিকে পানির খোঁজে বেরুতে।কিন্তু ওরা কিছুতেই আলাদা যেতে রাজি নয়।শেষে ঠিক হল ফেলে আসা নতুন পাড়ায় যাবে ওরা।ওখানে নিশ্চয় পানির ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।
ওরা চলে যেতেই সবাই হাত পা ছেঁড়ে দিলাম বাঁশের তৈরি মাচায়।হঠাৎ আবিষ্কার করলাম ৩ টা জোঁক ২ পায়ে চুম্মা দিয়ে যে কখন ধরসে আর ছাড়ার কোন নামগন্ধ নাই!!! আহা!কি গভীর প্রেমে জড়াইয়া ধরছে যে মনে হল অতি আবেগে ঘুমাইয়া পড়ছে।আমার পায়ে কি এমন পাইছে কে জানে!!ছাড়ছেইনা আর ততক্ষনে চেহারাও হইছে একেকজনের দেখার মত!বেশিক্ষণ আর আদর করার সুযোগ না দিয়ে ওদেরকে লবনের কাছে হস্তান্তর করলাম আর সাথে সাথে রক্তের বন্যা বয়ে গেল।ইশ!এতগুলা রক্ত এমন নির্দয় ভাবে আমার অনুমতি ছাড়াই নিয়ে নিল আমার থেকে?কি করে পারল ওরা ?!
অনেকক্ষণ হয়ে গেল আমাদের গাইড আর আসেনা।বিপদের গন্ধ পাচ্ছি আমরা।রাতে রান্না করার পানি তো দূরের কথা খাওয়ার সামান্য পানিটুকোও নেই আমাদের কাছে।ওরা না আসলে কি হতে পারে ভাবতেই আবার গাঁ কাঁটা দিয়ে উঠলো।রাত ৮ টা বেজে গেছে।এখনও কারও আসার খবর নেই।ওরা হয়তো নতুন পাড়া পেয়ে ওখানেই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ার চিন্তা করছে।আমাদের ১ টা লাইট সাথে পানির বোতল গুলোও নিয়ে গেছে ওরা।আবার ভাবছি এতগুলো টাকার চিন্তাটাও ওদের মাথায় না থেকে পারবেনা।তাই তাদের আমাদের কাছে আসতেই হবে।কিন্তু যদি আজ রাতে না এসে কাল সকালে আসে? ঠিক করলাম আর ৩০ মিনিট অপেক্ষা করব।না আসলে আমরাই দু’জন বেড়িয়ে পড়বো পানির খোঁজে।বাকি দু’জন থাকবে এখানে।সাথে থাকা পলিথিন যা আছে নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছি বের হবো বলে।আর তখনই ওদের লাইটের আলো দেখতে পাচ্ছি দূর থেকে।এতো রাতে এই নির্জন দুর্গম পাহাড়ে ওরা ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারেনা।অপেক্ষা করলাম।দেখি দু’জন হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।সাথে ৭/৮ বোতল পানি,কয়েক ব্যাগ পলিথিনেও পানি ভরে নিয়ে আসছে।আরও অবাক করা ব্যাপার হল পাড়া থেকে আমাদের কথা শুনে আমাদের ৪ জনের জন্য ৮ টা কলা দিয়ে দিয়েছে।অথচ ওরা আমাদের দেখেইনি,এমনকি যে দু’জন গাইড গেল ওদেরকেও চেনেনা।ওরাও আগে কখনও আসেনি এদিকটায়।আন্তরিকতা কেমন হতে পারে আমাদেরকে ওরা দূর থেকেই তা বুঝিয়ে দিল।লজ্জায় আমাদের মাথা নিচু হয়ে এল।এদেরকেই আমরা ভুল বুঝেছিলাম।অবশ্য আমাদের সিচুইয়েশন আমাদের বাধ্য করেছিল এমনটা ভাবতে এটাও সত্যি।
এবার গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত চিৎপটাং এর কিছু ছবি দেখি
সমূহ আক্রমনের সম্ভাবনা সত্ত্বেও দুঃসাহসিকের কাজ করলাম
আমরা নতুন উদ্যমে রান্না করতে লেগে গেলাম।রাতে নুডলস রান্না করবো আমরা।ওরা ওখান থেকে খেয়ে আসছে।তাই ৪ জনের জন্য রান্না চড়িয়ে দিলাম।ওরাই আগুন ধরিয়ে দিল চুলায়।রান্না হতে হতে জমজমাট ফটোসেশন হয়ে গেল।তারপর জম্পেশ ডিনার পার্টি।যা খাচ্ছি তাই মনে হচ্ছে যেন অমৃত।সব শেষে কফি তো আছেই শরীর মনকে চাঙ্গা করার জন্য।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই বাইরে বেড়িয়ে আসলাম।এসে দেখি চারপাশ ধবধবে হয়ে আছে।এতক্ষন টেনশনে আকাশের দিকে তাকানোর খেয়ালই ছিলনা।আমাদের জন্য পূর্ণ যৌবনা চাঁদ তাঁর সবটুকো যৌবন মেলে আছে আমাদের প্রতীক্ষায়।এই পাহাড়ের শেষ চূড়ায় যেখানে বসত আমাদের সেখানে অন্য কেউ নেই আমাদের আনন্দযজ্ঞে ভাগ বসাতে।শুধু আমরা আজ সাথে মস্ত আকাশ কে সাক্ষী রেখে প্রেমে মাতবো রাতভর প্রিয় জোছনার সাথে।গভীর রাত পর্যন্ত জম্পেশ আড্ডা দিলাম খোলা আকাশের নিচে।এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা।কোন ভাষার সাধ্য নেই সেই মুহূর্তগুলো কে বর্ণনা করার।যেটুকো বলবো সেটুকোই কম মনে হবে।তাই আর কিছু বললাম না!অগ্নিকন্যা তো বলেই দিল কোন এক ভরা পূর্ণিমায় আবার সে এখানে আসবে,একা হলেও।এতেই কিছুটা বোঝা যায়!
চলছে রান্নার প্রস্তুতি
আমি রক্তশুন্যতায় ভুগলে কে বা কারা দায়ী হবে আপনারাই বলেন
তাবুর ভেতর থেকে
কাল ভোরে আবার যাত্রা হবে শুরু।তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুমাতে যেতে হবে।মাচার তিন পাশে তিন টা তাবু ফেলে দিলাম।এক পাশে দুই গাইড তাদের পুষ্প শয্যা প্রস্তুত করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।শুভ রাত্রী জানিয়ে সবাই যার যার তাঁবুতে ঢুকে গেলাম।তাঁবুতে ঢুকলে কি হবে।ঘুম বাবাজীর আর কোন দেখা নেই।সারা দিনের দুর্গম অভিযাত্রার ফ্ল্যাশলাইট যেন ভাসছে আমার চোখের সামনে।কেবল মনে হয় একটু চোখ টা লাগলো হঠাৎ অগ্নিকন্যার চাপা চিৎকারের শব্দ পেলাম যেন।ডাকলাম ওরে।ও বলল কথা বলিস না।কেউ আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।বুঝতে পারলাম না এই নির্জন পাহাড়ে কে বা কারা আসতে পারে।আমিও কান পাতলাম।ঠিকই বলছে ও।দপদপ পায়ের শব্দ পাচ্ছি।আমাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।এবং সংখায় ওরা অনেক।অনেকগুলো পায়ের শব্দ একসাথে যেন মিছিল করছে।খুব তাড়াতাড়ি ভেবে নিলাম ঠিক কতটা আর কি ধরনের বিপদ হতে পারে।প্রথম মনে হল ডাকাতের দল হতে পারে।ওরা বাইরে থেকে হয়তো আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে।আবার ভাবছি এতো গভীর পাহাড়ে ওরা কীভাবে আসবে!আমার যুক্তি আমাকে বাধ্য করেছে আমার ভয়টাকে অমূলক প্রমান করতে।ফিসফিস করে ডাকলাম অনুপ দা আর সিয়াম কে।ওদের কে বললাম ঘটনা টা।কিন্তু ঘুমের ঘোরে থাকায় ওরা ঠিক পাত্তা দিলনা আমাদের।গাইডদের ডেকে তোললাম।ওরা আশপাশে লাইট মেরে দেখল।কিন্তু কিছু দেখা গেলনা।আর তখন আমরা কোন পায়ের শব্দও পাচ্ছিনা।তার মানে হল কেউ বা কিছু একটা এসেছিল কিন্তু আবার চলেও গেছে আমাদের দেখে।আমাদের বিজ্ঞ গাইডদের দাবি গয়ালের দল আসছিল মিছিল করতে করতে আমাদের দেখতে।হয়তো ওদের আস্তানায় আমরা তাবু ফেলেছি যা স্বাভাবিকভাবেই ওদের ভালো লাগার কথা না।কেউ যদি রাতে ঘুমাতে এসে দেখে ওদের ঘরে আমরা ঘুমিয়ে আছি তাহলে কেমন লাগে!ভাগ্যিস ওদের মাথা টা ঠাণ্ডা ছিল কিংবা ওরা হয়তো খুব উদার প্রকৃতির।নইলে রেগে গিয়ে আমাদের তাঁবুতে ২/১ টা লাথি চালিয়ে দিলে আমাকে আজ আর এখানে ব্লগ লিখতে হতোনা।একদম পাহাড়ের সাথে চিরস্থায়ী মিতালি পাতিয়ে নিতে হত পাহাড়ের পাদদেশে
প্রথম পর্ব এখানে
http://www.somewhereinblog.net/blog/Tushar007007/newpost
---------------------চলবে------------------------------
আমিয়াকুম,এক অনিন্দ্য সুন্দরীর খোঁজে (দ্বিতীয় পর্ব)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৩১টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন