পৃথিবীতে মা নেই কিংবা ছিল না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তেমনিভাবে আমাদের জীবনের অস্তিত্ব, সাফল্য ও উত্কর্ষতায় মায়ের ভূমিকা সীমাহীন, দিগন্ত বিস্তৃত, আকাশচুম্বী। আর মায়ের ভালোবাসা? কীসের সাথে তুলনা করা যায় বলুন? প্রকাশের ভাষা কোথায়? নির্লিপ্ত, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একমাত্র মায়ের। সন্তানের কল্যাণে শর্তহীন, স্বার্থহীন, বিনিময়হীন ভালোবাসা কেবল মা-ই দিতে পারেন। তাই তো আধুনিক আত্মকেন্দ্রিক বিশ্বেও মায়ের ভালোবাসর তুলনা বিরল। ছোট্ট একটি ঘটনা। জাপানের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ধ্বংসসূ্তুপে তিন মাসের একটি কন্যা শিশু মায়ের বুকের মাঝে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়। একটি কম্বল জড়ানো ঘুমন্ত শিশু। মা বেঁচে নেই। তার পাশে পড়ে থাকা একটি মোবাইল সেট। তার মধ্যে লিখা ‘If you survive, just remember, I love you’ মায়ের এ ভালোবাসার আকুতি কী দিয়ে পরিমাপ করা যায় বলুন। অন্তহীন, আসমুদ্র হিমাচল জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও যার বিরতি নেই। অথচ আমাদের স্বার্থপর মনোভাব, আত্মকেন্দ্রিক জীবন বোধ, ছলনাময়, আত্মভোলা সামাজিকতা ক্রমেই মায়ের তুলনাহীন ভালোবাসার উপলব্ধি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর অজানায়। ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ, হতাশ ও অশান্তির বিষকল্প ছড়ানো। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে আধুনিক সভ্যতার দোহাই দিয়ে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে ছোট পরিবার। স্বামী-স্ত্রী একটি বা দু’টি সন্তান নিয়ে গঠিত। কী নেই সেখানে। আধুনিক সভ্যতার সকল উপকরণ, ব্যক্তি বিলাসের সকল উত্স। সাজানো-গোছানো ছিমছাম বাসগৃহ, নির্জীব কাগজের ফুলে সাজানো ড্রয়িং রুম। নেই শুধু মায়ের ভালোবাসার কোন উত্স। কারণ আত্মকেন্দ্রিক শহুরে জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মা অনুপস্থিত। মা আছেন দূরে কোন গ্রামে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে। অথচ এ মা কী করেননি তার সন্তানকে বড় করার জন্য। সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রত্যাশায় কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে। দুর্যোগের ঘটনায়, ঘোর অমানিশায় কিংবা স্যাঁেসঁতে ভেজা বিছানায়। আমরা কী কদাচিত্ ভেবেছি সে কষ্টের কথা? যদি ভাবতাম তাহলে পত্রিকার পাতায় অশ্রুসিক্ত নয়নে কোন মায়ের মুখ বৃদ্ধাশ্রমে দেখা যেত না। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত (!), অর্থ-বিত্তে বলীয়ান, উচ্চপদস্থ, সুপ্রতিষ্ঠিত, সভ্য সমাজের চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক কোন মানব সন্তানের মা জীবন সায়াহ্নে একাকী বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পারেন না। এ কেমন সমাজে বাস করছি আমরা? সন্তান যতই সাফল্য লাভ করুক, শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হোক, মায়ের কাছে তা বড় নয়। মায়ের কাছে নাড়ির টান, রক্তে বহমান শেকড়ের নিরবছিন্নতাই মহা মূল্যবান। তাইতো দেখা যায় বৃদ্ধাশ্রমে মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে, বুকভরা ব্যথা নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে আছেন সন্তানের আগমন প্রত্যাশায় কোন এক আনন্দঘন দিবসে। এ দৃশ্য বড়ই মর্মান্তিক। তবুও সন্তানকে ভালোবাসেন মা। অথচ ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সন্তানের কাছে মায়ের প্রাপ্য অনেক যদি তা অনুভব করা যায়। বিশ্ববরেণ্য বহু মানুষের জীবন নাট্যের অনেক দৃশ্য অংকিত হয়েছে মায়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিরিখে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের চিঠি পেয়ে খরস্রোতা দামোদর নদী পার হয়েছেন সাঁতার কেটে। বায়েজীদ বোস্তামী অসুস্থ, ঘুমন্ত মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়েছিলেন গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে। কেবলই সম্ভব হয়েছিল মাতৃভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে। আজ কোথায় সে ভালোবাসা? সন্তান সুউচ্চ অট্টালিকায়, মা বৃদ্ধাশ্রমে। হায়রে আধুনিক সভ্যতা! কোনিদকে তোমার ক্রমবিকাশ? তাই যাদের মা বেঁচে আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- আসুন ভালোবাসি মাকে শর্তহীন, স্বার্থহীন, মানবিক চেতনায় ও সেবার অনুভূতিতে। কারণ মা হতে পারেন পার্থিব কল্যাণের নিরন্তর উত্স, পারলৌকিক মুক্তির অমূল্য সনদ।
লেখাটি ইত্তেফার প্রত্রিকা থেকে সংগ্রীহীত , লেখাটি পড়ে কখন যে দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো বুঝতে পারিনাই । আমার কাছে খুব ভাল লাগল তাই সবার জন্য শেয়ার করলাম ।