ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে। ধর্মকে যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তখন তাকে ধর্মব্যবসা বলা হয়।
ধর্মব্যবসার ফলে ধর্ম বিকৃত হয়, ধর্ম কাল্পনিক কল্প কাহিনীতে পরিণত হয়। সমাজে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিকৃত ধর্ম থেকে উৎপত্তি হয় নতুন বিকৃত ধর্মের ।
বর্তমানে আমরা ইসলামকে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে ফেলেছি। আমাদের ইসলাম লেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমাদের মধ্যে নীতি নৈতিকতা জন্ম নেয়নি, আমরা ইসলামের প্রকৃত আদর্শে আদর্শিত নই।
আমাদের দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ জনগণ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও আজ আমাদের সমাজে শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই, সুবিচার নেই। আজ আমরা ইসলামের মূল, ইসলামে বর্ণিত সেই শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বহুদূরে সরে এসেছি যার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। শুধু আমরাই নই বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের আজ একই অবস্থা।
আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ অনুমুদিত জীবনবিধান হচ্ছে কোরআন । আর কোরানের সাথে সামঞ্জস্যহীন কথিত কিছু হাদিস, ফিকহা, ইজমা , কিয়াস , এর বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনী দোয়া তাবিজ নির্ভর এক উতভট ধর্মচর্চা ইসলাম নামে আমাদের কাছে পরিচিত । আমরা না জানার কারনে এতে অভভস্থ ও হয়ে গিয়েছি । ধর্ম জীবনের নাম। ধর্ম বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধানের নাম।
আমাদের মূল ধর্মগ্রন্থই আমাদের সাকসেস ম্যানুয়াল শারীরিক, মানসিক, জাগতিক ও আত্মিক সাফল্যের মন্ত্র ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে কোরআন । কিন্তু এ কথাগুলো অনেকের কাছে খুব হাস্যকর শোনায়|
অধিকাংশ লোক তো কয়েকটা দোয়া পড়েই সকল গুনাহ মাফ করে ফেলছে কোটি কোটি পাহার পরিমান সওয়াব অর্জন করে বেহেশত নিশ্চিত করেছে ।
এই কোটি কোটি পাহার পরিমান সওয়াব দেওয়ার অঙ্গীকার কী করেছে আল্লাহ্ ?
কোরআনের বিধানাবলীর প্রতি আনুগত্য পোষন করে সে অনুযায়ী জীবনের সকল কাজ-আমল-আচরন-সম্পর্ক-লেনদেন-সমর্থন-বিরোধিতা না করলে, হারাম, হালাল না মানলে । আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কি সম্ভব ?
কোরআনের সহজ-সরল-সোজা জিনিষকে বাঁকা-জটিল-কুটিল করে তোলাটাই যেন কিছু লোকের অতি আগ্রহ ।
এখন কার মুসলমানরা প্রকৃত মুসলমানদের মধ্যে পড়ে না, এরা আসলে ভ্রান্ত আকীদার অনুসারী ভুয়া-ভন্ড-ডিস্কো মুসলমান, এরা সবাই হুজুর পুজারী, পীর পুজারী, মাজার পুজারী ।
কোরআন বহির্ভূত অমীমাংসিত কিছু জিনিস / কথা নিয়ে পরে আছে । প্রতিটি মুহর্তে আল্লাহর বিধান অনুসরন না করে এবং ভিন্ন বিধান অনুসরন করে চলেছে ।
নিজের গরজেই প্রত্যেক মুসলমানের ইসলামের বিধি বিধান আইন কানুন ও বিভিন্ন নীতি-আদর্শ জানার-বুঝার জন্য কোরআন অধ্যয়ন করা উচিত । ইসলামী-ঈমানী জিন্দেগী যাপন করার জন্য সচেতন-সক্রিয় হওয়া উচিত, অন্যথায় ইহকাল-পরকাল শুধুই অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই মিলবে না।
মুসলিম সমাজের লোকেদের ঈমানদারের কোন গুনাবলী কিংবা মানবীয় গুনাবলী বলতে কিছুই নাই, সততা-সত্যবাদিতা-সময়ানুবর্তিতা-নিয়মানুবর্তিতা-শৃংখলা-বিশ্বস্ততা-নির্ভরযোগ্যতা-বিবেক-লজ্জা-শরম-আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছুই নাই, দরকারও মনে করে না।
সামাজের অধিকাংশ লোক নিজের স্বার্থেই কাজ করে, নিজের স্বার্থের অনুকুলেই বার বার পাল্টাতে থাকে,বার বার ডিগবাজী খেতে থাকে, কখনো ঘনিষ্ঠ হয়, আবার কখনো অনিষ্টতায় লিপ্ত হয় ।
সমাজে বিশ্বস্তলোক তেমন একটা নাই বললেই চলে,কারন একজনলোক খাঁটি এবং উন্নতমানের ঈমানদার না হয়ে থাকলে তারপক্ষে বিশ্বস্ত-নির্ভরযোগ্যলোক হওয়া সম্ভব নয় ।
সমাজে যা আছে,তা হলো ঈমানহীন-ঈমানী সচেতনতাহীন পোশাকী ও আনুষ্ঠানিক বংশগত মুসলমান।
বিশ্বাসঘাতকতা-হিংসা-কুচক্রি-অসহিষ্ণুতা, নিজের স্বার্থ হাসিল এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
খেয়াল করে দেখবেন , বেশীর ভাগ মুসলমান - ভন্ড,আত্নমর্যাদাহীণ,অরাজক, দুর্নিতিপরায়ন,খুনি,ভূমিদখল,পরচর্চা যৌনউৎসুক, লম্পট, সমালোচনামুখর, অশ্লিল, অবৈধ কাজে ও জরিত অনুপ্রানীত,লুটপাট, খাবার নামে বিষ বিক্রি সহ ইত্যাদি সব অপকর্ম এদের চরিত্রে বিদ্যমান।
আধুনিক মুসলমানদের আরও আধুনিক মুসলমান হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু ?
আধুনিকতা মানুষের মধ্যে বস্তুবাদিতা-স্বার্থবাদিতা-যান্ত্রিকতা-বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে, পাশাপাশি বসবাস করলেও কেউ যেন কাউকে চিনেই না, কিংবা গরজ-দরকার বোধ করে না, কিংবা ঝামেলা এড়িয়ে নিজে একাকীত্ব-নিরিবিলি-নিরূপদ্রব থাকতে চায়। আধুনিকতা সভ্যতা মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
ভিতরে ভিতরে দেশটা-সমাজটাএবং সমাজের মানুষগুলো নৈতিকভাবে এতোটাই ডেমেজ হয়ে গেছে যে, এতোটাই দেউলিয়া হয়ে গেছে যে, সমস্যা-পরিস্থিতি-সম্পর্ক-লেনদেন-বিনিময়-সহায়তা-সহানুভূতি-সহমর্মিতার আচরন করতে গিয়ে যেন আকাশ থেকে পড়তে হয়। অনেক দিন ধরে ভেবে থাকা মানুষ গুলুর প্রতি নিজের ভাল ধারানা প্রসন করা ও এক সময় বিসাধ এ পরিণীত হয় ।
মূলত আলেম পরিচয়ধারী লোকগুলোই সকল অনিষ্টের মূল, এরা ওয়াজে-খোৎবায় মানুষকে অন্যায় থেকে দূরে থাকার জন্য তেমন কিছু করেনা । বরং মানুষকে অন্যায়-গুনাহের কাজে এক প্রকার উৎসাহিত করে , এমনকি এমন কথাও বলতে শুনেছি , গুনাহ না করাটাই হলো সবচেয়ে বড় গুনাহ। গুনাহ করে পরে তওবা করলেই তাতে আল্লাহ ভীষন খুশী হন, এতে আল্লাহ গুনাহগুলোকে সওয়াবে পরিনত করে দেন ।
আলেম নামধারী লোকজন এমন কথা সব সময়েই বলতে থাকেন যে, একজন মুসলমান যত গুনাহই করুক না কেন, এক সময়ে সে বেহেস্তে যাবেই, এর ফলে লোকেরা ভয়াবহ জঘন্য অপরাধ করতেও কোন দ্বিধা-সংকোচ করছে না।
মুসলমানদের কাজ কর্ম দেখে শয়তানও লজ্জিত হয়ে থাকবে হয়তো, কারন মুসলমানদের তেমন কোন ভাল গুন পাওয়া না গেলেও , তার খারাপ গুনের যেন শেষই নেই ।
নামধারী আলেমরা যাকে বা যাদেরকে পছন্দ হয় না তাদেরকে কথায় কথায় কাফের-জাহান্নামী হিসেবে ফতোয়া দিয়েই চলছে, কোন বাছ-বিচার ছাড়াই, যিনি মুফতি তিনিও ফতোয়া দেন, যিনি মহাদ্দেস তিনিও ফতোয়া দেন, যিনি মোফাসসি তিনিও ফতোয়া দেন, যিনি এমনকি কোরআন-হাদীস সম্পর্কে কোন ধারনা রাখেন না, তিনিও ফতোয়া দেন।একে অপরের ফতোয়ার বন্যায় ভেসে সবাই ঈমান হারা জাহান্নামী ।
এক সময় ইউরোপে চার্চের পোপরাও টাকার বিনিময়ে স্বর্গের টিকিট বিক্রি করত। এখন নামধারী আলেমরা বিক্রি করে কোন এক ওয়াজে শুনেছিলাম । নুর হোসেন মাত্র ২০০ টাকা দিয়ে পরকালে হুর নিয়ে করবে খেলা।
সমাজের নামধারী আলেমদের কথা বার্তা লেখা দেখলে মনে হয় তারা জান্নাত , জাহান্নাম লিজ নিয়েছে যে যার মত যাকে তাকে জান্নাতি , জাহান্নামী করে দিচ্ছে ।
আল্লাহর দীন বিকৃত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মতভেদ সৃষ্টি। এ কাজটি সাধারণ মুসলিমরা করেন না, করেন কথিত ধর্মজ্ঞানীরা। তাদের দীন সংক্রান্ত মতভেদের পরিণামে জাতি আজ হাজারো ফেরকা-মাজহাবে-তরিকায় খন্ড বিখন্ড হয়ে গেছে।
ধর্মীয় বিষয় বলে কোরআন এর মান্দন্ড ভেদ করে কোরআন বহির্ভূত , অমীমাংসিত বিষয় আদি নিয়ে তাদের আলোচনা সেই বিষয়ে নিজস্ব মতবাদে তারা শত শত বই লিখছেন, হাজার বছর ধরে বিতর্ক করে যাচ্ছেন।কিন্তু এখনও সেই বিষয়ে কোন সমাধান এ আসতে পারেনি ।
এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী জাতির কথিত আলেম সাহেবরা, দীনের অতি বিশ্লেষণকারী মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুজতাহিদ, মুফতিগণ, ভারসাম্যহীন সুফিবাদী পীর, মাশায়েখ, বুজুর্গানে দীনেরা। তারা তাদের অনুসারী তৈরি করেছেন । তাদের নিজস্ব মতবাদে নিজ স্বার্থে গরে উঠছে তাদের অনুসারি ।ধর্মব্যবসায়ীরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে যার ফলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।
ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করছে তারা নিজেদের ইচ্ছামত মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান করে ধর্মীয় বিধি-নিষেধগুলোকে পরিবর্তন, পরিমার্জন করছে। এর ফলে ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একদিকে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে এবং অপরদিকে যেই বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে ততটা গুরুত্ব বহন করে না সেগুলো গুরুত্বের বিচারে প্রথম দিকে চলে এসেছে।
“তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জেনে শুনে সত্যকে গোপন করো না (সুরা বাকারা ৪২)।
” সত্য ও মিথ্যার লড়াই পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তাই যখন একজন ব্যক্তি সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে না তখন সে বিপর্যস্ত হয়। এভাবে একজন ব্যক্তি থেকে একটি পরিবার, একটি পরিবার থেকে একটি সমাজ এবং ধারাবাহিকভাবে গোটা জাতি বিপর্যয়ের শিকার হয়। ধর্মব্যবসায়ীদের নানা ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্বে আজ এক ও অখ- জাতি নানারকম ফেরকা-মাজহাব-তরিকায় ও হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত। এই অনৈক্যের বিষে আজ জাতি জর্জরিত।
মানুষ আলেমদের মনে করে নবীর ওয়ারিশ। যার ফলে তাদের মুখের সকল কথাই তারা পুণ্য মনে করে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কথা এবং তাদের প্রতিটি কথাকে পালনে সওয়াব হবে এ আশায় পালন করা শুরু করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যারা হীনস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে অর্থাৎ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী জনগণের এ বিশ্বাসকেই কাজে লাগায়। তারা জনগণের ঈমানী চেতনাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।
প্রত্যেক নবী-রসুল তাদের জাতির উদ্দেশ্যে একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে।
এ বিষয়ে নবী রসুলদের (আ.) বেশ কয়েকজনের ঘোষণা আল্লাহ দৃষ্টান্তস্বরূপ পবিত্র কোর’আনেও সন্নিবদ্ধ করেছেন।
(১) নূহের (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট। (সুরা হুদ-২৯)
(২) নূহের (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো কেবল বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে। (সুরা শু’আরা ১০৯)
(৩) নূহের (আ.) এর ঘোষণা: যদি তোমরা আমার কথা না শোনো তাহলে জেনে রাখ, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই নি। আমার প্রতিদান কেবল আল্লাহর নিকট এবং আমাকে মুসলিম (সত্যের প্রতি সমর্পিত) হওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে। (সুরা ইউনুস ৭২)
(৪) হুদের (আ.) ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুদ্ধি (আক্ল) খাটাবে না? (সুরা হুদ-৫১)
(৫) হুদের (আ.) ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাচ্ছি না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি এই বিশ্বজাহানের ¯্রষ্টা। (সুরা শু’আরা ১২৭)
(৬) সালেহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। (সুরা শু’আরা-১৪৫)
(৭) লুতের (আ.) ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। (সুরা শু’আরা-১৬৪)
(৮) শোয়েবের (আ.) ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। (সুরা শু’আরা-১৮০)
ধর্মের কোনো কাজ করে নবী ও রসুলরা পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না, সুতরাং তাঁদের অনুসারী উম্মতের জন্যও পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়। তথাপি নবীদের বিদায়ের পরে জাতির মধ্যে অবধারিতভাবে জন্ম নিয়েছে দীনের পণ্ডিত, ধারক বাহক, বিভিন্ন নামধারী একটি অকর্মণ্য, কর্মবিমুখ, পরনির্ভরশীল শ্রেণি। তারা নিজেদেরকে নবী-রসুলদের প্রতিনিধি, ওয়ারিশ বা স্থলাভিষিক্ত (ওরাসাতুল আম্বিয়া) বলে দাবি করতে থাকেন কিন্তু আম্বিয়ায়ে কেরামের আদর্শের বিপরীতে গিয়ে ধর্মব্যবসায় মত্ত হয়ে যান।
ধর্মব্যবসা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন -
হে বিশ্বাসীগণ! অবশ্যই ‘আলিম ও দরবেশদের অনেকেই ভুয়ো কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষদের সম্পদ গ্রাস করে থাকে আর আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে আর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ দাও।
যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পার্শ্বে এবং পিঠে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) ‘এটা তা-ই যা তোমরা নিজদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ কর’(সুরা তওবা ৩৪-৩৫)।
পূর্ববর্তী ধর্ম-সম্প্রদায়ের আলেমরাও এভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা নিজদের জিহবা দ্বারা বিকৃত করে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা সেটা কিতাবের অংশ মনে কর, অথচ সেটি কিতাবের অংশ নয়। তারা বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, অথচ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। আর তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা বলে, অথচ তারা জানে।(সুরা ইমরান ৭৮)
তারা কুরআনের আয়াত তো পড়ে; কিন্তু মাসআলা বয়ান করে নিজেদের মনগড়া। সাধারণ লোক মনে করে যে, মৌলভী সাহেব মাসআলা কুরআন থেকেই বলছেন। অথচ বর্ণিত মাসআলার কুরআনের সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না। আবার কখনো অর্থের পরিবর্তন ঘটিয়ে অতি চমৎকার ভঙ্গিমায় পরিবেশন করে এটাই বুঝাতে চেষ্টা করে যে, এ নির্দেশ আল্লাহর পক্ষ হতে!
সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে। সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস।(সুরা বাকারা ৭৯)।
পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বারংবার উল্লেখ করেছেন যেন রসুলাল্লাহর উম্মাহর আলেমরা পূর্ববর্তী পথভ্রষ্ট ধর্মব্যসায়ী আলেমদের মত না হতে । আল্লাহ বনী ইসরাইলকে বলেছিলেন, “তোমরা কেতাবের প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়ো না আর তুচ্ছমূল্যে আমার আয়াত বিক্রি করো না। এবং আমার (আযাব) থেকে বাঁচ। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বেও সত্যকে গোপন করো না। (সুরা বাকারা ৪১, ৪২)
ধর্মব্যবসায়ীরা এ কাজটি করার মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজেদের জন্য মহান আল্লাহর লানত উপার্জন করছে অপরদিকে জাতিকে টেনে এনেছে ঘোর অন্ধকারে।
➡নিশ্চয় যারা গোপন করে সু-স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও হিদায়াত যা আমি নাযিল করেছি, কিতাবে মানুষের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর, তাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেন এবং লা‘নতকারীগণও তাদেরকে লা‘নত করে। সুরা বাকারা আয়াত ১৫৯
একজন ধর্মব্যবসায়ী কখনো ঈমানদার হতে পারে না, একজন ঈমানদার কখনো ধর্মব্যবসায়ী হতে পারেন না, ইসলামের প্রচার এবং প্রকৃত ইসলামী দ্বীনের প্রতি, ভাল আমলের প্রতি এবং খারাপ আমল থেকে মানুষকে সতর্ক করার দাওয়াত দেওয়াটা প্রত্যেক মুমিনের সার্বক্ষনিক ঈমানী দায়িত্ব ।
নিজেদের জীবনে কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান বাস্তবায়নের পাশাপাশি পরিবার ও পাশ্ববর্তীদেরকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহ্বান করা মুমিন বান্দার আবশ্যক কর্তব্য।
আল্লাহ তাআলা এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কুরআনে উল্লেখ করেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।’ (সুরা আল-ইমরান : ১০৪)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণে) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ কর এবং আল্লাহকে বিশ্বাস কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১১০)
এ কারণে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে মুমিনদের একটি বড় দায়িত্বের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘ন্যায় কাজের আদেশ দেয়া এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা।’ ন্যায় কাজে আদেশ এবং অন্যায় কাজে নিষেধকে একত্রে বুঝায় ‘আল্লাহর পথে আহ্বান’।
হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর; যেখানে রয়েছে নির্মম ও কঠোর ফেরেশতাকূল, আল্লাহ তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তারা সে ব্যাপারে তার অবাধ্য হয় না। আর তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়। সুরা তাহরিম আয়াত ৬
ধর্মের প্রচারক
ইসলাম প্রচারের নামে কতিপয় আলেম-ওলামাদের কোরআন ও সহীহ হাদিসের ব্যাখ্যা ‘বিকৃত’ ও ব্যাখ্যা গত ভুল’ আলোচনা-সমালোচনা দেখা যায়।
আলেমগণকে ধর্মের প্রচারক/ ইসলামের পাহারাদার হিসেবে উল্লেখ করলেও দুর্ভাগ্য, বর্তমানে আমাদের সমাজে পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত আলেমের সংখ্যা বেড়ে গেছে, দিনদিন বেড়েই চলেছে। তাদের অজ্ঞতায় সৃজিত জাল-যঈফ (বানোয়াট-দুর্বল) হাদিসের জন্য সাধারণ মুসলিম শির্ক ও বিদআত (পৌত্তলিকতা বা বহুঈশ্বরবাদ চর্চা-নতুনত্ব বা নবতর উদ্ভাবন) কী এটি চিনতে-বুঝতে পারছেন না বরং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। আর এরাই বলে বেড়ায় ‘ধর্ম বুঝা কঠিন, তাদের ছাড়া ধর্ম জানা যায় না ।
আল্লাহ্ বলেন, হে ঈমানদারগণ, যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোন কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে। সুরা হুজুরাত, আয়াত: ৬।
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর-এর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৩৬।
আমাদের জনে জনে সচেতন হতে হবে। আলেম কী বলল, কী পরামর্শ তুলে ধরল–এটি বিশ্বাস করার আগে নিজেই যাচাই-বাচাই করতে হবে। পবিত্র কোরআন পড়ার অভ্যাস গড়তে হবে।
ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া বা আলেমদের বক্তব্য শুনি। কেন শুনি ভালো লাগে তাই শুনি। আলেম-ওলামাদের শ্রদ্ধা করি তাই শুনি। তাঁদের কাছ থেকেও জানার বা শেখার থাকে মনে করি তাই শুনি। তাদেরকে ধর্মের প্রচারক মনে করে শুনি ।
কিন্তু বাস্তবে এইসব বক্তারা উল্টো । খেয়াল করে দেখবেন তাদের চোখের চাহনি, মুখের ভাষা, আঙুল নড়ানো, অহংকার দেখানো, চিৎকার করা, হুমকি দেওয়া, নোংরা আক্রমণে যাওয়া, সংকীর্ণ মানসিকতা আর পরশ্রীকাতরতা , হিংসাত্মক ডায়লগ দেওয়া, কিচ্ছা-কাহিনী বলা, হাস্যকর, উদ্ভট, কোরআন বহির্ভূত কথা , এবং অন্তঃসারশূন্য যুক্তি উপস্থাপন করা । এই সকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সব গুলই বা অধিকাংশ তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । একজন সাধারণ আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন মানুষের মধ্যেও এসব নোংরা বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত না । ইসলামি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের মধ্যে থাকার তো প্রশ্নই আসে না!
কিছু লোকের সামনে বক্তৃতা দিয়ে জাতির মোড়লের ভাব দেখায় । অনেকে ত পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আপাদমস্তক ধর্ম ব্যাবসায়ী ।
তাদের যারা আইডল মনে করে । তারা তাদের থেকে অনুসরণ করে কি শিখবে ? ।
ধর্মের প্রচারক হিসাবে তাদের যেমন হওয়ার কথা ছিল কোরআনের বর্ণনায় । অতএব- ইসলামের দাওয়াত বা কথা বলার সময় যা আমলে নিতে হবে ।
➡কথাবার্তায় কর্কশ হবে না । (০৩ঃ১৫৯)
➡কোনো ভণিতা না করে, ধোঁকা না দিয়ে, যা বলতে চাও পরিস্কার করে বলবে ➯ ৩৩:৭০
➡অন্যকে উপহাস করবে না (৪৯ঃ ১১)
➡চিৎকার করবে না, কর্কশ ভাবে কথা বলবে না, নম্র ভাবে কথা বলবে ➯ ৩১:১৯
➡গালি-গালাজ করা যাবে না (৩৩/৫৮)
➡নম্র ভাষায় কথা বলতে হবে (১৭/৫৩)
➡ভদ্রভাবে কথা বলতে হবে (২০/৪৪)
➡সভ্যভাবে কথা বলতে হবে (১৭/২৩)
➡সর্বদা সত্য কথা বলতে হবে (সূরা নং-৩ আয়াত-৭)
➡স্পষ্টভাষী হতে হবে (৩৩/৭০)
➡ন্যায় কথা বলতে হবে (৬/১৫২)
➡মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলতে হবে (২/৮৩)
➡যুক্তিসংগত কথা বলতে হবে (১৭/২৮)
➡অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকতে হবে (২৩/৩)
➡মিথ্যা কথা বর্জন করতে হবে (২২/৩০)
➡পশ্চাতে গোপন দোষ-ত্রুটি খোঁজ করা ও গীবত পরিহার করতে হবে (৪৯/১২)
➡প্রমাণবিহীন কোন কথা বলা যাবে না (২/১১১)
➡ কিন্তু দুঃখের বিষয় হল উপরিক্ত গুন গুলোই তাদের মাঝে বিদ্দামান ।
এমন সব বিষয় নিয়ে এই বইটি লিখা হয়েছে ।
চাইলে বইটি সংগ্রহ করতে পাড়েন রকমারি ডট কম থেকে
https://www.rokomari.com/book/235752/atmasuddhi?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২২ রাত ৯:৫০