ঈদের পূর্বরাত দু’টার সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। দেখি রাসুর চায়ের দোকানটা তখনও খোলা। দোকানে ২৫ পাওয়ারের একটা রুগ্ন বাল্ব মিটমিট করে জ্বলছে। বাল্বের অপর্যাপ্ত আলোয় একটা অতিপরিচিত অবয়ব ভেসে এলো অস্পষ্ট। গায়ে সেই চিরচেনা সবুজ পাঞ্জাবী। মুখে লেগে আছে ততোধিক চেনা সেই হাসিটা। দরজা খুলে তড়িঘড়ি দোকানে ছুটলাম। দোকানে গিয়ে দেখি সবুজ মূর্তি উধাও। রাসু বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে তার মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠলো। একটা কাস্টমার অন্তত জুটলো। বললো, ভাইয়া চা খাবেন?
আমি বললাম, রাসু তোর দোকানে এইমাত্র যে সবুজ পাঞ্জাবী পরা একজন মানুষকে দেখলাম তিনি কোথায় গেলেন?
রাসু আমার কথা শুনে আফসোস করতে লাগলো, কি বলেন ভাইয়া? কাস্টমার আইছিলো? হায়! হায়! দেখলেন আমার কাণ্ড। কাস্টমার আইসা ফেরত যায় আর আলো জ্বালাইয়া আমি বইসা বইসা ঘুমাই।
কথা শেষেই সে চা প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিলো। আমি তার আফসোসের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়ে দোকান ছেড়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। রাসু দোকান থেকে চিল্লাতে লাগলো, ভাইয়া চা রেডি হইয়া গেছে। চা না খাইয়া কই যান?
-- রাখ এসে খাচ্ছি।
-- সবুজ পাঞ্জাবীর মানুষ কে ভাইয়া?
-- মুসা ভাই।
-- মুসা ভাইটা আবার কে?
-- তুই চিনবি না। গত বছর মেঘনায় হারিয়ে গেছেন লঞ্চ দুর্ঘটনায়। অনেক ভালো একজন মানুষ। মানুষকে ভালোবাসতেন। দুঃস্থ মানবতার কল্যাণে ছুটতেন অহর্নিশি অক্লান্ত...
ইতোমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আমি দোকান ছেড়ে বেশ দূরে চলে এসেছি। রাসু কি জানি বললো আবার। তার কথার আওয়াজ আমার কর্ণকুহরে ঢুকলো না স্পষ্ট। আমি হাঁটতেই লাগলাম। রাতের শরীরে লেপটে আছে পরিপক্ক আঁধার। চিকণ চাঁদ সেই আঁধারের আধিক্যে অসহায় হয়ে আকাশের কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে মুখ লুকিয়ে। সজলদের বাড়ির পেছনের নিম গাছটির ডালে একটা পেঁচা বসে আছে। গাঢ় আঁধারে তার চোখদুটি জ্বলজ্বল করছে, চিকণ চাঁদের চেয়ে ধারালো। কেমন শান্ত নিরীহ পাখি। মানুষ কেনো যে এই পাখিটাকে অলক্ষণের প্রতীক ভাবে?
নিম গাছ ফেলে আরও একটু এগিয়ে গেলাম। সবুজ মূর্তির দেখা পেলাম না। ফিরে এলাম ব্যর্থ মনোরথে। ফিরে এসে দেখি রাসুর চায়ের দোকান বন্ধ। দোকানের বাইরের বেঞ্চে একটা চায়ের কাপ রাখা। আমি চায়ের কাপ হাতে রুমের ভেতর গেলাম।
ঈদের দিন সকালে রাতের এই ব্যাপারটা পুরোপুরি ভুলে গেলাম। ঈদের নামাযে যাওয়ার পথে সবুজ পাঞ্জাবী পরিহিত একজন মানুষকে দেখে ব্যাপারটা মনে পড়লো হঠাৎ। নামাজ শেষে রাসুর সাথে দেখাও হয়ে গেলো। রাসুর সাথে কোলাকুলি করার সময় বললাম, কিরে গাধা কালকে চা বাইরে রেখে দোকান বন্ধ করলি ক্যান?
রাসু অবাক হয়ে বললো, কখন?
-- কখন মানে? কালকে রাত দু’টার সময়?
রাসু এবার আরও বেশি অবাক হলো। বললো, কাইলকে তো রাত দশটার সময়ই দোকান বন্ধ কইরা ফালাইছি। দুইটার সময় আপনারে আমি চা দিমু ক্যামনে?
আমি রাসুর সাথে আর কথা বাড়ালাম না। ঈদগা থেকে তড়িঘড়ি বাড়িতে ফিরে আগে রুমের ভেতর ঢুকলাম। দেখি রুমে ঠিকই গতকাল রাতের সেই চায়ের কাপটা টেবিলের পীঠে বসে আছে ঠিকঠাক। ব্যাপারটার কোন কূলকিনারা খুঁজে পেলাম না। কূলকিনারা খুঁজার চেষ্টাও করলাম না। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলোর কোন কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো এভাবেই একদিন সত্যি সত্যি মুসা ভাইয়ের দেখা পেয়ে যাবো। কোন এক প্রশান্ত সন্ধ্যায় ছবির হাঁটে গিয়ে দেখবো মুসা ভাই বসে আছে বই হাতে। চোখে চোখ পড়তেই তাঁর মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠবে শব্দহীন মায়াবী হাসিতে। কিংবা কোন এক বিষণ্ণ রাতে আমার কমদামী মোবাইলটা বেজে উঠবে। মোবাইলের আয়নায় চোখ রেখে দেখবো মুসা ভাই। তড়িঘড়ি ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতে ভুলে যাবো। শুধুমাত্র একটা পরিচিত কণ্ঠের স্পর্শের অপেক্ষায়...